সিপাহি বিদ্রোহের কারণ

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের ইংরেজ আধিপত্য, ডালহৌসির সাম্রাজ্যবাদী নীতি, দেশীয় রাজন্যবর্গের প্রতি হীন আচরণ, লুণ্ঠন প্রভৃতি রাজনৈতিক কারণ, সম্পদের বহির্গমন, কুটির শিল্প ধ্বংস, বর্ধিত রাজস্ব, জমিদারির অবলুপ্তি, অসহনীয় করভার প্রভৃতি অর্থনৈতিক কারণ, ভারতীয়দের প্রতি ঔদ্ধত্য ও ঘৃণাসূচক আচরণ, শাসক – শাসিতের বিস্তর ব্যবধান প্রভৃতি সামাজিক কারণ, মিশনারিদের ধর্মপ্রচার, ধর্মান্তরিত করাকরা প্রভৃতি ধর্মীয় কারণ, ভারতীয় সিপাহিদের বঞ্চনা, বেতন বৈষম্য প্রভৃতি সামরিক কারণ ও মহাবিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ।

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহের কারণ প্রসঙ্গে মহাবিদ্রোহের পাঁচটি কারণ, সিপাহী বিদ্রোহের রাজনৈতিক কারণ, সিপাহী বিদ্রোহের অর্থনৈতিক কারণ, সিপাহী বিদ্রোহের সামাজিক কারণ, সিপাহী বিদ্রোহের সামরিক কারণ, সিপাহী বিদ্রোহের ধর্মীয় কারণ, সিপাহী বিদ্রোহ কেন হয়েছিল, সিপাহী বিদ্রোহের কারণগুলি, সিপাহী বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ, সিপাহী বিদ্রোহের সূচনা।

সিপাহি বিদ্রোহের কারণ

ঐতিহাসিক ঘটনাসিপাহি বিদ্রোহের কারণ
সময়কাল১৮৫৭-৫৮ খ্রিস্টাব্দ
স্থানব্যারাকপুর, মীরাট, দিল্লি, কানপুর, অযোধ্যা
নেতৃত্বনানা সাহেব, তাঁতিয়া টোপি, বেগম হজরত মহল, রাণী লক্ষ্মীবাই
ফলাফলব্যর্থতা
সিপাহি বিদ্রোহের কারণ

ভূমিকা :- ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে বড়লাট ক্যানিং-র শাসনকালে (১৮৫৬-৬২ খ্রিঃ) ভারত -এর এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। এই বিদ্রোহ ভারতে ইংরেজ শাসনের ভিতকাঁপিয়ে দেয়।

সিপাহি বিদ্রোহ

এই বিদ্রোহ প্রথম শুরু করেছিল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ভারতীয় সৈনিক বা সিপাহিরা। এই কারণে ইউরোপ -এর ঐতিহাসিকেরা এই বিদ্রোহকে ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ (‘Sepoy Mutiny’) বলে অভিহিত করেছেন।

সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ

এই বিদ্রোহ পূর্ববর্তী বিদ্রোহগুলির মতো কোনও স্থানীয় বা বিশেষকোনও গোষ্ঠীর বিদ্রোহ ছিল না। ভারতের যেমন এক বিস্তীর্ণ স্থানে এই বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল, তেমনি বিদ্রোহের সূচনার অল্পদিনের মধ্যেই দেশের রাজা, প্রজা, সৈনিক, সাধারণ মানুষ – সর্বশ্রেণী ও সর্বস্তরের মানুষ এতে অংশগ্রহণ করেছিল।

মহাবিদ্রোহ

কোনও কোনও অঞ্চলে সিপাহিদের অপেক্ষায় না থেকে জনসাধারণ নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিদ্রোহে অংশ নেয়, আবার কোথাও বা জনতাই সেনাবাহিনীকে বিদ্রোহে প্রণোদিত করে। তাই এই বিদ্রোহকে ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ না বলে ‘১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ‘ বলাই যুক্তিসঙ্গত।

বিপাণ চন্দ্রের অভিমত

ডঃ বিপান চন্দ্র বলেন যে, “এই  বিদ্রোহের উৎস ছিল কোম্পানির শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনসাধারণের পুঞ্জীভূত অসন্তোষ এবং বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র বিতৃষ্ণা।”

রমেশচন্দ্র মজুমদারের অভিমত

ঐতিহাসিক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন যে, “ভারতের সর্বশ্রেণীর মানুষই ইংরেজদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছিল। সুতরাং এটাই স্বাভাবিক যে, সর্বশ্রেণীর মানুষ ঘৃণ্য ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হবে।”

ড. দেশাইয়ের অভিমত

ঐতিহাসিক ডঃ এ. আর. দেশাই বলেন যে, “১৮৫৭-র বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ শাসনে নির্যাতিত বিভিন্ন শ্রেণীর ভারতবাসীর সম্মিলিত অসন্তোষের ফল। এই অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল রাজনৈতিক বিস্তৃতি, অর্থনৈতিক শোষণ এবং নানা সামাজিক উদ্ভাবন থেকে।”

সিপাহি বিদ্রোহের কারণ

এই বিদ্রোহ ছিল সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের পুঞ্জীভূত বিক্ষোভের ফল। এই বিদ্রোহের পশ্চাতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় এবং সামরিক কারণ বিদ্যমান ছিল।

(ক) সিপাহি বিদ্রোহের রাজনৈতিক কারণ

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের রাজনৈতিক কারণ গুলি হল –

(১) ইংরেজ আধিপত্য

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধ -এর পর থেকে একশ বছরের মধ্যে ভারতের এক বিস্তীর্ণ অংশে ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজ সামরিক শক্তির কাছে পদানত হলেও ভারতীয় রাজন্যবর্গ কোনওদিনই ইংরেজ শাসনকে মেনে নিতে পারেন নি।

(২) ডালহৌসির সাম্রাজ্যবাদী নীতি

লর্ড ডালহৌসির নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী নীতি রাজন্যবর্গ ও প্রজাবর্গের মনে এক তীব্র ব্রিটিশ-বিরোধী মনোভাবসৃষ্টি করে। স্বত্ববিলোপ নীতি ও কুশাসনের অজুহাতে তিনি সাতারা, সম্বলপুর, নাগপুর, ফাঁসি, তাঞ্জোর, কর্ণাটক, অযোধ্যা প্রভৃতি রাজ্য গ্রাস করেন।

(৩) রাজন্যবর্গের প্রতি হীন আচরণ

পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও এর দত্তক পুত্র নানাসাহেবের বাৎসরিক ভাতা ও পেশোয়াপদ তিনিলুপ্ত করেন। তিনি দিল্লির বাদশাহকে তাঁর প্রাসাদ থেকে বহিষ্কৃত করেন এবং তাঁর উপাধি বিলুপ্ত করা হয়। বলা বাহুল্য, রাজন্যবর্গের প্রতি এই হীন আচরণ হিন্দু-মুসলিম সাধারণ ভারতবাসী ভালো চোখে দেখে নি।

(৪) লুণ্ঠন

ডালহৌসি নির্লজ্জভাবে অযোধ্যা ও নাগপুরের রাজপ্রাসাদ লুণ্ঠন করেন। ঐতিহাসিক জন কেবলেছেন যে, রাজপরিবারের বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে নাগপুরের রাজপ্রাসাদ লুণ্ঠিত হয়। আসবাবপত্রাদি, মণি-মুক্তা, অলঙ্কার—এমনকী হাতি, ঘোড়া পর্যন্ত লুণ্ঠিত হয় এবং এর কিছু কলকাতায় প্রকাশ্যভাবে বিক্রি করা হয়। এই সব কার্যকলাপ সাধারণ প্রজাবর্গের মনে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও ভারতীয় রাজন্যবর্গের মনে তীব্র আতঙ্ক ও অসন্তোষের সৃষ্টি করে।

(৫) সন্নিহিত অঞ্চলের প্রতিক্রিয়া

জন কে বলেন যে, নাগপুর রাজ্য দখল অপেক্ষাও এই ধরনের নির্লজ্জ লুণ্ঠন ও মালপত্র বিক্রির ঘটনা সন্নিহিত প্রদেশগুলিতে অধিকতর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।

(৬) অস্বস্তি ও সন্দেহ

ডঃ কালীকিঙ্কর দত্ত বলেন যে, এই সব ঘটনা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল প্রাচীন রাজন্যবর্গের মনে অস্বস্তি ও সন্দেহের সৃষ্টি করে।

(৭) ইংরেজ কর্তৃক অধিকৃত বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যের রাজপরিবারের আশ্রিত ব্যক্তিগণ, জমিদার, তালুকদার ও সেনাদল কর্মচ্যুত ও জীবিকাহীন হয়ে পড়ে। এর ফলে তাদের মধ্যে তীব্র নৈরাশ্য ও প্রবল অসন্তোষ দেখা দেয়।

(খ) সিপাহি বিদ্রোহের অর্থনৈতিক কারণ

ইংরেজদের স্বৈরাচারী ও সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক শোষণের ফলে দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয়দের মনে তীব্র অসন্তোষ পুঞ্জীভূত হয়। যেমন –

(১) সম্পদের বহির্গমন

১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ—এই একশ বছরের মধ্যে কোম্পানি আমাদের দেশ থেকে প্রচুর সোনা-রূপা ইংল্যান্ড -এ নিয়ে যায়। যা সম্পদের বহির্গমন নামে পরিচিত।

(২) কুটির শিল্প ধ্বংস

ইংরেজদের একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকার যেমন এ দেশীয়বণিকদের দুর্দশার কারণ হয়, তেমনি শুল্ক-রহিত ইংল্যাণ্ড-জাত পণ্যসামগ্রীর সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় দেশীয় কুটিরশিল্প-জাত সামগ্রী টিকতে পারে নি। এর ফলে ভারতীয় কুটিরশিল্প—বিশেষত তাঁতশিল্প ধ্বংস হয় এবং বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়।

(৩) কাঁচামাল সরবরাহের দেশ

ভারত পরিণত হয় ম্যাঞ্চেস্টার ও ল্যাঙ্কাশায়ারের কাঁচামাল সরবরাহের উৎস ও উৎপন্ন পণ্যের খোলাবাজারে।

(৪) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল

ইংরেজদের ভূমি-সংস্কার ও ভূমিরাজস্ব নীতি দেশবাসীকে চরম অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেয়। লর্ড কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কৃষক, প্রাচীন জমিদার সম্প্রদায় ও সাধারণ গ্রামবাসীর জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনে।

(৫) বর্ধিত রাজস্ব

মাদ্রাজের ‘উত্তর সরকার’ অঞ্চলের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার ফলে জমিদার শ্রেণী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাদ্রাজে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত -এর ফলে ভূমি রাজস্বের পরিমাণ প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ গুণ বৃদ্ধি পায়।

(৬) জমিদারি অবলুপ্ত

বেন্টিঙ্কের ভূমি-সংস্কার নীতির ফলে বহু প্রাচীন জমিদার বংশ অবলুপ্ত হয় এবং মহাবিদ্রোহের মাত্র পাঁচ বৎসর পূর্বে ডালহৌসিনিযুক্ত ‘ইনাম কমিশন’ বোম্বাই প্রেসিডেন্সির প্রায় ২০,০০০ জমিদারি বাজেয়াপ্ত করায় দেশের অর্থনৈতিক সংকট তীব্রতর হয়ে ওঠে।

(৭) অসহনীয় করভার

দরিদ্র কৃষকদের ওপর অসহনীয় করভার চাপানো হয়। উত্তর ভারতে কর্মরত জেলাশাসক মার্ক থর্নহিল ইংরেজদের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থাকে ‘নিষ্ঠুর’ বলে অভিহিত করেছিলেন।

(৮) প্রজাদের শোচনীয় অবস্থা

ডঃ শশীভূষণ চৌধুরী বলেন যে, নতুন ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্তের ফলে সাধারণ প্রজার অবস্থাশোচনীয় হয়ে পড়ে। তাই ভূমি ও সম্পত্তি সংক্রান্ত স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়ার জন্য সাধারণ ভারতবাসী বিদ্রোহে অবতীর্ণ হয়। তাঁর মতে, ধর্মীয় কারণের চেয়ে অর্থনৈতিক স্বার্থই ছিল অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।

(৯) তালুকদার ও কৃষকদের দুর্দশা

অযোধ্যায় প্রবর্তিত ব্রিটিশ রাজস্ব নীতি এবং এই অঞ্চলের মুখ্য কমিশনার কোভারলি জ্যাকসন ও গাবিনস সাহেবের উদ্ধত আচরণ ও অসহানুভূতিপূর্ণ মনোভাবের ফলে তালুকদার ও কৃষকদের দুর্দশার অন্ত ছিল না। অযোধ্যার রাজধানী মুখ্য কমিশনারের সদর দপ্তরে পরিণত হয়, নবাবের সেনাদল ভেঙ্গে দেওয়া হয় এবং রাজকর্মচারী ও অনুগৃহীতদের বেতন বন্ধ হয়ে যায়।

(১০) তালুকদারদের বিতাড়ন

ইংরেজ কর্মচারী গাবিনস বলেন যে, ইংরেজ শাসনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়তালুকদার শ্রেণী। বংশ-পরম্পরায় তারা যে জমিদারি ভোগ-দখল করছিল, সেগুলি থেকে তারা বিতাড়িত হয়।

(১১) অগ্নিগর্ভ অযোধ্যা

১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রায় ২১,০০০ তালুকদারের জমিদারি কেড়ে নেওয়া হয়। এই সব বিক্ষুব্ধ তালুকদার, তাদের অধীনস্থ কৃষক, কর্মচ্যুত সেনাদল ও কর্মচারীদের বিক্ষোভে অযোধ্যা অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। তারা নিজেদের অধিকার ফিরে পাওয়ার উদ্দেশ্যে একযোগে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

(১২) লর্ড ক্যানিং কে পত্র

কোম্পানির পরিচালক সভা ভারতের বড়লাট ক্যানিং-কে এক পত্রে জানায় (১৯শে এপ্রিল, ১৮৫৮ খ্রিঃ) যে, অযোধ্যার নবাবকে গদিচ্যুত করা এবং সেখানে নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা গ্রহণ করে ভূস্বামীদের জমির অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ফলেই অযোধ্যার বিদ্রোহ একটি গণ-বিদ্রোহের রূপ ধারণ করে।

(১৩) বিভিন্ন করে দূর্বিসহ কৃষক

গোচারণ কর, বন কর, খাদ্যদ্রব্য, বাড়ি-ঘর, খেয়াঘাট, চৌকিদারি কর, পথ কর, যানবাহন ও অন্যান্য নানা করভার প্রজাদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। দরিদ্র কৃষক এক শোচনীয় অবস্থার সম্মুখীন হয়। এ জন্য অনেকে একে ‘কৃষক বিদ্রোহ’ বলে চিহ্নিত করতে চান।

(১৪) দেশিয় রাজন্যবর্গের অপসারণ

গদিচ্যুত শাসকদের আশ্রিত ব্যক্তি, কর্মচ্যুত সেনাদল, রাজকর্মচারী ও অভিজাত পরিবারবর্গের জীবিকা নির্বাহের পথ বন্ধ হয়ে যায়। দেশীয় রাজন্যবর্গ শিল্পী, সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ প্রভৃতি নানা গুণীজনের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। মন্দির, মসজিদ ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁরা নিষ্কর ভূমি ও অন্যান্য সাহায্য দান করতেন। দেশীয় রাজ্যগুলি ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে এই সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলিও ধ্বংসের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়।

(১৫) জন কে-র অভিমত

ঐতিহাসিক জন কে বলেন যে, কর্মচ্যুত হওয়ার পর অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছিল যে, মূল্যবান আসবাবপত্র ও অলঙ্কার সামগ্রী বিক্রির পর অভিজাত পরিবারের মহিলারা রাত্রির অন্ধকারে অন্যের গৃহে ভিক্ষা করে জীবননির্বাহ করতেন। সুতরাং এই অবস্থার বিরুদ্ধে জনগণ যে বিদ্রোহী হয়ে উঠবে এ সম্পর্কে কোনও সন্দেহ নেই।

(গ) সিপাহি বিদ্রোহের সামাজিক কারণ

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার পশ্চাতে বিভিন্ন কারণ বিদ্যমান ছিল। যেমন –

(১) ভারতীয়দের ঘৃণা করা

ভারতে কোম্পানির শাসন প্রবর্তিত হওয়ার সময় থেকেই ইংরেজরা ভারতবাসী, তাদের আচার-আচরণ ও সামাজিক রীতিনীতিকে তীব্রভাবে ঘৃণা করত। ইংরেজদের চোখে ভারতীয়রা ‘বর্বর’ ছাড়া অন্য কিছু ছিল না।

(২) ঔদ্ধত্য ও ঘৃণাসূচক আচরণ

১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে রচিত ‘সিয়ার-উল-মুতাক্ষরিন’ গ্রন্থে বলা হচ্ছে যে, ইংরেজরা ইচ্ছে করেই ভারতীয়দের সংস্পর্শ বর্জন করে চলত। ভারতীয়দের প্রতি তাদের আচরণ ছিল ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও ঘৃণাসূচক।

(৩) সৈয়দ আহমদ খানের অভিমত

স্যার সৈয়দ আহমদ খান লিখেছেন যে, ইংরেজ রাজকর্মচারীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে সম্ভ্রান্ত ভারতীয়রাও ভীত হয়ে উঠতেন।

(৪) ওয়ারেন হেস্টিংসের বর্ণনা

১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস লিখেছেন যে, কয়েক বছর পূর্বেও অধিকাংশ ইংরেজ ভারতীয়দের বর্বর বলেই মনে করত।

(৫) উচ্চপদে ভারতীয়দের নিয়োগ নিষিদ্ধ

লর্ড কর্ণওয়ালিস সরকারি উচ্চপদে ভারতীয়দের নিয়োগ নিষিদ্ধ করেন কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে ভারতীয়রা সকলেই দুর্নীতিগ্রস্ত।

(৬) মেকলের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য

ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে লর্ড বেন্টিঙ্কের আইনসচিব মেকলে -র কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য স্মরণীয়। বহু ইংরেজ ক্লাবে নোটিশ দেওয়া থাকত যে, “কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ।”

(৭) আগ্রার ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ

আগ্রার এক ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট আদেশ দিয়েছিলেন যে, কোনও ইংরেজ সামনে এলেই ভারতীয়দের তাঁকে সেলাম জানাতে হবে।

(৮) শাসক-শাসিতের ব্যবধান

ভারতীয়দের প্রতি তাদের এই ধরনের বিজেতাসুলভ ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ শাসক ও শাসিতের মধ্যে বিরাট ব্যবধানের সৃষ্টি করে। এর ফলে ইংরেজদের সম্পর্কে ভারতীয়দের মনে স্থায়ী সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়।

(৯) ভারতীয়দের সন্দেহ

ইংরেজদের জনহিতকর কার্যাবলী যথা — ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তন, রেলপথ, টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা, দেশে ইংরেজি আইনের প্রবর্তন প্রভৃতিকে ভারতবাসী সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে।

(১০) ভারতীয়দের বঞ্চনা

১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন -এ জাতি-ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল যোগ্যতাসম্পন্ন ভারতীয়কে উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত হওয়ার অধিকর দেওয়া হলেও, বাস্তবে ভারতীয়দের প্রতি বঞ্চনার নীতি গ্রহণ করা হয়।

(১১) দুর্নীতি

এই সময় প্রশাসনের নিম্নস্তরবিশেষ করে পুলিশ, ছোটখাটো রাজকর্মচারী এবং নিম্নতর আদালতগুলি ‘দুর্নীতির লীলাক্ষেত্রে’ পরিণত হয়।

(১২) পুলিশের অত্যাচার ও শোষণ

১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে সিপাহি বিদ্রোহের কারণগুলি আলোচনা প্রসঙ্গে উইলিয়াম এডওয়ার্ডস নামে কোম্পানির জনৈক কর্মচারী লেখেন যে, জনসাধারণের কাছে পুলিশ ছিল রীতিমত ‘বিভীষিকাজনক বস্তু’ এবং সরকারের ওপর জনসাধারণের বিরাগের মূল কারণ হল তাদের ওপর পুলিশের অত্যাচার ও শোষণ।

(১৩) ইংরেজ কর্মীদের ব্যভিচার

কিছু কিছু উচ্চপদস্থ ইংরেজ সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীর নৈতিক জীবনযাত্রা ও ব্যভিচার ভারতবাসীদের চোখে তাদের হেয় প্রতিপন্ন করে।

(ঘ) সিপাহি বিদ্রোহের ধর্মীয় কারণ

মহাবিদ্রোহের ধর্মীয় কারণ গুলি হল –

(১) মিশনারিদের ধর্মপ্রচার

খ্রিস্টান মিশনারিদের ধর্মপ্রচারের চেষ্টা এবং হিন্দু-মুসলিম ধর্ম ও দেব-দেবী সম্পর্কে তাদের বিষোদ্গার ভারতীয় মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

(২) মিশনারিদের কর্মকাণ্ড

সরকারি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে বাইবেল পড়ানোর ব্যবস্থা, কারাগারে বন্দিদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচার, ধর্মান্তরিত ব্যক্তিদের বিভিন্ন সুযোগ প্রদান, মন্দির-মসজিদের খাস জমি ও বিভিন্ন ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানের ওপর কর আরোপ, ধর্মান্তরিত পুত্রের সম্পত্তির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে আইন – এই সব ভারতবাসী ভালোভাবে মেনে নেয়নি।

(৩) ধর্মান্তরকরণ

ভারতবাসী উপলব্ধি করেছিল যে, সরকারের অন্যতম উদ্দেশ্য হল ভারতীয় খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা। স্যার সৈয়দ আহমদ খান লিখছেন যে, সব ভারতীয়ই বিশ্বাস করত যে মিশনারিগণ কর্তৃক ধর্মান্তরীকরণের কাজে সরকারের মদত আছে।

(৪) ২১ নং রেগুলেশন পাশ

১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে ‘২১ নং রেগুলেশন’ দ্বারা ধর্মান্তরিত ভারতীয়কে সম্পত্তির উত্তরাধিকার দান করা হলে ভারতীয় সমাজের সর্বস্তরের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়। স্যার সৈয়দ আহমদ খান বলেন যে, সংখ্যায় আরও বেশি মানুষকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার জন্য এই আইন পাশ করা হয়।

(৫) পদাতিক বাহিনীর ধারণা

বিদ্রোহীদের বিভিন্ন ঘোষণাপত্রেও এই ধর্মান্তিকরণের ভীতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ৩৪ নং দেশীয় পদাতিক বাহিনীর সেনাদের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে তাদের অচিরেই খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা হবে।

(৬) দি টাইমস পত্রিকার সংবাদ

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ই জুন ‘দি টাইমস’ পত্রিকায় লেখা হয় যে, বড়লাট লর্ড ক্যানিং লর্ড সামারস্টোনের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন যে সমগ্র ভারতবাসীকে ধর্মান্তর করার ব্যাপারে তিনি সর্বশক্তি প্রয়োগ করবেন।

(৭) তৎকালীন চেয়ারম্যানের নির্দেশ

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের প্রাক্কালে কোম্পানির তৎকালীন চেয়ারম্যান মি. ম্যাঙ্গলেসভারত সরকারকে নির্দেশ দেন, “সমগ্র ভারতকে খ্রিস্টান করতে যে কাজ শুরু হয়েছে তাতে যেন কোনওপ্রকার শৈথিল্য না ঘটে।”

(৮) ভারতীয়দের তীব্র সন্দেহ

ইংরেজি শিক্ষা, স্ত্রীশিক্ষা, বিধবা বিবাহ, হিন্দু উত্তরাধিকার আইন এবং সতীদাহ ও শিশুহত্যা নিবারণ প্রভৃতি আইন এমনকী রেলওয়ে, টেলিগ্রাম, টেলিগ্রাফ, গঙ্গানদীতে সেচব্যবস্থা প্রবর্তন ভারতীয়দের মনে ইংরেজদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে এক তীব্র সন্দেহের সৃষ্টি করে। রক্ষণশীল ভারতীয়রা এগুলির মধ্যে হিন্দু ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ওপর তীব্র আঘাতের আভাস পান।

(ঙ) সিপাহি বিদ্রোহের সামরিক কারণ

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সামরিক কারণও যথেষ্ট ছিল।যেমন –

(১) ভারতীয় সৈন্যদের মদত

ইংরেজরা একদিন বাহুবলের সাহায্যে ভারতবর্ষ জয় করেছিল এবং ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের ভিত্তিই ছিল বাহুবল। ভারতে ইংরেজ সামরিক বাহিনীর মূল ভিত্তি ছিল ভারতীয় সামরিক সৈনিকরা।

(২) ভারতীয় সৈন্যদের অবহেলা

সমকালীন একজন ইংরেজ লিখছেন যে, “সিপাহি ও ব্রিটিশ উচ্চতম সামরিক কর্মচারীদের মধ্যে কোনও বন্ধুত্ব ও সহমর্মিতা বোধ ছিল না। দুই দলই যেন ছিল বিচ্ছিন্ন ও পরস্পরের অপরিচিত। সামরিক বাহিনীতে সিপাহিদের নিকৃষ্ট শ্রেণীর জীব বলে গণ্য করা হত।”

(৩) বৈষম্যমূলক নীতি

বেতন, পদমর্যাদা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে ইংরেজ ও ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি ভারতীয় সিপাহিদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। সেনাবাহিনীর ইংরেজ কর্মচারীদের তুলনায় ভারতীয়দের বেতন ছিল অনেক কম, তাদের পদোন্নতির কোনও সুযোগ ছিল না এবং তাদের বাস করতে হত অতি জঘন্য পরিবেশে।

(৪) ইংরেজ সৈন্যদের সুযোগ সুবিধা প্রদান

ইংল্যাণ্ড থেকে আগত যে-কোনও তরুণ ইংরেজ সেনা দক্ষ। ও অভিজ্ঞ যে-কোনও ভারতীয় সৈনিকের চেয়ে বেশি বেতন, পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত।

(৫) হোমসের অভিমত

ইংরেজ ঐতিহাসিক হোমস লিখছেন যে, “একজন সিপাই হায়দার আলিরমাতা নৈপুণ্য ও দক্ষতা দেখিয়েও একজন সাধারণ ইংরেজ সৈনিকের মতো মর্যাদা আশা করতে পারত না।”

(৬) বেতন বৈষম্য

একজন সর্বনিম্ন পদের ইংরেজ কর্মচারী চাকুরিতে যোগ দিয়ে বছরে পেত ১,০৮০ ডলার, আর একজন ভারতীয় সিপাই বছরে পেত মাত্র ৮৪ টাকা। কোনও ভারতীয়ের পক্ষে সুবাদারের চেয়ে উঁচু পদে প্রমোশন পাওয়া সম্ভব ছিল না, এবং সেক্ষেত্রে তার বেতন হত মাসিক ৬০ টাকা বা ৭০ টাকা।

(৭) ভারতীয় সৈন্যদের গালিগালাজ

অনেক সময়ই কারণে-অকারণে ইংরেজ অফিসাররা অভিজ্ঞ ও বয়স্ক ভারতীয় সৈনিকদের ‘নিগার’, ‘নেটিভ’, ‘শুয়োর’ এবং আরও অন্যান্য অশালীন ভাষায় গালাগালি করত, যা সহ্য করা সম্ভব ছিল না।

(৮) অতিরিক্ত ভাতা বন্ধ

দেশীয় সিপাহিদের অধিকাংশ সময়ই বহুদূর প্রদেশে যুদ্ধযাত্রা করতে হত। এ জন্য অতিরিক্ত ভাতা বা ‘বাট্টা’ দেওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল। সিপাহি বিদ্রোহের অব্যবহিত পূর্বে এই অতিরিক্ত ভাতা বন্ধ করে দিলে তাদের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ দেখা দেয়।

(৯) খ্রিস্টান মিশনারিদের নিন্দা বাক্য

মিশনারিরা সিপাহিদের মধ্যে ধর্মপ্রচার করতে আসত এবং হিন্দু-মুসলিমদের ধর্মের বিরুদ্ধে নানাপ্রকার নিন্দা করত। এর ফলে তাদের ধর্মবিশ্বাসে প্রচণ্ড আঘাত লাগে।

(১০) ধর্মে আঘাত

সামরিক কর্তৃপক্ষ সিপাহিদের কপালে তিলক কাটা, দাড়ি ও টিকি রাখা, পাগড়ি ব্যবহার প্রভৃতি নিষিদ্ধ করলে তাঁদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সঞ্চার হয়, কারণ এগুলিকে তারা নিজেদের ধর্মের অঙ্গ বলে মনে করত।

(১১) ধর্মচ্যুত হওয়ার ভয়

১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ‘জেনারেল সার্ভিস এনলিস্টমেন্ট অ্যাক্ট’ পাশ করে সিপাহিদের ভারত ও ভারতের বাইরে যে-কোনও স্থানে নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয়। এর ফলে ভারতীয় সিপাহিরা ধর্মচ্যুতির সম্ভাবনায় আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। তৎকালীন ভারতীয় সমাজে সমুদ্রযাত্রা জাতিচ্যুত হওয়ারই সামিল ছিল। ভারতীয় সৈন্যদের সমুদ্র অতিক্রম করে ব্রহ্মদেশে যুদ্ধের জন্য পাঠানো হলে তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়।

(১২) মনোবল বৃদ্ধি

প্রথম আফগান যুদ্ধ (১৮৩৯ খ্রিঃ) ও ক্রিমিয়ার যুদ্ধ -এ (১৮৫৪-৫৬ খ্রিঃ) ইংরেজ সেনাবাহিনীর সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশার কাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর মনে আশার সঞ্চার করে। তারা ইংরেজ সৈনিকদের বীরত্বের প্রতি শ্রদ্ধা হারায় এবং তাদের বিরুদ্ধে জয়লাভের আশায় উৎসাহিত হয়ে ওঠে।

(১৩) গ্রামের দুর্দশার প্রতিফলন

সিপাহিরা ছিল “উর্দিপরা কৃষক’। তাদের চেতনা ও গ্রামের মানুষের চেতনা বিচ্ছিন্ন ছিল না। গ্রামীণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা যেমন সেনানিবাসে ঢেউ তুলতো, তেমনই বিক্ষুব্ধ সিপাহিদের ভাবনা-চিন্তা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ত।

(১৪) অযোধ্যার পরিস্থিতি

অযোধ্যার প্রতিটি কৃষিজীবী পরিবারের কেউ না কেউ সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। তাদের সংখ্যা ছিল ৭৫ হাজার। অযোধ্যার নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সেনাদের স্বার্থেও আঘাত হানে। এর প্রতিকারের জন্য সিপাহিরা প্রশাসনের কাছে ১৪ হাজার আবেদনপত্র পাঠায়। এখানেই আমজনতার সাথে সিপাহিদের স্বার্থ মিশে যায়।

(১৫) সাধু সন্ন্যাসীদের ভবিষ্যদ্বাণী

এই সময় বহু সাধু-সন্ন্যাসী ও দরবেশ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচার করে বেড়াতেন যে, পলাশির যুদ্ধের একশ বছরের মধ্যে ভারতে ব্রিটিশ শাসন অবলুপ্ত হবে। এই ভবিষ্যদ্বাণী সিপাহিদের মনে প্রবল উৎসাহের সঞ্চার করে।

(চ) সিপাহি বিদ্রোহে মহাবিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ

বিদ্রোহের ক্ষেত্র পূর্ব থেকেই প্রস্তুত ছিল। ঠিক এই সময় এনফিল্ড রাইফেল ঘটনা বিদ্রোহে ইন্ধন জোগায়।

(১) এনফিল্ড রাইফেলের প্রবর্তন

এই সময় ইংরেজ কোম্পানি এনফিল্ড রাইফেল নামে নতুন এক ধরনের রাইফেলের প্রবর্তন।এই রাইফেলে যে টোটা ব্যবহৃত হত তার খোলসটি দাঁতে কেটে রাইফেলে ভরতে হত।

(২) সৈন্যদের টোটা ব্যবহারে অসম্মতি

এইরাইফেলের টোটার খোলসটি গোরু ও শুয়োরের চর্বি দিয়ে তৈরি হত। ধর্মচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় হিন্দু – মুসলিম সিপাহিরা এই টোটা ব্যবহারে অসম্মত হয়। এই টোটার প্রচলনই হল মহাবিদ্রোে প্রত্যক্ষ কারণ, মূল কারণ বা প্রধান কারণ নয়।

সিপাহি বিদ্রোহ সম্পর্কে ডিসরেলির অভিমত

ইংল্যাণ্ডের টোরি পার্টির নেতা ডিসরেলী টোটাকে বিদ্রোহের মূল কারণ বলতে রাজিনন।

সিপাহি বিদ্রোহ সম্পর্কে সাভারকরের অভিমত

ভি. ডি. সাভারকার বলেন যে, চর্বি-মাখানো টোটাই যদি বিদ্রোহে প্রধান কারণ হত, তাহলে গভর্নর জেনারেল কর্তৃক এই টোটা ব্যবহার নিষিদ্ধ করে হুকুম জারির পরই এই বিদ্রোহ বন্ধ হয়ে যেত।

সিপাহি বিদ্রোহ সম্পর্কে হরিশ্চন্দ্রের অভিমত

স্বনামধন্য সাংবাদিক ও বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদ নেতা হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বলেন যে, বিদ্রোহীদের চোখের সামনে টোটাগুলি ধ্বংস করে ফেলা হলেও বিদ্রোহ ঘটতই, কারণ বিদ্রোহের মূলে ছিল জনগণের প্রবল অসন্তোষ।

সিপাহি বিদ্রোহের সূচনা

বলা বাহুল্য, বিদ্রোহীরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় এই চর্বি-মাখানো টোটাই ব্যবহার করেছে।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “সিপাহি বিদ্রোহের কারণ” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) সিপাহি বিদ্রোহের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সিপাহি বিদ্রোহ কখন শুরু হয়?

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে।

২. সিপাহি বিদ্রোহ প্রথম কোথায় শুরু হয়?

ব্যারাকপুরে।

৩. প্রথম কে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন?

মঙ্গল পাণ্ডে।

৪. সিপাহি বিদ্রোহের প্রথম শহীদ কে?

মঙ্গল পাণ্ডে।

৫. সিপাহি বিদ্রোহের সময় ভারতের গভর্নর জেনারেল)বড়লাট কে ছিলেন?

লর্ড ক্যানিং।

অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনা বা গল্পগুলি

Leave a Comment