আর্যদের বসতি বিস্তার প্রসঙ্গে উত্তর পশ্চিম ভারতে বসবাস, দুই দল আর্য জাতির আগমন তত্ত্ব, গঙ্গা-যমুনা উপত্যকায় বসতি বিস্তার, পূর্ব ভারতে আর্য বসতি বিস্তার ও দক্ষিণ ভারতে আর্য বসতি সম্পর্কে জানবো।
আর্যদের বসতি বিস্তার
ঐতিহাসিক ঘটনা | ভারতে আর্য বসতি বিস্তার |
প্রথম বসতি | সপ্তসিন্ধু অঞ্চল |
সভ্যতা | বৈদিক সভ্যতা |
সাহিত্য | বেদ |
পূর্ববর্তী সভ্যতা | হরপ্পা সভ্যতা |
পরবর্তী যুগ | ষোড়শ মহাজনপদ |
ভূমিকা :- আর্যদের ভারত -এ বসতি স্থাপন ও তার বিস্তার সম্পর্কে ঋগ্বেদ -এ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যগুলিতে এ সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু বৈদিক সাহিত্যে আর্যগণের বসতি স্থাপন ও তার বিস্তার সম্পর্কে কোনো ধারাবাহিক বিবরণ দেওয়া হয় নি। বৈদিক সাহিত্য -এ ছড়িয়ে থাকা তথ্য সংযোজন করে এবং কিছু প্রত্নতাত্বিক প্রমাণের সাহায্যে পণ্ডিতেরা এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।
উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে আর্যজাতির বসবাস
- (১) ঋকবেদে আফগানিস্থান -এর কয়েকটি স্থান ও নদ-নদীর নাম এবং সপ্তসিন্ধুর নাম পাওয়া যায়। এই স্থানগুলি হল কুভা বা কাবুল, সুবাস্তু বা স্বাত, ক্রুম্ব বা কুররম, গোমতি বা গোমাল। এছাড়া সপ্তসিন্ধু অর্থাৎ পাঞ্জাবের পাঁচ নদী যথা শতদ্রু, ইরাবতী, চন্দ্রভাগা, বিপাশা, ঝিলাম এবং সিন্ধু ও সরস্বতী বুঝায়। এই সপ্তসিন্ধু আফগানিস্তান সীমান্ত থেকে পাঞ্জাব সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
- (২) এছাড়া হিমাবত বা হিমালয় পর্বতের নাম পাওয়া যায়। এছাড়া ঋকবেদের নদীস্তোত্রে সিন্ধু ও অন্যান্য নদনদীগুলির নাম জানা যায়। এটা লক্ষ্য করার বিষয় যে, ভারতের প্রধান নদী গঙ্গা বা যমুনার উল্লেখ ঋকবেদের গোড়ার দিকের রচনায় দেখা যায় না। সুতরাং ঋকবেদের যে ভৌগোলিক প্রমাণ পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে বলা যায় যে, আর্যরা ভারতে আসার পর প্রথমে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল ও পাঞ্জাবে বসবাস করত।
- (৩) সম্ভবতঃ আর্যরা প্রথমে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে এবং পরবর্তী পর্যায়ে পাঞ্জাবের সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে ঢুকে পড়ে। পাঞ্জাবের আদি অনার্য অধিবাসীদের সঙ্গে বহিরাগত আর্যদের কঠিন সংগ্রাম হয়। এই অনার্য কারা ছিল তা সঠিক জানা যায় নি। হয়ত এরা দ্রাবিড় জাতি ছিল। এই সংগ্রামের ফলে আর্যরা জয়লাভ করলেও আর্য ভাষায় দ্রাবিড় তালব্য বর্ণ যথা ‘ন” ‘ৎ’ ঢুকে যায় বলে মনে করা হয়।
দুই দল আর্য জাতির আগমন তত্ত্ব
- (১) কোনো কোনো পণ্ডিত বলেন যে, দুই দল আর্য দুইবার পাঞ্জাবে ঢুকে পাঞ্জাব জয় করে। প্রথম দল ঢুকে স্থানীয় অনার্যদের ধ্বংস করে। তারপর আর একদল আর্য মধ্য এশিয়া থেকে গিলগিটের ভেতর দিয়ে ভারতে ঢুকে পড়ে।
- (২) প্রথম দলটি বৈদিক সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী। দ্বিতীয় দলটি ছিল ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী। প্রথম দলটি পাঞ্জাব থেকে বিস্তার লাভ করে। দ্বিতীয় দল মধ্যদেশ গঙ্গা-যমুনা উপত্যকায় আধিপত্য স্থাপন করে। গ্ৰীয়ারসন নামে ভাষাতত্ববিদও এই অভিমত সমর্থন করেন।
- (৩) তিনি মধ্যদেশ বা গঙ্গা-যমুনা উপত্যকায় হিন্দুস্থানী ভাষার সঙ্গে পাঞ্জাবের ভাষার তফাৎ দেখেছেন। কেমব্রিজ ইতিহাসের লেখক রাপসন এই মত অগ্রাহ্য করেছেন। তিনি বলেন যে, দুই দল আর্য জাতির আগমনের কোনো প্রমাণ নেই। পাঞ্জাব থেকে আর্যরা ভারতের অভ্যন্তরে গঙ্গা-যমুনা উপত্যকায় উপনিবেশ বিস্তার করে মাত্র।
- (৪) সম্প্রতি স্বাত বা সোয়াট বা বৈদিক গান্ধার অঞ্চলে খননকার্যের ফলে যে সকল নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে তা থেকে মনে করা হয় যে, খাইবার গিরিপথ দিয়ে গন্ধারের পথে কিছু আর্যগোষ্ঠী ভারতে আসে। গান্ধারে যে নরকঙ্কাল পাওয়া গেছে তা ভূমধ্যসাগরীয় বা আর্য জাতির। তাদের ছিদ্রযুক্ত কুঠার, তৈজস ও আসবাব-পত্র আর্য জাতির বলে মনে করা হয়।
গঙ্গা-যমুনা উপত্যকায় আর্যদের বসতি বিস্তার
- (১) আর্যরা দীর্ঘদিন ধরে ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। আর্যদের লোকসংখ্যা বাড়লে পাঞ্জাবে বাড়তি লোকের স্থান সঙ্কুলান হওয়া সম্ভব ছিল না। লোকসংখ্যা বাড়ার ফলে গোচারণ, ভূমি, বনজ সম্পদ, কৃষিক্ষেত্রের অভাব দেখা দেয়।
- (২) রাভি বা পারুষ্ণি নদীর জলের ভাগ নিয়ে আর্যগোষ্ঠীগুলির মধ্যে ঝগড়া বিবাদ দেখা দেয়। ঋকবেদের দশ রাজার যুদ্ধ -এর বিবরণ এই বিবাদের ইঙ্গিত দেয়। পূর্ব ভারতে গঙ্গা-যমুনা উপত্যকায় ছিল বিশাল উর্বরা প্রান্তর, নদ-নদী এবং মাটির নীচে তামা ও লোহা। এই সকল সম্পদের লোভে এবং পাঞ্জাবে স্থানাভাবের কারণে আর্যরা পূর্বদিকে বসতি বিস্তার করে।
- (৩) পাঞ্জাব থেকে সোজা দক্ষিণে বসতি বিস্তারের বাধা ছিল রাজপুতানার মরু অঞ্চল। সুতরাং প্রথমে যমুনা ও পরে গঙ্গা নদীর উপত্যকায় আর্য বসতি বিস্তৃত হয়। যমুনা ও গঙ্গার অববাহিকায় যে অরণ্য ছিল তার বেশীর ভাগ আগুনে পুড়িয়ে আর্যরা বাসযোগ্য করে ফেলে।
- (৪) ঋকবেদের শেষ দিকে সরযূ নদীর উল্লেখ থেকে একথা প্রমাণ হয় যে, আর্যরা মধ্যদেশ বা উত্তরপ্রদেশের সরযু নদীর তীর পর্যন্ত ঋকবেদের যুগে বসতি বিস্তার করেছিল। রোমিলা থাপার বলেছেন যে, ঋকবেদের যুগে দিল্লী অঞ্চল পর্যন্ত আর্য বসতির বিস্তার হয়।
পূর্ব ভারতে আর্য বসতি বিস্তার
- (১) ঋকবেদের পরবর্তী বৈদিক যুগ -এ আর্যরা গঙ্গা পার হয়ে আরও পূর্ব দিকে বসতি বিস্তার করে। যজুর্বেদের সংশ্লিষ্ট গ্রন্থ শতপথ ব্রাহ্মণে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ১০০০-৮০০ খ্রিস্টপূর্বের মধ্যে পূর্ব ভারতে এই বিস্তৃতি ঘটে বলে অনুমান করা হয়।
- (২) এই যুগে আর্যরা পশুপালন ছেড়ে অন্যান্য জীবিকায় দক্ষতা লাভ করে। কৃষি, প্রস্তর ও ধাতু শিল্পে তাদের দক্ষতার কথা জানা যায়। যজুর্বেদ -এর একটা স্তোত্রে দেখা যায় আর্যরা দেবতার কাছে সুবৃষ্টি, সুফসল, লোহা, ব্রোঞ্জ ও তামা প্রার্থনা করছে। গাঙ্গেয় উপত্যকায় তামা ও লোহার প্রাচুর্য এবং উর্বর মাটি পূর্ব ভারতে আর্য বসতি বিস্তারের পক্ষে সহায়ক ছিল।
- (৩) পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্য সভ্যতার কেন্দ্র পাঞ্জাব থেকে মধ্যদেশ অর্থাৎ গঙ্গা-যমুনা উপত্যকায় চলে আসে। পূর্ব ভারতের জঙ্গলগুলি আগুনে পুড়িয়ে আর্যরা এই অঞ্চলে বসতি বিস্তার করে। শতপথ ব্রাহ্মণে এই যুগে কোশাম্বি, বিদেহ, কাশী, মগধ, অঙ্গ প্রভৃতি রাজ্যের নাম জানা যায়। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য-এ পূর্ব অঞ্চলের নাম ছিল প্রাচী।
- (৪) পূর্ব ভারতের ব্যাঘ্র-সস্কুল বঙ্গদেশে আর্য বসতি বিস্তারে কিছু বিলম্ব ঘটে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে পুন্ড্রদেশ বা উত্তর বাংলাকে দস্যু বা অনার্যদের আবাসস্থল বলে উল্লেখ করা হয়। বৌধায়ন তাঁর ধর্ম সূত্রে পুণ্ড্র ও বঙ্গকে (পূর্ব বাংলা) বর্বর অঞ্চল বলে অভিহিত করেছেন। এই অঞ্চলে এলে তিনি আর্যবংশীয়দের প্রায়শ্চিত্ত করার বিধান দেন।
- (৫) মহাকাব্যের যুগ -এ বাংলায় আর্য-সভ্যতা বিস্তৃত হয় বলে জানা যায়। মহাভারতের বন পর্বে উত্তর বাংলার করতোয়াকে একটি পবিত্র নদী এবং পশ্চিম বাংলার তাম্রলিপ্তকে আর্য সভ্যতার অন্তর্গত বলা হয়।
- (৬) পশ্চিমবঙ্গ -এর অজয় নদীর তীরে পান্ডু রাজার ঢিপিতে সাম্প্রতিক খননকার্যের ফলে তাম্র সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে। কোনো কোনো পণ্ডিত মনে করেন যে, বাংলাদেশ -এ আর্য সভ্যতা বিস্তারের আগে অপর একটি বিশেষ সভ্যতা এখানে বিদ্যমান ছিল। মহাভারতে পৌণ্ড্র বাসুদেবের কাহিনী এরূপ একটি স্বতন্ত্র সভ্যতা থাকার ইঙ্গিত দেয়।
দক্ষিণ ভারতে আর্য বসতি
দক্ষিণ ভারতে আর্য সভ্যতার বিস্তার সম্পর্কে সঠিক বিবরণ পাওয়া যায় নি। তবে অগস্ত্য যাত্রার কিংবদন্তি অনুসরণ করে অনেকে মনে করেন যে, ঋষি অগস্ত্য ছিলেন বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে আর্য সভ্যতা বিস্তারের প্রতিভু।
উপসংহার :- দক্ষিণে আর্য সভ্যতা পুরাপুরি জয়লাভ করে একথা বলা যায় না। দক্ষিণ ভারতে আর্য সভ্যতার পাশাপাশি দ্রাবিড় সভ্যতার নিদর্শন একথা প্রমাণ করে। শবর, পুলিন্দ, অন্ধ্র প্রভৃতি অনার্য জাতির অস্তিত্ব থেকে জানা যায় যে, দক্ষিণ ভারতে আর্য সভ্যতা পুরোপুরি বিস্তৃত হয় নি।
(FAQ) আর্যদের বসতি বিস্তার সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
সপ্তসিন্ধু অঞ্চল।
পাঞ্জাব।
পাঞ্জাবের পাঁচ নদী যথা শতদ্রু, ইরাবতী, চন্দ্রভাগা, বিপাশা, ঝিলাম এবং সিন্ধু ও সরস্বতী।