আকবরের প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা

মুঘল সম্রাট আকবরের প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা প্রসঙ্গে সামন্ত রাজ্য, সুবাদার, দেওয়ান, দেওয়ানের অধীনে কর্মচারী, মীর বকসী, সদর, ফৌজদার, আমাল গুজার, পরগনা ও আমিল সম্পর্কে জানবো।

মুঘল সম্রাট আকবরের প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা

ঐতিহাসিক ঘটনাআকবরের প্রাদেশিক শাসন
সম্রাটআকবর
সুবা১৫ টি
সরকারফৌজদার
পরগণাশিকদার
মুঘল সম্রাট আকবরের প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা

ভূমিকা :- প্রাদেশিক শাসনের জন্য আকবর তার সাম্রাজ্যকে প্রথমে ১২ টি সুবায় বিভক্ত করেন। পরে আহমদনগর, খান্দেশ ও বেরার এই তিনটি সুবা যুক্ত হলে সর্বোচ্চ ১৫টি সুবায় তাঁর সাম্রাজ্যকে ভাগ করা হয়।

আকবরের আমলে সামন্ত রাজ্য

মোঘল সম্রাট আকবরের অধীনে স্বায়ত্ব-শাসিত বহু সামন্ত রাজ্য ছিল। রাজ্যগুলির আভ্যন্তরীণ প্রশাসনে আকবর হাত দিতেন না।

আকবরের প্রাদেশিক শাসনে সুবাদার

  • (১) প্রতি সুবায় একটি করে রাজধানী স্থাপন করা হয়। প্রতি সুবার শাসনের দায়িত্ব থাকত সিপাহসালার নামে কর্মচারীর হাতে। সিপাহসালারকে সুবাদারও বলা হত। সুবাদার ছিলেন সম্রাটের প্রতিনিধি এবং প্রদেশের আইন-শৃঙ্খলা, শান্তি ও নিরাপত্তা তাঁকে রাখতে হত। তার অধীনে প্রাদেশিক সেনা ও প্রশাসন। ছিল।
  • (২) তিনি ফৌজদারী মামলার বিচার করতেন। সম্রাটের আইনগুলি তাঁকে চালু রাখতে হত। কৃষির উন্নতির দিকে নজর রাখতে হত। তিনি সেনাদলে শৃঙ্খলা রাখতেন এবং বিদ্রোহী জমিদারদের দমন করতেন।
  • (৩) সম্ভবত সুবাদারের রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা ছিল না। আবুল ফজল-এর আইন-ই-আকবরী থেকে জানা যায় যে, সকল প্রদেশের সুবাদারদের সমান ক্ষমতা ছিল না। গুজরাটের সুবাদার হিসেবে টোডরমল সন্ধি স্বাক্ষর করতে পারতেন। এই ক্ষমতা অন্য সুবাদারদের ছিল না।
  • (৪) বিদ্রোহী জমিদারদের শায়েস্তা করা সুবাদারের অন্যতম কর্তব্য ছিল। তাছাড়া প্রদেশের শাসন, বিচার প্রভৃতি কাজ যাতে সুশৃঙ্খলভাবে চলে সেদিকে সুবাদারকে নজর রাখতে হত। সুবাদারদের ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণও রাখা হয়। তাঁরা প্রদেশে সম্রাটের মত দরবার, খিলাৎ প্রদান করতে পারতেন না।

সম্রাট আকবরের প্রাদেশিক শাসনে নিজুক্ত দেওয়ান

  • (১) প্রতি সুবায় একজন দেওয়ান থাকতেন। তাঁর কাজ ছিল রাজস্ব বিভাগের সকল দায়িত্ব বহন করা। দেওয়ান সম্রাট দ্বারা নিযুক্ত হতেন এবং তিনি সুবাদারের অধীনে ছিলেন না। সুবাদার পদমর্যাদায় দেওয়ানের ওপরে হলেও দেওয়ান তার অধীন ছিলেন না।
  • (২) আকবর রাজস্ব বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃথক করার উদ্দেশ্যেই দেওয়ানের হাতে রাজস্ব বিভাগের ক্ষমতা আলাদা করে দেন। দেওয়ানের কোনো সামরিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা ছিল না। তিনি রাজস্ব আদায় করে কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিতেন।
  • (৩) রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীদের তিনি নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ করতেন। তিনি দেওয়ানী মামলার বিচার করতেন। আকবর প্রদেশের দায়িত্ব দেওয়ান ও সুবাদারের মধ্যে ভাগ করে দেন। দেওয়ান ও সুবাদার ছিলেন পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। এজন্য তারা দুজনেই কেন্দ্রের মুখাপেক্ষী থাকতেন।
  • (৪) তারা প্রত্যেকে অপরের আচরণ সম্পর্কে কেন্দ্রে রিপোর্ট পাঠাতেন। যদিও এই দুই কর্মচারী প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তার জন্য প্রদেশের শাসনের কোনো ব্যাঘাত হত না। প্রত্যেকে নিজ নিজ এক্তিয়ার মেনে কাজ করতেন।

আকবরের প্রাদেশিক শাসনে নিযুক্ত দেওয়ানের অধীনে কর্মচারী

  • (১) দেওয়ানের কাজে সাহায্যের জন্য তাঁর অধীনে বিভিন্ন কর্মচারী নিযুক্ত হত। দেওয়ানের ব্যক্তিগত সহকারি ছিলেন পেস্কার। দারোগা বাজারগুলির তদন্ত করতেন এবং দপ্তরখানার কাজ দেখতেন। তার মাসিক বেতন ছিল ৪০ টঙ্কা।
  • (২) তহবিলদার ছিলেন কোষাধ্যক্ষ। তাঁরও বেতন ছিল ৪০ টঙ্কা। হুজুর নভিস কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে চিঠিপত্র লেখালেখি করতেন। মুহুরি-ই খালসা সরকারি খলিসা জমির কাজ দেখতেন। আর ছিল বহু কেরানী।

আকবরের প্রাদেশিক শাসনে নিযুক্ত মীর বকসী

  • (১) প্রদেশেও কেন্দ্রের মতই মীর বকসীর পদ ছিল। প্রদেশের সেনা সংগঠন, অশ্বারোহী বাহিনীর তদারকি, মনসবদারদের কাজ সম্পর্কে রিপোর্ট প্রভৃতি দায়িত্ব তিনি বহন করতেন। তাঁর রিপোর্ট পেলে তবেই দেওয়ান মনসবদারদের বেতন দিতেন।
  • (২) যুদ্ধের সময় মীর বকসী প্রাদেশিক কর্মচারীদের অধীনস্থ সেনা সহ যুদ্ধে যোগদানের আদেশ দিতেন এবং তা যাতে পালিত হয় তা দেখতেন। মীর বকসী যাতে প্রাদেশিক সুবাদারের সঙ্গে যোগ দিয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ না হয় এজন্য আলাদা পরিদর্শক-বা কুফিয়া নভিস তার কাজকর্ম সম্পর্কে রিপোর্ট পাঠাতেন।

সম্রাট আকবরের প্রাদেশিক শাসনে নিযুক্ত সদর

প্রদেশেও কেন্দ্রের মত সদর নিযুক্ত হতেন। তিনি প্রধানত কাজী বা বিচারকের কাজ করতেন। তিনি কেন্দ্রের প্রধান সদরের কাছে বিভিন্ন ধর্মীয় বা দাতব্য বিষয়ে সুপারিশ পাঠাতেন।

আকবরের সুবার অন্যান্য কর্মচারী

এছাড়া ওয়াকিয়া নবিশ, ফৌজদার, কাজী, দারোগা সদর প্রভৃতি বিভিন্ন কর্মচারী প্রদেশের শাসনে সাহায্য করতেন। কোতোয়াল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, চুরি, ডাকাতি দমন প্রভৃতি পুলিশী দায়িত্ব পালন করতেন। মীর বহর নামক কর্মচারী শুল্ক ব্যবস্থা এবং নদীপথে নৌকা ও ফেরীর ব্যবস্থা করত।

আকবরের প্রাদেশিক শাসনে নিযুক্ত ফৌজদার

  • (১) প্রদেশ বা সুবাকে শাসনের সুবিধার জন্য সরকার বা জেলায় ভাগ করা হয়। সরকারের শাসনের দায়িত্ব ছিল ফৌজদারের হাতে। তিনিই ছিলেন জেলার অধিকর্তা। ফৌজদার ছিলেন সামরিক কর্মচারী। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, চুরি-ডাকাতি দমন, সরকারি আইন কার্যকর করা তার দায়িত্ব ছিল।
  • (২) তার অধীনস্থ সেনাদলকে যুদ্ধের জন্য তৈরি রাখা ছিল তার দায়িত্ব। রাজস্ব আদায়ে দরকার হলে তাঁকে সাহায্য করতে হত। ফৌজদারের প্রশাসনিক দক্ষতার ওপরেই জেলার শাসন নির্ভর করত। এজন্য আকবর কেন্দ্রীয় কর্মচারীর দ্বারা ফৌজদারের কাজের তদারকি করাতেন।
  • (৩) ফৌজদার সাধারণত সুবাদার ও মীর বসীর নির্দেশে কাজ করতেন। জমিদারদের বিদ্রোহ দমন, চুরি-ডাকাতি নিবারণ, কৃষক বিদ্রোহ দমন প্রভৃতি কাজ তাকে করতে হত। তার অধীনে কোতোয়াল সদর বা কাজী শুধু বিচারের কাজ করতেন না।
  • (৪) ফৌজদার ও কোতোয়াল অত্যাচার করলে তাঁর বিরুদ্ধে সুবার কাজী বা প্রদেশের প্রধান কাজীর কাছে নালিশ করতেন। আকবরের আমলে ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে ১০৫টি সরকার ছিল বলে আইন-ই-আকবরী থেকে জানা যায়।

আকবরের প্রাদেশিক শাসনে নিযুক্ত আমাল গুজার

সরকার বা জেলা প্রশাসনকে সাহায্য করার জন্য আমাল গুজার নামে কর্মচারী রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব বহন করত। আমাল গুজার বা আমিল দেওয়ানের অধীনে কাজ করত। আমাল গুজারের অধীনে রাজস্ব আদায়, হিসেব রাখা, কৃষকদের ঋণ দেওয়া ও তা আদায় করার জন্য বহু কর্মচারী ছিল। এছাড়া পতিত জমিকে আবাদযোগ্য করার জন্য উৎসাহ দান ও কৃষির উন্নতির দিকে লক্ষ্য রাখা ছিল আমিলের প্রধান কর্তব্য।

আকবরের প্রাদেশিক শাসনে নিযুক্ত অন্যান্য কর্মচারী

বিটিকাচ জমি জরিপের কাগজ ও রাজস্বের রিপোর্ট তৈরি করত। খাজনাদার ছিল কোষাধ্যক্ষ।

আকবরের আমলে পরগণা

জেলার নীচে ছিল কসবা বা পরগণা। ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে আকবরের সাম্রাজ্যে ২৭৩৭টি পরগণা ছিল। শিকদার পরগণার আইন-শৃঙ্খলা, শান্তিরক্ষা, বিচার ও সাধারণ প্রশাসন পরিচালনা করত।

আকবরের প্রাদেশিক শাসনে নিযুক্ত আমিল

আমিল ছিল পরগণার রাজস্ব বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী। রাজস্ব নির্ধারণ, জরিপ, রাজস্ব আদায় প্রভৃতি কাজ তাকে করতে হত। গ্রামের কৃষক ও গ্রাম প্রধানের সঙ্গে তাকে সংযোগ রাখতে হত।

উপসংহার :- আকবরের প্রশাসনে ফোতেদার ছিল পরগণার সরকারি কোষাধ্যক্ষ এবং কানুনগো জরিপ ও তৎসংক্রান্ত কাগজপত্র পাটওয়ারিদের সাহায্যে রক্ষা করত।

(FAQ) মুঘল সম্রাট আকবরের প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. আকবরের আমলে কতগুলি সুবা ছিল?

১৫ টি।

২. আকবরের আমলে সুবার প্রধান কি নামে পরিচিত ছিল?

সুবাদার।

৩. আকবরের আমলে কতগুলি পরগণা ছিল?

২৭৩৭ টি।

৪. আকবরের আমলে জেলা গুলিকে কি বলা হত? – সরকার

সরকার।

৫. সরকারের প্রধান কে ছিলেন?

ফৌজদার।

Leave a Comment