ভারতের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা -র সময়কাল, সাহসিকতাপূর্ণ পরিকল্পনা, মহলানবীশ মডেল, ভারী শিল্পে গুরুত্ব আরোপ, দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য, দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ব্যয়, দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ফলাফল, দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ত্রুটি, দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার গুরুত্ব সম্পর্কে জানবো।
ভারতের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা
ঐতিহাসিক ঘটনা | দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা |
সময়কাল | ১৯৫৬-১৯৬১ সাল |
রূপরেখা তৈরি | প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ |
প্রধানমন্ত্রী | পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু |
লক্ষ্য | শিল্পায়ন |
বরাদ্দ | ৪৬০০ কোটি টাকা |
ভূমিকা:- স্বাধীন ভারত -এর প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু সদ্য স্বাধীন ভারতের বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে মজবুত করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৫১-৫৬ খ্রি.) মােটামুটিভাবে সফল হওয়ার পর দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাও ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।
ভারতের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কার্যকাল
দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কার্যকাল ছিল ১৯৫৬ সালের ১লা এপ্রিল থেকে ১৯৬১ সালের ৩১শে মার্চ পর্যন্ত।
প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সম্প্রসারিত রূপ
দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা হল প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সম্প্রসারিত রূপ।
সাহসিকতাপূর্ণ পরিকল্পনা
প্রথম পরিকল্পনায় উন্নয়নের যে ভিত্তিরচিত হয়, দ্বিতীয় পরিকল্পনায় তা আরও সুদূরপ্রসারী, সুদৃঢ়, দুঃসাহসিক ও বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে। বলা হয় যে, দ্বিতীয় পরিকল্পনা ছিল প্রথম পরিকল্পনা অপেক্ষা অধিকতর উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও সাহসিকতাপূর্ণ।
দুই পরিকল্পনার পার্থক্য
প্রথম পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল দেশের মৌলিক অভাবগুলি দূর করা, আর দ্বিতীয়টির লক্ষ্য ছিল শিল্পায়ন।
মহলানবীশ মডেল
রাশিয়ার পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অনুকরণে বিশিষ্ট রাশিবিজ্ঞানী ডঃ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের প্রস্তাব অনুসারে, যা ‘মহলানবীশ মডেল’ নামে পরিচিত, এই পরিকল্পনার খসড়া প্রস্তুত করা হয়। পরবর্তী কয়েক দশক ধরে এই মডেল ভারতীয় উন্নয়ন-সংক্রান্ত চিন্তা-ভাবনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
ভারী শিল্পে গুরুত্ব আরোপ
প্রথম পরিকল্পনায় কৃষির ওপর প্রধান গুরুত্ব আরোপিত হয় এবং ভারী শিল্প উপেক্ষিত হয়। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ভারী ও যন্ত্রপাতি নির্মাণ শিল্পের ওপর গুরুত্ব আরোপিত হয়।
সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজ
এই পরিকল্পনায় কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে কুটির শিল্পের দিকেও যথেষ্ট নজর দেওয়া হয়। এই সময় নেহরু ‘সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজ’ গঠনের কথা ঘোষণা করেন। তাঁর এই আদর্শের প্রতিফলনও এই পরিকল্পনায় দেখা যায়।
ভারতের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য
দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল চারটি। যেমন –
- (১) জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য জাতীয় আয় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা।
- (২) ভারী ও মূল শিল্পগুলির ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়ে শিল্পায়নের গতি বৃদ্ধি করা।
- (৩) অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা—এই পরিকল্পনায় ৮০ লক্ষ কর্মসংস্থানের কথা বলা হয়।
- (৪) আয় ও সম্পদ বন্টনের বৈষম্য হ্রাস করে অর্থনৈতিক ক্ষমতার সুষম বন্টন করা।
ভারতের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার জন্য ব্যয়
প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ব্যয় হয় ১,৯৬০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় পরিকল্পনায় এর পরিমাণ বৃদ্ধি করে হয় ৪,৮০০ কোটি টাকা। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্য উৎপাদন ও বৈদেশিক মুদ্রায় ঘাটতি প্রভৃতি কারণে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে প্রস্তাবিত ব্যয়ের পরিমাণ হ্রাস করে করা হয় ৪,৬০০ কোটি টাকা।
ভারতের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ফলাফল
- (১) দ্বিতীয় পরিকল্পনার ফলাফল বিশেষ সন্তোষজনক হয় নি। পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল জাতীয় আয় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা, কিন্তু সেই লক্ষমাত্রা পূরণ হয় নি—জাতীয় আয় বৃদ্ধি পায় মাত্র ২০ শতাংশ।
- (২) ১৯৫৫-৫৬ সালে ভারতের জাতীয় আয় ছিল ১০,৪০০ কোটি টাকা। ১৯৬০-৬১-তে হয় ১২,৭৫০ কোটি টাকা। ১৯৫৫-৫৬ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ২৬৭.৮ টাকা, কিন্তু ১৯৬০-৬১ সালে তা হয় ২৯৩.৭ টাকা।
- (৩) কৃষির ক্ষেত্রেও উৎপাদন আশানুরূপ হয় নি। খাদ্যশস্য উৎপাদনেরলক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ কোটি ৫০ লক্ষ টন, কিন্তু বাস্তবে উৎপাদন হয় মোট ৭ কোটি ৯৭ লক্ষ টান।
- (৪) বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৫ লক্ষ কিলোওয়াট, কিন্তু ১৯৬০-৬১ খ্রিস্টাব্দেই উৎপাদিত হয়, ৫৭ লক্ষ কিলোওয়াট। সরকারি তিনটি ইস্পাত কারখানা (দুর্গাপুর, তিলাই, রাউরকেল্লা), ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং ও যন্ত্রপাতি নির্মাণ শিল্পের সূচনা হয়।
- (৫) কয়লা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ কোটি টন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উৎপাদন হয় ৫ কোটি ৪৪ লক্ষ টন। ইস্পাতপিণ্ডের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৫ লক্ষ টন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উৎপাদন হয় ৩৫ লক্ষ টন।
- (৬) এই পরিকল্পনায় প্রথমে ১ কোটি লোকের কর্মসংস্থানের কথা বলা হয়, কিন্তু পরে তা কমিয়ে করা হয় ৮০ লক্ষ।
ভারতের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ত্রুটি
দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ত্রুটি গুলি হল –
- (১) আর্থিক সংকটের কারণে এই পরিকল্পনার মাঝপথে ব্যয়ের পরিমাণ কমিয়ে ৪,৬০০ কোটি টাকা করা হয়।
- (২) কৃষি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় পৌছােতে ব্যর্থ হয়। খাদ্য উৎপাদনও লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করতে পারেনি।
- (৩) কয়লা, ইস্পাত ও সিমেন্ট উৎপাদনও তার লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছােতে পারেনি। পাট, তুলা ও তৈলবীজ উৎপাদন যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
- (৪) ভারতের জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি ছিল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ শতাংশ কম।
- (৫) এই পরিকল্পনার সময়কালে দ্রব্যমূল্য যথেষ্ট বৃদ্ধি পাওয়ায় মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।
- (৬) ১ কোটি বেকারের কর্মসংস্থানের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তা-ও পূরণ হয়নি।
- (৭) এই পরিকল্পনার শেষে মহলানবিশ কমিটির (১৯৬১ খ্রি.) রিপাের্টে বলা হয়েছিল যে, সমাজের মুষ্টিমেয় উচ্চশ্রেণির মানুষ এই পরিকল্পনার দ্বারা উপকৃত হয়েছিল। এতে সাধারণ দরিদ্র মানুষের কোনাে উপকার হয়নি।
ভারতের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার গুরুত্ব
কিছু ব্যর্থতা সত্ত্বেও দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যেমন –
- (১) দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে দুর্গাপুর, ভিলাই ও রাউরকেল্লায় ইস্পাত কারখানা নির্মিত হয়।
- (২) এই পরিকল্পনায় শক্তি উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।
- (৩) ভারী শিল্প ও শিল্পপ্রযুক্তির অগ্রগতিও সন্তোষজনক হয়।
- (৪) অন্তত ৯০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হয়।
- (৫) বিদ্যুৎ উৎপাদন, রেল ও সড়ক পরিবহণ, জাহাজ ও বিমান চলাচল প্রভৃতি ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে।
- (৬) দেশে স্কুল কলেজের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পায়।
- (৭) বহু স্থানে নতুন নতুন চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে ওঠে। এক কথায়, দেশের দীর্ঘকালীন অর্থনৈতিক বিকাশের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়।
উপসংহার:- বাস্তবে এই সময় কৃষি-বহির্ভূত ক্ষেত্রে ৬৫ লক্ষ এবং কৃষিক্ষেত্রে ২৫ লক্ষ, অর্থাৎ মোট ৯০ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান হয়, কিন্তু এর মধ্যে কতটা স্থায়ী এবং কতটা অস্থায়ী ছিল, তা বলা শক্ত।
(FAQ) দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৯৫৬-৬১ সাল।
প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ।
পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু।
শিল্পায়ন।