মুঘল সম্রাট আকবরের জাতীয় নীতি প্রসঙ্গে হিন্দুদের পরিস্থিতি, আকবরের পূর্বে জাতীয় নীতি, সর্বপ্রথম জাতীয় নীতি গ্রহণ, জাতীয় শাসক ও জাতীয় নীতি, বৈষম্য মূলক কর রদ, ক্রীতদাস প্রথা রদ, সামাজিক কুপ্রথা রদের চেষ্টা, ধর্ম সহিষ্ণুতার নীতি, যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ, রাজপুত নীতি, ভারতের সাহিত্য ও শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতা সম্পর্কে জানবো।
মুঘল সম্রাট আকবরের জাতীয় নীতি
ঐতিহাসিক ঘটনা | আকবরের জাতীয় নীতি |
সম্রাট | আকবর |
সাম্রাজ্য | মুঘল সাম্রাজ্য |
ইবাদত খানা | ১৫৭৫ খ্রি |
তীর্থকর রদ | ১৫৬৩ খ্রি |
জিজিয়া রদ | ১৫৬৪ খ্রি |
ভূমিকা :- আকবর ছিলেন এক উদার প্রাণ, প্রতিভাবান সম্রাট। তিনি উপলব্ধি করেন যে, কেবলমাত্র সামরিক শক্তির জোরে ভারত জয় করে শাসন-ব্যবস্থাকে স্থায়ী করা যাবে না। বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, বিশেষত সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের আস্থা পেলে তবেই তারা তার প্রতি স্বাভাবিক আনুগত্য দেবে একথা তিনি বুঝতেন।
আকবরের উক্তি
ঐতিহাসিক আবুল ফজল-এর আকবরনামার মতে আকবর বলেন যে, “তিনি ভারতের সকল সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলিম সকলের বাদশাহ হতে চান।”
আকবর সম্পর্কে পার্সিভ্যাল স্পিয়ারের অভিমত
ঐতিহাসিক পার্সিভ্যাল স্পিয়ার বলেছেন যে, “আকবর এক ইন্দো-বিদেশীয় (মুসলিম) সম্প্রদায়ের সংখ্যালঘু শ্রেণীর নেতৃত্ব ত্যাগ করে সমগ্র হিন্দুস্থানের স্বীকৃত শাসকে পরিণত হন।”
আকবরের পূর্বে হিন্দুদের পরিস্থিতি
- (১) সুলতানি যুগে হিন্দুরা প্রশাসনে এবং সেনাদলে যোগ দিত। কিন্তু তারা সরকারের নীতি নির্ধারণের কাজে অংশীদার হতে পারত না এবং মুসলিম শাসকশ্রেণীর সমমর্যাদা পেত না।
- (২) দিল্লী সুলতানরা হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাস ও জীবনধারায় সাধারণভাবে আঘাত না করলেও, তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু প্রজাদের সমমর্যাদা ও সমান অধিকার দিয়ে জাতীয় ঐক্যবোধ বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ নেন নি।
আকবরের পূর্বে জাতীয় নীতি
ভারতে আকবরের আগে কোনো সম্রাট বিজিত অধিবাসীদের সম মর্যাদা ও সম অধিকার দান করে উৎসাহিত করেন নি। কাজেই জাতীয় নীতি বলতে যা বোঝায় তা আকবরের আগে গঠিত হয় নি।
আকবর কর্তৃক সর্বপ্রথম জাতীয় নীতি গ্ৰহণ
মোঘল সম্রাট আকবর সর্বপ্রথম জাতীয় নীতি গ্রহণ করে হিন্দু-মুসলিম সকল সম্প্রদায়কে সমমর্যাদা দেন। কেবলমাত্র Utility বা প্রয়োজনের কথা মনে রেখে আকবর একাজ করেন নি। আকবরনামা হতে জানা যায় যে, “তিনি সিংহাসনে বসার কিছুকাল পরে এক আধ্যাত্মিক প্রেরণা অনুভব করেন।” এর ফলেই তিনি এই জনহিতকর ব্যবস্থাগুলি প্রবর্তন করেন।
জাতীয় শাসক আকবর ও জাতীয় নীতি
- (১) যদি কোনো শাসক ধর্ম, জাতি বা বর্ণের ভিত্তিতে তার প্রজাবর্গের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ না করে, সকলকে সমান চোখে দেখেন তবে তাকে জাতীয় শাসক বলা যায়।
- (২) যদি তিনি কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা না করে, বিভিন্ন সংস্কৃতির সমন্বয়ের চেষ্টা করেন তবেই তাকে জাতীয় নীতি বলা চলে। আকবরের আমলেই আমরা এই জাতীয় নীতির প্রকাশ দেখতে পাই।
আকবর কর্তৃক বৈষম্যমূলক কর রদ
সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ওপর যে বৈষম্যমূলক করগুলি চালু ছিল আকবর তা রদ করে দেন। ডঃ আর. পি. ত্রিপাঠীর মতে, আকবর উপলব্ধি করেন যে, তাঁর প্রজাদের মধ্যে বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর লোক আছেন। তাদের ঐক্যের বাঁধনে বাঁধার জন্য একটি জাতীয় নীতি দরকার। হিন্দু-মুসলিম ভারতের এই দুই প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈষম্যমূলক আইনবিধি দূর করে ঐক্য স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা তিনি বুঝেন।
(১) তীর্থকর রদ
১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি হিন্দু তীর্থযাত্রীদের ওপর তীর্থকর লোপ করেন। এর ফলে হিন্দু তীর্থযাত্রীরা বৈষম্যমূলক কর প্রদান ও হায়রানির হাত থেকে অব্যাহতি পায়।
(২) জিজিয়া কর রদ
১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি বহু সমালোচিত জিজিয়া কর লোপ করেন। জিজিয়া ছিল অ-মুসলিমদের ওপর কর। আকবর এই কর লোপ করে হিন্দুদের মুসলিম প্রজাদের সঙ্গে সমান মর্যাদা দেন।
(৩) জাকাৎ রদ
এর সঙ্গে তিনি মুসলিম প্রজাদের ওপর জাকাৎ বা ধর্মকরও লোপ করেন।
(৪) অন্যান্য কর লোপ
তিনি গৃহপালিত পশু, ফলের গাছ, গৃহে লবণ উৎপাদন, পাগড়ী পরিধানের জন্য কর লোপ করেন। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল কৃষক এতে উপকৃত হয়।
আকবর কর্তৃক ক্রীতদাস প্রথা লোপ
তিনি ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে ক্রীতদাস প্রথা লোপ করেন। যুদ্ধ বন্দীদের দাসে পরিণত করার প্রথা রহিত করেন। বহু বন্দী দাসকে মুক্তি দেওয়া হয়। “দাস” কথাটির বদলে ‘চেলা’ কথাটি ব্যবহার করা হয়।
উৎসবে হিন্দু-মুসলিম একত্রে যোগদান
হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায় যাতে পরস্পরের অনুষ্ঠানে যোগ দেন এজন্য তিনি উৎসাহ দেন। তিনি নিজে-হিন্দু উৎসব দীপাবলি, হোলি বা দোলযাত্রা, দশেরাতে যোগ দেন।
আকবর কর্তৃক সামাজিক কুপ্রথা রদ করার চেষ্টা
হিন্দু সমাজের বেশ কয়েকটি সামাজিক কুপ্রথা দূর করার জন্য তিনি চেষ্টা করেন। এজন্য তিনি সতীদাহ প্রথাকে নিয়ন্ত্রিত করার আইন রচনা করেন। হিন্দু সমাজের কুপ্রথা দূর করার জন্যে তিনি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আইন রচনা করেন।
আকবর প্রবর্তিত ইলাহী সম্বত
- (১) আকবর তার সরকারি কাজের জন্য হিজরী সম্বতের স্থলে পারসিক সৌর সম্বৎ প্রচলন করেন। যদিও এই সম্বতটি ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে চালু করা হয়, তথাপি এই সম্বত ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ থেকে গণনা শুরু করা হয়।
- (২) খাকী খাঁর মতে ভারতের ঋতু, জলবায়ু ও ফসলের মরশুমের কথা বিবেচনা করেই সম্রাট আকবর চান্দ্রমাস ও চান্দ্র বৎসরের স্থলে ভারতবর্ষের প্রচলিত সৌরবর্ষের সম্বৎ গ্রহণ করেন। তিনি এই সম্বৎকে ‘ইলাহি’ সম্বৎ নাম দেন।
আকবরের ধর্মসহিষ্ণুতা নীতি
- (১) আকবরের ধর্মনীতির মধ্যেও তাঁর জাতীয় নীতির প্রভাব দেখা যায়। যদিও তিনি সুন্নী মুসলমান ছিলেন, কিন্তু তিনি গোঁড়ামি ত্যাগ করে অন্য ধর্মমতগুলির মূল নীতি জানার চেষ্টা করেন। ইবাদতখানা স্থাপন করে তিনি বিভিন্ন ধর্মের প্রবক্তাদের পক্ষে তাদের ধর্মের সারবত্ত জেনে নিতে চেষ্টা করেন।
- (২) শেষ পর্যন্ত আকবর এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, কোনো বিশেষ ধর্মই একমাত্র সত্য নয় সকল ধর্মের সারবস্তু মূলত একই প্রকার নৈতিক আচরণবিধির দিকে নির্দেশ দেয়।
- (৩) এই বিশ্বাস থেকে তাঁর সুলহ-ই-কূলনীতি বা সকল ধর্মের প্রতি সমান উদারনীতি গঠিত হয়। বহুধর্ম বিশ্বাসে কণ্টকিত ভারতীয় সমাজে আকবর তাঁর ধর্মসহিষ্ণুতা নীতির মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যকে প্রতিষ্ঠা করেন।
সম্রাট আকবরের আমলে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ
- (১) প্রশাসনিক স্তরেও আকবর তাঁর জাতীয় নীতিকে প্রতিফলিত করেন। কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি উচ্চপদগুলিতে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগের নীতি চালু করেন। ঐতিহাসিক জন রিচার্ডসের মতে, আকবরের অধীনে অমুসলিম অভিজাত কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ৪৩।
- (২) তিনি সাম্রাজ্যের সর্বত্র সমান আইন, প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও বিচার ব্যবস্থা দ্বারা জাতীয় সংহতি বৃদ্ধি করেন। তাঁর রাজস্ব সংস্কারগুলি কেবলমাত্র খলিসাজমিতে প্রয়োগ না করে জায়গীর জমিতেও তিনি তা প্রয়োগ করেন।
আকবরের ধর্মনীতি সম্পর্কে ত্রিপাঠীর অভিমত
ডঃ ত্রিপাঠির মতে, তাঁর সুলহ-ই-কুল নীতির ফলে হিন্দু সম্প্রদায় নিজেদের মুঘল সাম্রাজ্যের অঙ্গ বলে মনে করে এবং এই সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য জীবন বিসর্জন করতে ভয় পায় নি। বহু হিন্দু অভিজাত এই সাম্রাজ্যের উন্নতির জন্য জীবনপাত করেন।
সম্রাট আকবরের রাজপুত নীতি
- (১) আকবরের রাজপুত নীতি ছিল তাঁর হিন্দু নীতির বিশেষ অঙ্গ। রাজপুতরাই ছিল ‘হিন্দু সমাজের মুখপাত্র। এজন্য রাজপুতদের প্রতি আকবরের আচরণ তাঁর হিন্দু সমাজের প্রতি উদার দৃষ্টির পরিচয় দেয়। তিনি রাজপুত রাজাদের বশ্যতার বিনিময়ে তাদের স্বায়ত্ব শাসনের অধিকার দেন।
- (২) তিনি রাজপুত সেনাপতি ও প্রশাসকদের উচ্চপদে নিয়োগ করেন। এমন কি ৭ হাজারী মনসবদারের পদও তিনি মান সিংহ-এর মত রাজপুত সেনাপতির জন্য খুলে দেন। আগে উচ্চ মনসবদারের পদগুলি মুসলিম প্রশাসক বা সেনাপতিদের একচেটিয়া ছিল।
- (৩) তাঁর রাজসভায় টোডরমল, বীরমল, ভগবান দাস, মানসিংহ প্রমুখ প্রশাসক ও সেনাপতি উচ্চ মনসবদার হিসেবে স্থান পান। আকবর রাজপুত কন্যা যোধাবাঈয়ের পাণিগ্রহণ করেন এবং এই বিবাহজাত পুত্রের নাম যুবরাজ সেলিম।
- (৪) তিনি যুবরাজ সেলিমকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করেন। এইভাবে হিন্দু বিবাহজাত পুত্রকে সিংহাসনে বসাবার প্রথা তিনি আরম্ভ করেন। এই প্রথা শাহজাহান পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
ভারতীয় সাহিত্য ও শিল্পের পৃষ্ঠপোষক আকবর
- (১) আকবর ভারতীয় সংস্কৃতির গুণগ্রাহী ছিলেন। হ্যাভেলের মতে, “আকবর ছিলেন ভারতীয়ের মধ্যে ভারতীয় (Indian of Indians )। যদিও তার শিরায় কোনো ভারতীয় রক্ত ছিল না, তবুও তিনি ভারতীয় শিল্পকলা, স্থাপত্য, সঙ্গীত ও সাহিত্যের সমাদর করতেন।
- (২) তাঁর সভায় ছিলেন বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ তানসেন, সুরসিক সমালোচক বীরবল, চিত্রকর মহেশ দাশ। তিনি বদাউনির সাহায্যে রামায়ণ-এর ফার্সী অনুবাদের ব্যবস্থা করেন। তিনি ফার্সীকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দিলেও হিন্দী ও ফার্সীর মিশ্রণে গঠিত হিন্দভী বা উর্দু ভাষাকেও সমাদর করতেন।
- (৩) তিনি সংস্কৃত গ্রন্থ থেকে ফার্সীতে অনুবাদ কর্মের দ্বারা হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির মিলনে উদ্যম দেখান। তিনি যেমন আরবী ও ফার্সী সাহিত্যের সমাদর করতেন, সেই রকম সংস্কৃত সাহিত্যেরও তিনি সমাদর করতেন।
- (৪) তারই উদ্যোগে সিংহাসন বত্তিসি বা বত্রিশ সিংহাসন, অথর্ববেদ, মহাভারত, ভগবদ গীতা, রামায়ণ, হরি বংশ পুরাণ, পঞ্চতন্ত্র, কথাসরিৎসাগর, নল-দময়ন্তীর উপাখ্যানের ফার্সী অনুবাদ করান হয়। এর সঙ্গে ফার্সী সাহিত্যের বহু উৎকৃষ্ট রচনা তাঁর আগ্রহে রচিত হয়।
আকবরের আমলে চিত্রকলা
আকবর রামায়ণের বহু ঘটনাকে অবলম্বন করে চিত্রাঙ্কনে উৎসাহ দেন। রাবণের জটায়ু বধ, দশরথের পুত্রেষ্ঠি যজ্ঞ প্রভৃতি কাহিনীকে অবলম্বন করে তাঁর দরবারের চিত্রকররা ইন্দো-ইসলামীয় চিত্রকলার বিকাশ ঘটান। আকবরের আমলে ইন্দো-মুসলিম স্থাপত্যের নবযুগের সূচনা হয়।
উপসংহার :- মুঘল সম্রাট আকবর বিশেষ কোনো সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা না করে বিভিন্ন সংস্কৃতির সমন্বয়ের চেষ্টা করেন। তাই তিনি জাতীয় সম্রাটের মর্যাদা অর্জন করেন।
(FAQ) মুঘল সম্রাট আকবরের জাতীয় নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
আকবর।
আকবর।
আকবর।
আকবর।