নেপোলিয়ন বোনাপার্টের উত্থান সম্পর্কে বিস্ময়কর উত্তরণ, ইউরোপের ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন, কিংবদন্তি নেপোলিয়ন, পরস্পর বিরোধী মত, নতুন যুগে উত্তরণ, প্রথম জীবন, প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ, প্রিয় বিষয়, ফরাসি বাহিনীতে যোগদান, কর্সিকার স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান, ফরাসি সরকারের প্রতি বিদ্বেষ দূর, জেকোবিন দলের সমর্থক, তুলোঁ বন্দর পুনরুদ্ধার, ভাদেমিয়ার ঘটনা, ফরাসি সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ, ডিরেক্টরি শাসন, ইতালি অভিযান, পাঁচটি খণ্ডযুদ্ধ, অস্ট্রিয়া ও পোপের বিরুদ্ধে জয়ী, ক্যাম্পোফর্মিওর সন্ধি, জনপ্রিয়তা অর্জন, মিশরে ব্যর্থতা, বিজয়ী বীরের সম্মান, কনস্যুলেটের শাসন, নেপোলিয়নের যুগ ও ফরাসি জাতির সম্রাট উপাধি লাভ সম্পর্কে জানবো।
নেপোলিয়ন বোনাপার্টের উত্থান
ঐতিহাসিক ঘটনা | নেপোলিয়ন বোনাপার্টের উত্থান |
জন্ম | ১৫ আগস্ট, ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দ |
পিতামাতা | কার্লো বোনাপার্ট, লেটিজিয়া |
ইউরোপ-এর মুক্তিদাতা | নেপোলিয়ন বোনাপার্ট |
পিরামিডের যুদ্ধ | ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দ |
নীলনদের যুদ্ধ | ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দ |
ফরাসি জাতির সম্রাট | ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দ |
ভূমিকা :- নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ছিলেন ফরাসি বিপ্লব -এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান এবং বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রণনিপুণ সেনানায়ক। ইউরোপের ইতিহাসে তিনি এক বর্ণময় রোমান্টিক নায়ক ও কিংবদন্তি পুরুষ।
নেপোলিয়নের বিস্ময়কর উত্তরণ
অতি সাধারণ এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, কেবলমাত্র নিজ প্রতিভাবলে তিনি ফ্রান্স-এর সম্রাট পদ লাভ করেন। তাঁর এই উত্তরণ যেমন ছিল বিস্ময়কর, তেমনি অবিশ্বাস্য।
ইউরোপের ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন
১৭৯৯ থেকে ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ফ্রান্সের ভাগ্য নিয়ন্তা ছিলেন। তাঁর কার্যকলাপের ফলে ফ্রান্স এবং সমগ্র ইউরোপের ইতিহাসে নানা সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন দেখা দেয়।
কিংবদন্তি নেপোলিয়ন
তাঁর জীবন ও কীর্তিকাহিনি নিয়ে নানা কিংবদন্তি গড়ে উঠেছে, রচিত হয়েছে দুই লক্ষেরও বেশি জীবনী-গ্রন্থ এবং অসংখ্য পুস্তক-পুস্তিকা ও নিবন্ধ।
নেপোলিয়ন সম্পর্কে পরস্পর বিরোধী মন্তব্য
অনেকের কাছে তিনি ‘ফরাসি বিপ্লবের জাগ্রত প্রতিমূর্তি’—‘ফ্রান্স ও ইউরোপের মুক্তিদাতা”। আবার অনেকের কাছে তিনি ‘বিপ্লবের সংহারক’, ‘বিপ্লবের দানব’, ‘নরকের আবর্জনা’।
নতুন যুগে উত্তরণ
নানা পরস্পর-বিরোধী মতাদর্শ সত্ত্বেও অকপটে বলা যায় যে, ইউরোপের ইতিহাসে নেপোলিয়ন এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, যাঁর আবির্ভাব ফ্রান্স ও ইউরোপের ইতিহাসকে নতুন যুগে পৌঁছে দেয়।
নেপোলিয়নের প্রথম জীবন
১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট ইতালির অন্তর্গত ভূমধ্যসাগরের কর্সিকা দ্বীপের অ্যাজাকসিও নামক স্থানে ফরাসি জাতির নায়ক নেপোলিয়ন বোনাপার্ট জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল লেটিজিয়া এবং পিতার নাম ছিল কার্লো বোনাপার্ট। তাঁর পিতা পেশায় উকিল ছিলেন।
প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ
পর্বত-সঙ্কুল প্রাকৃতিক পরিবেশ নেপোলিয়নের তরুণ মনে সাহস ও চারিত্রিক দৃঢ়তা গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
নেপোলিয়নের পছন্দের বিষয়
ভলতেয়ার, মন্তেস্কু, রুশো প্রমুখ দার্শনিকদের রচনা, ইতিহাস, ভূগোল, গণিত ও দর্শন ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়।
ফরাসি বাহিনীতে নেপোলিয়নের যোগদান
তিনি ষোলো বছর বয়সে পিতৃহীন হন। কঠোর দারিদ্র্য তাঁকে বাস্তববাদী করে তোলে। ব্রিওনি ও প্যারিসের সামরিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা শেষ করে মাত্র সতেরো বছর বয়সে তিনি ফরাসি গোলন্দাজ বাহিনীর সাব-লেফটেন্যান্ট পদে যোগদান করেন।
কর্সিকার স্বাধীনতা আন্দোলনে নেপোলিয়নের যোগদান
প্রথম জীবনে তিনি ফরাসি সাম্রাজ্য-এর অধীনতা থেকে কর্সিকার মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন। পূর্বে এই দ্বীপটি ছিল জেনোয়ার অধীনে, পরে তাঁর জন্মের এক বৎসর পূর্বে ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দে তা ফরাসি সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। এই কারণে তিনি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে কর্সিকার স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান করেন।
ফ্রান্সের প্রতি নেপোলিয়নের বিদ্বেষ দূর
ফরাসি বিপ্লবের সময় ফ্রান্সের সংবিধান সভা কর্সিকাকে ফ্রান্সের একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ বা ডিপার্টমেন্টের মর্যাদা দিলে ফরাসি সরকারের প্রতি তাঁর বিদ্বেষ কেটে যায়।
জেকোবিন দলের সমর্থক নেপোলিয়ন
সেনাবাহিনীর অন্যান্য সহকর্মীর মতো তিনিও ফরাসি বিপ্লবকে স্বাগত জানান। ফরাসি রাজনীতিতে তিনি জেকোবিন দলের সমর্থক ছিলেন। ফরাসি বিপ্লব তাঁকে বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রের সন্ধান দেয়।
তুলোঁ বন্দর পুনরুদ্ধার
১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ বাহিনী ভূমধ্যসাগরের উপকূলে ফ্রান্সের অধীনস্থ তুলোঁ বন্দর অবরোধ করলে, অতর্কিত আক্রমণে তিনি তা পুনরুদ্ধার করেন। এর ফলে তিনি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে উন্নীত হন।
ভাদেমিয়ার ঘটনা
১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ই অক্টোবর রাজতন্ত্রের সমর্থক উচ্ছৃঙ্খল জনতা ফরাসি জাতীয় সভা আক্রমণ করলে স্বল্পসংখ্যক সৈনিকের সাহায্যে প্যারিসের রাস্তায় কামান দেগে তিনি জনতাকে ছত্রভঙ্গ করেন। জাতীয় সভা রক্ষা পায়। এই ঘটনা ‘ভাদেমিয়ার ঘটনা’ বা ‘অক্টোবরের ঘটনা” নামে পরিচিত। এর পুরস্কার-স্বরূপ তিনি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন এবং ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব লাভ করেন।
ফরাসি সমাজে নেপোলিয়নের প্রতিষ্ঠা লাভ
১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি এক সেনানায়কের বিধবা পত্নী যোসেফাইনকে বিবাহ করে ফরাসি সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
ডিরেক্টরি শাসন
ইতিমধ্যে ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে অক্টোবর ‘জাতীয় কনভেনশন’-এর কার্যকাল শেষ হয় এবং ‘ডিরেক্টরি’ (১৭৯৫-১৭৯৯ খ্রিঃ) নামে নতুন এক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। এই শাসনপর্বে দেশের অভ্যন্তরে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটে।
নেপোলিয়নের ইতালি অভিযান
বৈদেশিক ক্ষেত্রে তখন ফ্রান্স-বিরোধী প্রথম শক্তিজোট ভেঙে গেলেও ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও সার্ডিনিয়া তখনও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। নেপোলিয়ন এই শক্তিজোটের বিরুদ্ধে ইতালিতে যুদ্ধযাত্রা করেন। এই ইতালিতেই তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের সূচনা হয়। যেমন –
(১) পাঁচটি খণ্ডযুদ্ধ
তিনি ইতালিতে এক মাসেরও কম সময়ে পাঁচটি খণ্ডযুদ্ধে সার্ডিনিয়া-কে পরাজিত করেন। সার্ডিনিয়া সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হয় এবং এর ফলে স্যাভয় ও নিস ফ্রান্সের অধিকারে আসে। পার্মা, মডেনা এবং নেপলস্-এর শাসকেরা তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
(২) অস্ট্রিয়া ও পোপের বিরুদ্ধে জয়ী
তিনি উত্তর ইতালিতে অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করে লম্বার্ডি, ভেনিস ও মিলান দখল করেন। তিনি পোপের রাজ্য আক্রমণ করলে পোপ টলেন্টিনো-র সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হন।
ক্যাম্পো-ফর্মিওর সন্ধি
এরপর নেপোলিয়নের নেতৃত্বে ফরাসি বাহিনী অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার সন্নিকটে উপস্থিত হলে অস্ট্রিয়ার সম্রাট ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই অক্টোবর ক্যাম্পো-ফর্মিওর সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হন।
নেপোলিয়নের জনপ্রিয়তা অর্জন
ইতালি ও অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে এই চমকপ্রদ সাফল্যে ইউরোপে ফ্রান্সের মর্যাদা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়, অস্ট্রিয়ার শাসন থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত ইতালির জনসাধারণ নেপোলিয়নকে ‘মুক্তিদাতা’ বলে অভিনন্দন জানায় এবং তিনি ফ্রান্সে প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
মিশরে নেপোলিয়নের ব্যর্থতা
এরপর তিনি ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মিশর অভিযানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেখানে ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দের ২১শে জুলাই পিরামিডের যুদ্ধে জয়লাভ করলেও নীলনদের যুদ্ধে তিনি ইংরেজ নৌ-সেনাপতি নেলসনের হাতে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হন (১৭৯৮ খ্রিঃ)।
নেপোলিয়নের বিজয়ী বীরের সম্মান লাভ
তাঁর পরাজয়ের সংবাদ ফ্রান্সে পৌঁছানোর আগেই তিনি ফ্রান্সে প্রত্যাবর্তন করেন এবং সেখানে তিনি বিজয়ী বীরের সম্মান পান।
কনস্যুলেটের শাসন প্রবর্তন
ডিরেক্টরির শাসনাধীনে ফ্রান্সে তখন চরম বিশৃঙ্খলা চলেছে। জনগণ এই শাসন সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে সেনাবাহিনীর সাহায্যে তিনি ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দের ৯ই নভেম্বর ডিরেক্টরি শাসনের অবসান ঘটিয়ে ফ্রান্সে কনস্যুলেট (Consulate) নামে নতুন এক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।
নেপোলিয়নের যুগ
নেপোলিয়ন-সহ আরও দু’জন কনসালের উপর শাসনভার অর্পিত হয়। তিনি হলেন সর্বশক্তিমান প্রথম কনসাল। এইভাবে ফ্রান্স তথা ইউরোপের ইতিহাসে ‘Age of Napoleon’ বা ‘নেপোলিয়নের যুগ’ (১৭৯৯-১৮১৪ খ্রিঃ) শুরু হয়।
যাবজ্জীবন কনসাল নেপোলিয়ন
প্রথমে সংবিধান অনুসারে দশ বছরের জন্য কনসাল নিযুক্ত হন। ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে সংবিধান সংশোধন করে তাকে যাবজ্জীবনের জন্য কনসাল পদে নিযুক্ত করা হয়।
ফরাসি জাতির সম্রাট নেপোলিয়ন
১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে সিনেটের প্রস্তাব মতো গণভোটের মাধ্যমে তিনি ‘ফরাসি জাতির সম্রাট’ উপাধি ধারণ করেন। এইভাবে ফ্রান্সে আবার বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
উপসংহার:- ঐতিহাসিক রেড্ডাওয়ে বলেন যে, ১৭৯৯ থেকে ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইউরোপের ইতিহাস হল ফ্রান্সের ইতিহাস এবং ফ্রান্সের ইতিহাস হল নেপোলিয়নের কর্মময় জীবনের ইতিহাস।
(FAQ) নেপোলিয়ন বোনাপার্টের উত্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।
১৫ আগস্ট ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে ভূমধ্যসাগরের কর্সিকা দ্বীপে।
১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড ও নেপোলিয়ন নেপোলিয়ন ফরাসি জাতির।
১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে।