ভারতের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা

স্বাধীন ভারতের বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রসঙ্গে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও অন্যান্য পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা সম্পর্কে জানবো।

স্বাধীন ভারতের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা

ঐতিহাসিক ঘটনাভারতের বিভিন্ন পার্ষিকী পরিকল্পনা
প্রথম১৯৫১-৫৬ খ্রি
দ্বিতীয়১৯৫৬-৬১ খ্রি
তৃতীয়১৯৬১-৬৬ খ্রি
চতুর্থ১৯৬৯-৭৪ খ্রি
পঞ্চম১৯৭৪-৭৮ খ্রি
স্বাধীন ভারতের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা

ভূমিকা :- স্বাধীন ভারত-এর প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর উদ্যোগে ভারতে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এর ফলে অতি দ্রুত ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটে।

ভারতের বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা

স্বাধীন ভারতের বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা সম্পর্কে নীচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল –

(ক) প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৫১-৫৬ খ্রি)

স্বাধীনতা লাভের পর ভারত যে বহুমুখী অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল তা দূর করার উদ্দেশ্যে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এই পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য

ভারতের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য ছিল দুটি। এগুলি হল –

  • (i) যুদ্ধ ও দেশবিভাগের ফলে সৃষ্ট ভারতের অর্থনৈতিক সংকট দূর করা।
  • (ii) উন্নয়নমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি করা এবং ভারতীয়দের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটানো।
(২) প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পদক্ষেপ

এই পরিকল্পনায় কৃষি, সেচ, শক্তি উৎপাদন, গোষ্ঠী উন্নয়ন, পরিবহণ, পুনর্বাসন প্রভৃতি বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত করার জন্য মোট ব্যয় ধরা হয় ২,০৬৯ কোটি টাকা। পরে তা বাড়িয়ে ২,৩৭৮ কোটি টাকা করা হয়।

(৩) প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অগ্রগতি

এই পরিকল্পনার লক্ষ্যগুলি মোটামুটিভাবে সফল হয়েছিল। এই পরিকল্পনার ফলে ভারতের জাতীয় আয় ১৮ শতাংশ, মাথাপিছু আয় ১০.৮ শতাংশ, কৃষি উৎপাদন ২২ শতাংশ এবং শিল্প উৎপাদন ৩১ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সেচ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতিও যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।

(৪) প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ত্রুটি

যথেষ্ট সাফল্যলাভ সত্ত্বেও প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ২,৩৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষমাত্রা ধরা হলেও পুরো টাকা কাজে লাগানো যায় নি। বাস্তবে ব্যয় হয় ১,৯৬০ কোটি টাকা। কৃষির ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ার ফলে শিল্পের অগ্রগতিও আশানুরূপ হয় নি।

(৫) প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল্যায়ন

কিছু ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। যেমন –

  • (i) প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারতীয় অর্থনীতিতে দীর্ঘকাল ধরে চলা স্থিতাবস্থার অবসান ঘটে।
  • (ii) প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারতে পরিকল্পিত অর্থনীতির পথচলা শুরু হয়।
  • (iii) এই পরিকল্পনার ফলে ভারতবাসীর মধ্যে দেশের উন্নয়ন সম্পর্কে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা দেয়।

(খ) দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৫৮-৬১ খ্রি)

প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় খাদ্য ও কাঁচামালের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সামাজিক কল্যাণসাধন এবং বেসরকারি উদ্যোগ – উভয়কেই সমান গুরুত্ব দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। এই পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) নেহেরু-মহলানবিশ মডেল

নেহরুর আদর্শকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইন্সটিটিউট-এর প্রখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার একটি রূপরেখা বা মডেল তৈরি করেন। প্রধানমন্ত্রী নেহরু কিছু সংশোধনের পর এই মডেলটির প্রয়োগ ঘটান। এই মডেল ‘নেহরু মহলানবিশ মডেল’ নামে পরিচিত।

(২) দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য

দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল-

  • (i) জনসাধারণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের উদ্দেশ্যে জাতীয় আয় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা,
  • (ii) ভারী শিল্প ও যন্ত্রপাতি নির্মাণ শিল্পের ওপর গুরুত্ব দিয়ে শিল্পায়নের গতি বৃদ্ধি করা,
  • (iii) কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা,
  • (iv) কুটির শিল্পের বিকাশ ঘটানো।
(৩) দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পদক্ষেপ

দ্বিতীয় পরিকল্পনায় ভারী শিল্প ও প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি, কুটির শিল্পের প্রসারের মাধ্যমে অন্তত ১ কোটি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা প্রভৃতি উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর জন্য ব্যয় ধরা হয় ৪,৮০০ কোটি টাকা।

(৪) দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অগ্রগতি

দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সাফল্য আশানুরূপ হয় নি। তবে এর দ্বারা জাতীয় আয় ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন যথেষ্ট বাড়ে, দুর্গাপুর, ভিলাই ও রাউরকেল্লায় ইস্পাত কারখানা স্থাপিত হয়, ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং ও যন্ত্রপাতি নির্মাণ শিল্পের সূচনা হয় ইত্যাদি।

(৫) দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ত্রুটি

দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রধান ত্রুটিগুলি ছিল – (i) মুদ্রাস্ফীতি ও অন্যান্য কারণে মাঝপথে এই পরিকল্পনার নির্ধারিত ব্যয়ের পরিমাণ কমিয়ে ৪,৬০০ কোটি টাকা করা হয়। (ii) কৃষি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছোতে পারে নি। (iii) কয়লা এবং ইস্পাত উৎপাদনও তার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম ছিল।

(৬) দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল্যায়ন

বিভিন্ন ব্যর্থতা সত্ত্বেও দ্বিতীয় পদ্মবার্ষিকী পরিকল্পনা কয়েকটি কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এগুলি হল – (i) এই পরিকল্পনায় শক্তি উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল। (ii) ভারী শিল্প ও শিল্পপ্রযুক্তির অগ্রগতিও যথেষ্ট হয়েছিল। (iii) অন্তত ৯০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছিল।

(গ) তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৬১-৬৬ খ্রি.)

ভারত সরকার ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য

তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্যগুলি ছিল –

  • (i) প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে জাতীয় আয় বাড়ানো,
  • (ii) খাদ্যোৎপাদনে স্বনির্ভর হওয়া,
  • (iii) শিল্প ও রপ্তানির চাহিদা মেটাতে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা,
  • (iv) ইস্পাত, রাসায়নিক দ্রব্য, শিল্প-যন্ত্রপাতি, শক্তি প্রভৃতির উৎপাদন বৃদ্ধি করা,
  • (v) কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা,
  • (vi) বৈষম্য দূর করে অর্থনৈতিক ক্ষমতার সুষম বণ্টন ইত্যাদি।
(২) তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পদক্ষেপ

এই পরিকল্পনা রূপায়ণে ব্যয় ধরা হয় ১১,৬০০ কোটি টাকা। এই পরিকল্পনায় (i) কৃষি উৎপাদনে গুরুত্ব বাড়ানো হয়। (ii) গ্রামীণ অর্থনীতির পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে গ্রাম পঞ্চায়েত, জেলাপরিষদ, সমবায় সমিতি প্রভৃতির সম্প্রসারণ ঘটানো হয়। (iii) ক্ষুদ্র ও ভারী বুনিয়াদি শিল্পের বিকাশে উদ্যোগ নেওয়া হয়। (iv) শিক্ষার প্রসার ও কর্মসংস্থানের ওপর গুরুত্ব বাড়ানো হয়।

(৩) তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অগ্রগতি

তৃতীয় পবার্ষিকী পরিকল্পনা বহু ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছিল। চিন-ভারত যুদ্ধ (১৯৬২ খ্রি.), পাক-ভারত যুদ্ধ (১৯৬৫-৬৬ খ্রি.), ব্যাপক খরা (১৯৬৫ খ্রি.) প্রভৃতি ঘটনা এই ব্যর্থতার জন্য বহুলাংশে দায়ী ছিল।

(৪) তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ত্রুটি

এই পরিকল্পনার প্রধান ত্রুটিগুলি ছিল –

  • (i) জাতীয় আয়, মাথাপিছু আয় তার লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়।
  • (ii) কৃষিক্ষেত্রে শোচনীয় ব্যর্থতা দেখা দেয়। ড. অমলেশ ত্রিপাঠী বলেন যে, “এই পরিকল্পনায় কৃষি উৎপাদন হল ‘একটি হতাশাজনক ব্যর্থতা”।
  • (iii) ইস্পাত, কয়লা, সিমেন্ট, বিদ্যুৎ প্রভৃতি উৎপাদনও আশানুরূপ হয় নি।
  • (iv) পরিকল্পনার শেষে বেকারসংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়।
(৫) তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল্যায়ন

এই সমস্ত ঘটনাগুলি তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকে তার লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানোর পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।

(ঘ) চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৬৯-৭৪)

ভারত সরকার ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য
  • (i) স্থিতিশীলতা বজায় রেখে অর্থনীতির বিকাশ ঘটানো।
  • (ii) কৃষিক্ষেত্রে বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৫.৬ শতাংশ।
  • (iii) খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন।
  • (iv) কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করে বেকারত্ব হ্রাস করা।
  • (v) রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৩০০ কোটি টাকা।
(২) চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল্যায়ন
  • (i) অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও বিকাশ কোনোটিই সম্ভব হয়নি।
  • (ii) কৃষিক্ষেত্রে বার্ষিক বৃদ্ধির হার ২.৮ শতাংশে পৌঁছোয়।
  • (iii) খাদ্য উৎপাদন লক্ষ্যে পৌঁছোতে ব্যর্থ হওয়ায় খাদ্য আমদানি করতে হয়।
  • (iv) পরিকল্পনার শেষে বেকারের সংখ্যা দাঁড়ায় ২.৩ কোটি।
  • (v) রপ্তানি নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৯০৫০ কোটি টাকায় পৌঁছোয়।

(ঙ) পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭৪-৭৮)

ভারত সরকার ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য
  • (i) জাতীয় আয় বৃদ্ধি ৪.৪ শতাংশ।
  • (ii) কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির হার ৪.৫৮ শতাংশ।
  • (iii) শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধির বার্ষিক হার ৮.১ শতাংশ।
  • (iv) কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো।
(২) পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল্যায়ন
  • (i) জাতীয় আয় বৃদ্ধি হয় ৩.৯ শতাংশ।
  • (ii) কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির হার লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে।
  • (iii) শিল্প উৎপাদনের বার্ষিক বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৫.৩ শতাংশ।
  • (iv) কর্মহীনতা বিপুল পরিমাণে বাড়ে।

(চ) ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৮০-৮৫)

ভারত সরকার ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য
  • (i) কৃষি উৎপাদনের পরিমাণ ৩.৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি করা।
  • (ii) শিল্প উৎপাদন ৬.৯ শতাংশ বাড়ানো।
  • (iii) দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূর করা।
  • (iv) জনবিস্ফোরণ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ।
(২) ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল্যায়ন
  • (i) কৃষি উৎপাদন বাড়ে ৪.৩ শতাংশ।
  • (ii) শিল্প উৎপাদনে বৃদ্ধির হার মাত্র ৩.৭ শতাংশে পৌঁছোয়।
  • (iii) পুরোনো বেকারের সংখ্যা ১.২ কোটি থেকে বেড়ে ৪.৬ কোটিতে পৌঁছোয়।
  • (iv) জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কিছু পদক্ষেপ কার্যকরী হয়।

(ছ) সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৮৫-৯০)

ভারত সরকার ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য
  • (i) স্বাধীন ও স্বনির্ভর অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা।
  • (ii) কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা৷
  • (iii) আর্থ-সামাজিক বৈষম্য দূর করা।
  • (iv) কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো।
  • (v) জাতীয় উন্নয়নের হার ৫ শতাংশ ধার্য করা
(২) সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল্যায়ন
  • (i) অর্থনীতিতে স্বনির্ভরতা বৃদ্ধি পায়।
  • (ii) খাদ্য উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।
  • (iii) বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচি সমাজের উন্নয়ন ঘটায়।
  • (iv) কর্মসংস্থান যথেষ্ট বাড়ে।
  • (v) জাতীয় উন্নয়নের হার ৫.৯ শতাংশে পৌঁছোয়।

(জ) অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৯২-৯৭)

ভারত সরকার ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে অষ্ট পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য
  • (i) বেকার সমস্যা হ্রাস করা।
  • (ii) জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ করা।
  • (iii) কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ৷
  • (iv) জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয় ৫.৬ শতাংশ।
(২) অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল্যায়ন
  • (i) প্রচুর বেকারের কর্মসংস্থান করা হয়।
  • (ii) জন্মহার পূর্ববর্তী বছরগুলি থেকে কিছুটা হ্রাস পায়।
  • (iii) কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
  • (iv) অর্থনৈতিক উদারনীতি গ্রহণ করা হয় এবং জাতীয় উন্নয়নের হার ৬.৭ শতাংশ পৌঁছোয়।

(ঝ) নবম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৯৭-২০০২)

ভারত সরকার ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে নব পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) নবম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য
  • (i) সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির উন্নতি ঘটানো।
  • (ii) কৃষি, শিল্প ও গ্রামীণ বিকাশকে গুরুত্ব দেওয়া।
  • (iii) সবার জন্য খাদ্য ও পুষ্টির ব্যবস্থা করা।
  • (iv) অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয় ৬.৫ শতাংশ।
(২) নবম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল্যায়ন
  • (i) পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়গুলির জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়।
  • (ii) কৃষি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক পূরণ হয় এবং শিল্পের বিকাশও সন্তোষজনক হয় নি।
  • (iii) খাদ্য উৎপাদন ও পুষ্টির ব্যবস্থা আশানুরূপ হয় নি।
  • (iv) অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ৫.৩৫ শতাংশ।

(ঞ) দশম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (২০০২-২০০৭)

ভারত সরকার ২০০২ সালে দশম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) দশম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য
  • (i) দারিদ্র্যের হার ৫ শতাংশ হ্রাস করা।
  • (ii) সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি এবং সকলের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
  • (iii) প্রতিটি গ্রামে পানীয় জলের ব্যবস্থা করা।
  • (iv) জাতীয় উন্নয়নের হার ধার্য করা হয় ৮.১ শতাংশ।
(২) দশম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল্যায়ন
  • (i) আশানুরূপ না হলে দেশের দারিদ্র্যের হার কিছুটা হ্রাস পায়।
  • (ii) দেশের সর্বত্র প্রচুর প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। সাক্ষরতার হার কিছুটা বৃদ্ধি পায়।
  • (iii) আশানুরূপভাবে প্রতিটি গ্রামে না হলেও দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পানীয় জলের ব্যবস্থা হয়।
  • (iv) জাতীয় উন্নয়ন ৭.৭ শতাংশ হয়।

(ট) একাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (২০০৭-২০১২)

ভারত সরকার ২০০৭ সালে একাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) একাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য
  • (i) দেশের দারিদ্র্য ও বেকারত্ব হ্রাস করা।
  • (ii) শিশু ও মায়ের মৃত্যুর হার কমানো।
  • (iii) দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসকারী পরিবারগুলির জন্য বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা।
  • (iv) নদীর জলদূষণ রোধ ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করা।
  • (v) প্রতিটি গ্রামে ‘ব্রডব্যান্ড’ ইন্টারনেট যোগাযোগ পৌঁছে দেওয়া৷
(২) একাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল্যায়ন
  • (i) বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের ফলে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব হ্রাস পায়।
  • (ii) শিশু ও মায়ের মৃত্যুর জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি রূপায়িত করা হয়।
  • (iii) দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিদ্যুৎ পৌঁছোয়।
  • (iv) নদীর জলদূষণ রোধ ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
  • (v) বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির উন্নতির বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়।

(ঠ) দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (২০১২-২০১৭)

ভারত সরকার ২০১২ সালে দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক গুলি হল –

দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য
  • (i) বৃদ্ধির হার প্রথমে ৯.৫৬ শতাংশ করা হলেও পরবর্তীকালে তা ৮ শতাংশে ধার্য করা হয়।
  • (ii) দারিদ্র্য ১০ শতাংশ হ্রাস করা।
  • (iii) কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির হার ৪ শতাংশ ধার্য করা হয়।
  • (iv) GDP-র ২.২ শতাংশ গবেষণা ও উন্নয়নের খাতে ব্যয় করা।

পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ভবিষ্যত

ভারতের পরিকল্পনা কমিশন বিলুপ্ত হওয়ার সাথে সাথে, অর্থনীতির জন্য আর কোনও আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনা তৈরি করা হয় না। তবে পঞ্চবার্ষিক প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা করা অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষটি হবে ২০১৭-২০২২ সাল। অবশ্য ত্রয়োদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নেই।

ভারতের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গুলির মূল্যায়ন

  • (১) পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলি রূপায়ণ করতে গিয়ে ভারতকে প্রথম থেকেই বিদেশি সহায়তার মুখাপেক্ষী থাকতে হয়েছে। প্রতিটি পরিকল্পনার সময় বিদেশ থেকে ঋণগ্রহণের ফলে ভারত বিপুল ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছে। পুরোনো ঋণের অর্থ শোধ করতে গিয়ে বারবার নতুন করে ঋণ নিতে হয়েছে।
  • (২) অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ব্যর্থতার জন্য কেউ কেউ ‘নেহরু-মহলানবিশ মডেল‘-এর সীমাবদ্ধতাকেই দায়ী করে থাকেন। অবশ্য অধ্যাপক ভবতোষ দত্ত মনে করেন যে, “এই মডেলের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও ১৯৫০-এর দশকে এই মডেলের কোনো বিকল্প ছিল না।”

উপসংহার :- এভাবেই ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশ পরিকল্পনা “ভারতবর্ষকে সাম্রাজ্যবাদীদের সেবাদাসে পরিণত করেছে” বলে অধ্যাপক অমিত ভট্টাচার্য উল্লেখ করেছেন।

(FAQ) বাংলায় পঞ্চাশের মন্বন্তর সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ভারতের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময়কাল কত?

১৯৫১-৫৬ খ্রিস্টাব্দ।

২. ভারতের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময়কাল কত?

১৯৫৬-৬১ খ্রি।

৩. ‘নেহরু মহলানবিশ মডেল’ কি?

নেহরুর আদর্শকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইন্সটিটিউট-এর প্রখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার একটি রূপরেখা বা মডেল তৈরি করেন। প্রধানমন্ত্রী নেহরু কিছু সংশোধনের পর এই মডেলটির প্রয়োগ ঘটান। এই মডেল ‘নেহরু মহলানবিশ মডেল’ নামে পরিচিত।

৪. ভারতের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময়কাল কত?

১৯৬১-৬৬ খ্রিস্টাব্দ।

৫. ভারতের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময়কাল কত?

১৯৬৯-৭৪ খ্রিস্টাব্দ।

৬. পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময়কাল কত?

১৯৭৪-৭৮ খ্রিস্টাব্দ।

Leave a Comment