ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কারণ

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধী পরিচালিত ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কারণ হিসেবে ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতা, জাপানের অগ্ৰগতি, ভারতীয় সেনাদের ক্ষোভ, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ভারতীয়দের প্রতি অবহেলা, ভারতীয়দের শোচনীয় অবস্থা, ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধি, কালোবাজারি, ইংরেজ সেনাদের অত্যাচার, সাধারণ মানুষের ক্ষোভ, জাপানি আক্রমণের আশঙ্কা এবং আন্দোলনের সূচনা সম্পর্কে জানবো।

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধী পরিচালিত ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কারণ

ঐতিহাসিক ঘটনাভারত ছাড়ো আন্দোলনের কারণ
সূচনা কাল৯ আগস্ট, ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ
প্রধান নেতামহাত্মা গান্ধী
স্লোগান“করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে”
ফলাফলব্যর্থতা
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কারণ

ভূমিকা :- ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলন বা ‘আগস্ট আন্দোলন’ জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। গান্ধীজি পরিচালিত সর্বভারতীয় গণ আন্দোলনগুলির মধ্যে ব্যাপকতা, বীরত্ব, সংগ্রামী মনোভাব এবং ত্যাগ ও তিতিক্ষার দিক থেকে এই আন্দোলন স্বীয় বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কারণ

এই আন্দোলনের পশ্চাতে নানা কারণ ছিল। যেমন –

(১) ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতা

ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হলে সারা ভারত ক্ষোভে রোষে ফেটে পড়ে। ভারতবাসী উপলব্ধি করে যে ইংরেজ সরকার কোনো অবস্থাতেই ভারতবাসীর সঙ্গে সমঝোতায় এসে তাদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে রাজি নয়। তারা বুঝতে পারে যে, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ব্যতীত ইংরেজদের কাছ থেকেকিছু আদায় করা সম্ভব নয়।

(২) জাপানের অগ্রগতি

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপান -এর চমকপ্রদ সাফল্য এবং সিঙ্গাপুর, মালয় ও ব্রহ্মদেশে ইংরেজদের শোচনীয় পরাজয় ভারতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ভারতবাসী উপলব্ধি করে যে, ভারতে জাপানি আক্রমণ আসন্ন এবং তা প্রতিহত করার কোনো ক্ষমতাই ইংরেজদের নেই—ভারতে ইংরেজদের দিন শেষ হয়ে এসেছে।

(৩) ভারতীয় সেনাদের ক্ষোভ

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ব্রহ্মদেশে কর্মরত আহত, অসুস্থ ও অভুক্ত ভারতীয় সেনারা কর্মচ্যুত হয়ে এই সময় ভারতে ফিরতে থাকে। জাপানিদের হাতে ভারতীয় সেনাদের পরাজয় এবং তাদের প্রতি ইংরেজদের হৃদয়হীন আচরণ ভারতবাসীকে ক্ষুব্ধ করে। এই মানসিকতা থেকেই ভারতে ব্যাঙ্ক ও ডাকঘর থেকে টাকা তোলার হিড়িক পড়ে যায় এবং সাধারণ মানুষ-জন সোনা, রূপা ও টাকা-পয়সা মজুত করতে থাকে।

(৪) দক্ষিণ-পূর্বএশিয়ায় ভারতীয়দের প্রতি অবহেলা

ব্রিটিশ শাসনাধীন মালয় ও ব্রহ্মদেশে বহু ভারতীয় বাস করত। জাপানিদের হাতে পরাজয়ের পর ব্রিটিশরা শ্বেতাঙ্গ অধিবাসীদের জাহাজে করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে গেলেও, কৃষ্ণকায় ভারতীয়দের সম্পূর্ণ ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেয়। ইংরেজদের এই বিশ্বাসঘাতকতায় ভারতীয়রা প্রবল ক্ষুব্ধ হয়।

(৫) ভারতীয়দের শোচনীয় অবস্থা

  • (ক) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভারতীয়রা ভারতে তাদের আত্মীয়দের কাছে যে-সব চিঠি-পত্র লিখতেন সেগুলিতে ইংরেজদের বিশ্বাসঘাতকতা ও তাঁদের শোচনীয় দূরবস্থার কাহিনীতে পূর্ণ থাকত।
  • (খ) এই সব অঞ্চলের লাখ লাখ ভারতীয় নদ-নদী, জঙ্গল অতিক্রম করে পায়ে হেঁটে চরম দুর্দশার মধ্যে ভারতের দিকে অগ্রসর হয়। পথে অনেকের মৃত্যু হয়, বর্মী ও আরাকানী দস্যুরা অনেকের যথাসর্বস্ব লুঠ করে এবং অনেককে হত্যা করে।
  • (গ) এইভাবে চরম দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নিঃস্ব, রিক্ত শরণার্থীর দল ভারতে পৌঁছায়। ভারতবাসী বুঝতে পারে যে, জাপান ভারত দখল করলে তাদেরও এই অবস্থা হবে।

(৬) ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালীন করভার, খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির তীব্র সংকট এবং ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধি ভারতবাসীকে প্রবল সংকটের মুখে ঠেলে দেয়। ১৯৪১-এ শস্যের দাম ১৯৪০ এর তুলনায় ১৩.৫% বৃদ্ধি পায়। বাংলায় খুচরো চালের দাম মণ প্রতি ৩০-৫০ টাকায় পৌঁছায়। কাপড়, কেরোসিন এবং ওষুধপত্র দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য হয়ে ওঠে।

(৭) কালো বাজারি

মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে শুরু হয় মজুতদারি, কালোবাজারি ও ফাটকাবাজি। এর ফলে দেশের সাধারণ মানুষ ইংরেজ শাসনের প্রতি যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয় এবং এই অপশাসনের অবসান কামনা করে।

(৮) সেনাদলের অত্যাচার

যুদ্ধ উপলক্ষে ভারতে বিপুল সংখ্যক ইংরেজ, আমেরিকান ও অস্ট্রেলিয় সৈন্যের উপস্থিতি, ‘কালা আদমী’ ভারতীয়দের প্রতি তাদের উদ্ধত আচরণ এবং ভারতীয় নারীদের প্রতি অশালীন আচরণ ভারতবাসী ভালভাবে নেয় নি। জাতীয় কংগ্রেস এই ব্যাপারে বারংবার প্রতিবাদ জানালেও কোন সুরাহা হয়নি।

(৯) সাধারণ মানুষের ক্ষোভ

  • (ক) জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে সরকার বাংলা, আসাম ও উড়িষ্যায় যে “পোড়ামাটি” নীতি অনুসরণ করে তাও দেশবাসীর অসন্তোষে ঘৃতাহুতি দেয়।
  • (খ) এই সব অঞ্চলের গ্রামগুলি থেকে সরকার বলপূর্বক সাইকেল ও নৌকা দখল করে ধ্বংস করে ফেলে। সরকারের আশঙ্কা ছিল যে জাপানিরা এগুলি ব্যবহার করে গ্রামের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়বে।
  • (গ) সেই সময় গ্রামাঞ্চলের মানুষদের যাতায়াতের বাহন ছিল এই দু’টিই। পূর্ববঙ্গে বর্ষাকালে নৌকা ছাড়া চলাচল অসম্ভব ছিল। এই সব কারণে সাধারণ মানুষ সরকারের ওপর প্রবল ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

(১০) জাপানি আক্রমণের সম্ভাবনা

  • (ক) জাপানি আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মনে এই ধারণা জন্মায় যে, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য-এর পতন অনিবার্য এবং এই অবস্থায় আর নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকা উচিত নয়। এই কারণেই তারা গভীর আগ্রহ নিয়ে ‘ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাবের দিকে লক্ষ্য রাখছিল।
  • (খ) ডঃ বিপান চন্দ্র বলেন যে, এই সময় ভারতীয় নেতৃবৃন্দ একটি বিশেষ কারণে ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রাম শুরু করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তিনি বলেন যে, এই সময় নানা কারণে জনগণের মনোবল ভেঙ্গে যাচ্ছিল এবং নেতৃবৃন্দ মনে করেছিলেন যে জাপানিরা ভারত দখল করলে জনগণ হয়তো কোন বাধাই দেবে না।
  • (গ) তিনি আরও বলেন যে, তারা যাতে জাপানি আগ্রাসন প্রতিহত করতে পারে এই উদ্দেশ্যে জনগণের হতাশা কাটানো এবং নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে তাদের মনে আত্মবিশ্বাস আনার উদ্দেশ্যেই নেতৃবৃন্দ সংগ্রামের কথা চিন্তা করেন।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূচনা

এইসব বিভিন্ন কারণে জাতীয় নেতৃবৃন্দ ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু করেন। অবশ্য আন্দোলন শুরু হওয়ার পূর্বেই প্রধান নেতাদের বন্দী করা হয়।

উপসংহার :- তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি মৌলানা আজাদ লিখেছেন যে, জাপানি আক্রমণের সম্ভাবনাই গান্ধীজিকে গণ সংগ্রামের দিকে ঠেলে দেয়।

(FAQ) ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ভারত ছাড়ো আন্দোলন আর কি নামে পরিচিত?

আগস্ট আন্দোলন ও বিয়াল্লিশের আন্দোলন।

২. ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দেন কে?

মহাত্মা গান্ধী।

৩. ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হয় কখন?

৯ আগস্ট, ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Comment