মৌর্য যুগের অর্থনীতি প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক বিকাশের স্তর, কৃষিতে লোহার ব্যবহার, কৃষিকাজ, পশুপালন, শিল্প ও বানিজ্য সম্পর্কে জানবো।
মৌর্য যুগের অর্থনীতি
ঐতিহাসিক ঘটনা | মৌর্য যুগের অর্থনীতি |
প্রধান জীবিকা | কৃষিকাজ |
প্রধান ফসল | ধান ও গম |
বন্দর | ভৃগুকচ্ছ, তাম্রলিপ্ত |
রপ্তানি দ্রব্য | মশলা, সুগন্ধি দ্রব্য, দামী পাথর, হাতির দাঁতের জিনিষ, সুতি কাপড় |
আমদানি দ্রব্য | যুদ্ধের ঘোড়া, সোনা, কাচ, নীলকান্ত মণি |
ভূমিকা :- মৌর্য যুগে কৃষি ছিল বেশীর ভাগ লোকের জীবনধারণের উপায়। অর্থশাস্ত্র -এর বিবরণ এবং অশোকের শিলালিপিগুলি থেকে এই কথা স্পষ্ট হয় যে, মৌর্য যুগে পশুচারণ অর্থনীতি ও খাদ্য সংগ্রহ অর্থনীতির সমাধি ঘটে। তার স্থলে কৃষি ভিত্তিক খাদ্য উৎপাদনের অর্থনীতি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
অশোকের নির্দেশ
সম্রাট অশোক তাঁর শিলালিপিতে পশুচারণ যুগের বন পুড়িয়ে জমি বের করার প্রথা রদ করেন। তিনি বন সংরক্ষণের কথা বলেন। তিনি অকারণ প্রাণী হত্যা না করে পশুগুলিকে পালন করার কথা বলেন।
মৌর্য যুগে অর্থনৈতিক বিকাশের স্তর
ডঃ আর এস শর্মা প্রাচীন ভারত -এর অর্থনৈতিক বিকাশের কয়েকটি স্তরের নির্দেশ করেছেন যথা – লৌহযুগ ও নগর গঠন, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ অর্থনীতির অগ্রগতির যুগ, মুদ্রা অর্থনীতি, মুক্ত বাণিজ্যের যুগ।
মৌর্য যুগে কৃষিতে লোহার ব্যবহার
খ্রিস্ট পূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে উত্তর ভারতে লোহার যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়। খ্রিস্ট পূর্ব তৃতীয় শতকে অর্থাৎ মৌর্য যুগে কৃষির কাজে লোহার যন্ত্রপাতির ব্যবহার ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। ভারতে উন্নত মানের ইস্পাত উৎপাদন হতে থাকে। কার্টিয়াসের রচনা থেকে জানা যায় যে রাজা পুরুর কাছ থেকে আলেকজান্ডার প্রচুর পরিমাণ ভাল ইস্পাত আদায় করেন।
মৌর্য যুগে খনি
ভারতের মৌর্য যুগে মগধ -এর খনি গর্ভ থেকে প্রচুর লোহা সরববাহের ফলে চাষের কাজে লোহার ভারী লাঙ্গল ও লোহার যন্ত্রপাতির ব্যাপক ব্যবহার হয়। ভাল ইস্পাতের দ্বারা অস্ত্র তৈরি হত। লোহার দ্বারা কৃষির উপযোগী যন্ত্রপাতি তৈরি হত।
মৌর্য যুগে কৃষিকাজ
- (১) কৃষিই ছিল জনসাধারণের প্রধান জীবিকা। মেগাস্থিনিস কৃষকদের সংখ্যা সর্বাধিক ছিল বলেছেন। তার সপ্তজাতির মধ্যে কৃষকরা ছিল গুরুত্বে তৃতীয়, সংখ্যায় প্রথম। মৌর্য যুগে লোহার অস্ত্রের দ্বারা জঙ্গল কাটাই করে প্রচুর আবাদি জমিতে কৃষিকার্য করা হত।
- (২) মৌর্য সাম্রাজ্য -এ জমি দু প্রকার ছিল – কৃষকের নিজস্ব পৈত্রিক জমি। এই জমির জন্য কৃষক সাধারণত রাজাকে ফসলের অংশ রাজস্ব বা ভাগ দিত। রাজার খাস জমি বা সীতা জমিতে কৃষককে ফসলের বা অংশ দিয়ে রাজা বাকি অংশ নিতেন। তাছাড়া জল কর প্রভৃতি বাবদ কর আদায় করা হত।
- (৩) প্রতি গ্রামের বাসগৃহগুলির বাইরে কৃষিক্ষেত্র থাকত। প্রতি পরিবারের জমি খাল বা নালী দ্বারা চিহ্নিত হত। কৌটিল্য কর্ষিত, অকর্ষিত, স্থল বা ডাঙা জমি, ফসল হওয়া জমি, ফলের বাগান, বন প্রভৃতির পার্থক্য করেছেন। জমিতে ধান ও গম ছিল প্রধান শস্য।
- (৪) প্রাচী বা মগধ ও বাংলা বা গঙ্গা যমুনা অঞ্চলে ধানের চাষ ব্যাপক ছিল। পশ্চিম ভারতে গম, যবের চাষ হত। এছাড়া বিভিন্ন কলাই, ডাল, তিল, সরিষা, তরি-তরকারী ও ফলের চাষ হত। মেগাস্থিনিস বলেছেন, জমিতে বছরে দুবার ফসল ফলত।
- (৫) মৌর্য যুগে জলসেচের ব্যাপক ব্যবস্থা ছিল। বৌদ্ধজাতকে নদীতে বাঁধ দিয়ে সেচের ব্যবস্থা করা হত। সেচখাল খনন করা হত বলা হয়েছে। বৃহৎ সেচ প্রকল্পগুলি রাষ্ট্রের খরচায় তৈরি হত। গ্রামের অধিবাসীদের এজন্য শ্রমদান করতে হত। হাতিগুম্ফা শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, নন্দ রাজারা সেচখাল খনন করতেন।
- (৬) চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সৌরাষ্ট্রে সুদর্শন হ্রদ খোদাই করেন বলে জুনাগড় শিলালিপিতে বলা হয়েছে। অর্থশাস্ত্রে রাজাকে সেচব্যবস্থার উন্নতির জন্য যত্ন নিতে বলা হয়েছে।
মৌর্য যুগে পশুপালন
- (১) মৌর্য যুগে গৃহপালিত পশুর মধ্যে গবাদি পশুর কথা সর্বাগ্রে বলা দরকার। গরু, ঘোড়া, উট প্রভৃতি পশুকে পালন করা হত। আভীর নামে একটি সম্প্রদায় শুধু গো-মহিষ পালন করত। নিষাদ বা ব্যাধরা জঙ্গলের পশুদের হত্যা করে জনপদ-এর কৃষিক্ষেত্র ও অধিবাসীদের রক্ষা করত।
- (২) রাজার পতিত জমিতে গবাদি পশু চরাণ হত। প্রতি গ্রামের শস্যক্ষেত্রের বাইরে গোচারণ ক্ষেত্র ছিল। পশুপালন, বিশেষত গো-পালন মৌর্য ভারতের অর্থনৈতিক জীবনের একটি বড় স্তম্ভ ছিল। পশুমাংস খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হত। গরুর দুধ ছিল সকল শ্রেণীর প্রিয় পানীয়।
- (৩) গরু ও ঘোড়াগুলি মাল বইবার ও গাড়ী চালনার কাজে ব্যবহার করা হত। মেগাস্থিনিস পশুপালনকে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বলেছেন। এজন্য তিনি সপ্ত জাতির মধ্যে পশুপালনকারী যাযাবর একটি জাতির উল্লেখ করেছেন।
- (৪) অশোকের দ্বাদশ শিলালিপিতে ব্রজভূমিক নামে এক শ্রেণীর কর্মচারীর উল্লেখ দেখা যায় যাদের কর্তব্য ছিল গৃহপালিত পশুর সংখ্যা যাতে বাড়ে তার উদ্যোগ নেওয়া এবং পশুচারণের সুবন্দোবস্ত করা।
মৌর্য যুগে শিল্প
খ্রি পূর্ব যুগে মৌর্য সম্রাটদের উদ্যোগে ভারতীয় শিল্পের স্থায়ী পুনরুজ্জীবন ঘটে এবং মৌর্য যুগের শিল্পকলার বিশেষ উন্নতি হয়। মৌর্য যুগের শিল্প -এর মধ্যে হস্ত শিল্পের বিশেষ প্রসার হয়েছিল। লোহার, কাঠের, চামড়া, মাটি, বাঁশ ও পাথরের শিল্পের বেশ প্রসার হয়েছিল।
মৌর্য যুগের বাণিজ্য
এই মৌর্য সাম্রাজ্য-এর অধীনে ভারতের বিশাল অঞ্চলের রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপিত হলে মৌর্য যুগের বাণিজ্য -এর বিরাট প্রসার ঘটেছিল। ফলে হাতে তৈরি জিনিষের চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল। মৌর্যযুগে স্থলপথে এবং নদী ও সমুদ্র পথে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে এবং বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য চলত।
উপসংহার :- সর্বত্র শান্তি-শৃঙ্খলা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অগ্রগতি ছাড়াও সামুদ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার মৌর্য যুগের বৈষয়িক সমৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
(FAQ) মৌর্য যুগের অর্থনীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
কৃষিকাজ।
ধান ও গম।
মেগাস্থিনিস।
ভৃগুকচ্ছ, সোপারা, কল্যাণ, তাম্রলিপ্ত।