তেভাগা আন্দোলন

তেভাগা আন্দোলন সম্পর্কে রসুলের অভিমত, নরহরি কবিরাজের অভিমত, ভাগচাষিদের অবস্থা, আন্দোলনের পটভূমি হিসেবে কৃষক সভার দাবি, কৃষকদের মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টি, ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্ট, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, ভূমিহীন মজুরের সংখ্যা বৃদ্ধি, প্রস্তাব গ্ৰহণ, কৃষকদের দাবি, আন্দোলনের সূচনা, কৃষকদের ধ্বনি, আন্দোলনের বিস্তার, আন্দোলনের অবসান, আন্দোলনের নেতৃত্ব, বঙ্গীয় বর্গাদার নিয়ন্ত্রণ বিল, আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানবো।

১৯৪৬-৪৯ খ্রিস্টাব্দের তেভাগা আন্দোলন

ঐতিহাসিক ঘটনাতেভাগা আন্দোলন
সময়কাল১৯৪৬-৪৯ খ্রিস্টাব্দ
স্থানবাংলা
প্রধান কেন্দ্রঠাকুরগাঁও মহকুমা
নেতাবুড়িমা, অবনী লাহিড়ী
তেভাগা আন্দোলন

ভূমিকা:- ভারত -এর অন্যান্য স্থানের মত বাংলার কৃষকরাও ছিল নানা ধরনের সামন্ততান্ত্রিক শোষণের শিকার। সারা বছর জমিতে উদয়স্ত পরিশ্রম করেও অনাহার, অপুষ্টি, দারিদ্র, ব্যাধি ও অশিক্ষা ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী।

তেভাগা আন্দোলন

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে বাংলার দারিদ্র-পীড়িত কৃষকেরা জমিদার ও জোতদারের বিরুদ্ধে এক প্রবল আন্দোলনের সূচনা করে, যা তেভাগা আন্দোলন নামে পরিচিত।

ভারতের তেভাগা আন্দোলন সম্পর্কে রসুলের অভিমত

স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলার কৃষক আন্দোলনগুলির মধ্যে তেভাগা আন্দোলন ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। বিশিষ্ট মার্কসবাদী নেতা মহম্মদ আবদুল্লাহ রসুলের মতে “বাংলাদেশ -এর কৃষক সভার ইতিহাসে এটাই ছিল তখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যাপক ও শক্তিশালী আন্দোলন।”

তেভাগা আন্দোলন সম্পর্কে নরহরি কবিরাজের অভিমত

অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ বলেন যে, “তেভাগা আন্দোলন ছিল বর্গাদার ভাগচাষিদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রাম।”

বাংলার ভাগচাষিদের অবস্থা

  • (১) জোতদার বা ধনী ভূস্বামীর কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া জমিতে কর্মরত কৃষককে বলা হত বর্গাদার, ভাগচাষি বা আধিয়ার।এই কৃষকরা নিজের খরচে জোতদারের জমিতে চাষ করত এবং বিনিময়ে তাকে উৎপাদিত শস্য তুলতে হত জোতদারের খামারে।
  • (২) তার প্রাপ্য ছিল উৎপাদিত শস্যের অর্ধেক, যা সে কখনই পেত না।কারণ, নানা অছিলায় তা কেটে নেওয়া হত। নানা কারণে কৃষককে জোতদারের কাছ থেকে ধান ধার করতে হত। একে বলা হত ‘ধান-কর্জ’।
  • (৩) ফসল তোলার সময় কৃষকদের বিশাল সুদ-সহ ঐ ধান ফেরৎ দিতে হত, যার ফলে কৃষকের অবস্থা সঙ্গিন হয়ে পড়ত। নানা পূজা-পার্বণ ও বিভিন্ন কারণ-অকারণে কৃষকদের ওপর চাপানো হতনানা ধরনের ‘আবওয়াব বা বাড়তি করের বোঝা।
  • (৪) কৃষকের পারিবারিক জীবনের ওপরেও ছিল জোতদার জমিদারের অশুভ হস্তক্ষেপ। কৃষকদের বিবাহ, শ্রাদ্ধ, মিলাদ, পার্বণ – এমনকী মেয়েদের সম্ভ্রম সবই ছিল জমিদারের মর্জির ওপর।
  • (৫) দরিদ্র কৃষক হাটে-বাজারে সামান্য কিছু বিক্রি করতে গেলেও তার জন্য জোতদার জমিদারকে ‘তোলা’ দিতে হত। এত অনাচারের পরেও জমিতে ভাগচাষিদের স্বত্ব কিন্তু স্থায়ী ছিল না—জমিদার ইচ্ছে করলেই তাকে জমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারত। কৃষকদের পক্ষে যুগ যুগ ধরে এই সব মেনে নেওয়া বা সহ্য করা সম্ভব ছিল না।

তেভাগা আন্দোলনের পটভূমি

বাংলার এই তেভাগা আন্দোলনের পটভূমি ছিল নিম্নরূপ –

(১) কৃষক সভার দাবি

১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সারা ভারত কৃষক সভা’। ১৯৩৭-এর মার্চে প্রতিষ্ঠিতহয় এর অধীনস্থ ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা”। ‘কৃষক সভা’ দাবি তোলে ‘বিনা খেসারতে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ চাই’, ‘লাঙল যার জমি তার’।

(২) কৃষকদের মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টি

১৯৩৫-এর ‘ভারত শাসন আইন’ অনুসারে ১৯৩৭-এ যে নির্বাচন হয় তাতে বাংলায় ফজলুল হকের নেতৃত্বে ‘কৃষক প্রজা পার্টি”-র সরকার গঠিত হয়। তাঁর নেতৃত্বে ‘বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন’ সংশোধিত হয়। তিনি ‘ঋণ সালিসি বোর্ড গঠন করে ঋণের সুদের ঊর্ধ্ব সীমা বেঁধে দেন। এই সব কারণে কৃষকদের মধ্যে উৎসাহের সৃষ্টি হয়।

(৩) ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্ট

১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার নির্দেশে বাংলার ভূমিব্যবস্থা সম্পর্কে অনুসন্ধানের জন্য যে ‘ফ্লাউড কমিশন’ গঠিত হয়েছিল ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে তার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এই রিপোর্টে বাংলার ভাগচাষিকে উৎপন্ন ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ দেবার জন্য সুপারিশ করা হয়।

(৪) প্রস্তাব গ্ৰহণ

১৯৪০ খ্রিস্টাব্দেই ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা, বর্গাদারদের তেভাগা র দাবি সম্পর্কে প্রস্তাব গ্রহণ করে। বলা বাহুল্য, এই ব্যাপারে কাজ কিছুই এগোয় নি।

(৫) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। জিনিসপত্রের আকাল ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে।

(৬) ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ

১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে দেখা দেয় ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ। ৩০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটে এবং এক কোটি মানুষ একেবারে নিঃস্ব হয়ে যায়। ছোট ও মাঝারি চাষিরা তাদের জমি-জমা বিক্রি করে ভাগচাষি বা ভূমিহীন মজুরে পরিণত হয়।

(৭) ভূমিহীন মজুরের সংখ্যা বৃদ্ধি

গ্রাম বাংলার জমিদার-জোতদাররা সব জমি ক্রয় করে ফুলে ফেঁপে ওঠে। এই অবস্থায় গ্রামের ভাগচাষি বা ভূমিহীন মজুরের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৫-৮০ ভাগ, আর জোতদার ২-৫ ভাগ।

তেভাগা আন্দোলনের প্রস্তাব গ্ৰহণ

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে কলকাতা ও নোয়াখালিতে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার পর সেপ্টেম্বর মাসে ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভা’ খুলনা জেলার মৌভোগ অধিবেশনে তেভাগার সমর্থনে প্রস্তাব গ্রহণ করে।

বাংলার তেভাগা আন্দোলনে কৃষকদের দাবি

তাদের প্রধান দাবিগুলি হল—

  • (১) উৎপন্ন ফসলের তিনভাগের দু’ভাগ চাই।
  • (২) জমিতে ভাগচাষিকে দখলিস্বত্ব দিতে হবে।
  • (৩) শতকরা সাড়ে বারো ভাগের বেশি অর্থাৎ মনকরা ধানে পাঁচ সেরের বেশি সুদ নেইনেই।
  • (৪) রসিদ ছাড়া কোন ধান দেওয়া হবে না।
  • (৫) আবাদযোগ্য পতিত জমিতে আবাদ করতে হবে।
  • (৬) জোতদারের পরিবর্তে ভাগচাষিদের খোলানে ধান তুলতে হবে।
  • (৭) এ ছাড়াও তাদের দাবি ছিল জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ।

তেভাগা আন্দোলনের সূচনা

১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর মাসের গোড়ায় ধান পাকার সময় দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার আটোয়ারি থানার রামচন্দ্রপুর গ্রাম থেকেই তেভাগা আন্দোলনের ধানকাটার সূচনা হয়।

বাংলার তেভাগা আন্দোলনে চাষীদের ধ্বনি

ঠাকুরগাঁও মহকুমায় ভাগচাষিরা দলবদ্ধভাবে ধান কেটে নিজেদের খামারে তুলতে লাগল। তাদের কণ্ঠে ধ্বনি “তেভাগা চাই”, “নিজ খোলানে (খামারে) ধান তোল”, “জান দিব তবু ধান দিব না”।

তেভাগা আন্দোলনে কৃষকদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ

জোতদারের লাঠিয়াল বাহিনী ও পুলিশ বাধা দিতে এলে সংঘর্ষ হত। মেয়েরা কাঁসর-ঘন্টা ও শাঁখ বাজিয়ে পুরুষদের সতর্ক করে দিয়ে নিজেরা লাঠি, ঝাটা, দা-বটি, কুণ্ডুল নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত।

বাংলার তেভাগা আন্দোলনের ভলান্টিয়ার বাহিনী গঠন

ধান কাটা ও পাহারা দেবার জন্য গড়ে উঠল ভলান্টিয়ার বাহিনী। শহরের বহু ছাত্র ও কমিউনিস্ট কর্মী ভাগচাষিদের সংগঠিত করার কাজে অগ্রসর হন।

তেভাগা আন্দোলনের বিস্তার

  • (১) অচিরেই এই আন্দোলন দিনাজপুর জেলার ৩০টি থানার মধ্যে ২২টিতেই ছড়িয়ে পড়ে। ঠাকুরগাঁও মহকুমা ছিল এই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র।
  • (২) অল্পদিনের মধ্যেই এই আন্দোলন বাংলার উনিশটি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে দিনাজপুর, রংপুর, মালদহ, জলপাইগুড়ি, খুলনা, যশোহর, পাবনা, ২৪ পরগণা ও মেদিনীপুরে এর তীব্রতা ছিল খুব বেশি।
  • (৩) ময়মনসিংহ, ২৪ পরগণার কাকদ্বীপ এবং মেদিনীপুরের সুতাহাটা, মহিষাদল ও নন্দীগ্রামে গণ-আন্দোলনের রূপ ধারণ করে। ময়মনসিংহের হাজং আদিবাসীরা এই সময় টংকা আন্দোলন শুরু করে।
  • (৪) প্রায় ৭০ লক্ষ কৃষক এবং তাদের সহযোদ্ধা ক্ষেতমজুররা সক্রিয়ভাবে এই আন্দোলনে যোগ দেয়। যে-সব অঞ্চলে ভাগচাষির সংখ্যা বেশি ছিল, সেই সব অঞ্চলেই এই আন্দোলন তীব্রতর হয়।

কৃষকদের তেভাগা আন্দোলনের অবসান

শেষ পর্যন্ত সরকারি দমননীতির চাপে এই আন্দোলন ধীরে ধীরে নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। তীর ধনুক ও লাঠি-সড়কি নিয়ে গোলাগুলির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো সম্ভব ছিল না।

বাংলার তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব

দিনাজপুর জেলায় এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন গুরুদাস তালুকদার, অবনী লাহিড়ী, অবনী বাগচী, চারু মজুমদার, সুনীল সেন। রংপুরে নেতৃত্ব দেন সুধীর মুখার্জী ও মণিকৃষ্ণ সেন। জলপাইগুড়ি জেলায় ছিলেন সমর গাঙ্গুলী। জলপাইগুড়ির দেবীগঞ্জে এক বৃদ্ধা বিধবা রাজবংশী মহিলা নেতৃত্ব দেন। তিনি বুড়ি মা নামে পরিচিতা ছিলেন। মেদিনীপুরে বিমলা মণ্ডল-এর নেতৃত্বে মহিলারা এই সংগ্রামেঅংশ নেন।

তেভাগা আন্দোলনের ফলে ‘বঙ্গীয় বর্গাদার নিয়ন্ত্রণ বিল’

  • (১) সরকারের পক্ষে তেভাগা-র দাবি একেবারে উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। ১৯৪৭-এর ২২শে জানুয়ারি সরকার “বঙ্গীয় বর্গাদার সাময়িক নিয়ন্ত্রণ বিল” প্রকাশ করে।
  • (২) স্থির হয় যে, শীঘ্রই এই বিল আইনসভায় উঠবে। এই বিলে আন্দোলনের দুটি দাবি—জমি থেকে ভাগচাষিদের উচ্ছেদ বন্ধ এবং উৎপন্ন ফসলের দুই-তৃতীয়াংশের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
  • (৩) নিজ খোলানে ফসল তোলার অধিকার, ধান প্রাপ্তির রসিদ দেওয়া, কর্জ ধানের সুদ প্রভৃতি মানা হয় নি। এছাড়া ভাগচাষিকে জমি থেকে উচ্ছেদ করার নানা সুযোগ থেকেই যায়।
  • (৪) ভাগচাষিদের প্রধান দু’টি দাবি স্বীকৃত হওয়ায় কৃষকদের মধ্যে প্রবল উন্মাদনা দেখা দেয়। আন্দোলন এবার অন্যত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ফেব্রুয়ারির শুরুতে হিন্দু-মুসলিম জোতদাররা ‘জোতদার সমিতি’ গঠন করে।
  • (৫) বঙ্গীয় আইনসভায় বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষুব্ধ কৃষকরা জোতদার-জমিদারদের গৃহ ও খামার আক্রমণ করলে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।
  • (৬) সরকার নিষ্ঠুর দমননীতির পথ গ্ৰহণ করলে বহু কৃষকের মৃত্যু হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৯-এর অক্টোবর-নভেম্বর মাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটি ‘অর্ডিন্যান্স’ জারি করে তেভাগার দাবি মেনে নেয়।

তেভাগা আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য

এই আন্দোলনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখের দাবি রাখে। যেমন –

  • (১) বাংলার হিন্দু-মুসলিম, রাজবংশী, ওরাঁও, সাঁওতাল, নমঃশূদ্র, পৌণ্ড্র ক্ষত্রিয়, মাহিষ্য প্রভৃতি বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলার দরিদ্র মানুষ সংঘবদ্ধভাবে এই আন্দোলন পরিচালনা করে। শহরের সংগ্রামী ছাত্রসমাজও এই আন্দোলনে যোগ দেয়।
  • (২) মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে বাংলার সংগ্রামী কৃষককুল এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই আন্দোলনে মোট ৭০ জন হিন্দু-মুসলিম ও আদিবাসী নারী-পুরুষ কৃষক নিহত হয়। একমাত্র দিনাজপুর থেকেই শহিদ হন ৪০ জন কৃষক।
  • (৩) ১২০০ কৃষককে গ্রেপ্তার করা হয় এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে আহত হন প্রায় ১০ হাজার কৃষক। দিনাজপুর জেলার দুই ক্ষেতমজুর আদিবাসী শিবরাম ও সমিরুদ্দিন ছিলেন তেভাগা আন্দোলনের দুই প্রথম শহিদ। ১৯৪৭-এর ৪ঠা জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে তাঁদের মৃত্যু হয়।
  • (৪) এই আন্দোলনে কৃষক-ঘরের নিরক্ষর মা-বোনদের ভূমিকাও ছিল খুবই উজ্জ্বল। নিছক স্বেচ্ছাসেবী নয়— তাঁরা প্রত্যক্ষভাবে জোতদারের গুণ্ডা ও পুলিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।
  • (৫) জলপাইগুড়ির ‘বুড়ি মা’, মেদিনীপুরের বিমলা মণ্ডল, দিনাজপুরের রাজবংশী কৃষক-বধূ জয়মণি, দীপশ্বরী, শিখা বর্মণ, জয় বর্মণী, মাতি বর্মণী, কাকদ্বীপের উত্তমী, বাতাসী বীরমাতা অহল্যা প্রমুখনারীর নাম অতি উল্লেখযোগ্য। অশিক্ষিতা, নিরক্ষর, হতদরিদ্র গ্রাম্য বধূরা সত্যিই সেদিন এক নতুন ইতিহাস তৈরি করেন।
  • (৬) সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প যা সমগ্র জাতিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে, সমগ্র জাতি যখন ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় মত্ত (১৬ই আগস্ট, ১৯৪৬), তখন হিন্দু-মুসলিম আধিয়াররা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জোতদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়।
  • (৭) সাম্প্রদায়িকতার জিগির তুলেও আধিয়ারদের বিভক্ত করা যায় নি। শিক্ষিত মুসলিম হাজী মহম্মদ দানেশ, মহম্মদ ইয়াকুব মিয়া, আবদুর কাদেরের সঙ্গে সাধারণ মুসলিম কৃষক নেতা নিয়ামত আলি, বাচ্চা মামুদ, মজিদ মিয়া প্রমুখ একত্রে হিন্দু কৃষকদের সঙ্গে এই আন্দোলনে ঝাঁপ দেন। মৌলবীরাও কোরাণ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে জন্যসাধারণকে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে।
  • (৮) জাতীয় নেতাদের দ্বারা পরিচালিত আন্দোলন ছিল সংস্কারবাদী— সেখানে শ্রেণী-সংগ্রামের কোনো স্থান ছিল না। কিন্তু তেভাগা আন্দোলনের সঙ্গে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ পরিচালিত আন্দোলনের পার্থক্য অনেক। তেভাগা-র দাবি ছিল কৃষকদের নিজস্ব দাবি। এই আন্দোলন কৃষকদের শ্রেণী-সংগ্রামের অঙ্গনে এনে হাজির করে।
  • (৯) এটি ছিল একটি রাজনীতি-সচেতন আন্দোলন এবং এর মূল সংগঠক ছিল কমিউনিস্ট পার্টি। আন্দোলনের কর্মসূচি ও কলা-কৌশল—সবই পার্টি কর্তৃক স্থির হয়। এই জন্য একই দাবি নিয়ে সারা বাংলা জুড়ে এই আন্দোলন চালানো সম্ভব হয়।
  • (১০) এই আন্দোলনে একদিকে ছিল লাখ লাখ অশিক্ষিত কৃষক ও ক্ষেতমজুর এবং অপরদিকে ছিল শহরের শিক্ষিত কমিউনিস্ট নেতৃবর্গ। এর ফলে কৃষকদের মনে সাহসের সঞ্চার হয় এবং তারা রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে ওঠে।

তেভাগা আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা

এই আন্দোলন একেবারে ত্রুটিহীন ছিল না। এই আন্দোলনের বিভিন্ন ত্রুটি হল –

  • (১) এই আন্দোলন একেবারে সাম্প্রদায়িকতা-মুক্ত ছিল না। বহু ক্ষেত্রে মুসলিম জোতদারদের বিরুদ্ধে মুসলিম কৃষকদের সংগঠিত করার ব্যাপারে সমস্যা দেখা দেয়।
  • (২) নেতৃবর্গ মুখে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথা বললেও এই আন্দোলন মূলত ‘তেভাগা’ কর্মসূচির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সমাজব্যবস্থার কোনো মৌলিক পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলন পরিচালিত হয় নি।
  • (৩) এই আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণীকে যুক্ত করা সম্ভব হয় নি।
  • (৪) গ্রামের বিপুল সংখ্যক মধ্যবিত্ত অ-কৃষক মানুষকে এই আন্দোলনে সামিল করা যায় নি। তারা এই আন্দোলনে বরং আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। তারা সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনে সামিল হলেও এই সামন্ত-বিরোধী আন্দোলন থেকে দূরে ছিল।
  • (৫) এই আন্দোলন ছিল শহরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী পরিচালিত একটি কৃষক আন্দোলন। গ্রামীণ কৃষকদের তৃণমূল স্তর থেকে কোন নেতা উঠে আসে নি।

উপসংহার:- নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে, কৃষক-সত্তার জাগরণের ইতিহাসে তেভাগা আন্দোলন এক স্মরণীয় অধ্যায়। এর গুরুত্বকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

(FAQ) তেভাগা আন্দোলন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. তেভাগা আন্দোলনের সময়কাল লেখ।

১৯৪৬-১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ।

২. তেভাগা আন্দোলন কোথায় হয়?

বাংলায়।

৩. বুড়িমা কোন আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন?

বাংলার তেভাগা আন্দোলন।

৪. তেভাগা আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র কোথায় ছিল?

ঠাকুরগাঁও মহকুমা।

Leave a Comment