১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের সংকট

১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের সংকট প্রসঙ্গে শিয়া-সুন্নী বিরোধ, সামরিক সংস্কার ও তার ফল, মাহজরনামা ঘোষণা, মাহজরনামা ঘোষণার ফল, কাজী ইয়াকুবের ষড়যন্ত্র, সেনাদলের ভাতা ও বেতন হ্রাস, মীর্জার যড়যন্ত্র, বাংলা ও পূর্ব ভারতে বিদ্রোহ, টোডোরমলের বাংলা জয়, শাহ মনসুরের পরাজয় ও মির্জার পলায়ন সম্পর্কে জানবো।

১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের সংকট

ঐতিহাসিক ঘটনা১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের সঙ্কট
সাম্রাজ্যমুঘল সাম্রাজ্য
সম্রাটআকবর
রাজত্বকাল১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি
শেষ অভিযানঅসিরগড় দুর্গ জয়
১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের সংকট

ভূমিকা :- ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আকবর উত্তর ভারত-এর অধিকাংশ স্থান জয় করে তার শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন সুবায় তিনি রাজস্ব সংস্কার ও তাঁর উদার ধর্মনীতি প্রবর্তন করেন।

আকবরের সময় শিয়া-সুন্নী বিরোধ

  • (১) এই সময় পূর্ব ভারতে অকস্মাৎ এক প্রবল বিদ্রোহ দেখা দিলে তার অতর্কিত আঘাতে আকবরের সিংহাসন বিপন্ন হয়। এই বিদ্রোহের বিভিন্ন কারণ ছিল। বাংলার সুবেদার মুজাফ্ফর খাঁ এবং তাঁর সহকারি রায় পির দাসের ভ্রান্ত শাসন নীতির ফলে অকস্মাৎ বিদ্রোহ ঘটে। এই দুই শাসনকর্তা ছিলেন যথাক্রমে শিয়া ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
  • (২) বাংলার সুন্নী অভিজাতরা তাদের ঘৃণার চক্ষে দেখত। সুন্নী অভিজাতরা চাইত যে, বাংলায় কোনো সুন্নী প্রশাসক নিযুক্ত হওয়া উচিত। কিন্তু সম্রাট আকবর সুন্নীদের এই গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দিয়ে বাংলায় কোনো সুন্নী প্রশাসক নিয়োগ করতে রাজী হন নি।

আকবরের সামরিক সংস্কার ও তার ফল

  • (১) আকবরের উজীর শাহ মনসুরের নির্দেশে মুজাফফর খাঁ কয়েকটি সামরিক ও অসামরিক সংস্কার চালু করেন। এই সংস্কার দ্বারা জায়গীরদারদের কাছে জায়গীরের হিসেবপত্র দাবী করা হয় এবং কতগুলি ঘোড়ার গায়ে দাগ দেওয়া হয়েছে তা জানতে চাওয়া হয়।
  • (২) উজীর শাহমনসুর ছিলেন খুব কড়া লোক। তিনি মুজাফফর খাঁকে কড়াভাবে জায়গীরদারদের কাছ থেকে হিসেব আদায় করতে নির্দেশ দেন। এই নির্দেশ কার্যকরী হলে মুঘল কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। এছাড়া সেয়ুরঘাল অধিকারীরাও তাদের অনুদান হ্রাস করা হলে অসন্তুষ্ট হয়।

সম্রাট আকবরের মাহজরনামা ঘোষণা

১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে আকবর মহজরনামা নামে এক ঘোষণাপত্র জারী করেন। এই ঘোষণাপত্র দ্বারা তিনি উলেমাদের হাত থেকে শরিয়তী আইনের চূড়ান্ত ব্যাখ্যার অধিকার কেড়ে নেন। আকবর ঘোষণা করেন যে, কোনো আইন শরিয়ত অনুযায়ী বৈধ বা অবৈধ কিনা সে সম্পর্কে উলেমারা যাই বলুন, সম্রাটের ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

আকবরের মাহজরনামা ঘোষণার প্রতিক্রিয়া

এই ঘোষণা দ্বারা রাষ্ট্রে আইন প্রণয়নের অধিকার আকবর উলেমাদের হাত থেকে নিজ হাতে নেন। এজন্য গোঁড়া উলেমারা আকবরের ওপর ক্ষিপ্ত হন। তারা তাকে বিধর্মী ঘোষণা করে সিংহাসনচ্যুত করার চক্রান্ত করেন। এই চক্রান্তে দিল্লীর ভূতপূর্ব প্রধান কাজী জড়িত ছিলেন।

আকবরের আমলে কাজী ইয়াকুবের ষড়যন্ত্র

  • (১) কাজী ইয়াকুব আগে আগ্রায় প্রধান কাজীর পদে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর পদমর্যাদা হ্রাস করে আকবর তাকে কেবলমাত্র বাংলায় প্রধান কাজী হিসেবে নিযোগ করেন। এজন্য কাজী ইয়াকুব ভীষণ অসন্তুষ্ট হন। তাছাড়া তিনি মাহজরনামার বিরোধী ছিলেন।
  • (২) তিনি বাংলায় সুন্নীদের মধ্যে প্রচার করেন যে, সম্রাট আকবর ইসলামের স্বার্থবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়েছেন, আকবর হিন্দুদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাচ্ছেন এবং শরীয়তী শাসন অগ্রাহ্য করেছেন। কাজী ইয়াকুব গোড়া সুন্নীদের ডাক দেন। যাতে আকবরকে পদচ্যুত করা যায়।
  • (৩) আকবরের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা মীর্জা মহম্মদ হাকিম সর্বদাই আকবরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তার প্রতিনিধিরা বাংলায় এই সুযোগে আকবরের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে থাকে।

আকবরের সময় সেনাদলের ভাতা হ্রাস

বাংলায় ও বিহারে মুঘল সেনার ভাতা যথাক্রমে ৫০% ও ২০% কমিয়ে দেওয়া হয়। ভাতা নিয়ন্ত্রণ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়। আইন ভঙ্গ করায় জলেশ্বরের জায়গীরদারকে কারাদণ্ড ও দৈহিক শাস্তি দেওয়া হয়। এজন্য অন্যান্য জাগীরদাররা অসন্তুষ্ট হয়।

আকবরের বিরুদ্ধে মীর্জার যড়যন্ত্র

এই সময় মীর্জা মহম্মদ হাকিমের প্রতিনিধি রোশন বেগের প্ররোচনায় বাংলার সেনাদল বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং অন্যান্য অসন্তুষ্ট শক্তিগুলি তাদের পক্ষে যোগ দেয়।

আকবরের সময় বাংলায় ও পূর্ব ভারতে বিদ্রোহ

  • (১) এই বিদ্রোহ বাংলা থেকে বিহারে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। মীর্জা মহম্মদ হাকিমের প্রতিনিধি-মৌসম খান বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। জৌনপুরের শিয়া কাজী মোল্লা-মহম্মদ ইয়াজদি এই বিদ্রোহে ধর্মীয় সম্মতি জানান।
  • (২) তিনি একটি ফতোয়া জারি করে ঘোষণা করেন যে—“প্রতি খাঁটি মুসলমানের উচিত সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে যোগ দিয়ে তাকে পদচ্যুত করা। কারণ সম্রাট মসজিদ, মোল্লা ও ঈশ্বরকে অনুদান করা জমি পুর্নদখল করেছেন।”

আকবরের আমলে বাংলা ও বিহারে বিদ্রোহীদের সাফল্য

  • (১) বিদ্রোহীরা পাটনা আক্রমণ করে এবং শাসনকর্তা রায় পুরুষোত্তমকে নিহত করে। বিহারের বিদ্রোহীরা বাংলার বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তেলিয়াগর্হি থেকে মুঘল শাসনকর্তা খাজা সামসুদ্দিনকে বিতাড়িত করে।
  • (২) এর পর সম্মিলিত বাহিনী তাণ্ডা বা গৌড়-এ সুবাদার মুজাফ্ফর খাঁর দুর্গ অবরোধ করে এবং মুজাফ্ফর খাঁকে নিহত করে। বাংলা ও বিহার আপাতত মুঘল শাসন মুক্ত হয়। বিদ্রোহীরা আকবরের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা মীর্জা মহম্মদ হাকিমের নামে খুৎবা পাঠ করে। বিভিন্ন পদ বিদ্রোহী সর্দাররা ভাগ করে নেয়।

সম্রাট আকবরের আমলে পাটনা ও মুঙ্গেরের যুদ্ধ

  • (১) আকবর বাংলার বিদ্রোহ দমনের জন্য টোডরমল ও সেখ ফরিদ বক্সীকে নিয়োগ করেন। মুঘল বাহিনী শীঘ্রই পাটনা অধিকার করে। কিন্তু বিদ্রোহীরা মুঙ্গেরে টোডরমলকে অবরোধ করে। টোডরমলের সেনাদলে বিশ্বাসঘাতকতা দেখা দেয়। তাঁর শিবিরে সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়।
  • (২) আকবর মীর্জা আজিজ কোকা ও শাহবাজ খাঁকে টোডরমলের সাহায্যে পাঠান। এদিকে শাহবাজ খাঁ মেবার হতে বাংলায় চলে যাওয়ায় মেবারে মুঘল শক্তি দুর্বল হয়। মহারানা প্রতাপ সিংহ মেবারে মুঘল দুর্গ ও থানাগুলি দখল করতে থাকেন।
  • (৩) আকবর রাজধানী আগ্রায় বসে সাম্রাজ্যের সর্বত্র নজর রাখেন এবং মীর্জা মহম্মদ হাকিমের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেন। ইতিমধ্যে টোডরমলের পরামর্শক্রমে তিনি শাহ মনসুরকে উজীবের পদ থেকে অপসারিত করেন। শাহ মনসুরের কর নীতির জন্যই এই বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধরে। এর ফলে বিদ্রোহীদের ক্রোধ প্রশমিত হয়।

আকবরের সময় শাহবাজ খাঁর বিহার জয়

  • (১) ইতিমধ্যে বিদ্রোহী নেতাদের অন্যতম বাবা খাঁ কাকশালের মৃত্যু হয়। বিদ্রোহীদের অত্যাচারে স্থানীয় হিন্দু জনসাধারণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এই সুযোগে টোডরমল পাল্টা আক্রমণ চালান। আজিজ কোকা তাঁর সঙ্গে যোগ দিলে টোডরমলের শক্তি বাড়ে।
  • (২) শাহবাজ খাঁকে বিহারের বিদ্রোহ দমনের ভার দিয়ে টোডরমল ও আজিজ কোকা বাংলায় চলে আসেন। ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে সুলতানপুরের যুদ্ধে শাহবাজ খাঁ বিহারের বিদ্রোহীদের পরাস্ত করেন।

টোডরমলের বাংলা জয়

  • (১) বাংলায় বিদ্রোহীদের নেতা ছিলেন মাসুম কাবুলী ও উড়িষ্যার কতলু খাঁ। মুঘল বাহিনী তাদের কোনঠাসা করলে, মাসুম কাবুলী পূর্ব বাংলার জমিদার ঈশা খাঁর সঙ্গে যোগ দেন। কিন্তু মুঘল সেনা তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
  • (২) কাবুলের অধিপতি মীর্জা মহম্মদ হাকিম বাদাখশানের বিদ্রোহের জন্য আকবরের বিরুদ্ধে ভারত আক্রমণে বিলম্ব করেন। বাংলার বিদ্রোহ যখন তুঙ্গে ছিল তখন তিনি বাদাখশানে ব্যস্ত থাকায় ভারতে আসতে পারেন নি।
  • (৩) ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে তিনি সেনাদলসহ সিন্ধু নদ পার হন। কিন্তু তখন বাংলার বিদ্রোহের পতনশীল অবস্থা দেখা দেয়। আকবর মীর্জা হাকিমকে প্রতিরোধের জন্য তাঁর বিশ্বস্ত রাজপুত সেনাপতি মানসিংহকে নিয়োগ করেন।
  • (৪) নীলাবের যুদ্ধে মানসিংহ মীর্জা হাকিমের অগ্রবর্তী বাহিনীকে বিধ্বস্ত করেন। মীর্জা এর পর মূল বাহিনীসহ লাহোর আক্রমণ করেন। কিন্তু রাজা ভগবান দাস, মানসিংহ ও রাজপুত বাহিনী বীর বিক্রমে লাহোর রক্ষা করেন।

শাহ মনসুরের প্রাণদণ্ড

আকবর ৫০ হাজার সৈন্যের এক বিরাট বাহিনীসহ সীমান্তের দিকে যাত্রা করেন। আকবরের অর্থমন্ত্রী শাহ মনসুর শত্রুর সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। আকবরের শ্রেষ্ঠ অর্থমন্ত্রীর জীবন এইভাবে অপমান ও গ্লানির মধ্যে শেষ হয়।

মীর্জার পলায়ন

আকবর শিরহিন্দে এসে জানতে পারেন যে, রাজপুত বাহিনীর প্রবল বাধা এবং সাধারণ ভারতীয়দের আকবরের প্রতি আনুগত্য দেখে মীর্জা মহম্মদ হাকিম নিরুৎসাহ হয়ে লাহোর থেকে পিছু হঠে গেছেন। আকবর সীমান্ত সুরক্ষা করার ব্যবস্থা সমাপ্ত করে রাজধানীতে ফিরে আসেন।

উপসংহার :- এইভাবে ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ দমিত হয়। আকবরের সাম্রাজ্য ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। রাজপুত বাহিনীর আনুগত্য এবং আকবরের বিশ্বস্ত মুসলিম সেনাপতিদের ঐকান্তিক চেষ্টায় তিনি রক্ষা পান।

(FAQ) ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের সংকট সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা হয় কখন?

১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে।

২. ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কে?

বাবর

৩. ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সম্রাট কে ছিলেন?

আকবর।

৪. দীন-ই-ইলাহী কে প্রবর্তন করেন?

আকবর।

Leave a Comment