পেশোয়া বালাজি বিশ্বনাথ

মারাঠাদের প্রথম পেশোয়া বালাজি বিশ্বনাথ -এর জন্ম, রাজস্ব কর্মচারী, সেনাকর্তা, মারাঠা সম্রাটকে সহযোগিতা, পেশোয়া পদ লাভ, পেশোয়ার সমস্যা, উত্তর ভারতে মারাঠা আধিপত্য বিস্তার, আভ্যন্তরীণ শান্তি প্রতিষ্ঠা, মোগলদের সাথে সন্ধি, শাহুর মর্যাদা বৃদ্ধি, রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি, দিল্লির রাজনীতিতে প্রবেশ, রাষ্ট্র ব্যবস্থার শীর্ষে অবস্থান ও তার কৃতিত্ব সম্পর্কে জানবো।

পেশোয়া বালাজি বিশ্বনাথ (১৭১৩ -১৭২০ খ্রিঃ)

ঐতিহাসিক চরিত্রপেশোয়া বালাজি বিশ্বনাথ
জন্ম১৬৬২ খ্রিস্টাব্দ
রাজত্বকাল১৭১৩-১৭২০ খ্রিস্টাব্দ
পরিচিতমারাঠা পেশোয়া (প্রধানমন্ত্রী)
মৃত্যু১৭২০ খ্রিস্টাব্দ
পূর্বসূরিপরশুরাম ত্রিমবাক কুলকারণি
উত্তরসূরিপ্রথম বাজিরাও
পেশোয়া বালাজি বিশ্বনাথ

ভূমিকা :- মারাঠা সাম্রাজ্যের একজন শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বালাজি বিশ্বনাথ বা পেশোয়া বালাজি বিশ্বনাথ। অস্টাদশ শতাব্দীতে তিনি মারাঠা সাম্রাজ্যের আধিপত্য অর্জন করেন।

জন্ম

বংশানুক্রমিক ‘পেশোয়াতন্ত্রের’ প্রতিষ্ঠাতা বালাজি বিশ্বনাথের জন্ম১৬৬২ খ্রিস্টাব্দে চিৎপাবন বংশীয় এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে।

রাজস্ব কর্মচারী

১৭০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি শাহুর সেনাপতি ধনাজি যাদবের অধীনেএকজন ‘কারকুন” (রাজস্ব কর্মচারী) হিসেবে নিযুক্ত হন।

সেনাকর্তা

ধনাজির মৃত্যুর পর তাঁর পুর চন্দ্রসেন যাদবের অধীনে ‘সেনাকর্তা’ বা সেনাবাহিনীর সংগঠক নিযুক্ত হন। এইভাবে তিনি রাজস্ব ও সামরিক—দুই বিভাগেই অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।

মারাঠা সম্রাটকে সহযোগিতা

বিশ্বনাথ বালাজি তরুণ মারাঠা সম্রাট শাহুকে তার যুদ্ধ বিধ্বস্ত রাজ্যকে ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা করতে এবং মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের পুনঃ পুনঃ আক্রমণ থেকে রক্ষার ব্যাপারে সহযোগিতা করেছিলেন।

পেশোয়া পদ লাভ

তাঁর বুদ্ধি, বিচক্ষণতা ও কর্মদক্ষতায় আকৃষ্ট হয়ে শাহু তাঁকে ‘পেশোয়া’ পদে নিযুক্ত করেন।মারাঠা জাতির এক সংকটময় পরিস্থিতিতে তিনি ‘পেশোয়া’-র কর্মভার গ্রহণ করেন।

‘পেশোয়া’-র সমস্যা

বালাজি বিশ্বনাথ পেশোয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হন। যেমন –

  • (১) অযোগ্য শাহু রাজ্যের সকল দায়িত্ব পেশোয়ার হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন।
  • (২) গৃহবিবাদের ফলে মারাঠা সর্দাররা সাতারা ও কোলাপুর—দুই গোষ্ঠীতে বিভক্ত। এই সর্দারদের নিজ দলভুক্ত করে রাজ্যের শক্তিবৃদ্ধি এবং ঐক্যসাধন অপরিহার্য ছিল।
  • (৩) দুর্বিনীত মারাঠা সর্দারদের অবাধ লুণ্ঠনের ফলে চতুর্দিকে তখন চরম বিশৃঙ্খলা চলছে। এর অবসান ঘটিয়ে রাজ্যে শাস্তি প্রতিষ্ঠা করা দরকার।

উত্তর ভারতে মারাঠা আধিপত্য

সুচতুর বালাজি বিশ্বনাথ স্পষ্টই উপলব্ধি করেন যে, উত্তর ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তিম-লগ্ন আসন্ন। দুর্বল বাদশাহকে সামনে রেখে অভিজাতরা চক্রান্তে মত্ত। এই সুযোগে বালাজি বিশ্বনাথ উত্তর ভারতে মারাঠা আধিপত্য স্থাপনে উৎসাহী হন।

উত্তর ভারতে মারাঠা আধিপত্য বিস্তারে প্রতিবন্ধকতা

উত্তর ভারতে মারাঠা আধিপত্য বিস্তারে তাঁর দু’টি প্রতিবন্ধকতা ছিল — দাক্ষিণাত্যে মারাঠা প্রাধান্য বিস্তারের প্রতিবন্ধক কোলাপুরি শাখার তারাবাঈ, আর উত্তর ভারতে শাহুর মোগল-প্রীতি।

অভ্যন্তরীণ শান্তি প্রতিষ্ঠা

দক্ষ প্রশাসক ও সুচতুর কূটনীতিজ্ঞ বালাজি বিশ্বনাথ বিদ্রোহী মারাঠা দলপতিদের দমন করে অচিরেই মারাঠা রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করেন।

  • (১) তাঁর উদ্যোগে লোনাবেলার সন্ধি (১৭১৪ খ্রিঃ) দ্বারা পশ্চিম উপকূলের শাসক ও মারাঠা নৌবাহিনীর প্রধান কাহ্নোজি আংরে-র সঙ্গে শাহুর মিত্রতা স্থাপিত হয়। কাহ্নোজি আংরে পূর্বে তারাবাঈ-এর সমর্থনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু পেশোয়ার বন্ধুত্বপূর্ণ নীতির ফলে তিনি মিত্রে পরিণত হন।
  • (২) তিনি মারাঠা সর্দারদের মধ্যে ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা ভাগ করে দিয়ে ঐক্যের বন্ধন সুদৃঢ় করেন।
  • (৩) তিনি ‘চৌথ’ ও ‘সরদেশমুখি’ আদায়ের জন্য এক একটি এলাকা এক একজন মারাঠীসর্দারদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে তাদের আনুগত্য অর্জন করেন।
  • (৪) তিনি পুরোনো ‘অষ্টপ্রধান’ ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে একটি মারাঠা শক্তিসঙ্ঘ গড়ে তোলেন।
  • (৫) তিনি রাজস্ব বিভাগে নানা সংস্কার প্রবর্তন করে রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটান এবং মহীশূর ও নিজামের বিরুদ্ধে মারাঠা রাষ্ট্রের শক্তি সংহত করেন।

মোগলদের সঙ্গে সন্ধি

  • (১) বালাজি বিশ্বনাথ যখন ‘পেশোয়া’ পদে বসেন তখনমোগল দরবারে প্রবল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চলছে। সৈয়দ-ভ্রাতৃদ্বয় (সৈয়দ হোসেন আলি ও সৈয়দ আবদুল্লা খাঁ) তখন সাম্রাজ্যের সর্বেসর্বা।
  • (২) মোগল সম্রাট ফারুখশিয়র সৈয়দ-ভ্রাতৃদ্বয়ের সাহায্যে সিংহাসনে বসলেও তাঁদের ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য চক্রান্তে লিপ্ত।
  • (৩) সম্রাটের বিরুদ্ধে আসন্ন সংঘর্ষে মারাঠাদের সাহায্য লাভের উদ্দেশ্যে ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দে মোগল সেনাপতি সৈয়দ হোসেন আলি পেশোয়া-র সঙ্গে এক গোপন সন্ধি স্বাক্ষর করেন।

মোগলদের সাথে সন্ধির শর্তাবলী

এই সন্ধির শর্তগুলি হল –

  • (১) মোগল সম্রাট শিবাজি-অধিকৃত রাজ্যের ওপর তাঁর দাবি ত্যাগ করেন।
  • (২) দাক্ষিণাত্যের কিছু অঞ্চল — যথা খান্দেশ, গণ্ডোয়ানা, বেরার, কর্ণাটক ও হায়দ্রাবাদ শাহুকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
  • (৩) দাক্ষিণাত্যের মোগল অধিকৃত ছ’টি ‘সুবা’ থেকে শাহু চৌথ ও সরদেশমুখি আদায়ের অধিকার পান এবং
  • (৪) বিনিময়ে শাহু মোগল সম্রাটকে বার্ষিক ১০ লক্ষ টাকার কর দিতে এবং দাক্ষিণাত্যে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও মোগলদের সাহায্যের উদ্দেশ্যে সম্রাটের ব্যয়ে ১৫০০০ অশ্বারোহী সেনা রক্ষণাবেক্ষণে সম্মত হন।

শাহুর মর্যাদা বৃদ্ধি

মোগলদের সাথে সন্ধির ফলে দাক্ষিণাত্যের ওপর থেকে মোগল অধিকার কার্যত বিলুপ্ত হয়ে যায়, মারাঠা অধিপতি শাহুর মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং তিনি মহারাষ্ট্রের আইনসম্মত শাসক হিসেবে স্বীকৃতি পান।

মারাঠাদের ওপর মোগল বাদশাহের নির্ভরশীলতা

মোগল বাদশাহের ব্যয়ে মারাঠারা ১৫০০০ অশ্বারোহীর অধিপতি হয়।এই বাহিনী মোগলদের সাহায্যের জন্য গঠিত হয়।অর্থাৎ বাদশাহ মারাঠাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।

মর্যাদা ও প্রতিপত্তির অধিকারী

মোগল কর্তৃত্ব স্বীকার করে বালাজি বিশ্বনাথ শিবাজির স্বাধীনতার আদর্শকেবিসর্জন দিয়ে ‘নামেমাত্র’ মোগল কর্তৃত্ব স্বীকার করলেও মারাঠা ইতিহাসে এই সন্ধি দ্বারা মারাঠারা যথেষ্ট শক্তি, মর্যাদা ও প্রতিপত্তির অধিকারী হয়।

রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি

দাক্ষিণাত্যে চৌথ ও সরদেশমুখি আদায়ের অধিকার দিয়ে মারাঠাদের মোগল সাম্রাজ্যের প্রদেশগুলির রাজস্ব-ব্যবস্থার অংশীদার করা হয় এবং এর ফলে রাজনৈতিক ক্ষমতার ক্ষেত্রেও তারা মোগলদের সমান অংশীদার হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

রিচার্ড টেম্পল এর অভিমত

স্যার রিচার্ড টেম্পল ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দের এই সন্ধিকে মারাঠা সাম্রাজ্যের উত্থানের ‘ম্যাগনা কার্টা’ বলে অভিহিত করেছেন।

দিল্লির রাজনীতিতে প্রবেশ

  • (১) এই সন্ধির পর বালাজি বিশ্বনাথ ১৫০০০ সৈন্য-সহ দিল্লিতে আসেন এবং এই সময় থেকেই মারাঠারা দিল্লির রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। মোগল দরবারের রাজনীতিতে তিনি সৈয়দ-ভ্রাতৃদ্বয়ের সমর্থক ছিলেন।
  • (২) মারাঠাদের সাহায্যেই সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় সম্রাট ফারুশিয়রকে সিংহাসনচ্যুত করে মহম্মদ শাহকে সিংহাসনে বসান। মহম্মদ শাহ ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ হোসেন আলির সঙ্গে বালাজি বিশ্বনাথের সম্পাদিত চুক্তিটি অনুমোদিত করেন।
  • (৩)এইভাবে নিজ সমর্থনপুষ্ট ব্যক্তিকে দিল্লির সিংহাসনে স্থাপন এবং বাদশাহের মিত্র হিসেবে দিল্লির দরবারে মারাঠাদের উপস্থিতি তাদের রাজনৈতিক মর্যাদা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি করে।
  • (৪) এর ফলে আগামী দিনের মারাঠা সাম্রাজ্যের ভিত্তি নির্মিত হয়এবং বালাজি বিশ্বনাথের আমলে মারাঠারা দুর্ধর্ষ শক্তিতে পরিণত হয়।

রাষ্ট্র ব্যবস্থার শীর্ষে উত্থান

মহারাষ্ট্রের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেওকেবলমাত্র নিজ বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার দ্বারা তিনি নিজেকে রাষ্ট্রব্যবস্থার শীর্ষে প্রতিষ্ঠিত করেন। শিবাজিরমতো ব্যক্তিত্ব ও সামরিক প্রতিভা না থাকলেও তাঁর কূটনৈতিক বুদ্ধি ও পর্যবেক্ষণ শক্তি ছিল অসাধারণ।

কৃতিত্ব

তাঁর প্রধান কৃতিত্ব হল এই যে,

  • (১) তিনি তারাবাঈকে পরাজিত করে তাঁর প্রভু শাহুকে মারাঠা সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। এইভাবে মারাঠা গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে এবং মহারাষ্ট্রের জাতীয় ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
  • (২) ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দের মোগল-মারাঠা সন্ধির ফলে মারাঠা-রাষ্ট্র মোগলদের সঙ্গে সংঘর্ষের হাত থেকে মুক্তি পায়, দাক্ষিণাত্যে মারাঠা আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস সহজতর হয় এবং শাহু নিজ রাজ্যের পুনর্গঠনে মন দিতে পারেন।
  • (৩) সর্বশেষে বলা যায় যে, পতনোন্মুখ মোগল সাম্রাজ্যের স্থলে তিনি মারাঠা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হন।

উপসংহার :- মহারাষ্ট্রের জাতীয় জীবনের এক অতি সংকটময় পরিস্থিতিতে ‘পেশোয়া’ পদে আসীন হয়ে যোগ্যতার সঙ্গে তিনি মারাঠা রাষ্ট্র-তরণী পরিচালনা করেন। ঐতিহাসিক রোলিনসন তাঁকে মারাঠা জাতির ‘ত্রাণকর্তা’ এবং’ দ্বিতীয় মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা” বলে অভিহিত করেছেন।

(FAQ) পেশোয়া বালাজি বিশ্বনাথ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. মারাঠা পেশোয়া বালাজি বিশ্বনাথের সময়কাল কত?

১৭১৩-১৭২০ খ্রিস্টাব্দ।

২. পেশোয়া বালাজি বিশ্বনাথের সময় মারাঠা সম্রাট কে ছিলেন?

শাহু।

৩. মারাঠা সাম্রাজ্যে বংশানুক্রমিক পেশোয়া তন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?

বালাজি বিশ্বনাথ।

Leave a Comment