হুসেন শাহী বংশের অবদান প্রসঙ্গে উদারনৈতিক শাসন, স্বাধীন সুলতানের সূচনা, সাংস্কৃতিক জগতের উদ্ভাসন, হাবসি শাসনের অন্ধকার যুগের অবসান, উদার মানসিকতার পরিচয়, জাতীয় চেতনার সঞ্চার, শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব, সমাজ, ধর্ম ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে পরিবর্তন, সর্বধর্ম সমন্বয়, বাংলা সর্বাঙ্গিন উন্নতি, সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অবস্থা, শাসন ক্ষেত্রে সহিষ্ণুতা, পরধর্ম সহিষ্ণুতা ও সুলতানদের মহত্ব সম্পর্কে জানবো।
হুসেন শাহী বংশের অবদান
বিষয় | হুসেন শাহী বংশের অবদান |
বংশ | হুসেন শাহী বংশ |
প্রতিষ্ঠাতা | আলাউদ্দিন হুসেন শাহ |
শেষ সুলতান | গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ |
বড় সোনা মসজিদ | নসরৎ শাহ |
ভূমিকা :- বঙ্গদেশের ইতিহাসে ইলিয়াস শাহী বংশের সার্থক উত্তরাধিকারী ছিল হুসেন শাহী বংশ। বাংলাদেশ-এর ইতিহাসে হুসেন শাহী বংশের শাসনকাল এক গৌরবময় অধ্যায়।
হুসেন শাহী বংশের শাসনে আধুনিকতার পথে বাংলার উত্তরণ
প্রকৃতপক্ষে হুসেন শাহী বংশের শাসনকালেই বাংলাদেশ আধুনিকতার পথে তার উত্তরণ ঘটে। হুসেন শাহী বংশের লক্ষ্মণাবতী অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গদেশে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
বাংলায় হুসেন শাহী বংশের উদারনৈতিক শাসন
এই বংশের প্রধান বৈশিষ্ট্য, এর প্রথম দুই সুলতান পিতা-পুত্র দুজনেই ছিলেন উদার ও প্রজাহিতৈষণার মূর্ত প্রতীক। তাদের উদারনৈতিক শাসনে বঙ্গদেশে এক গৌরবোজ্জ্বল যুগের সূচনা হয়।
হুসেন শাহী বংশের আমলে বাংলায় স্বাধীন সুলতানির সূচনা
হুসেন শাহী বংশের শাসনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল বঙ্গদেশে প্রথম রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীন সুলতানির সূচনা।
বাংলায় হুসেন শাহী বংশের শাসনে সাংস্কৃতিক জগতের উদ্ভাসন
বঙ্গদেশের সীমানাকে কামতা-কামরূপ পর্যন্ত বিস্তার করা এবং শান্তি-সমৃদ্ধি অব্যাহত রেখে বঙ্গদেশের সাংস্কৃতিক জগৎকে নতুনভাবে উদ্ভাসিত করা কম গৌরবের নয়।
বাংলায় হুসেন শাহী বংশের গৌরবময় ভূমিকা
দিল্লি সুলতানির আধিপত্যের যুগেও বঙ্গদেশের রাজ্যবিস্তার হুসেন শাহী বংশের এক গৌরবময় ভূমিকা বলা যেতে পারে।
হুসেন শাহী বংশের শাসকদের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা
আলাউদ্দিন হুসেন শাহ জৌনপুরের রাজ্যচ্যুত সুলতানকে আশ্রয় দিয়ে, দিল্লির সুলতান সিকান্দার লোদীর সঙ্গে যেভাবে কূটনৈতিক বোঝাপড়া করে বঙ্গদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষা করেছিলেন, তা তাঁর চরম রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচায়ক।
হুসেন শাহী বংশের শাসকদের উচ্চস্তরের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি
নসরৎ শাহ মুঘল সম্রাট বাবর-এর সঙ্গে যেভাবে কূটনৈতিক বুদ্ধির দ্বারা সন্ধি করে বঙ্গদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছিলেন, তা তাঁর উচ্চস্তরের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির পরিচায়ক।
বঙ্গদেশের স্বাধীনতা রক্ষায় হুসেন শাহী বংশের ভূমিকা
সিকান্দার লোদি ও বাবরের মতো দুর্ধর্ষ সামরিক প্রতিভাদীপ্ত ব্যক্তির শ্যেনদৃষ্টি থেকে বঙ্গদেশের স্বাধীনতা যেভাবে রক্ষা করেছিলেন, তা মধ্যযুগের বঙ্গদেশের ইতিহাসে হুসেন শাহী বংশের এই গৌরবময় ভূমিকা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
হুসেন শাহী বংশের অবদান সম্পর্কে হবিবুল্লাহর অভিমত
এই সমস্ত দিক বিবেচনা করে ড. হবিবুল্লাহ বলেছেন, “The rule of Hussain Shah dynasty was a period of unparalleled activity, peace and prosperity and of great military conquests.”
হাবসি শাসনের অন্ধকার যুগের অবসান
বঙ্গদেশের সিংহাসনে হুসেন শাহী বংশের আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় হাবসি শাসন-এর এক অন্ধকারময় যুগের অবসান হয়। তাদের বিতাড়িত করে বঙ্গদেশে নিজেদের মনোমত লোককে বিভিন্ন পদে নিয়োগ করে কঠোর হস্তে শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপন, হুসেন শাহী বংশের এক বিরাট অবদান।
হুসেন শাহী বংশের শাসনে উদার মানসিকতার পরিচয়
- (১) উচ্চপদস্থ কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে হুসেন শাহী বংশ উদার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। শাসনব্যবস্থায় যোগ্য ব্যক্তিকে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে উপযুক্ত মর্যাদায় হুসেন শাহী বংশের সুলতানগণ অধিষ্ঠিত করেন।
- (২) বিশেষ করে হিন্দুদের উচ্চপদে নিয়োগ করে হুসেন শাহী বংশের সুলতানগণ মধ্যযুগের বঙ্গদেশে এক উদার মানসিকতার পরিচয় দেন। হুসেন শাহের উজির ছিলেন একজন প্রতিভাবান হিন্দু। তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন হিন্দু, তাঁর দেহরক্ষীদের প্রধান ছিলেন হিন্দু, তাঁর টাকশালের অধ্যক্ষ ছিলেন হিন্দু, তার সেনাপতি ছিলেন হিন্দু।
- (৩) খ্যাতিমান দুই ভ্রাতা রূপ ও সনাতন প্রথম জীবনে হুসেন শাহী বংশের রাজ্যশাসনে নিজেদের ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। এঁদের একজন ছিলেন সুলতানের একান্ত সচিব।
হুসেন শাহী বংশের শাসনে বাংলায় জাতীয় চেতনার সঞ্চার
এইভাবে হুসেন শাহী বংশ আধুনিক অর্থে না হলেও, বঙ্গদেশে একটা জাতীয় চেতনা সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, হুসেন শাহী বংশ বঙ্গদেশের জাতীয়তার অংশীদার হয়েছিল।
বাংলায় হুসেন শাহী বংশের শাসনে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব
- (১) হুসেন শাহী বংশের রাজত্বকালে শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব ঘটেছিল। চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারের ফলে বঙ্গদেশে সামাজিক ও ধর্মনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে নবজাগরণ-এর সূচনা হয়।
- (২) ঐতিহাসিক তথ্য থেকে সমর্থিত হয়েছে যে, আলাউদ্দিন হুসেন শাহ শ্রীচৈতন্যদেবকে শ্রদ্ধা করতেন এবং তাঁর অসাধারণত্ব স্বীকার করেছিলেন।
- (৩) ড. হবিবুল্লাহ মনে করেন, হুসেন শাহী বংশের এই উদারনৈতিক শাসনতান্ত্রিক পরিমণ্ডল ও পরধর্মসহিষ্ণু শাসন না থাকলে, শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণবধর্মের প্রচার ও প্রসার সম্ভব হত না।
- (৪) এমনকি মধ্যযুগের বঙ্গদেশে সাংস্কৃতিক নবজাগরণ সম্ভব হত না। এটা ঠিকই, হুসেন শাহী বংশের হিন্দুদের প্রতি উদার দৃষ্টিভঙ্গিই মধ্যযুগের বঙ্গদেশের নবজাগরণের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
বাংলায় হুসেন শাহী বংশের শাসনে সমাজ, ধর্ম ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে পরিবর্তন
হুসেন শাহী বংশের রাজত্বকালে বঙ্গদেশের মহান সন্তান শ্রীচৈতন্যের উদার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে মধ্যযুগের বঙ্গদেশের সমাজ, ধর্ম ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন দেখা দেয়। হুসেন শাহী বংশের সুলতান এই পরিবর্তনের সঙ্গে সহযোগিতা ছাড়া এই নতুন যুগের ভিত্তি-স্থাপন হত কিনা, তা একান্তই সন্দেহ।
হুসেন শাহী বংশের অবদান সম্পর্কে ডঃ মজুমদারের অভিমত
যদিও ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার হুসেন শাহী বংশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতাকে স্বীকার করেন না। কিন্তু ড. হাবিবুল্লাহ মনে করেন হুসেন শাহী বংশের উদার মানসিকতার জন্যই বঙ্গসাহিত্য অর্গলমুক্ত হয়ে বেগবতী নদীর মতো প্রবাহিত হয়।
হুসেন শাহী বংশের শাসনে বাংলায় সর্বধর্ম সমন্বয়
- (১) হিন্দুপ্রধান মধ্যযুগের বঙ্গদেশে হুসেন শাহী বংশের সুলতানগণ প্রথম সর্বধর্ম সমন্বয়ের এক নতুন ধারা প্রবর্তন করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পুনরুজ্জীবন ঘটান।
- (২) এই কারণে হুসেন শাহী বংশের সুলতানগণই প্রথম মধ্যযুগের সুলতান হওয়া সত্ত্বেও, তাঁরাই একমাত্র আকবর-এর সঙ্গে একাসনে বসবার যোগ্যতা দাবি করতে পারেন। যদিও আকবরের সঙ্গে তাঁদের সঠিক তুলনা করা যায় না। তবে এটা ঠিক, আকবরের পূর্বপর্যন্ত তাঁরাই ছিলেন উদারতার মূর্ত প্রতীক।
বাংলায় হুসেন শাহী বংশের শাসনে সাংস্কৃতিক জগতের বিকাশ
- (১) হুসেন শাহী বংশ বঙ্গদেশের সাংস্কৃতিক জগৎকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করে। মধ্যযুগের বঙ্গদেশে এই সাংস্কৃতিক বিকাশ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। যার প্রতিফলন ঘটে বঙ্গ ভাষার ও সাহিত্যের প্রতিটি পর্বের ভাবের আদান-প্রদানে।
- (২) চৈতন্যদেব যে শুধু ভক্তিবাদকে ধর্মীয় রূপ দিয়েছিলেন তা নয়, বঙ্গসাহিত্যের ক্ষেত্রেও এক নতুন যুগের সূচনা করে যান, যা পরবর্তীকালে বঙ্গদেশের সাংস্কৃতিক জীবনকে উন্নত করে। হুসেন শাহী বংশই আরবি-ফারসি সাহিত্যের যুগেও বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের পরম পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছে।
- (৩) চৈতন্যচরিত গ্রন্থগুলি বিশেষ করে চৈতন্যভাগবত, চৈতন্যচরিতামৃত, বিপ্রদাসের মনসামঙ্গল হুসেন শাহী বংশের রাজত্বকালের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ফসল। বঙ্গ-সাহিত্যের একটি পর্ব, অর্থাৎ পদাবলী সাহিত্যের সঙ্গেও হুসেন শাহী বংশের নাম ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
- (৪) এছাড়া মালাধর বসু, বিজয় গুপ্ত, যশোরাজ খান হুসেন শাহের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন। হুসেন শাহী বংশের রাজত্বকালেই পরমেশ্বর নামে জনৈক পণ্ডিত ‘মহাভারত’ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। বিদ্যাবাচস্পতির সঙ্গেও হুসেন শাহের যোগাযোগ ছিল।
- (৫) আবার কয়েকজন কবি, বিশেষ করে যশোরাজ খান, দামোদর, কবিরঞ্জন হুসেন শাহী বংশের আমলে রাজকর্মচারী ছিলেন। তাদের কাব্যসৃষ্টির পিছনে হুসেন শাহী বংশের অবদান ছিল। কয়েকজন মুসলমান পণ্ডিতও হুসেন শাহী বংশের সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন।
- (৬) হুসেন শাহী বংশের সুলতানগণ বিদ্বান ও ধর্মজ্ঞানীদের প্রতি অনুরাগ দেখিয়েছিলেন। রূপ গোস্বামী সংস্কৃতে বিদগ্ধমাধব ও ললিতমাধর নামে দু’খানি গ্রন্থ রচনা করেন। হুসেন শাহী বংশের পৃষ্ঠপোষকতাতেই মালাধর বসু ‘শ্রীমদ্ভাগবত’ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। এই কাজের জন্য তিনি ‘গুণরাজ খান’ উপাধি পেয়েছিলেন।
- (৭) প্রকৃতপক্ষে, হুসেন শাহী বংশের রাজত্বকালকে বাঙালি জাতির জাতীয় শাসন বলে অভিহিত করা যায়। কবিশেখর ‘বিদ্যাপতি হুসেন শাহী বংশের একজন রাজকর্মচারী ছিলেন।
হুসেন শাহী বংশের শাসনে বাংলার সর্বাঙ্গীন উন্নতি
ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার যে সর্বাঙ্গীণ উন্নতি ঘটেছিল তা হুসেন শাহী বংশের শাসনকালের অবদান। রাজনৈতিক দিক থেকেও এই বংশের শাসনকালে বাংলা, দিল্লি ও অন্যান্য রাজ্যের শাসকদের আক্রমণ প্রতিহত করে তার স্বাধীনতা রক্ষা করতে পেরেছিল, এটা কম গৌরবের কথা নয়।
হুসেন শাহী বংশের শাসনে বাংলার সীমানা বিস্তার
এই যুগে বাংলা কেবল নিজের স্বাধীনতাই রক্ষা করে নি, পূর্ব-পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে দিল্লি, উড়িষ্যা, আসাম ও আরাকান প্রভৃতি রাজ্যগুলির সঙ্গে যুদ্ধ করে সীমানার সম্প্রসারণ বৃদ্ধি করেছিল। এই সময় বাংলার সীমানা পশ্চিমে ত্রিহুত, দক্ষিণ-পশ্চিমে উড়িষ্যা, পূর্বে কুচবিহার ও দক্ষিণে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে।
শাসনক্ষেত্রে হুসেন শাহী বংশের সুলতানদের সহিষ্ণুতা
বাংলার শাসনক্ষেত্রে এই বংশের সুলতানগণ যে সহিষ্ণুতা দেখিয়েছিলেন তা মধ্যযুগের ইতিহাসে একান্তই দুর্লভ। তাই ড. যদুনাথ সরকার History of Bengal গ্রন্থে বলেছেন “Alauddin Hussain Shah was unquestionably the best, if not the greatest of the medieval rulers of Bengal.”
হুসেন শাহী বংশের শাসনে বাংলার সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অবস্থা
- (১) অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও হুসেন শাহী বংশের বাংলা ছিল এক সমৃদ্ধ রাজ্য। ব্যবসা- বাণিজ্যেও বাংলা ছিল খুবই সমৃদ্ধ। বৈষ্ণব পদাবলী ও মঙ্গলকাব্য থেকে সে যুগের বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য ও এক সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র পাওয়া যায়।
- (২) বাংলার বণিক যে বঙ্গোপসাগর পার হয়ে ব্রহ্মদেশ, ইন্দোচীন ও ইন্দোনেশিয়াতে বাণিজ্য করতে যেত সে তথ্য বিদেশি পর্যটকদের বিবরণে পাওয়া যায়। মা-হুয়ান ও বার্ণেমার বিবরণে তৎকালীন বাংলার এক সমৃদ্ধ ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়।
মধ্যযুগে হুসেন শাহী বংশের শাসনে বাংলায় স্থাপত্য শিল্পের বিকাশ
- (১) স্থাপত্যশিল্পের পৃষ্ঠপোষক হিসাবেও হুসেন শাহী বংশের অবদান যথেষ্ট। যদিও ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনকালেই বঙ্গদেশে শিল্প ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে নবযুগের সূচনা হয়েছিল, তবুও হুসেন শাহী বংশও সেই ধারাকে অব্যাহত রেখেছিল।
- (২) হুসেন শাহী বংশের শিল্প-স্থাপত্যের নিদর্শন হল গৌড়-এ অবস্থিত ছোটো সোনা মসজিদ, বড়ো সোনা মসজিদ, লোটন মসজিদ, কদম রসুল, দাখিল দরওয়াজা, একলাখি সমাধি-মন্দির প্রভৃতি। স্থাপত্যের ক্ষেত্রে নতুনত্বের কোনো পরিচয় এই যুগে পাওয়া যায় না।
- (৩) তবে হুসেন শাহী আমলে ইট ও পাথর দিয়ে তৈরি ছোটো সোনা মসজিদ ও বড়ো সোনা মসজিদ স্থাপত্যশিল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। তবে বড়ো সোনা মসজিদের গাম্ভীর্য ও সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে ফার্গুসন এটিকে সর্বোৎকৃষ্ট সৌধ বলে অভিহিত করেছেন।
- (৪) পার্সি ব্রাউন সামগ্রিক দিক থেকে হুসেন শাহী বংশের শিল্প-স্থাপত্যের নিদর্শনগুলি বিচার করে বলেছেন, এদের শিল্প মহান নয়, তবে এর গঠনাকৃতিতে সৌন্দর্য ও গাম্ভীর্যের এক নতুন ধারা দেখা যায়।
হুসেন শাহী বংশের শাসনে বাঙালির জাতির সাথে একাত্মতা
মধ্যযুগে হুসেন শাহী বংশের শাসনকালের সবদিক পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, হুসেন শাহী বংশের সুলতানগণ বাঙালি জাতির জাতীয় জীবনের মূলধারার সঙ্গে নিজেদের মিশিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং নিজেদের বাঙালি বলে মনে করতেন।
বাংলায় হুসেন শাহী বংশের শাসনে পরধর্মসহিষ্ণুতা
হুসেন শাহী বংশের শাসনকালের মতো পরমতসহিষ্ণুতার দৃষ্টান্ত বঙ্গদেশের ইতিহাসে একান্তই বিরল। ‘সত্যপীরের আরাধনার প্রচলন বঙ্গদেশের ইতিহাসে হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয়ের ক্ষেত্রে হুসেন শাহী বংশের প্রগতিশীলতার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
হুসেন শাহী বংশের অবদান সম্পর্কে অমিতাভ মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য
তাই অমিতাভ মুখোপাধ্যায় ‘সত্যপীরের’ আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, “মধ্যযুগের শেষে বাংলায় সত্যপীরের পূজা হিন্দু-মুসলিম ধর্ম সমন্বয়ের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।”
হুসেন শাহী বংশের শাসনে ঐতিহাসিক তথ্য
- (১) একটি ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায়, শ্রীচৈতন্যের গৌড়ে আগমন ঘটলে, সেখানকার কাজি তাঁর সংকীর্তন থেকে তাঁকে বিরত থাকার আদেশ দেন। কিন্তু এই সংবাদ হুসেন শাহের কর্ণগোচর হয়।
- (২) তিনি শ্রীচৈতন্যের ধর্মাচরণে কোনোরকম বাধা সৃষ্টি না করতে কাজিকে তখনই আদেশ দেন এবং তাঁর পরিভ্রমণের সুব্যবস্থা করার আদেশ দিয়ে বাঙালি জাতির হৃদয়ে হুসেন শাহী বংশের সুলতানগণ এক অক্ষয় আসন অধিকার করেন।
হুসেন শাহী বংশের সুতনদের সর্বজনীন আতিথ্য লাভ
মধ্যযুগে হুসেন শাহী বংশের সুলতানগণের মতো বাঙালি জাতির এমন সর্বজনীন আতিথ্য আর কেউ পান নি। তাই ড. হবিবুল্লাহ্ ঠিকই বলেছেন যে, হুসেন শাহের দুর্ভাগ্য যে আবুল ফজলের মতো জীবনীকার তাঁর ছিল না, যদি থাকত, তাহলে তাঁর জীবন আমাদের কাছে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠত।
আকবরের সঙ্গে হুসেন শাহী বংশের সুলতানের তুলনা
হুসেন শাহী বংশের সুলতানদের ঐতিহাসিক তথ্য যথেষ্ট নয়, তাতেও যতটুকু তথ্য আমরা পেয়েছি, তাতেই হুসেন শাহী বংশের সুলতানদের মহান সম্রাট আকবরের সঙ্গে সহজেই তুলনা করা যেতে পারে।
হুসেন শাহী বংশের সুলতানদের মহত্ত্ব
বাংলায় হুসেন শাহী বংশের সুলতানদের মহত্ত্বের জন্যই বাঙালি জাতির হৃদয়ে তারা একটা স্থায়ি আসন করে নিয়েছিলেন। বাঙালি জাতিও তাদের ‘জগৎভূষণ’ উপাধি দিয়ে বরণ করে নিয়েছিলেন।
উপসংহার :- ড. যদুনাথ সরকার তাঁর সুবিখ্যাত History of Bengal গ্রন্থে বলেছেন মধ্যযুগের বাংলার নবজাগরেণর সঙ্গে হুসেন শাহী বংশের শাসন নিবিড়ভাবে যুক্ত। এই বংশের শাসকগণের উদার মন ও ধর্মীয় সহনশীলতা ভিন্ন বাংলা ভাষা ও বৈষ্ণব ধর্মের উন্নতি ও প্রসার অসম্ভব ছিল।
(FAQ) হুসেন শাহী বংশের অবদান সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
আলাউদ্দিন হুসেন শাহ।
আলাউদ্দিন হুসেন শাহ।
নসরৎ শাহ।
আলাউদ্দিন হুসেন শাহ।