প্রাচীন ইতিহাসের ভয়াবহ কলিঙ্গ যুদ্ধ (Kalinga War) -এর সময়, স্থান, হতাহত, কারণ, ফলাফল, অশোকের মানসিক পরিবর্তন সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
প্রাচীন কালের কলিঙ্গ যুদ্ধ (Kalinga War) প্রসঙ্গে যুদ্ধের সময়কাল, যুদ্ধে বিবাদমান পক্ষ, কলিঙ্গ রাজ্য, যুদ্ধের সঠিক কারণ সম্পর্কে রহস্য, যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বা পটভূমি বা কারণ, যুদ্ধের স্থান, যুদ্ধে হতাহত, যুদ্ধের বিশেষত্ব, যুদ্ধের পর নির্মমতা থেকে ধার্মিকতা, সম্রাট অশোকের ওপর কলিঙ্গ যুদ্ধের প্রভাব, যুদ্ধের পর সমৃদ্ধির যুগ, কলিঙ্গ যুদ্ধ সম্পর্কে আঞ্চলিক ইতিহাস, যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফলে, কলিঙ্গ যুদ্ধের ফল অশোকের ধর্মবিজয় নীতি, যুদ্ধের গুরুত্ব, যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে রোমিলা থাপারের সমালোচনা, যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে নতুন ব্যাখ্যা ও কলিঙ্গ যুদ্ধের অর্থনৈতিক ফলাফল।
রক্তক্ষয়ী কলিঙ্গ যুদ্ধ (Bloody Kalinga War)
ঐতিহাসিক যুদ্ধ | কলিঙ্গ যুদ্ধ |
তারিখ | আনুমানিক ২৬১ – আনুমানিক ২৬০ খ্রিস্টপূর্ব |
অবস্থান | কলিঙ্গ, ভারত |
বিবাদমান পক্ষ | মৌর্য সাম্রাজ্য ও কলিঙ্গ |
ফলাফল | মৌর্য বিজয় |
ভূমিকা :- মৌর্য সম্রাট অশোক ২৬১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে (মতান্তরে ২৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) কলিঙ্গ আক্রমণ করেন। কলিঙ্গ যুদ্ধে অসংখ্য জীবনহানির ঘটনায় অশোক মর্মাহত হন এবং গৌতম বুদ্ধ প্রচারিত বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে অহিংস নীতি প্রচারে মনোনিবেশ করেন।
কলিঙ্গ রাজ্য (Kalinga State)
মৌর্য সম্রাট অশোকের সময় কলিঙ্গ বলতে উড়িষ্যা ও গঞ্জাম জেলার কিছু অংশকে বোঝানো হত।
কলিঙ্গ যুদ্ধের সঠিক কারণ আজও রহস্য (The exact cause of the Kalinga War remains a mystery today)
এই কলিঙ্গ যুদ্ধের সঠিক কারণ জানা যায় না। সম্রাট অশোক কেন কলিঙ্গ আক্রমণ করেন তার সঠিক কারণ অশোকের শিলালিপিতেও পাওয়া যায় নি। ঐতিহাসিকরা পারিপার্শ্বিক প্রমাণ থেকে কারণ আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন।
কলিঙ্গ যুদ্ধের কারণ (Cause of Kalinga war)
- (১) নন্দ বংশ -এর আমলে কলিঙ্গ মগধ -এর অধীনে ছিল। পরে চন্দ্রগুপ্তের আমলে কলিঙ্গ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল বলে মনে করা হয়। প্লিনির বিবরণ থেকে জানা যায় যে, চন্দ্রগুপ্তের আমলে কলিঙ্গ স্বাধীন রাজ্য ছিল।
- (২) ডঃ ভাণ্ডারকরের মতে, বিন্দুসার -এর আমলে কলিঙ্গ দক্ষিণের চোল ও পান্ড্য রাজাদের সঙ্গে জোট বেঁধে তাঁর বিরুদ্ধে বাধা দেয়। অশোক দেখেন যে, মগধের অধীনস্থ অন্ধ্র, উত্তরে কলিঙ্গ এবং দক্ষিণে চোল ও পান্ড্যদের দ্বারা বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এ কারণে তিনি কলিঙ্গ আক্রমণ করেন।
- (৩) কলিঙ্গ রাজ্য দিন দিন তার সামরিক শক্তি বাড়িয়ে চলছিল। প্লিনির বিবরণ থেকে জানা যায় যে, কলিঙ্গের ৬০ হাজার পদাতিক, ১ হাজার অশ্বারোহী ও ৭০০ রণহস্তী ছিল। এরূপ একটা শক্তিকে প্রতিবেশী হিসাবে সহ্য করা অশোকের পক্ষে কঠিন ছিল।
- (৪) তিব্বতীয় বিবরণ থেকে জানা যায় যে, অশোক দক্ষিণ ভারতে যাওয়ার স্থল ও জলপথকে নিরঙ্কুশ করার জন্যে কলিঙ্গ জয়। করেন। রোমিলা থাপার এই বিষয়টিকে কলিঙ্গ যুদ্ধের আসল কারণ বলে মনে করেন।
- (৫) মগধের বাণিজ্য তখন তাম্রলিপ্ত হয়ে বঙ্গোপসাগরের পথে ব্রহ্ম, সুমাত্রা, জাভা পর্যন্ত চলত। কলিঙ্গ, মগধের এই সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ায়।
- (৬) ধারণা করা হয় যে, মৌর্য সম্রাট অশোকের কোন ভাই কলিঙ্গ রাজ্যে আশ্রয় নেন। তার প্রতিশোধ নেবার জন্য অশোক কলিঙ্গ আক্রমণ করেন।
- (৭) কলিঙ্গ একটি সমৃদ্ধ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। শান্তিপূর্ণ এবং দক্ষ শিল্পী ব্যক্তিদের স্থান ছিল কলিঙ্গ। কলিঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর এবং একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী ছিল।
- (৮) অশোকের পিতামহ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য পূর্বে কলিঙ্গ জয় করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। সম্রাট অশোক তারই প্রতিশোধ নিতে কলিঙ্গ আক্রমণ করেন।
এই সকল কারণে অশোক কলিঙ্গ অভিযান করেন।
কলিঙ্গ যুদ্ধের স্থান (Location of the Battle of Kalinga)
দয়া নদীর নিকটবর্তী ধৌলি পাহাড়ের কাছে মৌর্য ও কলিঙ্গ বাহিনীর মধ্যে ভীষণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। দু’দলের প্রচুর হতাহতের মাধ্যমে অশোক কলিঙ্গ জয় করতে সক্ষম হন।
কলিঙ্গ যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা (Casualties in the Kalinga War)
এই যুদ্ধে কলিঙ্গ বাহিনীর ১,০০,০০০ সেনা ও মৌর্য বাহিনীর ১০,০০০ সেনা নিহত হয় ও অসংখ্য নর-নারী আহত হয়। যুদ্ধের বীভৎসতা সম্রাট অশোককে বিষাদগ্রস্থ করে তোলে এবং তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে অহিংসার পথে সাম্রাজ্য পরিচালনের নীতি গ্রহণ করেন।
কলিঙ্গ যুদ্ধের বিশেষত্ব (The specialty of Kalinga war)
মানবজাতির রাজনৈতিক ইতিহাস সত্যিই যুদ্ধের একটি ইতিহাস এবং যুদ্ধ শেষে মানবতার ও শান্তি রক্ষার জন্য কলিঙ্গ যুদ্ধের মত অন্য কোন যুদ্ধ সফল হতে পারেনি।
কলিঙ্গ যুদ্ধের ফলে সম্রাট অশোকের নির্মমতা থেকে ধার্মিকতা (Emperor Ashoka’s ruthlessness to righteousness as a result of the Kalinga War)
ভারতের ইতিহাসে কোন যুদ্ধই কলিঙ্গ যুদ্ধ থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ, মানব ইতিহাসে আর কোনো যুদ্ধেই বিজয়ী ব্যক্তির হৃদয়কে এক নির্মম নিষ্ঠুরতা ও অহংকারী মনোভাব থেকে দৃষ্টান্তমূলক ধার্মিকতায় পরিবর্তিত করতে পারে নি।
সম্রাট অশোকের ওপর কলিঙ্গ যুদ্ধের প্রভাব (Effect of Kalinga War on Emperor Ashoka)
অশোকের কলিঙ্গ যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া তাঁর শিলালিপিতে উৎকীর্ণ হয়েছে। কলিঙ্গের যুদ্ধ অশোককে বৌদ্ধ ধর্মবিরোধী থেকে অহিংস এবং ধার্মিক-বিজয় (ধর্মের মাধ্যমে বিজয়) দ্বারা বাকি জীবনকে উৎসর্গ করতে অনুপ্রানিত করে।
কলিঙ্গ যুদ্ধের পর সমৃদ্ধির যুগ (Era of prosperity after the Kalinga war)
ভয়াবহ কলিঙ্গ বিজয়ী হওয়ার পর সম্রাট অশোক সাম্রাজ্যের সামরিক সম্প্রসারণ শেষ করেন। এরপর তিনি ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শান্তি, সাদৃশ্য ও সমৃদ্ধির যুগ শুরু করেন।
কলিঙ্গ যুদ্ধ সম্পর্কে আঞ্চলিক ইতিহাস (Regional history about the Kalinga war)
আঞ্চলিক মৌখিক ইতিহাস থেকে জানা যায় যুদ্ধের পর বৌদ্ধের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা তৈরি করেছে একটি মহিলা যিনি তার কাছে গিয়ে বলেন, “আপনার যুদ্ধের কারণে আমার বাবা, স্বামী, এবং পুত্রকে আমি হারিয়েছি। এখন আমি কি জন্য জীবিত থাকব?
কলিঙ্গ যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফল (A direct result of the Kalinga War)
- (১) ত্রয়োদশ শিলালিপিতে অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়-ক্ষতির বিবরণ দিয়েছেন। কলিঙ্গ রাজ্যের ১ লক্ষ লোক নিহত হয়, ১ লক্ষ লোক বন্দী বা বিতাড়িত হয়। তাছাড়া আরও বহুলোক নানাভাবে প্রাণ দেয়।
- (২) কেউ কেউ বলেন যে, প্লিনি কলিঙ্গের সৈন্য সংখ্যার যে বিবরণ দিয়েছেন, অশোকের দেওয়া সংখ্যা তার থেকে অনেক বেশী।
- (৩) ডঃ ভাণ্ডারকর বলেন যে, হয়ত কলিঙ্গবাসীদের পক্ষ নিয়ে চোল ও পান্ড্যরাও যুদ্ধ করে, তাই এত লোক হতাহত হয়।
- (৪) ডঃ রায়চৌধুরীর মতে, এই যুদ্ধে শুধুমাত্র কলিঙ্গের যোদ্ধারাই নিহত হয় নি। কলিঙ্গের সাধারণ অধিবাসীরাও নিহত হয়। তাই অশোকের দেওয়া নিহত-আহতের সংখ্যা এত বেশী। যাই হোক, এই যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে কলিঙ্গ মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
রক্তক্ষয়ী কলিঙ্গ যুদ্ধের ফলে অশোকের ধর্মবিজয় নীতি (Ashoka’s policy of religious conquest resulted in the bloody Kalinga War)
- (১) কলিঙ্গ যুদ্ধ ছিল মগধের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। “বিম্বিসার অঙ্গরাজ্য জয় করে মগধের রাজ্য বিস্তারের যে সূচনা করেন, অশোকের কলিঙ্গ জয়ের দ্বারা তার সমাপ্তি ঘোষিত হয়।”
- (২) কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক রাজ্য জয় নীতি ছেড়ে ধর্মবিজয় নীতি নেন। ধর্মবিজয় নীতির মূলে ছিল কলিঙ্গ যুদ্ধে অসংখ্য লোকের প্রাণহানি। এত লোকের প্রাণহানিতে অশোক অনুতাপে জর্জরিত হন। তাঁর ত্রয়োদশ শিলালিপিতে অশোক তাঁর অনুতাপের কথা বলেছেন।
- (৩) অশোক তাঁর মানসিক শান্তি লাভের জন্য ভগবান তথাগতের ধর্মমতের আশ্রয় নেন। বৌদ্ধধর্মের অহিংসা মন্ত্র তাঁর তাপিত চিত্তে শান্তি এনে দেয়। বৌদ্ধধর্মের অহিংসাকে তিনি সার করে রাজ্যজয় নীতি ত্যাগ করে ধর্মবিজয় নীতি নেন।
- (৪) সম্রাট অশোক বিহারযাত্রা ছেড়ে ধর্মযাত্রার ব্যবস্থা করেন। “ভেরীঘোষ”কে অর্থাৎ যুদ্ধের দামামাকে “ধৰ্ম্মঘোষে” বা ধর্ম প্রচারের দামামায় পরিণত করেন। এভাবে কলিঙ্গ যুদ্ধের পর মৌর্য সাম্রাজ্য একটি শান্তিবাদী অহিংস রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
কলিঙ্গ যুদ্ধের গুরুত্ব (Importance of Kalinga War)
ভারতের ইতিহাসে কোন যুদ্ধই কলিঙ্গ যুদ্ধ থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।
(ক) জনকল্যাণ
(১) কলিঙ্গ যুদ্ধ অশোকের রাজ্যশাসন নীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। এরপর তিনি জন-কল্যাণমূলক শাসননীতি গ্ৰহণ করেন। ষষ্ঠ শিলালিপিতে সম্রাট অশোক বলেন যে,
“সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ সাধন করা অপেক্ষা মহৎ কিছু নেই। এরজন্য সামান্য যে চেষ্টা আমি করছি তার উদ্দেশ্য হল জীবজগতের কাছে আমার ঋণ পরিশোধ করা।”
(সম্রাট অশোক)
(২) কলিঙ্গ যুদ্ধের পর সম্রাট অশোক বলেন যে, “সর্বে মুনিষে পজা মমা”। অর্থাৎ সকল মানুষ আমার সন্তান।
(৩) কৌটিল্য -এর অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে মগধের রাজা ছিলেন সর্বময় শক্তির আধার। সেই মগধে চন্দ্রগুপ্তের পৌত্র অশোক যখন নিজেকে প্রজাদের কাছে ঋণগ্রস্থ বলে মনে করেন তা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর ছিল।
(খ) ধর্মমহামাত্র নিয়োগ
- (১) অশোক তাঁর রাজ্য শাসন নীতির পরিবর্তনকে সফল করার জন্যে কয়েকটি শাসনতান্ত্রিক সংস্কার করেন। তিনি ধর্ম মহামাত্র নামে এক নতুন কর্মচারী শ্রেণী নিয়োগ করেন।
- (২) সম্রাট অশোক প্রজাদের আধ্যাত্মিক ও পারলৌকিক মঙ্গলের জন্য ধর্মমহামাত্রদের কাজ করার নির্দেশ দেন।
- (৩) তিনি রাজুক, যুত, মহামাত্র প্রভৃতি কর্মচারীদের তিন ও পাঁচ বছর অন্তর ‘অনুসংযান’ বা পরিক্রমায় বেরোতে নির্দেশ দেন।
(গ) জনসেবা
সম্রাট অশোক পথের ধারে কূপ খনন, বৃক্ষরোপণ প্রভৃতি কাজের মাধ্যমে জনসাধারণের দুঃখকষ্ট দূর করার জন্যে চেষ্টা করেন। তিনি মানুষ ও পশুর জন্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন।
(ঘ) জীব হত্যা নিষিদ্ধ
অশোক আদেশ দেন যে, জীবহত্যা ও প্রাণী হত্যা নির্বিচারে করা চলবে না। রাজপ্রাসাদে, দেবতার উদ্দেশ্যে পশুবলি নিষিদ্ধ হয়। যেখানে পান-ভোজন, নৃত্য-গীত হত তা তিনি খারাপ কাজ বলে ঘোষণা করেন।
(ঙ) ধর্মযাত্রা
তিনি বিহারযাত্রা বা শিকার যাত্রাকে ‘ধর্মযাত্রা’য় পরিণত করেন এবং যুদ্ধের ‘ভেরীর ঘোষ বা নিনাদকে ধর্ম প্রচারের ভেরীতে পরিণত করেন।
কলিঙ্গ যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে রোমিলা থাপারের সমালোচনা (Romila Thapar’s critique of the outcome of the Kalinga War)
রোমিলা থাপার প্রভৃতি ঐতিহাসিক কলিঙ্গ যুদ্ধের ফলে অশোকের রাজ্য শাসন নীতির কোন মৌলিক পরিবর্তন হয়েছিল একথা স্বীকার করেন না।
- (১) যদি অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধে প্রকৃতই অনুতপ্ত হতেন তবে তিনি কলিঙ্গবাসীদের কলিঙ্গ রাজ্য ফিরিয়ে দিতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।
- (২) সম্রাট অশোক ত্রয়োদশ শিলালিপিতে তাঁর অনুতাপের কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি কলিঙ্গ দেশে তাঁর ত্রয়োদশ শিলালিপি প্রচার না করে অন্য শিলালিপি প্রচার করেন। সম্ভবতঃ তিনি তাঁর দুর্বলতার কথা কলিঙ্গবাসীদের জানতে দেননি।
- (৩) রোমিলা থাপারের মতে, অশোক কলিঙ্গ জয়ের পর তাঁর যুদ্ধনীতি ত্যাগ করেন এজন্যে যে, তাঁর আর যুদ্ধের দরকার ছিল না। কলিঙ্গ জয়ের ফলে মৌর্য সাম্রাজ্যের সংহতি সম্পূর্ণ হয়েছিল।
- (৪) কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক সম্পূর্ণ অহিংসা নীতি গ্ৰহণ করেন নি। তিনি কোনো বিদ্রোহীকে ক্ষমা করেননি। রোমিলা থাপার বলতে চেয়েছেন যে, অশোকের এই ধর্মবিজয় নীতির উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধ ছাড়া অন্য উপায়ে সাম্রাজ্যের সংগঠনকে মজবুত করা।
কলিঙ্গ যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে নূতন ব্যাখ্যা (A new interpretation of the outcome of the Kalinga war)
সম্প্রতি রুশ গবেষক বনগার্ড লেভিন কলিঙ্গ যুদ্ধ ও অশোকের নীতি সম্পর্কে নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
- (১) লেভিন বলেন যে, কলিঙ্গ যুদ্ধের জন্যে অশোকের তথাকথিত অনুতাপের কথা আমরা ত্রয়োদশ শিলালিপি থেকেই জানতে পারি। কিন্তু তিনি তাঁর অনুতাপের উল্লেখযুক্ত ত্রয়োদশ লিপি কলিঙ্গ দেশে প্রচার করেন নি।
- (২) লেভিনের মতে, কলিঙ্গ যুদ্ধে প্রাণহানির ফলে অনুতপ্ত হয়ে আশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন এই প্রচলিত মত সন্দেহের ঊর্দ্ধে নয়। কারণ, তাঁর রাজত্বের ৭-১১ বছরের মধ্যে তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন।
- (৩) লেভিনের মতে, কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক তাঁর বলপ্রয়োগে রাজ্য বিস্তার নীতি ত্যাগ করেন, এই বহু প্রচলিত মত ঠিক নয়। কারণ অশোকের কলিঙ্গ লিপি প্রমাণ করে যে কলিঙ্গ যুদ্ধের পর এই দেশকে দখলে রাখতে তিনি মাঝে মাঝে কঠোর ব্যবস্থা নিতেন।
(৪) লেভিন বলেন যে, কলিঙ্গ যুদ্ধের পর সাম্রাজ্যের সংহতি রক্ষার জন্যে অশোক নুতন নীতি নেন। তাঁর সংস্কারগুলি এই উদ্দেশ্যেই প্রবর্তিত হয়।
কলিঙ্গ যুদ্ধের অর্থনৈতিক ফল (Economic consequences of the Kalinga war)
- (১) বস্তুবাদী ঐতিহাসিক ডি. ডি. কোশাম্বীর মতে, খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে বৈদিক সভ্যতা -এর পশুচারণকেন্দ্রিক অর্থনীতির চল ছিল না, এর স্থলে কৃষি-ভিত্তিক, খাদ্য উৎপাদনকারী অর্থনীতি দৃঢ় হয়।
- (২) অশোক বুঝতে পারেন যে, পাঞ্জাব থেকে পেন্নার নদী পর্যন্ত যে বিরাট ভূভাগ তাঁর শাসনে এসেছে তার জনসাধারণকে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনের নিশ্চিন্ত সুযোগ দিতে হলে তাঁকে যুদ্ধনীতি ছেড়ে সংহতি রক্ষার নীতি নিতে হবে।
উপসংহার :- মগধ তথা ভারত ইতিহাসে কলিঙ্গ যুদ্ধ এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই যুদ্ধের মাধ্যমে মগধ সাম্রাজ্যবাদের পরিসমাপ্তি ঘটে। এরপর মগধের ইতিহাসে সাম্য, মৈত্রী, সামাজিক প্রগতি ও ধর্ম প্রচারের এক নতুন যুগের সূচনা হয়।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “কলিঙ্গ যুদ্ধ (Kalinga War)” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যেকোনো প্ৰশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।
সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।
(FAQ) কলিঙ্গ যুদ্ধ (Kalinga War) সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
উড়িষ্যা ।
ত্রয়োদশ মুখ্যগিরি অনুশাসন ।
বিন্দুসারের আমলে কলিঙ্গ দক্ষিণের চোল ও পান্ড্য রাজাদের সঙ্গে জোট বাঁধলে অশোক দেখেন যে মগধের অধীনস্থ অঙ্গ, উত্তরে কলিঙ্গ এবং দক্ষিণে চোল ও পান্ড্যদের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে পড়েছে। এ কারণেই তিনি কলিঙ্গ আক্রমণ করেছিলেন।