আকবরের ধর্ম নীতি

মোগল সম্রাট আকবরের ধর্ম নীতি প্রবর্তনে বিভিন্ন প্রভাব, ধর্মচিন্তার বিবর্তন, ধর্মচিন্তার বিবর্তনের প্রথম পর্যায়, দ্বিতীয় পর্যায়ে ইবাদতখানা প্রতিষ্ঠা, মাহজারনামা ঘোষণা, তৃতীয় পর্যায়ে দীন-ই-ইলাহী প্রবর্তন, গঠন, প্রবক্তা, দীন-ই-ইলাহী ধর্মচিন্তার পরিসমাপ্তি ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানবো।

আকবরের ধর্মনীতি প্রসঙ্গে হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য, সাম্রাজ্যের সংহতি সাধনে আকবরের ধর্মনীতি, আকবরের নতুন ধর্মমত দীন ই ইলাহি, মাহজরনামা ঘোষণা, ইবাদত খানা প্রতিষ্ঠা, ভক্তিবাদ ও সুফিবাদের ধারণা গ্ৰহণ, আকবরের ধর্মনীতির গুরুত্ব সম্পর্কে জানব।

আকবরের ধর্ম নীতি (Religious Policy of Akbar)

ঐতিহাসিক ঘটনাআকবরের ধর্ম নীতি
প্রথম পর্যায়েনিষ্ঠাবান সুন্নি মুসলিম
দ্বিতীয় পর্যায়েইবাদতখানা প্রতিষ্ঠা ও মাহজারনামা ঘোষণা
তৃতীয় পর্যায়েদীন-ই-ইলাহী প্রবর্তন
দীন-ই-ইলাহী প্রবর্তন১৫৮২ খ্রিস্টাব্দ
আকবরের ধর্ম নীতি

ভূমিকা :- ভারতবর্ষ-এ সমস্ত মুসলিম শাসকদের মধ্যে আকবরই ছিলেন ধর্মবিষয়ে সর্বাপেক্ষা উদার এবং পরধর্মমত-সহিষ্ণুতার প্রবর্তক। ভারতবর্ষে তিনিই ছিলেন প্রথম মুসলিম শাসক যিনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম সমন্বয় চেয়েছিলেন।

ধর্ম নীতির ক্ষেত্রে আকবরের লক্ষ্য

আকবরের লক্ষ্য ছিল ধর্মকে রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করা এবং রাষ্ট্রকে উলেমাদের প্রভাব থেকে মুক্ত করে ভারতে একটি জাতীয় রাষ্ট্র গড়ে তোলা।

আকবরের ধর্ম নীতি সম্পর্কে ঈশ্বরী প্রসাদের অভিমত

ঐতিহাসিক ডঃ ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন যে, “হিন্দুস্থানে যে-সকল মুসলিম শাসক রাজদণ্ড পরিচালনা করেন, তাঁদের মধ্যে আকবর ছিলেন ধর্মসহিষ্ণু নীতির সর্বাপেক্ষা উদার প্রবর্তক।”

আকবরের ধর্ম নীতির উপর বিভিন্ন প্রভাব

সম্রাট আকবরের এই উদার ধর্মনীতির মূলে নানা প্রভাব কার্যকর ছিল। এগুলি হল –

  • (১) সমগ্র বিশ্ব জুড়ে ষোড়শ শতক ছিল ধর্মীয় ক্ষেত্রে নানা সংশয়, সন্দেহ ও অনুসন্ধিৎসার যুগ এবং আকবর ছিলেন এই যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি।
  • (২) সুলতানি যুগে ভক্তিবাদী প্রচারক কবীর, নানক, দাদু, মীরাবাঈ, চৈতন্যদেব এবং বিভিন্ন সুফি ধর্মগুরুদের প্রচারের ফলে ভারতে উদারতা, সহিষ্ণুতা ও সমন্বয়ের এক নতুন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তীক্ষ্ণধী ও প্রতিভাবান রাষ্ট্রনায়ক আকবরের পক্ষে এই প্রভাব অস্বীকার করা সম্ভব ছিল না।
  • (৩) আকবরের পিতা হুমায়ুন ও পিতামহ বাবর ছিলেন ‘সুন্নি’ এবং তাঁদের কোনও ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না। তাঁর মাতা হামিদাবানু বেগম ছিলেন পারস্যের উদারমনা ‘শিয়া’ মৌলবি মির বাবাদোস্ত-এর কন্যা।
  • (৪) আকবরের জন্ম হয়েছিল অমরকোটের এক হিন্দু নরপতির গৃহে এবং শৈশবে কয়েকমাস এই হিন্দুগৃহেই মহারানির স্নেহচ্ছায়ায় তিনি লালিত হন।
  • (৫) তাঁর শৈশব অতিক্রান্ত হয় পারস্য ও কাবুলে। এই সময় তিনি মোগল, তুর্কি, আফগান, পারসিক প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী ও বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সঙ্গে পরিচিত হন, যা তাঁর মানসিক প্রসারতা বৃদ্ধি করে।
  • (৬) তাঁর বাল্যকাল অতিবাহিত হয় পিতৃবন্ধু ও অভিভাবক ‘শিয়া’ সম্প্রদায়ভুক্ত এবং ধর্মক্ষেত্রে উদারমনা বৈরাম খাঁ-র তত্ত্বাবধানে।
  • (৭) ছেলেবেলা থেকেই তিনি বিভিন্ন যোগী, সাধু-সন্ত, সুফি সাধক ও ফকিরদের সঙ্গে পরিচিত হন। এর ফলে বাল্যকালেই তাঁর মনে উদার ধর্মীয় চিন্তার উন্মেষ হয়।
  • (৮) আকবরের গৃহশিক্ষক মির আবদুল লতিফ বাল্য কালেই তাঁর হৃদয়ে উদারতার বীজ বপন করেন এবং তাঁকে ‘সুল-ই-কুল’ বা ‘সার্বজনীন শান্তি ও সহিষ্ণুতা’-র আদর্শে দীক্ষিত করেন।
  • (৯) শেখ মুবারক-এর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য এবং তাঁর দুই পুত্র আবুল ফজল ও ফৈজি-র নিবিড় বন্ধুত্ব আকবরের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। তাঁদের যুক্তিপূর্ণ আলোচনা তাঁকে গোঁড়ামি-মুক্ত সহিষ্ণুতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে।
  • (১০) এই ব্যাপারে তাঁরৎরাজপুত মহিষীদের প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। তাদের প্রভাবেই তিনি হিন্দু আচার অনুষ্ঠান ও যাগ-যজ্ঞ সম্পর্কে শ্রদ্ধাবান হয়ে ওঠেন।
  • (১১) আকবর ছিলেন যথার্থ ধর্মপ্রাণ মানুষ। রাজ্যজয় ও রাজকার্যে ব্যস্ত থাকলেও বাল্যকাল থেকেই তিনি ধর্মচিন্তা করতেন।
  • (১২) শিয়া, সুন্নি, সুফি, আল-মাহাদী প্রভৃতি ইসলামিয় সম্প্রদায়ের অন্তর্কলহ এবং হিন্দু ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে ইসলামের তীব্র বিরোধ তাঁকে প্রবল চিন্তান্বিত করে। এই সব বিরোধ এবং বিভিন্ন ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ ও সত্যকে জানার আগ্রহ তাঁকে অস্থির করে তুলত। এই অস্থিরতা থেকেই তিনি ছুটতেন বিভিন্ন সাধু-সঙ্গের দরগায়।
  • (১৩) জাহাঙ্গীর বলছেন যে, তাঁর পিতা কখনও এক মুহূর্তের জন্যও ঈশ্বরকে বিস্মৃত হন নি। আকবরের কঠোর সমালোচক গোঁড়া সুন্নি ঐতিহাসিক বদাউনি লিখছেন যে, বহু প্রত্যূষে তিনি প্রাসাদের কাছে এক নির্জন স্থানে মাথা নত করে প্রার্থনারত ও বিষদাচ্ছন্ন থাকতেন এবং প্রত্যুষের প্রশান্ত আশীর্বাদ গ্রহণ করতেন।
  • (১৪) সাম্প্রতিককালে স্মিথ, উলসলি, হেইগ, বেভারিজ, পার্সিভ্যাল স্পিয়ার, কেম্ব্রিজ ঐতিহাসিক জন রিচার্ডস, ইকতিদার আলম, মহম্মদ হুসেন আজাদ প্রমুখ আকবরের সমন্বয়ী ধর্মচিন্তার পশ্চাতে আত্মজিজ্ঞাসা ছাড়াও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য লক্ষ্য করেছেন।
  • (১৫) ঐতিহাসিকদের মধ্যে আকবর স্পষ্টই উপলব্ধি করেছিলেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সমর্থন ব্যতীত ভারতে কোনও স্থায়ী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এছাড়া, আফগান ও অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে হিন্দু-সমর্থনও তাঁর প্রয়োজন ছিল।

আকবরের ধর্মচিন্তার বিবর্তন

আকবরের ধর্মচিন্তার বিবর্তনে তিনটি পর্যায় লক্ষ্য করা যায়, যার চরম পরিণতি হল ‘দীন-ই-ইলাহী’ নামক এক নতুন ধর্মের প্রবর্তন। এই পর্যায় গুলি হল –

(ক) প্রথম পর্যায়

মোগল সম্রাট আকবরের ধর্মচিন্তার প্রথম পর্যায়ে দুটি দিক বিশেষ উল্লেখযোগ্য। যেমন –

(১) নিষ্ঠাবান সুন্নি মুসলিম

ধর্মচিন্তার প্রথম পর্বে, ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি একজন নিষ্ঠাবান সুন্নি মুসলিম ছিলেন। বদাউনি-র মতে এই সময় তিনি নিষ্ঠাবান মুসলিমের মতো সব ইসলামি আচার-আচরণ মেনে চলতেন এবং দিনে চারবার নমাজ পড়তেন।

(২)তীর্থকর ও জিজিয়া কর বিলোপ

তা সত্ত্বেও উপরিউক্ত বিভিন্ন প্রভাবের ফলে তাঁর মতাদর্শে কিছু উদারনৈতিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এরই ফলে তিনি হিন্দুদের ওপর থেকে তীর্থকর (১৫৬৩ খ্রিঃ) ও ‘জিজিয়া কর’ (১৫৬৪ খ্রিঃ) তুলে দেন।

(খ) দ্বিতীয় পর্যায়

আকবরের ধর্মীয় জীবনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে। শেখ মুবারক এবং তাঁর দুই পুত্র ফৈজি ও আবুল ফজলের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য তাঁকে একজন যথার্থ যুক্তিবাদীতে পরিণত করে।

(১) ইবাদতখানাপ্রতিষ্ঠা

ধর্ম ও দর্শনের মূল বিষয়গুলি আলোচনা এবং ধর্মের প্রকৃত সত্য ও উৎস নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী ফতেপুর সিক্রিতে তিনি ইবাদতখানা’ নামে একটি ধর্মীয় উপাসনা-গৃহ নির্মাণ করেন।

(২) ইবাদতখানার আলোচনা সভা

সূচনা পর্বে তিনি সেখানে কেবলমাত্র মুসলিম ধর্মজ্ঞানীদেরই আমন্ত্রণ জানান। প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এই আলোচনা সভা বসত।

(৩) ইবাদতখানা বন্ধ

মুসলিম ধর্মজ্ঞানীদের এই আলোচনা অবিলম্বে ‘কদর্য বিদ্বেষ, অস্বাস্থ্যকর গোঁড়ামি এবং ব্যক্তিগত আক্রমণে’ পরিণত হয়। ক্ষুব্ধ আকবর সাময়িকভাবে ইবাদতখানা’ বন্ধ করে দেন।

(৪) পুনরায় ইবাদতখানা চালু করা

কিছুদিন পর ১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে আবার তিনি ইবাদতখানা’-র দরজা খুলে দেন এবং ধর্মালোচনার জন্য সেখানে শিয়া, সুন্নি, হিন্দু, জৈন, শিখ, খ্রিস্টান, পারসি, জরথুস্ট্রিয় প্রভৃতি বিভিন্ন ধর্মজ্ঞানীদের আহ্বান জানান।

(৫) ধর্ম সংসদ

বিভিন্ন ধর্ম জ্ঞানীদের আগমনে ইবাদতখানা’ একটি উপাসনা-গৃহ থেকে যথার্থ ‘ধর্মসংসদে’রূপান্তরিত হয়।

(৬) ইবাদতখানায় আগত পণ্ডিত

এখানে সমবেত পণ্ডিতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন হিন্দুধর্মের পুরুষোত্তম ও দেবী, জৈন ধর্ম-এর হীরাবিজয় সুরী, বিজয়সেন সুরী ও ভানুচন্দ্র উপাধ্যায়, জরথুস্ট্রিয় পণ্ডিত মাহারজি রানা এবং জেসুইট ধর্মযাজক একোয়াভাইভা, মনসারেট প্রমুখ।

(৭) ইবাদতখানার গুরুত্ব
  • (i) ইবাদতখানা’-র বিভিন্ন আলোচনা আকবরের মনের প্রসারতা ঘটায়।
  • (ii) গোঁড়া মৌলবাদীদের উগ্রতা ও উন্নাসিকতাপূর্ণ আচরণে তিনি প্রবল ক্ষুব্ধ হন এবং গোঁড়া ইসলাম ধর্মের প্রতি তাঁর আনুগত্য শিথিল হয়ে যায়।
  • (ii) এই সময় তাঁর ব্যক্তিগত আচার-আচরণেও বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা দেয়। তিনি পশুহত্যা ও শিকার নিষিদ্ধ করে নিজে নিরামিষ আহার শুরু করেন। তিনি তিলক কেটে মাথায় পাগড়ি বেঁধে দরবারে আসতে আরম্ভ করেন এবং জরথুস্ট্রিয় প্রভাবে সূর্য ও অগ্নির উপাসনা শুরু করেন।
  • (iv) তিনি উপলব্ধি করেন যে, ঈশ্বর এক এবং সকল ধর্মের মূল কথা এক ও অভিন্ন।
(৮) খুৎবা পাঠ

১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জুন ফতেপুর সিক্রির মসজিদের প্রধান ইমাম-কে অপসারিত করে সম্রাট স্বয়ং উপাসনা পরিচালনা করেন এবং ফৈজি-রচিত ‘খুতবা’ নিজনামে পাঠ করেন। ‘খুতবা’-র বক্তব্য গোঁড়া উলেমাদের প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করে।

(৯) মাহজারনামা

উলেমাদের ক্ষোভ বিস্ফোরিত হবার আগেই ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দের ২ রা সেপ্টেম্বর তিনি শেখ মোবারক রচিত এক ‘মাহজারনামা’ বা ‘ঘোষণাপত্র’ জারি করে বলেন যে, তিনিই হলেন ইমাম-ই-আদিল’ বা ইসলামিয় আইনের চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকার এবং সাম্রাজ্যের সর্বপ্রকার জাগতিক ও ধর্মীয় বিষয়ের প্রধান।

(১০) সম্রাটের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত

তিনি বলেন যে, ইসলাম ধর্ম বা কোরানের কোনও ব্যাখ্যা নিয়ে উলেমাদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিলে সম্রাটের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।

(১১) অভ্রান্ত নির্দেশ নামা

ঐতিহাসিক স্মিথ বলেন যে, এই ঘোষণার দ্বারা আকবর একই সঙ্গে পোপ ও সিজারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিনি এই ঘোষণাপত্রটিকে ‘অভ্রান্ত নির্দেশনামা’ বলে অভিহিত করেন।

(১২)সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী

ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীদের কাছে পোপের নির্দেশ যেমন অভ্রান্ত ও অবশ্যপালনীয় ছিল, তেমনি এই ঘোষণার দ্বারা ধর্মীয় ব্যাপারে আকবর সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হন।

(১৩) মাহজারনামার গুরুত্ব
  • (i) ডঃ মাখনলাল রায়চৌধুরী এই ঘোষণাপত্রটিকে ইংল্যান্ড-এর রানি এলিজাবেথের রাজত্বকালের ‘অ্যাক্ট অব সুপ্রিমেসি’-র সঙ্গে তুলনা করেছেন।
  • (ii) ঐতিহাসিক স্মিথ-এর মতে, এই ঘোষণার দু-এক বছরের মধ্যেই আকবর ইসলাম-বিরোধী হয়ে ওঠেন। বলা বাহুল্য, স্মিথের এই বক্তব্য সঠিক নয়—বরং বলা যায় যে, উলেমাদের প্রভাব খর্ব করে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সমন্বয় সাধন করাই ছিল আকবরের উদ্দেশ্য।
  • (iii) ডঃ আর. পি. ত্রিপাঠী বলেন যে, এই সময় শিয়া, সুন্নি ও মাহাদিদের ধর্মীয় সংঘাত, কাশ্মীর ও আহম্মদনগরে সাম্প্রদায়িক হানাহানি এবং গোঁড়া মুসলিম ও অমুসলিমদের বিবাদে সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছিল।
  • (iv) আকবর এই ‘ঘোষণাপত্র’ দ্বারা ধর্মীয় সংঘাত দূর করে ভারতের রাষ্ট্রীয় ঐক্য সুনিশ্চিত করেন।
  • (v) এই সময় ইরানের শাহ ও তুরস্ক-এর সুলতান নিজেদের যথাক্রমে শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়ের ‘খলিফা’ বলে দাবি করে ভারতের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপনে প্রয়াসী ছিলেন। সম্রাট আকবর তাঁর ‘মাহজারনামা’ দ্বারা তাঁদের সেই দাবি নস্যাৎ করে দেন।

(গ) তৃতীয় পর্যায়

আকবরের ধর্মচিন্তার বিবর্তনে তৃতীয় বা শেষ পর্যায় ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

(১) দীন-ই-ইলাহী প্রবর্তন

সম্রাট আকবর ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে) দীন-ই-ইলাহী’ নামে এক একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রবর্তন করেন।

(২) দীন-ই-ইলাহী ধর্মমতের গঠন

উপনিষদের একেশ্বরবাদ, হিন্দু দর্শনের জন্মান্তরবাদ, বৌদ্ধ ধর্ম অবলম্বী (গৌতম বুদ্ধ) ও জৈনদের (মহাবীর) অহিংসা নীতি, পারসিকদের সূর্য ও অগ্নি উপাসনা, ইসলাম ধর্মের নমাজ, রমজান, হজযাত্রা প্রভৃতি নয়টি বিধি এবং খ্রিস্টধর্মের সৌভ্রাতৃত্ব প্রভৃতি আদর্শ নিয়ে এই ধর্মমত গঠিত হয়।

(৩) দীন-ই-ইলাহী ধর্মমতের প্রবক্তা

এই ধর্মমতে কোনও সাম্প্রদায়িকতা, অন্ধ বিশ্বাস, দেবতা, দেব-মন্দির, পুরোহিত বা ধর্মগ্রন্থের স্থান ছিল না—স্বয়ং সম্রাটই ছিলেন এর প্রবক্তা এবং যে কোনও মানুষ এই ধর্মমত গ্রহণ করতে পারত।

(৪) দীন-ই-ইলাহী ধর্মমতের পরিসমাপ্তি

দীন-ই-ইলাহী’ বেশি দিন স্থায়ী হয় নি এবং আকবরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এরও পরিসমাপ্তি ঘটে।

(৫) দীন-ই-ইলাহী ধর্মমতের গুরুত্ব

জাতীয় জীবনে এর গুরুত্বকে অস্বীকার করা যাবে না। যেমন –

  • (i) কেবলমাত্র রাজনৈতিক ঐক্যই নয়—এই ধর্মের মাধ্যমে তিনি ভারতের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐক্যকে সুদৃঢ় করতে সচেষ্ট হন। ঐতিহাসিক ডঃ মাখনলাল রায়চৌধুরী-র মতে, আকবর-প্রচারিত ‘মাহজার’-টি ছিল সম্রাটের রাজনৈতিক বিচক্ষণতার চমকপ্রদ নিদর্শন।
  • (ii) আকবরের লক্ষ্য ছিল সুল-ই ‘কুল’ বা সকল ধর্মের সার নিয়ে একটি জাতীয় ধর্ম গড়ে তোলা। দীন-ই-ইলাহী হল এই ধরনের একটি জাতীয় ধর্ম এবং এই মতবাদ প্রচার করে আকবর ভারতবর্ষের জাতীয় নেতায় পরিণত হন।
  • (iii) ডঃ ত্রিপাঠী বলেন যে, ‘দীন-ই-ইলাহী’ এমন একটি আদর্শ স্থাপন করল যাতে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পার্থক্য সত্ত্বেও জনগণ একটি সাধারণ বেদিতে মিলতে পারে। এটি সম্রাটের সিংহাসনে একটি আধ্যাত্মিক জ্যোতির্বলয় রচনা করে নিঃসন্দেহে আকবরের হাতকে শক্তিশালী করে।
  • (iv) এই মতাদর্শের ফলে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে বিবাদ যথেষ্ট পরিমাণে স্তিমিত হয়। রাষ্ট্রকার্যে উলেমা ও মোল্লাদের প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণে খর্ব হয় এবং ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে সম্রাটের সর্বময় কর্তৃত্ব স্বীকৃতি লাভ করে।

উপসংহার :- আকবরের ধর্মনীতি মােগল-সাম্রাজ্যের শক্তি সুসংহত করার পক্ষে সহায়ক হয়েছিল। তার নিরপেক্ষ উদার ধর্মনীতি ভারতের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী জনগণের মধ্যে ঐক্যবােধ সঞ্চারিত করে।

(FAQ) আকবরের ধর্ম নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সম্রাট আকবর কবে কোথায় ইবাদতখানা প্রতিষ্ঠা করেন?

১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে ফতেপুর সিক্রিতে।

২. সম্রাট আকবর কবে মাহজারনামা ঘোষণা করেন?

১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে।

৩. কে কবে দীন-ই-ইলাহী প্রবর্তন করেন?

মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে)।

৪. সম্রাট আকবরের রাজধানী কোথায় ছিল?

ফতেপুর সিক্রিতে।

Leave a Comment