প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠিত সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মধ্যে তুলনা প্রসঙ্গে দুই প্রতিষ্ঠানের সাদৃশ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা, সংগঠন, উদ্দেশ্য ও নীতি, ভেটো, দুই প্রতিষ্ঠানের বৈসাদৃশ্য হিসেবে আদর্শবাদ বনাম বাস্তবতা, রাষ্ট্র বনাম জনগণ, কাজের পরিধি, ভার্সাই চুক্তির অংশ, বিশ্বজনীন প্রতিষ্ঠান, সাংগঠনিক পার্থক্য, অ-সদস্যদের উপর অধিকার, হস্তক্ষেপের অধিকার ও সেনাবাহিনী সম্পর্কে জানবো।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠিত জাতিপুঞ্জের মধ্যে তুলনা
বিষয় | জাতিসঙ্ঘ ও জাতিপুঞ্জের মধ্যে তুলনা |
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা | প্রথম বিশ্বযুদ্ধ -এর পর |
প্রতিষ্ঠা দিবস | ২৮ এপ্রিল (১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ) |
প্রথম অধিবেশন | ১০ জানুয়ারি, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ |
প্রথম মহাসচিব | এরিক ড্রুমন্ড |
জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠা | দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ -এর পর |
প্রতিষ্ঠা দিবস | ২৪ অক্টোবর (১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ) |
প্রথম মহাসচিব | ট্রিগভি লি |
বর্তমান মহাসচিব | আন্তোনিও গুতেরেস |
ভূমিকা:- বিশ্বের আধুনিক ইতিহাস-এ জাতিসঙ্ঘ ও সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ হল দুটি উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান দুটির উৎপত্তি, সংগঠন, কার্যকলাপ, দোষ-ত্রুটি প্রভৃতি নানা দিক থেকে তাদের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
জাতিসঙ্ঘ ও জাতিপুঞ্জের মধ্যে সাদৃশ্য
এই দুই আন্তর্জাতিক সংগঠনের মধ্যে যে সকল দিক দিয়ে সাদৃশ্য বর্তমান সেগুলি হল –
(১) প্রতিষ্ঠা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানে জাতিসঙ্ঘ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয়। দুটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতারাই ছিলেন দুই বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী পক্ষ এবং দুটি ক্ষেত্রেই জার্মানি ছিল পরাজিত শক্তি। জাতিসঙ্ঘ ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের মানস সন্তান। অপরপক্ষে, জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
(২) সংগঠন
সাংগঠনিক দিক থেকেও দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। সাধারণ সভা, লিগ পরিষদ, আন্তর্জাতিক বিচারালয় ও সচিবালয় — মূলত এই চারটি সংস্থার মাধ্যমে জাতিসঙ্ঘ তার কাজকর্ম সম্পাদন করত। জাতিপুঞ্জও সাধারণ সভা, নিরাপত্তা পরিষদ, আন্তর্জাতিক বিচারালয় এবং দপ্তরের মাধ্যমে কাজকর্ম সম্পাদন করে। জাতিসঙ্ঘের ম্যান্ডেট-ব্যবস্থা এবং জাতিপুঞ্জের অছি-ব্যবস্থা মূলত একই জিনিস।
(৩) উদ্দেশ্য ও নীতি
দুটি প্রতিষ্ঠানেরই উদ্দেশ্য হল আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং এর উপায় হিসেবে দুটি প্রতিষ্ঠানই শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনা ও মীমাংসার নীতিতে বিশ্বাসী। আদর্শ ও কর্মপদ্ধতির এই সাদৃশ্য লক্ষ্য করে অনেকে জাতিপুঞ্জকে জাতিসঙ্ঘের নতুন সংস্করণ বলে মনে করেন।
(৪) ভেটো
কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে জাতিসঙ্ঘ পরিষদের সব সদস্যের একমত হওয়ার প্রয়োজন ছিল। কোনও একটি রাষ্ট্র ‘ভেটো’ প্রয়োগ করে আক্রমণকারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে কোনও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে বাধাদান করতে পারত। অপরপক্ষে, জাতিপুঞ্জও এই ধরনের ব্যবস্থা থেকে অব্যাহতি পায় নি। জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের যে কোনও স্থায়ী সদস্য ‘ভেটো’ প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা দিতে পারে।
জাতিসঙ্ঘ ও জাতিপুঞ্জের মধ্যে বৈসাদৃশ্য
এইসব সাদৃশ্য সত্ত্বেও উভয় সংগঠনের মধ্যে যথেষ্ট বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্য বিদ্যমান। যেমন –
(১) আদর্শবাদ বনাম বাস্তবতা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলসনের ‘চোদ্দো দফা নীতি’-র ভিত্তিতে মিত্রপক্ষ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার মহৎ উদ্দেশ্যে জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করে। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার মূলে মহান আদর্শবাদ কাজ করলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠার পিছনে কাজ করেছিল বাস্তববোধ। বিশ্বকে যুদ্ধের ভীতিমুক্ত করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধাবসানের বহু আগে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে লন্ডন ঘোষণা’-র সময় থেকেই এই উদ্যোগ শুরু হয় এবং বহু আলাপ-আলোচনার পর জাতিপুঞ্জ জন্মলাভ করে।
(২) রাষ্ট্র বনাম জনগণ
জাতিসঙ্ঘের সদস্য-রাষ্ট্রগুলি নিজেদের চুক্তি-স্বাক্ষরকারী পক্ষ বলে মনে করত। তারা তাদের সরকারের প্রতিনিধি বলে ভারত-নিজেদের কখনোই বিশ্ব জনগণের প্রতিনিধি বলে মনে করে নি। অপরপক্ষে জাতিপুঞ্জের সনদের প্রস্তাবনা শুরু হচ্ছে—”আমরা সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের জনগণ” বলে—অর্থাৎ এখানে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের উপর গুরুত্ব না দিয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বিশ্বের জনগণের উপর।
(৩) কাজের পরিধি
জাতিসঙ্ঘের চুক্তিপত্র অপেক্ষা জাতিপুঞ্জের সনদ অনেক দীর্ঘ ও সুস্পষ্ট। জাতিপুঞ্জ সনদে বিভিন্ন দপ্তরের সংগঠন, কর্মধারা ও কর্মের পরিধি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা আছে। জাতিসঙ্ঘ অপেক্ষা জাতিপুঞ্জের কাজকর্মের পরিধি অনেক বিস্তৃত এবং এই প্রতিষ্ঠানটি অনেক বেশি প্রতিনিধিত্বমূলক।
(৪) ভার্সাই চুক্তির অংশ
জাতিসঙ্ঘ ছিল ভার্সাই সন্ধির অংশবিশেষ এবং এই কারণে জাতিসঙ্ঘের সাফল্য বহুলাংশে ভার্সাই সন্ধির সাফল্যের উপর নির্ভরশীল ছিল। ভার্সাই চুক্তি ভঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে জাতিসঙ্ঘের মর্যাদা ও পবিত্রতা বিনষ্ট হতে শুরু করে। অপরপক্ষে জাতিপুঞ্জ কোনও সন্ধি বা চুক্তির অঙ্গীভূত ছিল না। ফলে এই প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব বা সফলতা অন্য কোনও চুক্তির উপর নির্ভরশীল ছিল না।
(৫) বিশ্বজনীন প্রতিষ্ঠান
- (ক) জাতিসঙ্ঘ কখনোই এক বিশ্বজনীন প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারে নি। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলি কখনোই একসঙ্গে এর সদস্য হয় নি। এই কারণে জাতিসঙ্ঘ শুরু থেকেই একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। জাতিসঙ্ঘের মূল উদ্যোক্তা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কখনোই এর সদস্য হয় নি।
- (খ) ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি এবং ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত রাশিয়া জাতিসঙ্ঘে যোগদান করে। আবার পক্ষান্তরে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে জাপান, ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি ও ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ইতালি জাতিসঙ্ঘ ত্যাগ করে এবং ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়াকে জাতিসঙ্ঘ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
- (গ) এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত ইঙ্গ-ফরাসি শক্তির কুক্ষিগত হয়ে পড়ে এবং তারা নিজ স্বার্থে একে ব্যবহার করে। অপরপক্ষে, বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের যোগদানে শুরু থেকেই জাতিপুঞ্জ একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
(৬) সাংগঠনিক পার্থক্য
- (ক) সাংগঠনিক দিক থেকেও দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। জাতিসঙ্ঘের প্রধান সংস্থা ছিল তিনটি—সাধারণ সভা, লিগ পরিষদ ও সচিবালয়। অপরপক্ষে, জাতিপুঞ্জের প্রধান সংস্থা হল ছয়টি—সাধারণ সভা, নিরাপত্তা পরিষদ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ, আন্তর্জাতিক বিচারালয়, অছি পরিষদ এবং দপ্তর।
- (খ) জাতিসঙ্ঘ অপেক্ষা জাতিপুঞ্জের কাজের পরিধি ব্যাপক। জাতিসঙ্ঘ মূলত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। অপরদিকে জাতিপুঞ্জের উদ্দেশ্য হল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবন। এই কারণে মানবাধিকার, খাদ্য, কৃষি, শিক্ষা, শ্রম, স্বাস্থ্য প্রভৃতি বিভিন্ন দিকে তার কর্মধারা বিস্তৃত।
(৭) অ-সদস্যদের উপর অধিকার
জাতিসঙ্ঘের সদস্য নয় বা জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদ ত্যাগ করেছে, এমন কোনও রাষ্ট্রের উপর জাতিসঙ্ঘের কোনও কর্তৃত্ব ছিল না। অপরপক্ষে, জাতিপুঞ্জের সদস্য নয়, এমন কোনও রাষ্ট্র জাতিপুঞ্জের আদর্শ-বিরোধী কাজ করলে জাতিপুঞ্জ সেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
(৮) হস্তক্ষেপের অধিকার
- (ক) জাতিসঙ্ঘের নিয়ম অনুসারে একমাত্র ‘ঘোষিত যুদ্ধই ছিল যুদ্ধ—অঘোষিত যুদ্ধ,যুদ্ধ নয়। এই কারণে বহু রাষ্ট্র যুদ্ধ ঘোষণা না করেই নিজ স্বার্থসিদ্ধি করেছে। যুদ্ধের সংজ্ঞায় পড়ে না বলে জাতিসঙ্ঘ সেই সব ক্ষেত্রে কোনও ব্যবস্থা নিতে পারে নি।
- (খ) অপরপক্ষে, ঘোষিত বা অঘোষিত যুদ্ধ যাই হোক না কেন, কোথাও যুদ্ধ-পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বা শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা দেখা দিলে জাতিপুঞ্জ সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে।
- (গ) শান্তি বা নিরাপত্তার জন্য জাতিসঙ্ঘ নিজে থেকে কোনও উদ্যোগ নিতে পারত না। এই ব্যাপারে সদস্যরা দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তবেই জাতিসঙ্ঘ সক্রিয় হত। অপরপক্ষে, কোথাও শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখলে জাতিপুঞ্জের সেক্রেটারি জেনারেল বা মহাসচিব নিজেই ব্যবস্থা নিতে পারেন।
(৯) সেনাবাহিনী
- (ক) আক্রমণকারী বা অভিযুক্ত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘ অর্থনৈতিক অবরোধের নীতি গ্রহণ করতে পারত। এই নীতি ব্যর্থ হলে অভিযুক্ত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হত। এক্ষেত্রে, সদস্য-রাষ্ট্রগুলি সেনাদল পাঠিয়ে সাহায্য করত। তাদের পক্ষে এই সেনাদল পাঠানোও ছিল ঐচ্ছিক।
- (খ) অপরপক্ষে জাতিপুঞ্জ কোনও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে মহাসচিব সদস্য দেশগুলিকে প্রয়োজনীয় সেনা ও অস্ত্র পাঠাতে নির্দেশ দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে জাতিপুঞ্জের সিদ্ধান্ত পালনে সদস্য রাষ্ট্রগুলি বাধ্য।
উপসংহার:- উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে আদর্শ, কর্মপন্থা, কর্মের ব্যাপকতা—সব দিক থেকেই জাতিপুঞ্জ অনেক উন্নত, সংগঠিত ও সুসংহত। তাই বলা হয় যে, জাতিপুঞ্জ হল জাতিসঙ্ঘের এক সংশোধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ।
(FAQ) জাতিসংঘ ও জাতিপুঞ্জের মধ্যে তুলনা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।
২৮ এপ্রিল ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ।
এরিক ড্রুমন্ড।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
২৪ অক্টোবর ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ।
ট্রিগভি লি।
আন্তোনিও গুতেরেস।