যবদ্বীপ

ঐতিহাসিক স্থান যবদ্বীপ বা জাভা দ্বীপ প্রসঙ্গে হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে বহু কাহিনী, চীনে দূত প্রেরণ, পল্লবদের রাজ্য প্রতিষ্ঠা, যবদ্বীপের রাজা পূর্ণবর্মা, যবদ্বীপে শৈলেন্দ্ররাজ্যের প্রভুত্ব, হিন্দু সভ্যতা নিষ্প্রভ, যবদ্বীপে বরবুদুরের মন্দির, যবদ্বীপের ধর্ম ও সামাজিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জানবো।

ঐতিহাসিক স্থান যবদ্বীপ বা জাভা দ্বীপ

ঐতিহাসিক স্থানযবদ্বীপ
নামের উল্লেখরামায়ণ
বিখ্যাত রাজাদেববর্মা
বিখ্যাত মন্দিরবরবুদুরের মন্দির
ধর্মহিন্দু ও বৌদ্ধ
ঐতিহাসিক স্থান যবদ্বীপ বা জাভা দ্বীপ

ভূমিকা :- রামায়ণে যবদ্বীপের উল্লেখ আছে। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে টলেমিও যবদ্বীপের নাম করেছেন।

যবদ্বীপে হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে বহু কাহিনী

কোন সময়ে প্রথম হিন্দুরা যবদ্বীপে গিয়ে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে তা অজ্ঞাত। এই বিষয়ে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। কিন্তু ইতিহাসের ভিত্তি হিসাবে সেগুলিকে গ্রহণ করা যায় না।

প্রাচীন যবদ্বীপের রাজার চীনে দূত প্রেরণ

চীনদেশীয় ইতিবৃত্তে পাওয়া যায় যে ১৩২ খ্রিষ্টাব্দে যবদ্বীপের রাজা দেববর্মা চীনে এক প্রতিনিধি পাঠান।

যবদ্বীপে পল্লবদের রাজ্য প্রতিষ্ঠা

সম্প্রতি চতুর্থ বা পঞ্চম শতাব্দীর পল্লব লিপিতে লিখিত রাজা মূলবর্মার এক ‘যুপশাসন’ পাওয়া গিয়েছে। এ থেকে মনে হয় ঐ সময়ে বা তার আগে পল্লবরা যবদ্বীপে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

হিন্দু রাজ্য যবদ্বীপের রাজা পূর্ণবর্মা

বাটাভিয়া প্রদেশে প্রাপ্ত সংস্কৃত ভাষায় লিখিত চারটি ‘শিলাশাসন’ থেকে সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে ষষ্ঠ শতাব্দীতে পূর্ণবর্মা নামে এক রাজা ঐ অঞ্চলে রাজত্ব করছিলেন। তাঁর রাজধানী ছিল তারুমা। তাঁর পিতামহ ছিলেন রাজর্ষি এবং পিতা সম্ভবত ছিলেন রাজাধিরাজ।

যবদ্বীপের রাজা পূর্ণবর্মার দ্বারা খাল খনন

তাঁর পিতা চন্দ্রভাগা নামে, এবং তিনিও তাঁর রাজত্বের ২২ বছর কালে গোমতী নদী নামে, ৬১২২ ধনুস (ধনস = ৪ হাত) লম্বা এক খাল খনন করেন এবং সেই উপলক্ষ্যে ব্রাহ্মণদের একহাজার গরু দক্ষিণা দেন। ঐ ‘শাসনে’ ভারতীয় মাস, তিথি এবং দৈর্ঘ্যের পরিমাপক ধনুসের উল্লেখ আছে।

হিন্দু রাজ্য যবদ্বীপে শৈলেন্দ্ররাজ্যের প্রভুত্ব

ঐ সময়ে পূর্ণবর্মার রাজ্য ভিন্ন যবদ্বীপের কতকাংশ শৈলেন্দ্র রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। পূর্ব-যবদ্বীপে তখন অন্য রাজা ছিলেন। শৈলেন্দ্রদের সঙ্গে এই অঞ্চলের রাজাদের অনেক যুদ্ধবিগ্রহ হয়। যবদ্বীপে শৈলেন্দ্রের প্রভুত্ব অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে নবম শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত ছিল।

সমস্ত যবদ্বীপেশ্বর

এর পরেও যবদ্বীপে একাধিক রাজা ছিলেন। কিন্তু যোড়শ শতাব্দীতে মজপহিটকে রাজধানী করে কৃতরাজস্ জয়বর্ধন সমস্ত যবদ্বীপের অধিপতি হন। তিনি নিজেকে ‘সমস্ত যবদ্বীপেশ্বর’ বলে ঘোষণা করেন।

যবদ্বীপে হিন্দু সভ্যতা নিষ্প্রভ

ষোড়শ শতাব্দীতে মুসলমান বিজয়ের ফলে যবদ্বীপ থেকে বাজবংশের এবং সঙ্গতিপন্ন বহু লোক নিজেদের সভ্যতা বজায় রাখবার জন্য বলীদ্বীপ-এ চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে যবদ্বীপ থেকে পনেরোশ বছরের হিন্দু সভ্যতা নিষ্প্রভ হয়।

প্রাচীন যবদ্বীপের হিন্দু সভ্যতা সম্বন্ধে ফা হিয়েনের মত

এই পনেরোশ বছর ধরে ভারতীয় সভ্যতা যবদ্বীপের উপর পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করেছিল। পঞ্চম শতাব্দীর প্রথম ভাগে লিখিত ফা-হিয়েনের বিবরণ থেকে হিন্দু সভ্যতা সম্বন্ধে আমরা প্রথম প্রামাণিক মত পাই। তাঁর মতে সেই সময়ে ব্রহ্মণ্যধর্ম এবং বিভিন্ন প্রকারের ভ্রান্ত মত যবদ্বীপে চলতি ছিল, কিন্তু বৌদ্ধ ধর্ম-এর প্রভাব উল্লেখযোগ্য ছিল না।

বৌদ্ধভিক্ষু গুণবর্মার যবদ্বীপ গমন

  • (১) এর অল্পকাল পরেই বিখ্যাত বৌদ্ধভিক্ষু গুণবর্মা (৩৬৮-৪০১ খ্রি) যবদ্বীপে গিয়ে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব বিস্তার করেন। গুণবর্মা কাশ্মীরের এক রাজবংশের পুত্র। বাল্যকাল থেকেই তিনি ধর্মভাবাপন্ন ছিলেন।
  • (২) ৩০ বছর বয়সে কাশ্মীরের রাজা নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। তখন গুণবর্মাকে সিংহাসন গ্রহণ করতে বলা হয়। কিন্তু তিনি রাজত্ব গ্রহণ না করে সিংহলে চলে যান এবং কয়েক মাস পরে চীনেই ৬৫ বছর বয়সে মৃত্যুমুখে পতিত হন। তিনি একজন ভালো চিত্রশিল্পীও ছিলেন।

যবদ্বীপে বরবুদুরের মন্দির

  • (১) যবদ্বীপে বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান কীর্তি শৈলেন্দ্রবংশের তৈরি বরবুদুরের মন্দির। শিল্পকলার দিক দিয়ে বিচার করলে বরবুদুর জগতের শ্রেষ্ঠ কীর্তিসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আসন পাওয়ার যোগ্য।
  • (২) ঐ মন্দিরের প্রথম গ্যালাবীব দেওয়ালের উৎকীরণ-চিত্র এবং ভাস্কর্য ‘ললিতবিস্তার’ নামক বুদ্ধ-এর জীবনী সম্বন্ধে লিখিত সংস্কৃত গ্রন্থের অবলম্বনে অঙ্কিত।

হিন্দু রাজ্য যবদ্বীপে ধর্ম

  • (১) মোটের উপর যবদ্বীপে বৌদ্ধ ধর্ম যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। কিন্তু বৌদ্ধধর্মের চেয়ে হিন্দুধর্মের প্রভাব বেশি ছিল। কাম্বোজচম্পার মতো যবদ্বীপের অধিকাংশ লোকও ছিল শৈব মতাবলম্বী। অধিকাংশ মন্দিরই শিবের।
  • (২) শিবকে সেখানেও ভারতবর্ষ-এর মতো রুদ্র ও কল্যাণময় মূর্তিতে অর্থাৎ মহাকাল বা ভৈরব এবং মহাদেব রূপে উপাসনা করত। যে সমস্ত মূর্তি পাওয়া গেছে তারও অধিকাংশ শিব বা তার পরিবারভূক্ত অন্যান্য দেবদেবীর। বহু গণেশ মূর্তি রয়েছে।
  • (৩) বিষ্ণুভক্তও সেখানে ছিল, কিন্তু তাদের সংখ্যা শৈব ও বৌদ্ধদের চেয়ে কম। ব্রহ্মার মূর্তি সংখ্যায় খুবই কম। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব এই তিনের একত্র সমাবেশে যে ত্রিমূর্তি তাও যবদ্বীপে পাওয়া গিয়েছে।
  • (৪) শৈব ও বৌদ্ধমতাবলম্বীরা সংখ্যায় বেশি ছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব বা সংঘর্ষ হয় নি বরং শিব ও বুদ্ধের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা সুস্পষ্ট, যার পরিপূর্ণ, রূপ দেখতে পাই বলীদ্বীপে। যিনি শিব তিনিই বুদ্ধ – এই মতই সেখানে প্রচলিত।

যবদ্বীপের প্রামবাননের হিন্দু মন্দির

প্রামবাননে অবস্থিত হিন্দু মন্দিরের উৎকীরণ-চিত্র বরবুদুরের চিত্রের চেয়ে নিকৃষ্ট নয়। ঐ সমস্ত চিত্রে লঙ্কা অভিযান পর্যন্ত রামায়ণের ঘটনাসমূহ অঙ্কিত হয়েছে।

প্রাচীন যবদ্বীপে পাল ও গুপ্তযুগের শিল্পের প্রভাব

  • (১) যবদ্বীপে ব্রোঞ্জের শিব, পার্বতী, মঞ্জুশ্রী, বোধিসত্ত্ব প্রভৃতির মূর্তি পাওয়া গেছে। এই সমস্ত মূর্তির উপর পালযুগের শিল্পের প্রভাব অত্যন্ত পরিস্ফুট। মগধ ও বাঙলার সঙ্গে যবদ্বীপের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।
  • (২) দেবপাল-এর রাজত্বের সময় যবদ্বীপের রাজা বালপুত্রদেব নালন্দায় একটি বৌদ্ধবিহার তৈরি করে দেন। রমেশ মজুমদারের মতে সমস্ত সুবর্ণদ্বীপের স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের উৎস গুপ্তযুগের শিল্পকলা।

যবদ্বীপের সাহিত্য ও সংস্কৃতি

  • (১) এই যবদ্বীপে শুধু যে সংস্কৃতচর্চাই হত তা নয়, রামায়ণ, মহাভারত যেমন ভারতবর্ষের সাহিত্যের প্রেরণা যুগিয়েছে, যবদ্বীপেও তেমনি। রামায়ণ যবদ্বীপের সাহিত্যে এক বিখ্যাত পুস্তক। মূল বাল্মিকী রামায়ণে সীতার বনবাস বা উত্তরকাণ্ড নেই। যবদ্বীপের রামায়ণেও তা নেই।
  • (২) একথা এখানে বলা বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে বাংলার কৃত্তিবাসী রামায়ণ রচিত হওয়ার অনেক আগে, ১০৯৪ খ্রিষ্টাব্দে যবদ্বীপের কবির ভাষায় রামায়ণ রচিত হয়। তারও আগে ৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে মহাভারতের এক সংস্করণ ঐ ভাষায় হয়।
  • (৩) মহাভারত অবলম্বনে দ্বাদশ শতাব্দীতে লিখিত ‘ভারত-যুদ্ধ’ যবদ্বীপের ‘ইলিয়ড’ নামে খ্যাত। এ ছাড়া ইন্দ্রবিজয়, পার্থযজ্ঞ, স্মারদহন প্রভৃতি পুস্তক রচিত হয়েছিল।

হিন্দু রাজ্য যবদ্বীপে ভারতীয় সামাজিক ব্যবস্থা

  • (১) ভারতীয় ধর্ম, সাহিত্য ও শিল্পকলার প্রভাবই যে শুধু যবদ্বীপে ছিল তা নয়। চতুর্বর্ণের ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় সামাজিক ব্যবস্থা সেখানে প্রচলিত ছিল। সেখানকার ধর্মশাস্ত্র ও প্রধানত মানবধর্মশাস্ত্রের দ্বারা প্রভাবান্বিত। অবশ্য স্থানীয় অবস্থান অনুযায়ী পরিবর্তন রয়েছে।
  • (২) যাজ্ঞবল্ক স্মৃতি ও অন্যান্য স্মৃতির পুস্তকও যবদ্বীপে চলতি ছিল। ভারতীয়দের মতো পান খাওয়ার প্রথা ছিল। নৃত্য ও বয়ঙ্গ বা ছায়ানাটক যবদ্বীপের সভ্যতার সুন্দর অলঙ্কারস্বরূপ। এই দুইয়ের মূলেও ভারতীয় প্রথা।

উপসংহার :- মোট কথা এক সময় যবদ্বীপকে ভারতের একটি প্রদেশ বলেই গণ্য করা যেতে পারত।

(FAQ) ঐতিহাসিক স্থান যবদ্বীপ বা জাভা দ্বীপ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. যবদ্বীপের উল্লেখ কোথায় আছে?

রামায়ণে।

২. যবদ্বীপের কোন রাজা চীনে দূত প্রেরণ করেন?

দেববর্মা।

৩. যবদ্বীপে বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান কীর্তি কি ছিল?

বরবুদুরের মন্দির।

৪. বরবুদুরের মন্দির কাদের আমলে তৈরি হয়?

শৈলেন্দ্র রাজবংশ।

Leave a Comment