শিবাজির শাসনব্যবস্থা

শিবাজির শাসনব্যবস্থা প্রসঙ্গে উপাদান, জনকল্যাণের আদর্শ, শিবাজির মারাঠা রাজ্য, অষ্টপ্রধান, মন্ত্রীদের দায়িত্ব, নিয়োগ, প্রাদেশিক শাসন, রাজস্ব, বিচারব্যবস্থা, সামরিক বাহিনী, সেনাবাহিনীর ত্রুটি ও শিবাজির শাসন ব্যবস্থার সমালোচনা সম্পর্কে জানো।

শিবাজির শাসনব্যবস্থা

ঐতিহাসিক ঘটনাশিবাজির শাসনব্যবস্থা
সর্বেসর্বাসম্রাট
প্রত্যক্ষ শাসনাধীন অঞ্চলস্বরাজ্য
মন্ত্রীপরিষদঅষ্টপ্রধান
পেশোয়াপ্রধানমন্ত্রী
শিবাজির শাসনব্যবস্থা

ভূমিকা :- কেবলমাত্র সমরকুশলী বীর হিসেবেই নয়—একজন সুদক্ষ শাসক ও সংগঠক হিসেবেও শিবাজি স্মরণীয় হয়ে আছেন। রোলিনসন শিবাজিকে নেপোলিয়নের সঙ্গে তুলনা করে তাঁকে একজন দক্ষ প্রশাসক ও সংগঠক বলে অভিহিত করেছেন।

বিরোধী মতামত

অনেক ইউরোপীয় ঐতিহাসিকের মতে, শিবাজির শাসনব্যবস্থায় ‘জনকল্যাণের’ কোনও স্থান ছিল না। ঐতিহাসিকস্মিথশিবাজিরসাম্রাজ্যকে‘দস্যুরাষ্ট্র'(‘RobberState’)বলেঅভিহিতকরেছেন।

উপাদান

সমকালীন অন্যান্য শাসনব্যবস্থা অপেক্ষা তাঁর শাসনব্যবস্থা অনেক উন্নত ছিল। যে সব উপাদানগুলি থেকে তাঁর শাসনব্যবস্থার বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় সেগুলি হল –

  • (১) অমাত্য রামচন্দ্র পন্থের রচনাবলী।
  • (২) শিবাজির সভাসদ কৃষ্ণাজি অনন্ত রচিত শিবাজির জীবনী ও শাসনব্যবস্থার বিবরণ।
  • (৩) পণ্ডিত হনুমন্তরাও-এর রচনা।
  • (৪) পেশোয়া দপ্তরের দলিলপত্র এবং
  • (৫) সমকালীন ইওরোপীয় পর্যটকদের বিবরণ।

জনকল্যাণের আদর্শ

  • (১) মধ্যযুগের রীতি অনুযায়ী তিনি স্বৈরতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তিনিই ছিলেন সকল ক্ষমতার উৎস।তা সত্ত্বেও তিনি কিন্তু কখনোই স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না।
  • (২) তাঁর শাসনব্যবস্থার মূল নীতিই ছিল প্রজাদের কল্যাণসাধন করা। এই ব্যাপারে তিনিআহম্মদনগরের বিখ্যাত প্রশাসক মালিক অম্বরের শাসনব্যবস্থা থেকে বহু শিক্ষা গ্রহণ করেন।
  • (৩) এছাড়া, মোগলদের নজিরও তাঁর সামনে ছিল। নিজ প্রতিভা দ্বারা তিনি প্রচলিত শাসনব্যবস্থার ত্রুটিগুলি দূর করে নিজ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেন।

শিবাজির মারাঠা রাজ্য

শিবাজির মারাঠা রাজ্য দু’ধরনের অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল— স্বরাজ্য ও মুলকাগিরি।

(১) স্বরাজ্য

শিবাজির প্রত্যক্ষ শাসনাধীন অঞ্চলকে ‘স্বরাজ্য’ বলা হত। তাঁর শাসনব্যবস্থা কেবলমাত্র ‘স্বরাজ্য’ অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল।

(২) মূলকাগিরি

যে সব অঞ্চল তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নিয়ে নিয়মিত কর দিত বা মারাঠা সৈন্যরা যে সব অঞ্চলে নিয়মিত লুঠতরাজ চালাত বা কর আদায় করত, সেগুলিকে বলা হত ‘মুলকাগিরি’।

অষ্ট প্রধান

শাসনব্যবস্থায় তিনিই সর্বেসর্বা ছিলেন এবং এই ব্যাপারে তাকে পরামর্শ দেবার জন্য অষ্টপ্রধান বা আটজন মন্ত্রী নিয়ে গঠিত একটি পরিষদ ছিল। তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ বা বর্জন করা ছিল সম্পূর্ণ তাঁর ইচ্ছাধীন। এই আটজন মন্ত্রী হলেন —

(১) ‘মুখ্য প্রধান’ বা ‘পেশোয়া’ (প্রধানমন্ত্রী)

এই পদটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সমগ্র শাসনব্যবস্থা তদারকি করতেন, রাজার অনুপস্থিতিতে তাঁর প্রতিনিধিত্ব করতেন এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের মধ্যে মতভেদ দূর করতেন।

(২) ‘অমাত্য’ (রাজস্বমন্ত্রী)

রাজস্ব আদায় এবং রাজ্যের আয়-ব্যয়ের হিসেব রাখতেন।

(৩) মন্ত্রী

রাজ্যের সকল ঘটনা লিপিবদ্ধ করতেন।

(৪) দবীর’ বা ‘সামন্ত’ (পররাষ্ট্রমন্ত্রী)

যুদ্ধ ও সন্ধির ব্যাপারে রাজাকে পরামর্শ দিতেন, অন্য রাষ্ট্র সম্পর্কে খবর সংগ্রহ করতেন এবং রাজাকে রাষ্ট্রদূত নিয়োগের ব্যাপারে পরামর্শ দিতেন।

(৫) ‘সচিব’ বা ‘সর্ণাবিস’

এই পদাধিকারী ছিলেন সরকারি পত্রাদি প্রেরণের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী।

(৬) ‘পণ্ডিতরাও’ (ধর্মাধ্যক্ষ)

ধর্মীয় বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেনপণ্ডিতরাও। ব্রাহ্মণদের পুরষ্কৃত করা, ধর্মীয় বিরোধের নিষ্পত্তি করা এবং ধর্মবিরোধীদের শাস্তিদান করা ছিল তাঁর কাজের অন্তর্ভুক্ত।

(৭) ‘ন্যায়াধীশ’ (প্রধান বিচারপতি)

সর্বপ্রকার দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার বিচার নিষ্পত্তি করতেনন্যায়াধীশ।

(৮) ‘সেনাপতি’ বা সর-ই-নৌবৎ

সামরিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীছিলেন সেনাপতি। সেনা নিয়োগ, সামরিক শিক্ষাদান, সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা রক্ষা তাঁর দায়িত্বের অঙ্গীভূত ছিল।

মন্ত্রীদের বর্ণ

আটজন মন্ত্রীর মধ্যে কেবলমাত্র ‘সেনাপতি’ বাদে সবাই ছিলেন ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ভুক্ত।

মন্ত্রীদের দায়িত্ব

‘ন্যায়াধীশ’ ও ‘পণ্ডিতরাও’ ব্যতীত সকল মন্ত্রীকে নিজ নিজ দপ্তরের দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে সামরিক দায়িত্বও পালন করতে হত। অষ্টপ্রধান-দের ‘রাজমণ্ডল’ বলেও অভিহিত করা হত।

নিয়োগদান

কোনও মন্ত্রীই নিজ বিভাগের কর্মচারী নিয়োগ করতে পারতেন না। একমাত্র রাজাই ছিলেন নিয়োগের অধিকারী।

অষ্টপ্রধান ছাড়া অন্যান্য কর্মচারী

অষ্টপ্রধান ছাড়াও তাঁর রাজ্যে ‘চিটনিস্’, ‘পটনিস্’, ‘সুবনিস্’, ‘দেওয়ান’ ‘মজুমদার’ প্রভৃতি কর্মচারী ছিল।

প্রাদেশিক শাসন

  • (১) সুশাসন এবং রাজস্ব সংগ্রহের সুবিধার জন্য শিবাজি তাঁর সমগ্র রাজ্য-কে তিনটি ‘প্রান্ত’ বা প্রদেশে বিভক্ত করেন। প্রত্যেক ‘প্রান্তে’ একজন করে রাজপ্রতিনিধি নিযুক্ত ছিলেন। তাঁকে বলা হত ‘মামলাদার’।
  • (২) তিনি রাজার ইচ্ছায় নিযুক্ত ও পদচ্যুত হতেন। এই রাজপ্রতিনিধিকে সাহায্যের জন্য প্রত্যেক ‘প্রান্তে’ আটজন করে কর্মচারী দ্বারা গঠিত একটি সভা ছিল।
  • (৩) প্রত্যেকটি ‘প্রান্ত’ আবার কয়েকটি ‘পরগণা’ বা ‘তরফ-এ বিভক্ত ছিল। ‘তরফ’-এর শাসনকর্তাকে বলা হত হাবিলদার’ বা ‘কারকুন’। শাসনব্যবস্থার সর্বনিম্ন স্তর ছিল গ্রাম। গ্রামের শাসনভার ছিল গ্রাম পঞ্চায়েতের ওপর।
  • (৪) কয়েকটি গ্রামের শাসনকার্য পরিদর্শনের জন্য ‘দেশপাণ্ডে’ ও ‘দেশমুখ’ নামে দু’জন কর্মচারী থাকতেন।রাজকর্মচারীরা বেতন ভোগ করতেন এবং তাঁদের কোনও পদই বংশানুক্রমিক ছিল না।

রাজস্ব

মালিক অম্বরের রাজস্ব নীতি অনুসরণ করে তিনি প্রজাদের কাছ থেকে সরাসরি রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করেন। এক্ষেত্রে তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেমন –

(১) রাজস্বের পরিমাণ

রাজ্যের সকল জমি জরিপ করে তিনি প্রথমে প্রজাদের কাছ থেকে উৎপন্ন শস্যের ৩০% এবং পরে অন্যান্য সকল কর প্রত্যাহার করে উৎপন্ন শস্যের ৪০%রাজস্ব হিসেবে আদায় করতেন। প্রজারা শস্য বা নগদ অর্থে রাজস্ব দিতে পারত।

(২) ঋণ প্রদান

কৃষির উন্নতির জন্য সরকার থেকে কৃষকদের গরু, বীজ প্রভৃতি ক্রয়ের জন্য ঋণ দেওয়া হত। রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে তিনি কঠোর ছিলেন—তবে এ সম্পর্কে তিনি সর্বপ্রকার অত্যাচারের বিরোধী ছিলেন।

(৩) দুটি অতিরিক্ত কর

তিনি আরও দু’ধরনের কর আদায় করতেন— ‘মহাতরফা’ ও ‘জাকাৎ’। বণিকদের কাছ থেকে ‘মহাতরফা’ আদায় করা হত এবং বাজারে প্রতিটি জিনিসের ক্রয়-বিক্রয় থেকে আদায় করা হত ‘জাকাৎ’।

(৪) রাজস্ব আদায়ের কর্মচারী

হাওয়ালদার’, ‘কারকুন’, ‘সুবাদার’, ‘মুখ্য দেশাধিকারী’ প্রভৃতি কর্মচারীদের ওপর রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব অর্পিত ছিল। বিদেশি পর্যটক ফ্রায়ার (Fryer) শিবাজির রাজস্ব ব্যবস্থার নিন্দা করলেও গ্রান্ট ডাফ (Grant Duff) তাঁর রাজস্ব ব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

(৫) চৌথ ও সরদেশমুখী

নিজের রাজ্য ছাড়াও শিবাজি পার্শ্ববর্তী বিজাপুর ও মোগল অধিকৃত অঞ্চল থেকেও ‘চৌথ’ (ফসলের এক-চতুর্থাংশ) এবং ‘সরদেশমুখি’ (ফসলের এক-দশমাংশ) নামে দুই প্রকারের কর আদায় করতেন। এর বিনিময়ে এই সব অঞ্চল মারাঠাদের আক্রমণ ও লুণ্ঠন থেকে অব্যাহতি পেত।

(৬) ‘চৌথ’ ও ‘সরদেশমুখি-র প্রকৃতি

এই দুটি করের প্রকৃতি নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। যেমন –

  • (ক) মহাদেব গোবিন্দ রাণাডে-র মতে, এটি হল ‘রক্ষা কর’ (‘Protection Money’) – অন্য কোনও তৃতীয় শক্তির আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য প্রতিবেশী অঞ্চল থেকে এই কর আদায় করা হত। বলা বাহুল্য, এ বক্তব্য সঠিক নয়, কারণ বিদেশি তৃতীয় শক্তির আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করার কোনও প্রতিশ্রুতি এতে ছিল না।
  • (খ) ডঃ সরদেশাই বলেন যে, শত্রু বা বিজিত দেশ থেকে এই কর আদায় করা হত। স্যার যদুনাথ-এর মতে এই কর দু’টি ছিল ‘নিষ্কৃতি কর’। যে অঞ্চল থেকে এই কর আদায় করা হত, সেই অঞ্চল মারাঠা আক্রমণের হাত থেকে অব্যাহতি পেত।
  • (গ) যদুনাথ সরকার এই অবৈধ করের নিন্দা করে বলেন যে, এইভাবে কর আদায়ের ফলে মারাঠাদের সুনাম নষ্ট হয়। ঐতিহাসিক স্মিথ একে ‘দস্যু কর’ (‘Robber Tax’) বলে অভিহিত করেছেন।
  • (ঘ) এই করের সমর্থনে বলা যায় যে, চতুর্দিকে শত্রু-পরিবেষ্টিত মহারাষ্ট্র ছিল অনুর্বর অঞ্চল। আত্মরক্ষার জন্য সেনাদল গঠন এখানে অপরিহার্য ছিল। সেনাবাহিনীকে নিয়মিত বেতন দিতে গেলে এছাড়া অন্য পথ ছিল না।

বিচার ব্যবস্থা

শিবাজির শাসনকালে বিচারব্যবস্থা তেমন উন্নত ছিল না। তিনি কোনও স্থায়ী বিচারালয় স্থাপন করেন নি। গ্রামের বিচার নিষ্পন্ন করত গ্রাম পঞ্চায়েতগুলি। ফৌজদারি বিচারের ভার ছিল ‘গ্রাম প্রধান’ বা ‘প্যাটেল’-এর ওপর। আপিলের বিচার করতেন ‘ন্যায়াধীশ’। ‘হাজির মজলিস’ নামে এক সভা বা বিচারালয় ছিল চূড়ান্ত আপিল আদালত।

সামরিক বাহিনী

  • (১) অসাধারণ সামরিক প্রতিভার অধিকারী শিবাজি একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী গঠন করেন। প্রথমদিকে তাঁর সেনাবাহিনীতে বেতন-ভোগী স্থায়ী সেনা ছিল না। রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্থায়ী সেনাদল গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন।
  • (২) তাঁর সেনাবাহিনী মূলত পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনীতে বিভক্ত ছিল। এছাড়া, তিনি একটি নৌবাহিনী, হস্তিবাহিনী ও উষ্ট্রবাহিনী—এমনকীগোলন্দাজ বাহিনীও গঠন করেন।
  • (৩) তাঁর সেনাবাহিনীতে ১ লক্ষ পদাতিক এবং ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার অশ্বারোহী ছিল। ‘সভাসদ বখর’ থেকে জানা যায় যে, তাঁর ১২৬০টি যুদ্ধ হস্তি, ১৫০০ থেকে ৩০০০টি উট এবং ২০০টি রণতরী ছিল। জানা যায় যে, তিনি সুরাটের ফরাসিদের কাছ থেকে ৮০টি কামান ও গাদা বন্দুকের জন্য প্রচুর সিসা ক্রয় করেন।
  • (৪) তার অশ্বারোহী বাহিনী ‘পাগা’ বা ‘বারগীর ও শিলাদার’ নামে দুইভাগে বিভক্ত ছিল। বারগীরদের সরকার থেকে অস্ত্র, পোশাক ও অশ্ব দেওয়া হত। শিলাদাররা নিজ দায়িত্বে সাজ-সরঞ্জাম ও অস্ত্রাদি সংগ্রহ করত।
  • (৫) তাঁর সেনাদলে হিন্দু, আফগান, আরবি এবং মুসলিম সেনা ছিল। দুর্গগুলি ছিল শিবাজির শক্তির প্রধান কেন্দ্র। তাঁর জীবনের শেষদিকে দুর্গের সংখ্যা ছিল ২৪০। হাবিলদার, সর্নিশ, সর্ণোবৎ প্রভৃতি কর্মচারীরা দুর্গের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন।
  • (৬) সেনাবাহিনীতে নিয়ম-শৃঙ্খলা খুবই কঠোর ছিল। সেনা শিবিরে নারীর প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। সেনাদল কর্তৃক কোনও নারী, শিশু, ধর্মস্থান বা ধর্মগ্রন্থের অমর্যাদা করা কঠোর দণ্ডনীয় ছিল। সামরিক আইনভঙ্গের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড।

সেনাবাহিনীর ত্রুটি

শিবাজির সেনাবাহিনীতে বেশ কিছু ত্রুটি দেখা যায়। ডঃ সুরেন্দ্রনাথ সেন বেশ কিছু মৌলিক ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন।

  • (১) মারাঠাসেনাবাহিনী পুরোনো যুদ্ধকৌশল ও যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করত। তারা কোনও নতুন রণকৌশল বা যুদ্ধাস্ত্র আবিষ্কার করতে পারে নি।
  • (২) শিবাজি তাঁর সেনাবাহিনীতে আফগান, পর্তুগিজ, ফরাসি, আরবি, মোগল প্রভৃতি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সেনা গ্রহণ করেন। এর ফলে মারাঠা বাহিনীর সংহতি বিনষ্ট হয়।
  • (৩) শিবাজির মৃত্যুর পর সামন্ত প্রথার পুনঃপ্রবর্তন সেনাদলের দক্ষতা ভীষণভাবে হ্রাস করে।

সমালোচনা

স্যার যদুনাথ সরকার শিবাজির শাসনব্যবস্থাকে ‘মধ্যযুগীয় রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিস্ময়’ বলে অভিহিত করেছেন। অপরপক্ষে আধুনিক ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র তাঁর শাসনব্যবস্থায় কোনও মৌলিকত্ব খুঁজে পান নি। তাঁর মতে দক্ষিণী সুলতানি রাজ্যসমূহে প্রচলিত শাসনব্যবস্থার অনুকরণে শিবাজি তাঁর শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলেন। যাই হোক, তাঁর শাসনব্যবস্থা একেবারে ত্রুটিমুক্ত ছিল না। যেমন –

  • (১) ডঃ ঈশ্বরী প্রসাদ -এর মতে, তাঁর শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিগত যোগ্যতার ওপর নির্ভরশীল ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর মারাঠা রাজ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।
  • (২) তিনি জায়গির প্রথা সম্পূর্ণ বিলোপ করেন নি এর ফলে পরবর্তীকালে মারাঠা রাজ্যে সিন্ধিয়া, ভোঁসলে, হোলকার প্রমুখ সামন্ত রাজাদের উৎপত্তি হয়।
  • (৩) ফ্রায়ার-এর মতে, শিবাজির রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীরা ছিল নিষ্ঠুর তারা প্রজাদের ওপর অত্যাচার চালাত।
  • (৪) প্রতিবেশী রাজ্যগুলি থেকে বলপূর্বক ‘চৌথ’ ও ‘সরদেশমুখি’ আদায় করা হত। এতে মারাঠা রাজ্যের সুনাম নষ্ট হয়। স্মিথ তাই শিবাজির রাষ্ট্রকে ‘দস্যু রাষ্ট্র’ (‘Robber state’) বলে অভিহিত করেছেন।
  • (৫) শিবাজি শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির দিকে নজর দেন নি।
  • (৬) রাজ্য থেকে তিনি জাতিভেদ দূর করতে পারেন নি। তিনি ব্রাহ্মণদের খুশি করে চলতেন। তাঁর ‘অষ্টপ্রধানের’ অধিকাংশইছিলেন ব্রাহ্মণ এবং ‘পেশোয়া’ পদ চিৎপাবন ব্রাহ্মণদেরই একচেটিয়া ছিল।

উপসংহার :- শিবাজী ছিলেন নতুন আশা ও মুক্তির তারকা এবং মারাঠা জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা। তাঁর শাসন ব্যবস্থা জনকল্যাণের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।প্রকৃতপক্ষে শিবাজী এমন একটি শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন যা মধ্যযুগের শাসন ব্যবস্থার চেয়ে অনেক উন্নত।

(FAQ) শিবাজির শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. শিবাজির শাসন ব্যবস্থায় মন্ত্রীপরিষদ কি নামে পরিচিত?

অষ্টপ্রধান।

২. শিবাজি পার্শ্ববর্তী বিজাপুর ও মোগল অধিকৃত অঞ্চল থেকে কি কি কর আদায় করত?

চৌথ ও সরদেশমুখী।

৩. শিবাজির রাষ্ট্রকে দস্যু রাষ্ট্র বলেছেন কে?

ঐতিহাসিক স্মিথ।

Leave a Comment