ওপেক (OPEC)

পশ্চিম এশিয়ার আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংগঠন ওপেক প্রসঙ্গে এর প্রতিষ্ঠা, গঠন, সদর দপ্তর, সদস্য রাষ্ট্র, লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য, কার্যাবলী ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানবো।

ওপেক (OPEC)

ঐতিহাসিক বিষয়ওপেক (OPEC)
প্রতিষ্ঠাকাল১৯৬০/৬১ খ্রি
প্রথম সদর দপ্তরজেনেভা
বর্তমান সদর দপ্তরভিয়েনা
সদস্যইরান, ইরাক, কুয়েত কাতার ইত্যাদি
উদ্দেশ্যতেলের ভাণ্ডার নিয়ন্ত্রণ
ওপেক (OPEC)

ভূমিকা :- মধ্যপ্রাচ্য বা পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিই হল বিশ্বের পেট্রোপণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির মূল উৎস। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি বিশ্ব অর্থনীতিতে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করার লক্ষ্যে এক আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংগঠন গড়ে তোলে, যার নাম ওপেক (Organisation of Petroleum exporting Countries বা OPEC)। বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ তেল সম্পদের আধার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি ওপেক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বের তেলের ভাণ্ডারকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ নেয়।

ওপেক (OPEC) এর গঠন

এই সংস্থাটি গঠনের বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(ক) ওপেক প্রতিষ্ঠা

ওপেক প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে (মতান্তরে ১৯৬১ খ্রি., জানুয়ারি) ইরাকের রাজধানী বাগদাদে।

(খ) ওপেক-এর সদস্য

প্রতিষ্ঠাকালে ওপেক এর সদস্য ছিল ছয়টি দেশ। যথা – মধ্যপ্রাচ্যের ইরান, ইরাক, সৌদি আরব, কুয়েত, লিবিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার ভেনেজুয়েলা। পরে আরও বেশ কয়েকটি দেশ এর সদস্য হয়। যথা – কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, আলজেরিয়া ইত্যাদি।

(গ) পশ্চিম এশিয়ার আন্তরাষ্ট্রীয় সংগঠন ওপেক

ওপেককে পশ্চিম এশিয়ার আন্তরাষ্ট্রীয় সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করা হলেও পশ্চিম এশিয়ার বাইরের সর্ববৃহৎ তেল উৎপাদনকারী রাষ্ট্র হিসেবে ভেনেজুয়েলা (ক্যারিবীয় উপসাগরের একেবারে উত্তর প্রান্তের দক্ষিণ আমেরিকাভুক্ত দেশ)-কে ওপেক-এর সদস্যপদ দেওয়া হয়েছিল।

(ঘ) ওপেক-এর সদর দপ্তর

প্রতিষ্ঠার পরবর্তী চার বছর ওপেকের সদর দপ্তর ছিল জেনেভায়। পরে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে এর সদর দপ্তর অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে স্থানান্তর করা হয়।

(ঘ) ওপেক এর সাংগঠনিক কাঠামো

স্থির হয় প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্র থেকে Board of Governors নিযুক্ত হবেন। তার পরবর্তী স্তরে থাকবে সচিবালয়। সচিবালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হিসেবে থাকবেন একজন মহাসচিব (Secretary General)। স্থির হয় সচিবালয়ের মহাসচিব Board of Governors-এর নির্দেশ মেনেই কাজ করবেন।

ওপেক এর উদ্দেশ্য

এই আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংগঠনটির উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য ছিল নিম্নরূপ। –

(১) প্রকৃত লক্ষ্য

ওপেক গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল দীর্ঘদিন ধরে তেল নিষ্কাশন ও পরিশোধনের কাজে নিয়োজিত পুঁজিবাদী বহুজাতিক সংস্থাগুলির ওপর লাগাম টানা। এ ছাড়াও ওপেক-এর সদস্য রাষ্ট্রগুলি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে খনিজ তেলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল, যাতে তারা বিশ্বরাজনীতিতে সমীহ আদায় করতে পারে।

(২) ঘোষিত লক্ষ্য

ওপেক তার ঘোষিত লক্ষ্যে বলে –

  • (a) ক্রেতাদের যাতে হয়রানি না হয় তার জন্য তেলের মূল্যস্তরে স্থিতিশীল অবস্থা বজায় রাখা হবে।
  • (b) তেলের দাম এমনভাবে নির্ধারণ করা হবে। যাতে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েই উপকৃত হয়।
  • (c) বিশ্বে তেলের বাজারেও স্থিতাবস্থা বজায় রাখা হবে।
  • (d) সদস্য রাষ্ট্রগুলির তেল উৎপাদন প্রকল্পগুলির মধ্যে সমন্বয়সাধন করা হবে ইত্যাদি।

ওপেক এর কার্যাবলি

পশ্চিম এশিয়ার আন্তরাষ্ট্রীয় সংগঠন ওপেক এর বিভিন্ন কার্যাবলী হল –

(১) তেলের দাম নির্ধারণ

ওপেক গঠিত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব বর্তায় এই সংগঠনটির ওপর। লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে ওপেক অধিক মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে তেলের দাম বেশ কিছুটা বাড়িয়ে দেয়।

(২) তৃতীয় বিশ্বের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা

ওপেক-এর সদস্য রাষ্ট্রগুলি ছিল তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্গত। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলরপ্তানিকারক সংস্থা হিসেবে ওপেক পশ্চিম এশিয়া তথা তৃতীয় বিশ্বে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় সফল হয়।

(৩) আরব জাতীয়তাবাদের উত্থান ও প্রসার

ওপেকের প্রায় সমস্ত সদস্যরাষ্ট্রই ছিল আরব জাতিভুক্ত। তেল কূটনীতির সুবাদে ওপেকের কার্যাবলির মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে আরব জাতীয়তাবাদের উত্থান ও প্রসার ঘটে।

(৪) বিশ্ব-অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ

আধুনিক বিশ্ব অর্থনীতিতে পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও তেলরপ্তানি থেকে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেনের সম্পর্ক তৈরি হয়, তা বিশ্ব-অর্থনীতিকে অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে।

(৫) অনুন্নত দেশগুলির উন্নয়ন

তেল রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত মুনাফার একটি নির্দিষ্ট অংশ নিয়ে ওপেক ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করে। এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির নাম হল OFID (OPEC Fund for International Development)। এই অর্থ দিয়ে ওপেক-বহির্ভূত অনুন্নত দেশগুলির উন্নয়নের চেষ্টা করা হয়।

(৬) পরিবেশবান্ধব কাজে প্রাধান্য

ওপেকের সদস্য রাষ্ট্রগুলি রাষ্ট্রপুঞ্জ সংগঠিত পরিবেশ সংক্রান্ত আলোচনায় অংশ নেয় ও উৎসাহ দেখায়। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির উন্নয়নের লক্ষ্যে ওপেকের সদস্যরাষ্ট্রগুলি অর্থ বিনিয়োগ করে চলেছে। উন্নত দেশগুলির ওপর Green Tax বা সবুজ কর বসানোর পরিকল্পনা নেয় ওপেক।

ওপেক এর সীমাবদ্ধতা

ওপেকের উদ্দেশ্য ও কার্যাবলির মধ্যে ফারাক থেকে যায়। যে সমস্ত উদ্দেশ্য নিয়ে ওপেক গড়ে উঠেছিল সেগুলি শেষপর্যন্ত পূর্ণ হয়ে ওঠে নি। তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং বিশ্ব-অর্থনীতিতে নিজেদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করা ছাড়া ওপেকভুক্ত দেশগুলি অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছিল বলা চলে। সবথেকে বড়ো কথা, মুসলিম রাষ্ট্রগুলি নিজেদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে বা একে অপরের সঙ্গে সমন্বয়মূলক সম্পর্ক বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়। মুসলিম রাষ্ট্রগুলির এই দৈন্যতা ধরা পড়ে ইরাকের ওপর অবাধ মার্কিনি আক্রমণের মধ্যে দিয়ে।

উপসংহার :- তৃতীয় বিশ্বের এক আঞ্চলিক সংস্থা হিসেবে ওপেক এর প্রচেষ্টা সাময়িকভাবে হলেও বিশ্ব-অর্থনীতি তথা রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পেরেছিল। এটাই ওপেকের একমাত্র সাফল্য বলা চলে।

(FAQ) ওপেক সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ওপেক (OPEC) এর পুরো নাম কি?

Organization of Petroleum exporting Countries

২. ওপেক কখন প্রতিষ্ঠিত হয়?

১৯৬০-৬১ খ্রিস্টাব্দে।

৩. ওপেক এর সদর দপ্তর প্রথমে কোথায় ছিল?

জেনেভা।

৪. বর্তমানে ওপেক এর সদর দপ্তর কোথায়?

ভিয়েনা।

৫. ওপেক এর সদস্য কারা?

ইরান, ইরাক, সৌদি আরব, কুয়েত, লিবিয়া, ভেনেজুয়েলা, কাতার ইত্যাদি।

Leave a Comment