মারাঠা বীর যোদ্ধা শিবাজির কৃতিত্ব প্রসঙ্গে তাঁর মারাঠা জাতি গঠন, পরস্পর বিরোধী অভিধা, ঈশ্বরী প্রসাদের অভিমত, মানুষ হিসেবে শিবাজি, ত্রুটি মুক্ত চরিত্র, সহজাত গুণ, শিক্ষার পৃষ্ঠপোষক, ধর্মমত, ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের অভিমত ও শিবাজির প্রজাহিতৈষনার আদর্শ সম্পর্কে জানবো।
শিবাজির চরিত্র ও কৃতিত্ব (Estimate of Shivaji)
বিষয় | শিবাজির চরিত্র ও কৃতিত্ব |
জন্ম | ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দ |
পিতামাতা | শাহজি ভোঁসলে, জীজাবাঈ |
রাজ্যাভিষেক | ১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দ, রায়গড় দুর্গ |
মৃত্যু | ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দ |
সূচনা :- শক্তিশালী মোগল সাম্রাজ্য ও বিজাপুর রাজ্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে শিবাজি এক শক্তিশালী রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করেন। শতধা-বিভক্ত সপ্তদশ শতকের ভারত ইতিহাসে শিবাজি এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব।
মারাঠা জাতি গঠনে শিবাজির অবদান
সামান্য এক জায়গিরদারের পুত্র হয়েও কেবলমাত্র নিজ প্রতিভা, দক্ষতা, নিষ্ঠা ও সামরিক শক্তির বলে মারাঠাদের ঐক্যবদ্ধ ও জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তিনি মারাঠা জাতি গঠন করেন।
শিবাজির পরস্পর বিরোধী অভিদা
সমকালীন মুসলিম ঐতিহাসিকেরা তাঁকে ‘প্রতারণার জনক’, ‘শয়তানের অসৎ পুত্র’ বা ‘নরকের কুকুর’ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু সমকালীন মারাঠারা তাকে ‘মহামানব’ ও ‘দেবদূত’বলে মনে করতেন।
শিবাজি সম্পর্কে ঈশ্বরী প্রসাদের অভিমত
ডঃ ঈশ্বরী প্রসাদ-এর মতে, “তিনি নতুন আশা ও মুক্তির তারকা রূপে উদিত হন।” স্টুয়ার্ট গর্ডন (Stuart Gordon) তাঁকে মারাঠা ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা সফল “জনমোহিনী ও গতিশীল” নেতা (“The most charismatic and dynamic leader in Maratha history”) বলে অভিহিত করেছেন।
মানুষ হিসেবে শিবাজি
মানুষ হিসেবে তাঁর উদারতা ছিল প্রশ্নাতীত। তিনি ছিলেন যোগ্য পুত্র, দায়িত্বশীল স্বামী ও বিশ্বস্ত বন্ধু।
ত্রুটিমুক্ত চরিত্র শিবাজি
ব্যক্তিগত জীবনে রণজিৎ সিংহ ও হায়দার আলির মতো সম্পূর্ণ নিরক্ষর হয়েও তিনি সমকালীন সর্বপ্রকার চারিত্রিক ত্রুটিমুক্ত ছিলেন। পানাসক্তি বা ব্যাভিচার তাঁকে স্পর্শ করতে পারে নি।
শিবাজির সহজাত গুণ
উচ্চ নৈতিকতা, ধর্মবোধ, নারী সমাজ, জ্ঞানী-গুণী ও বিভিন্ন ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল তাঁর চরিত্রের সহজাত গুণ। যুদ্ধকালে তিনি অযথা হত্যাকাণ্ডের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন।
শিক্ষার পৃষ্ঠপোষক শিবাজি
- (১) নিজে নিরক্ষর হলেও তিনি বিদ্যা ও বিদ্বানের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, পণ্ডিতদের সাহচর্যে দিন কাটাতেন, বিদ্বান ও ব্রাহ্মণদের দান করতেন এবং ছাত্রদের বৃত্তি দিতেন।
- (২) তিনি তৎকালে ব্যবহৃত পারসিক শব্দাবলীর একটি সংস্কৃত পরিভাষা তৈরির জন্য ব্রাহ্মণদের নিয়োগ করেন এবং এভাবেই ‘রাজ-ব্যবহার কোষ’ নামক বিখ্যাত পারিভাষিক অভিধান সংকলিত হয়।
শিবাজির ধর্মমত
- (১) ধর্মের দিক থেকেও তিনি ছিলেন খুবই উদার। নিজেকে ‘গো-ব্রাহ্মণ-প্রতিপালক’বলে অভিহিত করলেও তাঁকে কখনোই আলাউদ্দিন খলজি বা তৈমুর লঙের ‘হিন্দু সংস্করণ’ বলা যাবে না বা তাঁকে কখনোই ‘জিন্দাপির’ ঔরঙ্গজেব-এর সঙ্গে এক আসনে বসানো যাবে না।
- (২) তাঁর কঠোর সমালোচক কাফি খাঁ-ও তাঁর ধর্মীয় উদারতার কথা স্বীকার করেছেন। মানুষের ধর্ম নয়—যোগ্যতাই ছিল তাঁর কাছে আসল। এ জন্য মুন্সি হায়দার, সিদ্দি সম্বল, দৌলত খাঁ, নূর খাঁ প্রমুখ মুসলিমদের তিনি উচ্চ রাজপদে নিয়োগ করতে কুণ্ঠা করেন নি।
- (৩) যুদ্ধকালে মসজিদ, কোরান, নারী বা শিশুর মর্যাদা হানি হলে তিনি কঠোর ব্যবস্থা নিতেন। মুসলিম সাধুদের প্রতিও তিনি শ্রদ্ধাবান ছিলেন। মুসলিম পণ্ডিতদের তিনি অর্থসাহায্য ও নিষ্কর জমি দান করতেন।
- (৪) তিনি নিজ ব্যয়ে বাবা ইয়াকৎ নামে জনৈক মুসলিম দরবেশের দরগা নির্মাণ করে দেন। খ্রিস্টান যাজকদের প্রতিও তিনি অনুরূপ শ্রদ্ধা দেখাতেন।
শিবাজি সম্পর্কে যদুনাথ সরকারের অভিমত
ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার বলেন যে, “No blind fanatic, no mere brigand can found a state.”।
শিবাজির প্রজাহিতৈষণার আদর্শ
তাঁর শাসনব্যবস্থায় নানা দোষ ছিল ঠিকই। তাঁর বিচারব্যবস্থা উন্নত ছিল না, রাজ্য থেকে তিনি জাতিভেদের বীজ দূর করতে পারেন নি এবং শিবাজির শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে তাঁর ব্যক্তিগত ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল ছিল। এ সব সত্ত্বেও এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, তাঁর পরধর্মমত-সহিষ্ণুতা, নারী ও কোরানের প্রতি শ্রদ্ধা এবং প্রজাহিতৈষণার আদর্শ সত্যিই বিস্ময়কর ছিল।
উপসংহার :- তিনি ছিলেন মারাঠা জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা। গ্রান্ট ডাফ-এর মতে, কেবলমাত্র মারাঠা জাতির স্রষ্টা নয়- শিবাজি ছিলেন মধ্যযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভাসম্পন্ন জাতীয় স্রষ্টা। স্যার যদুনাথ সরকারের মতে তিনি হলেন হিন্দু জাতির শেষ গঠনমূলক প্রতিভা ও জাতি-সংগঠক।
(FAQ) শিবাজির চরিত্র ও কৃতিত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
শাহজি ভোঁসলে।
দাদাজি কোণ্ডদেব।
১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে রায়গড় দুর্গে।