হিদাসপিসের যুদ্ধ -এর সময়কাল, যুদ্ধে বিবাদমান পক্ষ, যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান, পটভূমি, যুদ্ধের কৌশল ও যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে জানবো।
প্রাচীন ভারতে হিদাসপিসের যুদ্ধ প্রসঙ্গে হিদাসপিসের যুদ্ধক্ষেত্র, আলেকজান্ডার ও রাজা পুরুর মধ্যে হিদাসপিসের যুদ্ধ, ঝিলমের যুদ্ধ বা হিদাসপিসের যুদ্ধের পটভূমি, হিদাসপিসের যুদ্ধে আলেকজান্ডার ও রাজা অম্ভির জোট গঠন, হিদাসপিসের যুদ্ধে আলেকজান্ডারের উদ্দেশ্য, হিদাসপিসের যুদ্ধে আলেকজান্ডারের সফল প্রতিপক্ষ, হিদাসপিসের যুদ্ধের পূর্বে প্রাক যুদ্ধ কৌশল, হিদাসপিসের যুদ্ধ, হিদাসপিসের যুদ্ধে রাজা পুরুর বীরত্ব প্রদর্শন, হিদাসপিসের যুদ্ধে পরাজিত রাজা পুরুর আত্মসমর্পণ, হিদাসপিসের যুদ্ধ শেষে রাজার প্রতি রাজার আচরণ, হিদাসপিসের যুদ্ধের পর নতুন শহর প্রতিষ্ঠা, হিদাসপিসের যুদ্ধের পর আলেকজান্ডারের ভারত ত্যাগ, হিদাসপিসের যুদ্ধে রাজা পুরুর পরাজয়ের কারণ ও হিদাসপিসের যুদ্ধ থেকে শিক্ষা।
ঝিলমের যুদ্ধ বা হিদাসপিসের যুদ্ধ
বিবাদমান পক্ষ | আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এবং পুরু |
সময়কাল | ৩২৬ খ্রিস্টপূর্ব |
অবস্থান | হিদাসপিস নদী (আধুনিক পাঞ্জাব, পাকিস্তান) |
ফলাফল | ম্যাসেডোনিয়ার জয় এবং পাঞ্জাব দখল |
ভূমিকা :- ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার এবং রাজা পুরু -র মধ্যে হিদাসপিসের যুদ্ধ হয়েছিল। প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করেও শেষ পর্যন্ত রাজা পুরু পরাজিত ও বন্দী হন।
হিদাসপিসের যুদ্ধের যুদ্ধক্ষেত্র
ভারতীয় উপমহাদেশের পাঞ্জাব অঞ্চলে (আধুনিক পাঞ্জাব, পাকিস্তান) ঝিলম নদীর তীরে (প্রাচীন গ্রীকদের কাছে হিদাসপিস নামে পরিচিত) এই যুদ্ধ হয়েছিল।
আলেকজান্ডারের ব্যয়বহুল হিদাসপিসের যুদ্ধ
বিজয়ী হলেও হিদাসপিসের যুদ্ধ ছিল আলেকজান্ডারের সবচেয়ে ব্যয়বহুল যুদ্ধ। পুরু এবং তার লোকদের দ্বারা প্রচণ্ড প্রতিরোধের ফলে আলেকজান্ডারের সম্মান জিতেছিল। যুদ্ধের পর তিনি পুরুকে তাঁর একজন সামন্ত হতে বলেছিলেন।
ঝিলমের যুদ্ধ বা হিদাসপিসের যুদ্ধের পটভূমি
- (১) ৩২৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আকিমেনিয় সাম্রাজ্যের শেষ বাহিনীকে পরাজিত করার পর সাম্রাজ্যকে আরও সম্প্রসারিত করার জন্য ৩২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শুরু হয় আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ।
- (২) ১০০০০ লোক নিয়ে ব্যাকট্রিয়াকে শক্তিশালী করার পর আলেকজান্ডার খাইবার গিরিপথ দিয়ে ভারত আক্রমণ শুরু করেন।
- (৩) অনেক বড় সৈন্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধে আনুমানিক ৪০০০০ পদাতিক এবং ৫০০০ অশ্বারোহী বাহিনী শত্রুকে ঘেরাও করার জন্য সময়মতো নদী পার হয়।
হিদাসপিসের যুদ্ধে আলেকজান্ডার ও রাজা অম্ভির জোট গঠন
আলেকজান্ডার তক্ষশীলা -র রাজা অম্ভির সাথে একটি জোট গঠন করেন।
হিদাসপিসের যুদ্ধে পুরুর বিরুদ্ধে জোট গঠন
হিদাসপিসের রাজা পুরুর বিরুদ্ধে তাদের বাহিনীকে একত্রিত করেছিল। কারণ, আলেকজান্ডারের আত্মসমর্পণের আদেশ প্রত্যাখ্যান করে পুরু যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
আলেকজান্ডারের উদ্দেশ্য
- (১) ভারতের পূর্ব দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য আলেকজান্ডার রাজা পুরুকে বশ করতে বাধ্য হয়েছিল। কারণ, এত শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে তার পাশে রেখে দিলে পরবর্তী যে কোনো শোষণ বিপন্ন হবে।
- (২) পুরুকে তার রাজ্য রক্ষা করতে হয়েছিল এবং আলেকজান্ডারের অগ্রগতি পরীক্ষা করার জন্য নিখুঁত স্থান বেছে নিতে হয়েছিল।
হিদাসপিসের যুদ্ধে আলেকজান্ডারের সফল প্রতিপক্ষ
ঝিলমের যুদ্ধ বা হিদাসপিসের যুদ্ধে হেরে গেলেও আলেকজান্ডারের সবচেয়ে সফল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিলেন রাজা পুরু।
হিদাসপিসের যুদ্ধের পূর্বে প্রাক যুদ্ধ কৌশল
- (১) আলেকজান্ডার তার শিবির স্থাপন করেন নদীর ডান তীরে ঝিলাম শহরের আশেপাশে। ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের বসন্তে পুরু ঝিলাম নদীর দক্ষিণ তীরে যেকোনো প্রতিরোধ প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন।
- (২) ঝিলাম নদী এতটা গভীর এবং দ্রুত ছিল যে, পার হবার যে কোনও প্রচেষ্টা আক্রমণকারী শক্তিকে ধ্বংস করে দেবে।
- (৩) অবশেষে আলেকজান্ডার তার শিবিরের প্রায় ২৭ কিমি (17 মাইল) উজানে একটি উপযুক্ত ক্রসিং খুঁজে পান এবং ব্যবহার করেন। এখানেই একটি জনবসতিহীন দ্বীপ নদীটিকে ভাগ করেছে।
- (৪) সৈন্যদের নেতৃত্ব দেওয়ার সময় তিনি দ্বীপে অবতরণ করেন এবং তার সৈন্যরা এপারে চলে যায়। তিনি শেষ পর্যন্ত ডান দিক থেকে পুরুর প্রধান বাহিনীর উভয় পাশে ভারতীয় অশ্বারোহী বাহিনীকে আক্রমণ করবেন।
- (৫) তিনি তার সেনাপতি ক্রেটারাসকে বেশিরভাগ সেনাবাহিনীর সাথে পিছনে রেখেছিলেন, নিশ্চিত করার জন্য যে পুরু তার নদী পার হবার সম্পর্কে জানতে পারবে না।
- (৬) তিনি একটি শক্তিশালী দল নিয়ে নদীটির উজানে পার হয়েছিলেন। গ্রীক ঐতিহাসিক আরিয়ানের মতে এই দলে ৬০০০ পদাতিক এবং ৫০০০ অশ্বারোহী ছিল। যদিও এটি সম্ভবত আরও বড় ছিল।
- (৭) আলেকজান্ডার নিঃশব্দে তার সেনাবাহিনীর একটি অংশকে উজানে নিয়ে যান এবং তারপরে সর্বোচ্চভাবে নদীটি অতিক্রম করেন।
- (৮) নদী পার হওয়ার পর আলেকজান্ডার তার সমস্ত ঘোড়সওয়ার এবং পদাতিক তীরন্দাজদের নিয়ে পুরুর শিবিরের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হন।
- (৯) বিপরীত তীরে ভারতীয় বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে হিদাসপিস পার হওয়া আলেকজান্ডারের একটি উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব।
হিদাসপিসের যুদ্ধ
অবশেষে দুই বাহিনী হিদাস্পিস বা ঝিলম নদীর তীরে মিলিত হয় এবং ঐতিহাসিক হিদাসপিসের যুদ্ধের জন্য নিজেদের সাজিয়ে নেয়। আলেকজান্ডারের সুচতুর রণকৌশল পুরুর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করে।
হিদাসপিসের যুদ্ধে পুরুর বীরত্ব দর্শন
বলা হয় পুরো যুদ্ধ জুড়ে, আলেকজান্ডার ক্রমবর্ধমান প্রশংসার সাথে পুরুর বীরত্ব দেখেছিলেন এবং বুঝতে পেরেছিলেন যে, পুরু বন্দী হওয়ার পরিবর্তে যুদ্ধে মারা যেতে চেয়েছিলেন।
হিদাসপিসের যুদ্ধে পরাজিত পুরুর আত্মসমর্পণ
শেষ পর্যন্ত পুরুর ব্যক্তিগত বন্ধু মেরোস তাকে আলেকজান্ডারের বার্তা শুনতে রাজি করান। ভারতের রাজা এগিয়ে আসছেন শুনে আলেকজান্ডার নিজেই তার সাথে দেখা করতে বেরিয়ে পড়েন এবং বিখ্যাত আত্মসমর্পণ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
হিদাসপিসের যুদ্ধের শেষে রাজার প্রতি রাজার আচরণ
আলেকজান্ডার যখন জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তিনি কীভাবে আচরণ করতে চান, তখন পুরু উত্তর দিয়েছিলেন “আমার সাথে এমন আচরণ করুন যেভাবে একজন রাজা অন্য রাজার সাথে আচরণ করবে”। মুগ্ধ হয়ে আলেকজান্ডার প্রকৃতপক্ষে তার সাথে একজন রাজার মতোই আচরণ করেছিলেন।
হিদাসপিসের যুদ্ধের পর নতুন শহর প্রতিষ্ঠা
যুদ্ধের পরে আলেকজান্ডার এই অঞ্চলে দুটি শহর প্রতিষ্ঠা করেন, একটি তার সাফল্যের স্মরণে Nicaea (গ্রীক বিজয়ের জন্য) নামক যুদ্ধের স্থানে এবং আরেকটি হিদাস্পিস নামক আলেকজান্দ্রিয়া বুসেফালাস নামে, তার বিশ্বস্ত পথচারীকে সম্মান জানাতে, যিনি এই যুদ্ধের পরই মারা যান।
আলেকজান্ডারের ভারত ত্যাগ
৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনী ধননন্দ -এর নন্দ সাম্রাজ্যের সীমানার কাছাকাছি পৌঁছেছিল। কিন্তু তার সেনাবাহিনী ক্রমাগত পদচারণা থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে যাওয়ার দাবি জানায়।
হিদাসপিসের যুদ্ধে পুরুর পরাজয়ের কারণ
- (১) পুরুর পরাজয়ের প্রধান কারণ ছিল আলেকজান্ডারের চতুর কৌশলের ব্যবহার এবং মেসিডোনীয়দের উচ্চতর শৃঙ্খলা ও প্রযুক্তি।
- (২) ভারতীয়রা যে রথ ব্যবহার করত তা গ্রীকদের অশ্বারোহী বাহিনী থেকে নিকৃষ্ট ছিল।
- (৩) রাজা পুরুর একটি ভাল সামরিক অবকাঠামো বা স্থায়ী সেনাবাহিনী ছিল না।
- (৪) ভারতীয় পদাতিক বাহিনী এবং অশ্বারোহী বাহিনী দুর্বল ছিল। ধাতব বর্ম ছিল না এবং তাদের তরবারি মেসিডোনিয়ানদের তুলনায় নিকৃষ্ট ছিল।
- (৫) পুরু নিজে উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হন এবং প্রতিপক্ষের চাল পাল্টানোর চেষ্টা করেন। তবে গ্রিস -এর ঐতিহাসিকরা একমত যে পুরু শেষ অবধি সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেছিলেন।
হিদাসপিসের যুদ্ধ থেকে শিক্ষা
মৌর্য সাম্রাজ্য -এর পরবর্তী শাসনের সময় কৌশলবিদ কৌটিল্য এই যুদ্ধকে একটি পাঠ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন এবং যুদ্ধের আগে সামরিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছিলেন। প্রথম মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী বজায় রেখেছিলেন।
উপসংহার :- এই যুদ্ধটি ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এর ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীন গ্রীক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের উন্মোচন হয়েছিল, যার ফলে গ্রিকো-বৌদ্ধ শিল্পের বিকাশ ঘটে, আর এর প্রভাব বহু শতাব্দী ধরে অব্যাহত ছিল।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “হিদাসপিসের যুদ্ধ” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যেকোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।
সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।
(FAQ) হিদাসপিসের যুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার ও পুরুর মধ্যে।
পাঞ্জাবের হিদাসপিস বা ঝিলম নদীর তীরে।
রাজা অম্ভি।