মিশরে ক্রীতদাস ব্যবস্থা

মিশরে ক্রীতদাস ব্যবস্থা প্রসঙ্গে মিশরের শ্রেণীবিভক্ত সমাজ, ক্রীতদাস প্রথা, ক্রীতদাস প্রথার বিতর্ক ও তার কারণ, ক্রীতদাস ব্যবসা, ক্রীতদাস সংগ্রহ, ক্রীতদাসদের কাজ, ক্রীতদাসদের অবস্থা ও মিশরের অর্থনীতিতে ক্রীতদাস প্রথার প্রভাব সম্পর্কে জানবো।

প্রাচীন মিশরে ক্রীতদাস ব্যবস্থা প্রসঙ্গে প্রাচীন মিশরের শ্রেণীবিভক্ত সমাজ, মিশরে ক্রীতদাস প্রথার বিতর্ক, মিশরে ক্রীতদাস ব্যবসা, মিশরে ক্রীতদাস সংগ্রহ, মিশরের ক্রীতদাসদের কাজ, মিশরের অর্থনীতিতে ক্রীতদাস প্রথার প্রভাব ও মিশরে ক্রীতদাসদের অবস্থা সম্পর্কে জানব।

মিশরে ক্রীতদাস ব্যবস্থা

ঐতিহাসিক ঘটনামিশরের ক্রীতদাস ব্যবস্থা
সমাজশ্রেণিবিভক্ত
অভিজাত শ্রেণিসম্রাট, রাজপরিবার, পুরোহিত
মধ্যবিত্ত শ্রেণিব্যবসায়ী, শিল্পী, কারিগর
নিম্নশ্রেণিদরিদ্র কৃষক, শ্রমিক
৯০ হাজার ক্রীতদাসতৃতীয় থুটমোস
মিশরে ক্রীতদাস ব্যবস্থা

ভূমিকা :- প্রাচীন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গাছ বা ক্রীতদাস কোথায় অবস্থিত ছিল তবে প্রাচীন মিশর-এ রোমান সভ্যতার মত ক্রীতদাস ব্যবস্থা এত ব্যাপক ছিল না।

প্রাচীন মিশরের শ্রেণিবিভক্ত সমাজ

প্রাচীন রোমান সমাজের মতো প্রাচীন মিশরীয় সমাজও ছিল শ্রেণিবিভক্ত। মিশরীয় সমাজ প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যথা  –

(১) অভিজাত শ্রেণি

মিশরীয় সম্রাট, রাজপরিবার, ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবার, পুরোহিত, ভিজিয়ার নামে উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার ও অন্যান্য উচ্চবিত্তরা ছিল অভিজাত শ্রেণিভুক্ত। মিশরীয় সমাজে তাদের সর্বাধিক প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল এবং তারা বিভিন্ন ধরনের বিশেষ সুযোগসুবিধা ভোগ করত।

(২) মধ্যবিত্ত শ্রেণি

মিশরের বিভিন্ন ব্যবসায়ী, শিল্পী, কারিগর, নির্মাতা, শিক্ষিত সম্প্রদায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারা মোটামুটি সুখে স্বাচ্ছন্দ্যেই জীবন অতিবাহিত করত।

(৩) নিম্ন শ্রেণি

নিম্ন শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল সেদেশের দরিদ্র কৃষক, শ্রমিক ও অন্যান্য মানুষ যারা কায়ক্লেশে দিনযাপন করত।

মিশরের ক্রীতদাসপ্রথা

  • (১) প্রাচীন রোমান সমাজের মতো প্রাচীন মিশরীয় সমাজেও ক্রীতদাস প্রথার বহুল প্রচলন ছিল। মিশরের ক্রীতদাসপ্রথা ছিল রোমান ক্রীতদাস- প্রথার চেয়েও প্রাচীন। ওল্ড টেস্টামেন্টে প্রাচীন মিশরে ক্রীতদাস প্রথার অস্তিত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে উল্লেখ আছে যে, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের দ্বিতীয়ার্ধে ইজরায়েলের বহু মানুষকে মিশরে ক্রীতদাসে পরিণত করা হয়েছিল।
  • (২) মিশরের ক্রীতদাসদের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা জানা না গেলেও সেদেশে ক্রীতদাসপ্রথা যে ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল তার বিভিন্ন প্রমাণ পাওয়া যায়। মিশরের ফ্যারাও তৃতীয় থুটমোস ক্যানন অভিযান করে ফেরার সময় প্রায় ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দিকে ক্রীতদাসে পরিণত করেছিলেন বলে জানা যায়।
  • (৩) অবশ্য মিশরের ক্রীতদাসদের বাস্তব অবস্থা প্রাচীন গ্রিস বা রোম-এর ক্রীতদাসদের থেকে পৃথক ছিল। প্রাচীন মিশরে ‘ক্রীতদাস’ বলতে সেই মানুষকে বোঝাত যিনি কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের সম্পত্তি হিসেবে সেই ব্যক্তি বা পরিবারের গোলামি বা দাসত্ব করতে বাধ্য। এই অর্থে প্রাচীন মিশরের ক্রীতদাসরা ছিল প্রভুর ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তবে সেখানকার ক্রীতদাসদের কিছু কিছু নাগরিক অধিকারও ছিল যা রোমের ক্রীতদাসদের ছিল না।

মিশরে ক্রীতদাসপ্রথা বিতর্ক

প্রসঙ্গত বলা দরকার যে, প্রাচীন মিশরের ক্রীতদাস প্রথা সম্পর্কিত কয়েকটি প্রশ্নে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক বা মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। এই বিতর্ক বা প্রশ্ন গুলি হল –

  • (১) প্রাচীন মিশরের ক্রীতদাসদের প্রকৃত অর্থে ক্রীতদাসের পর্যায়ভূক্ত করা যায় কি না,
  • (২) তাদের ক্রীতদাসের সমপর্যায়ভুক্ত করলেও মিশরের ক্রীতদাসপ্রথা সত্যিই সুতীব্র আকার ধারণ করেছিল কি না,
  • (৩) মিশরের ক্রীতদাসপ্রথার প্রকৃতি বা স্বরূপ কেমন ছিল,
  • (৪) সেদেশের সামাজিক কাঠামোয় তথাকথিত এই ক্রীতদাস ব্যবস্থা কীভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল প্রভৃতি।

মিশরে ক্রীতদাসপ্রথা বিতর্কের কারণ

মিশরের ক্রীতদাস ব্যবস্থা সম্পর্কে উক্ত বিতর্কের বেশ কয়েকটি কারণ আছে। যেমন –

(১) ক্রীতদাস ও সাধারণ ভৃত্য আলাদা করা অসম্ভব

মিশরের ক্রীতদাস ও সাধারণ ভৃত্যদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের কোনো সুনির্দিষ্ট উপায় ছিল না বলে তাদের পৃথকভাবে চেনা যেত না।

(২) ক্রীতদাস ও সাধারণ মানুষ আলাদা করা অসম্ভব

মিশরের প্রাচীন শিল্প নিদর্শনগুলিতে যেসব মানুষজন সম্পর্কিত চিত্র বা ভাস্কর্য রয়েছে তাতে সেখানকার সাধারণ মানুষদের থেকে ক্রীতদাসদের পৃথক করে চেনার কোনো উপায় নেই।

(৩) পিরামিড নির্মাণের সময়কাল

পণ্ডিতরা একদা মনে করতেন যে, ক্রীতদাসরাই প্রাচীন মিশরের পিরামিড ও অন্যান্য বৃহদায়তন অট্টালিকাগুলি নির্মাণ করেছিল। কিন্তু বর্তমান কালের বহু পণ্ডিত এই অভিমতের বিরোধিতা করে বলেছেন যে, পিরামিড নির্মাণের পরবর্তীকালে মিশরে ক্রীতদাসপ্রথার প্রসার ঘটেছিল। মিশরে মধ্য রাজতন্ত্রের (২০৫০-১৬৫০ খ্রি.পূ.) পূর্বে ক্রীতদাসপ্রথার অস্তিত্বের বিশেষ প্রমাণ পাওয়া যায় না। অথচ সেদেশে আদি রাজতন্ত্রের (২৬৮৬-২১৮১ খ্রি.পূ.) সময় থেকেই পিরামিড নির্মাণ শুরু হয়।

(৪) নির্মাণ কাজে অবসর সময়ের কৃষক

বর্তমান কালে মনে করা হয় যে, মিশরের কৃষকরা তাদের কৃষিকাজ বন্ধ থাকার মরসুমে সেদেশের পিরামিড, বিশালাকার স্থাপত্য ও জলপ্রণালীগুলি নির্মাণে শ্রম দিত।

মিশরে ক্রীতদাস ব্যাবসা

  • (১) বিতর্ক সত্ত্বেও অধিকাংশ পণ্ডিত মনে করেন যে, প্রাচীন মিশরে ক্রীতদাস ব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল। তবে মিশরের ক্রীতদাসদের জীবন রোমের ক্রীতদাসদের মতো ততটা দুর্বিষহ ছিল না। রোমের মতো ব্যাপক আকারে না হলেও প্রাচীন মিশরেও ক্রীতদাস ক্রয়বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে দাস বাজার গড়ে উঠেছিল এবং ক্রীতদাস ক্রয়বিক্রয় একটি লাভজনক ব্যাবসা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
  • (২) মূলত ধনীরাই মিশরে ক্রীতদাস ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। নয়া রাজতন্ত্রের যুগ (১৫৮০-১০৮৫ খ্রি.পূ.) থেকে মিশরে ক্রীতদাস ব্যাবসার শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল এবং তা আন্তর্জাতিক চরিত্র লাভ করেছিল। বিদেশের বাজারে মিশরের ক্রীতদাসদের যথেষ্ট চাহিদা ছিল। বিশেষ গুণসম্পন্ন মিশরীয় ক্রীতদাসদের বিদেশে বিক্রি করা হত। মিশরে ক্রীতদাসের চেয়ে ক্রীতদাসীর মূল্য বেশি ছিল।

মিশরে ক্রীতদাস সংগ্রহ

প্রাচীন মিশরে বিভিন্ন উপায়ে ক্রীতদাস সংগ্রহ করা হত। এই উপায়গুলি ছিল –

(১) যুদ্ধবন্দি

মিশরীয় সেনারা পরাজিত শত্রুসৈন্যদের বন্দি করে ক্রীতদাসে পরিণত করত। শত্রুপক্ষের পরাজিত সৈন্যদের সঙ্গে পরাজিত দেশের বহু সাধারণ বা অসামরিক নাগরিককেও বন্দি করে ক্রীতদাসে পরিণত করা হত। যুদ্ধবন্দিদের স্ত্রী এবং সন্তানরাও ক্রীতদাসে পরিণত হত।

(২) দারিদ্র্য

প্রাচীন রোমান সমাজের মতো মিশরীয় সমাজেও কোনো কোনো দরিদ্র পিতামাতা অভাবের তাড়নায় নিজেদের অথবা নিজ সন্তানদের ক্রীতদাস হিসেবে ধনী ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি করে দিত। প্রধানত প্রভুর অধীনে দাসত্ব করে দুটো খাদ্যের সংস্থান করতেই কোনো কোনো দরিদ্র ব্যক্তি নিরুপায় হয়ে এই পথ বেছে নিত।

(৩) জন্মসূত্রে ক্রীতদাস

ক্রীতদাসের সন্তান-সন্ততি জন্মসূত্রে ক্রীতদাসে পরিণত হত। জন্মসূত্রে ক্রীতদাস হওয়া এসব সন্তানরা তাদের পিতামাতার প্রভুর অধীনেই দাসত্ব করত। শৈশব থেকে ক্রীতদাসে পরিণত হওয়া এসব সন্তানদের ওপর তাদের পিতামাতার কোনো অধিকার থাকত না ।

(৪) ঋণ পরিশোধে অক্ষমতা

কখনো-কখনো কোনো ঋণগ্রহীতা দীর্ঘদিন ধরে মহাজন বা ঋণদাতার ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে ঋণদাতা সেই ঋণী ব্যক্তিকে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে নিজের আর্থিক ক্ষতি মিটিয়ে নিত।

(৫) ধর্মীয় উদ্দেশ্য

কোনো কোনো মানুষ ধর্মীয় কারণে, বিশেষ করে পুণ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় ক্রীতদাসত্ব বরণ করত। কোনো কোনো নারী নিজেকে ক্রীতদাসী হিসেবে মন্দিরে উৎসর্গ করত। এরূপ উৎসর্গীকৃত ক্রীতদাসীরা ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করত যে, “আমি, আমার সন্তান-সন্ততি এবং সন্তানের সন্তান-সন্ততি তোমার ভৃত্য। আমি কখনও তোমার কাছ থেকে দাসত্ব মুক্ত হতে চাই না। তুমিই আমায় রক্ষা করবে, নিরাপত্তা দেবে।”

(৬) অপহরণ

কোনো কোনো সময় মিশরীয় বা পুরুষ মহিলাকে নদী বা সমুদ্রের উপকূল বা গ্রামের বাইরে থেকে অপহরণ করে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হত। এছাড়া সুযোগ পেলে মিশরে ভ্রমণ করতে আসা বিদেশিদেরও অপহরণ করে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হত।

(৭) আইন ভঙ্গের শাস্তি

মিশরে রাষ্ট্রীয় আইন ভঙ্গকারী ব্যক্তিকে বিভিন্ন ধরনের শাস্তি প্রদান করা হত। এর মধ্যে অন্যতম শাস্তি হিসেবে কোনো কোনো সময় আইন ভঙ্গকারী অপরাধীকে ক্রীতদাসে পরিণত করা হত ।

(৮) ক্রীতদাস আমদানি

উক্ত বিভিন্ন উপায়ে মিশরে যত সংখ্যক ক্রীতদাস সৃষ্টি হত তা মিশরীয় সমাজের প্রয়োজনীয় ক্রীতদাসের চাহিদা মেটাতে পারত না। ফলে লিবিয়া, মিরো, কুশ প্রভৃতি অঞ্চল থেকে বিপুল সংখ্যক ক্রীতদাস মিশরে আমদানি করা হত।

মিশরে ক্রীতদাসদের কাজ

প্রাচীন মিশরের ক্রীতদাসরা তাদের প্রভুর এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন কাজকর্ম করে দিত। মিশরের ক্রীতদাসদের নিম্নলিখিত বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে হত। যেমন –

(ক) গৃহকাজ

মিশরের ক্রীতদাসদের মধ্যে অধিকাংশই বিভিন্ন পরিবারে গৃহভৃত্য হিসেবে নিযুক্ত থাকত। তারা গৃহভৃত্য হিসেবে তাদের প্রভুর গৃহ পরিষ্কার, উদ্যান পরিচর্যা, রান্নাবান্না এবং পরিবারের নিত্যদিনের অন্যান্য যাবতীয় কাজকর্ম করত। ক্রীতদাসরা পরিবারের যাবতীয় কাজকর্ম করে দেওয়ার ফলে তাদের প্রভুরা অত্যন্ত সুখেস্বাচ্ছন্দ্যে ও বিলাসিতায় দিন যাপন করতে পারত।

(খ) কৃষিকাজ

মিশরের ক্রীতদাসরা তাদের প্রভুর কৃষিকাজেও নিযুক্ত থাকত। তাদের শ্রমে মিশরের উর্বর কৃষিজমিতে প্রচুর ফসল উৎপাদিত হত। খাদ্যশস্য এবং বাণিজ্যপণ্য উভয় ধরনের উৎপাদনকাজেই মিশরের ক্রীতদাসরা নিযুক্ত থাকত। তারা প্রভুর হয়ে নদী থেকে মাছও ধরত। উদ্‌বৃত্ত কৃষিপণ্য ও মাছ বিদেশের বাজারে রপ্তানি করে মিশরের যথেষ্ট অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঘটেছিল।

(গ) শ্রমিকের কাজ

  • (১) মিশরের বিভিন্ন খনি থেকে খনিজ পদার্থ উত্তোলনের কাজে প্রচুর ক্রীতদাস নিযুক্ত থাকত। মিশরের বিপদসংকুল নুবিয়া ও সিনাই-এর সোনা ও তামার খনি-সহ অন্যান্য ধাতুর খনিগুলিতে বহু ক্রীতদাস শ্রমিক কাজ করত। ক্রীতদাসদের কঠোর শ্রমে উত্তোলিত এইসব মূল্যবান খনিজ সম্পদ মিশরের আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটিয়েছিল।
  • (২) বিপদসংকুল ও অস্বাস্থ্যকর খনিগুলিতে কাজ করার সময় জলের অভাবে এবং মরুভূমির প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে প্রচুর ক্রীতদাসের মৃত্যু হত। খনিতে কাজ করা ছাড়াও বহু ক্রীতদাস নীলনদের নুড়ি-পাথর পরিষ্কার করে নদীকে নৌ চলাচলের উপযোগী করার কাজে নিযুক্ত থাকত। বহু ক্রীতদাস নির্মাণ কাজে যুক্ত ছিল।

(ঘ) অভিজাত পরিবারে কাজ

  • (১) বিভিন্ন ক্রীতদাস অনেক অভিজাত ও ধনী পরিবারে কাজের দায়িত্ব সামলাত। তারা ফ্যারাও, অভিজাত ও পুরোহিতদের স্থাবর সম্পত্তির দেখাশোনা করত। এরুপ কাজের দায়িত্বে থাকা ক্রীতদাসরা মিশরের কৃষকদের চেয়েও সুখে দিনযাপন করত।
  • (২) অভিজাত পরিবারের সান্নিধ্যে থাকায় এইসব ক্রীতদাসের সন্তানরা কখনো কখনো বিশেষ মেধা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে প্রভুর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠত। সেক্ষেত্রে ক্রীতদাসরা বিভিন্ন উচ্চ সরকারি পদ লাভের সুযোগ পেত এবং দাসত্ব থেকে মুক্তিলাভের পর পূর্বতন প্রভুর পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কও স্থাপন করতে পারত।

(ঙ) ক্ষুদ্র শিল্পের কাজ

  • (১) ক্রীতদাসরা বিভিন্ন কুটিরশিল্পের কাজেও নিযুক্ত থাকত। তারা শণের চাষ করত এবং তা থেকে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করত। ক্রীতদাসীরা সুতো কাটত এবং বস্ত্র বুনত। অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষুদ্র শিল্পের কাজেও ক্রীতদাসরা নিযুক্ত থাকত। খনি থেকে উত্তোলিত ধাতু দিয়ে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরি হত।
  • (২) ক্রীতদাসদের শিল্পোৎপাদনের ফলে মিশরের কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গে শিল্প অর্থনীতির বিকাশ ঘটতে শুরু করেছিল এবং দেশের আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটেছিল। পরবর্তীকালে প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতির ফলে শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল।

(চ) সামরিক কাজ

মিশরের বহু ক্রীতদাস ছিল শত্রুপক্ষের যুদ্ধবন্দি। যোদ্ধা হিসেবে তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল। ফলে বহু ক্রীতদাসকে মিশরের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হয়েছিল। এ ছাড়া সম্রাটের দেহরক্ষী বা রাজপরিবারের পাহারাদার হিসেবেও বহু ক্রীতদাস কাজ করত।

(ছ) হিসাবরক্ষকের কাজ

মিশরের বেশ কিছু ক্রীতদাস তাদের প্রভুর ব্যাবসা ও অন্যান্য কাজে হিসাবরক্ষক বা করণিক হিসেবে কাজ করত। ক্রীতদাসের মাধ্যমেই প্রভুর ব্যাবসাবাণিজ্য পরিচালিত হত। ক্রীতদাস সততা ও দায়িত্বের সঙ্গে প্রভুর ব্যাবসা সামলাত।

(জ) শিল্পীর কাজ

মিশরের কোনো কোনো ক্রীতদাস নৃত্য বা সংগীত কলার সঙ্গেও যুক্ত ছিল। শিল্পী হিসেবে তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের শিল্পকর্ম প্রদর্শন করে দর্শকদের মনোরঞ্জন করত। শিল্পকর্ম থেকে উপার্জিত অর্থ তারা প্রভুর হাতে তুলে দিত।

মিশরে ক্রীতদাসদের অবস্থা

প্রাচীন মিশরের ক্রীতদাসদের অবস্থা কতটা শোচনীয় ছিল বা প্রভুরা তাদের অধীনস্থ ক্রীতদাসদের সঙ্গে কীরূপ আচরণ করত তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র থেকে এবিষয়ে পরস্পরবিরোধী তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। বস্তুতপক্ষে, প্রাচীন রোমে ক্রীতদাস বলতে যা বোঝাত প্রাচীন মিশরে তা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মিশরীয় ক্রীতদাসদের অবস্থা এবং তাদের প্রতি প্রভুদের আচরণ নীচে আলোচনা করা হল –

(ক) মোটামুটি সুখকর অবস্থা

মিশরীয় ক্রীতদাসদের অবস্থা গ্রিস বা রোমের ক্রীতদাসদের চেয়ে অনেক বেশি সুখকর ছিল বলে কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন। মিশরের প্রাচীন শিল্পনিদর্শন গুলিতে যেসব মানুষজনের চিত্র ও ভাস্কর্য পাওয়া যায় সেগুলিতে ক্রীতদাসদের চরম দুর্দশাগ্রস্ত জীবনের সন্ধান পাওয়া যায় না। অনেক পণ্ডিত মনে করেন যে, মিশরে যাদের ক্রীতদাস বলে মনে করা হয়। তারা ছিল আসলে ভৃত্য। মিশরের অধিকাংশ ক্রীতদাসই বিভিন্ন স্বাধীন নাগরিকের বাড়িতে গৃহভৃত্য হিসেবে কাজ করত। প্রভু ইচ্ছা করলে অর্থের বিনিময়ে তার অধীনস্থ ক্রীতদাসকে পরিবর্তন করতে পারত।

(খ) প্রভূ-ক্রীতদাসের বৈবাহিক সম্পর্ক

মিশরীয় প্রভুরা তাদের অধীনস্থ ক্রীতদাসদের সঙ্গে যথেষ্ট সদয় ব্যবহার করত। কখনো কখনো তা সন্তানস্নেহের পর্যায়ে পৌঁছে যেত। ক্রীতদাসরা কখনো-কখনো তাদের প্রভুর কন্যা বা অন্য কোনো মহিলাকে বিবাহ করতে পারত বলে জানা যায়। একজন নাপিত নিজ কন্যাকে তাঁর অধীনস্থ এক ক্রীতদাসের সঙ্গে বিবাহ দিয়েছিলেন এবং সেই ক্রীতদাসকে নিজের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করেছিলেন বলে জানা যায়।

(গ) ফ্যারাও-এর ব্যক্তিগত সম্পত্তি

মিশরের সকল যুদ্ধবন্দি ক্রীতদাস সেদেশের সম্রাট অর্থাৎ ফ্যারাও-এর ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হত বলে মনে করা হয়। সম্রাটের নিজস্ব সম্পত্তি হওয়ায় সেইসব ক্রীতদাস অন্যত্র বিক্রি করা হত না বা তাদের সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করা হত না। অবশ্য ফ্যারাও সেনাপ্রধান বা পুরোহিতকে উপহার হিসেবে ক্রীতদাস প্রদান করতেন। তবে, সম্রাটের অধীনস্থ হওয়ায় এইসব ক্রীতদাসের জীবন অত্যন্ত দুর্বিষহ বা কষ্টকর ছিল না।

(ঘ) অভিজাত পরিবারের সুখী ক্রীতদাস

মিশরের বিভিন্ন অভিজাত ও ধনী পরিবারে কর্মরত ক্রীতদাসরা তাদের প্রভুর অধীনে যথেষ্ট সুখেস্বাচ্ছন্দ্যেই জীবন কাটাত বলে মনে করা হয়। অভিজাত বা ধনী পরিবারের এসব ক্রীতদাস অন্যান্য ক্রীতদাসের তুলনায় অনেক ভালো খাদ্য, পোশাক ও অবসর যাপনের সুযোগ পেত। প্রভুর আর্থিক সমৃদ্ধির কারণে তার অধীনস্থ ক্রীতদাসদের ওপর তীব্র শোষণ চালানোর বিশেষ প্রয়োজন পড়ত না। গৃহশিক্ষক, সুদক্ষ শিল্পী প্রভৃতি পেশার সঙ্গে যুক্ত শিক্ষিত ক্রীতদাসরা মিশরে কখনোই সীমাহীন দুর্দশার শিকার হয় নি।

(ঙ) স্বাধীনতা

রোমান সভ্যতায় ক্রীতদাসদের কোনো স্বাধীনতা না থাকলেও মিশরের ক্রীতদাসরা বেশ কিছু স্বাধীনতা ভোগ করত। তারা কিছু সম্পত্তি ভোগদখল করতে পারত এবং মিশরের স্বাধীন নাগরিকদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারত। একজন নাপিত নিজ কন্যাকে তাঁর অধীনস্থ ক্রীতদাসের সঙ্গে বিবাহ দিয়ে সেই ক্রীতদাসটিকে নিজের যাবতীয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করেছিলেন।

(চ) দুর্বিষহ জীবন

অবশ্য কোনো কোনো মিশরীয় ঐতিহাসিক তথ্য থেকে সেদেশের ক্রীতদাসদের দুর্বিষহ জীবনের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন  –

  • (১) সেখানকার ক্রীতদাসরা গৃহভৃত্য হিসেবে দিবারাত্র পরিবারের যাবতীয় কাজ করত, বিপদসংকুল খনিগর্ভে খনিজ উৎপাদনের কাজ করত, বিশালাকার অট্টালিকা, পিরামিড-সহ অন্যান্য পরিশ্রমসাধ্য নির্মাণকার্যগুলি সম্পন্ন করত ইত্যাদি। সিনাই-এর তামার খনিতে কাজ করতে করতে বহু ক্রীতদাসের মৃত্যু হয়েছিল।
  • (২) পরিশ্রমসাধ্য যাবতীয় কাজগুলি করে দিয়ে মিশরের ক্রীতদাসরা সেদেশের সাধারণ নাগরিকদের জীবনে বাড়তি সুখস্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে আসত।
  • (৩) মিশরের শিশু ক্রীতদাস সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায় যে, “মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার জন্যই দাস-শিশু জন্মগ্রহণ করে। শিশুটি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর অতিরিক্ত পরিশ্রমে তার শরীর ভেঙে যায়।”

মিশরের অর্থনীতিতে ক্রীতদাসপ্রথার প্রভাব

মিশরের অর্থনীতিতে ক্রীতদাস প্রথার বিভিন্ন প্রভাব পড়েছিল। যেমন –

(১) কার্য সম্পাদন

মিশরের কৃষি, শিল্প ও পরিশ্রমসাধ্য নির্মাণ কাজগুলি ক্রীতদাসদের দ্বারাই সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিল।

(২) অর্থনৈতিক অগ্রগতি

ক্রীতদাসদের শ্রমের ফলে মিশরের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর ফলে একদিকে যেমন মিশরের রপ্তানি বাণিজ্য বেড়েছিল, অন্যদিকে তেমনি সেদেশের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল।

(৩) অর্থের স্থানান্তর

বিদেশ থেকে বহু ক্রীতদাস ক্রয় করে মিশরে আমদানির ফলে মিশরের প্রভূত অর্থ বিদেশে চলে গিয়েছিল। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে মিশরের যথেষ্ট আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল।

(৪) কর্মবিমুখতা

মিশর ক্রীতদাসদের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়লে সেদেশের স্বাধীন নাগরিকরা দীর্ঘদিন ধরে অলসভাবে জীবন কাটিয়ে কর্মবিমুখ হয়ে পড়েছিল। পরবর্তীকালে দেশের অর্থনীতিতে এর ক্ষতিকারক প্রভাব পড়েছিল।

উপসংহার :- প্রাচীন মিশরে ক্রীতদাস প্রথার বহুল প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। এমনকি এই দাস প্রথা ছিল রোমান সভ্যতার দাস প্রথার চেয়েও প্রাচীন। তবে রোমের তুলনায় মিশরের ক্রীতদাসদের অবস্থা তুলনায় ভালো ছিল।

(FAQ) মিশরে ক্রীতদাস ব্যবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. প্রাচীন মিশরীয় সমাজ কটি ভাগে বিভক্ত ছিল?

তিনটি।

২. তৃতীয় থুটমোস কতজন বন্দীকে ক্রীতদাসে পরিণত করেন?

৯০ হাজার।

৩. মিশরের অভিজাত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন কারা?

সম্রাট, রাজপরিবার, পুরোহিত, ভিজিয়ার।

৪. মিশরের মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল কারা?

ব্যবসায়ী, শিল্পী, কারিগর।

৫. মিশরের নিম্নশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল কারা?

দরিদ্র কৃষক, শ্রমিক।

অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি

Leave a Comment