বিপ্লবী আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ

বিপ্লবী আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে সরকারি দমন নীতি, সাংগঠনিক ত্রুটি, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ও যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধ, পত্রিকা প্রকাশে মতবিরোধ, বিপ্লবী মতাদর্শ নিয়ে মতবিরোধ, সংকীর্ণ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ, উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ, মুসলিম সমাজের দূরত্ব, হীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিমত, সুমিত সরকারের অভিমত ও বিপান চন্দ্রের অভিমত সম্পর্কে জানবো।

ভারতে বিপ্লবী আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ

ঐতিহাসিক ঘটনাবিপ্লবী আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ
বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনামহারাষ্ট্র
বিপ্লবী আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্রবাংলা
বিপ্লবীদের আদর্শবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়স্বামী বিবেকানন্দ
বিপ্লবী আন্দোলনের ফলাফলব্যর্থতা
বিপ্লবী আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ

ভূমিকা:- মহারাষ্ট্রে বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা হলেও বাংলা ছিল তার প্রাণকেন্দ্র। বঙ্কিমচন্দ্র ও স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশমাতৃকার মুক্তির উদ্দেশ্যে বাংলার তরুণ দল বিপ্লবী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

বিপ্লববাদী আন্দোলনের সূচনা

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিপ্লববাদী আন্দোলন বাংলায় সুসংহত রূপ ধারণ করলেও, বাংলায় এর সূচনা হয়েছিল ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকেই।

বিপ্লববাদী কার্যকলাপের প্রস্তুতি শুরু

জাতীয়তার পিতামহ রাজনারায়ণ বসুর অনুপ্রেরণা এবং নবগোপাল মিত্র -এর হিন্দু মেলা -র উদ্যোগে ব্যায়াম ও শরীরচর্চার মাধ্যমে বাংলার যুবসমাজের মধ্যে বিপ্লববাদী কার্যকলাপের প্রস্তুতি শুরু হয়।

বিপ্লবী আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ

প্রবল উৎসাহ, উদ্দীপনা, বীরত্ব ও প্রভূত আত্মদান সত্ত্বেও বিপ্লবীদের আন্দোলন ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে পড়ে। এই ব্যর্থতার পশ্চাতে বেশ কিছু কারণ ছিল। যেমন –

(১) সরকারি দমননীতি

আন্দোলনের ব্যর্থতার জন্য সরকারের দমননীতিকে দায়ী করা যায়। আন্দোলন দমনের জন্য সরকার প্রথম থেকেই নিষ্ঠুর দমননীতির পথ ধরেন। সভা-সমিতির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করা হয় এবং ১৯০৮ সালে ভারতীয় দণ্ডবিধির পরিবর্তন ঘটিয়ে দমননীতিকে আরও জোরদার করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ‘ভারতরক্ষা আইন’ প্রবর্তন করে দেশে স্বৈরশাসন কায়েম করা হয়।

(২) সাংগঠনিক ত্রুটি

কেবলমাত্র সরকারি দমন-পীড়নই নয় – এই ব্যর্থতার পশ্চাতে সাংগঠনিক ত্রুটি বিচ্যুতিও ছিল। জন্মলগ্ন থেকেই বিপ্লবী আন্দোলনে ঐক্য ও সংহতির অভাব পরিলক্ষিত হয়।

(৩) বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ও যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধ

অনুশীলন সমিতি‘-র সূচনা পর্বেই বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ও যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধ সর্বজনবিদিত। বীতশ্রদ্ধ যতীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত রাজনীতি থেকে সরে যান।

(৪) পত্রিকা প্রকাশে মতবিরোধ

যুগান্তর পত্রিকার প্রকাশ নিয়ে পি. মিত্রের সঙ্গে বারীন্দ্রকুমার ও অন্যান্য তরুণদের বিরোধ কারও অজানা নয়। যুগান্তর পত্রিকা প্রকাশের ব্যাপারে অরবিন্দ ঘোষ -এর ভূমিকাও ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

(৫) বিপ্লবী মতাদর্শ নিয়ে বিরোধ

বিপ্লবী আদর্শ নিয়েও মতবিরোধ ছিল। পি. মিত্র, ডাঃ যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় প্রমুখ গণ-সংযোগের পক্ষপাতী ছিলেন। অন্যদিকে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, পুলিনবিহারী দাস প্রমুখ ব্যক্তি হত্যা ও সন্ত্রাসের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। অধিকাংশ বিপ্লবীই এই মতের সমর্থক ছিলেন—দীর্ঘ সংগ্রামের পথে তাঁদের কোনও আস্থা ছিল না।

(৬) সংকীর্ণ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ

বিপ্লবী আন্দোলন সারা ভারত জুড়ে সম্প্রসারিত হয় নি। এই আন্দোলন মূলত মহারাষ্ট্র, বাংলা ও পাঞ্জাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এছাড়া, বিহার, উড়িষ্যা, মাদ্রাজ ও রাজস্থানের কিছু কিছু অংশে তা বিস্তৃত হয়। এই আন্দোলন দেশজুড়ে বিস্তৃত হলে সরকারের পক্ষে তা দমন করা কষ্টকর হত।

(৭) উচ্চবর্ণ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ

এই আন্দোলনের গণভিত্তি ছিল খুবই সংকীর্ণ। কেবলমাত্র শিক্ষিত উচ্চবর্ণ ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যেই এই আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল—সমাজের বৃহত্তর অংশ শ্রমিক, কৃষক বা নিম্নবর্ণের মানুষের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক ছিল না। রাওলাট কমিটির রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বৈপ্লবিক কর্মপ্রচেষ্টার ফলে ১৮৬ জন ব্যক্তি কারাদণ্ড-প্রাপ্ত হন। এর মধ্যে ১৬৫ জন ছিলেন ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্য। ব্রাহ্মণ ও কায়স্থের সংখ্যা ছিল ১৫২ জন।

(৮) মুসলিম সমাজের দূরত্ব

বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল ছিলেন। গীতা, শ্রীকৃষ্ণ, হিন্দু দেবদেবী, শিবাজি, রাণা প্রতাপ ছিলেন তাঁদের অনুপ্রেরণার উৎস। বিভিন্ন বিপ্লবী আচার-অনুষ্ঠানেও হিন্দুয়ানি অত্যন্ত প্রকট ছিল। এর ফলে মুসলিম সমাজের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছায় এবং তারা এই আন্দোলন থেকে দূরে সরে যায়।

বিপ্লবী আন্দোলন সম্পর্কে হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের অভিমত

অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন যে “তাঁরা আবার আমাদের মনুষ্যত্বের গর্ব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।”

বিপ্লবী আন্দোলন সম্পর্কে সুমিত সরকারের অভিমত

ঐতিহাসিক ডঃ সুমিত সরকার তাঁদের এই ব্যর্থতাকে ‘বীরোচিত ব্যর্থতা’ (“heroic falilure’) বলে অভিহিত করেছেন।

বিপ্লবী আন্দোলন সম্পর্কে বিপান চন্দ্রের অভিমত

ডঃ বিপানচন্দ্র বলেন যে, “সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী চেতনা জাগিয়ে তোলার কাজে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদীরা বিরাট সফলতা অর্জন করেছিলেন। জাতীয়তাবাদী উদ্দেশ্যের কথা বাদ দিলেও তাঁরা দেশকে জাগাতে এবং দেশের মানুষের ভালবাসা ও শ্রদ্ধা অর্জন করতে সফল হয়েছিলেন। এই সাফল্য খুব কম নয়।

উপসংহার:- আপাত ব্যর্থতা সত্ত্বেও বিপ্লবীরা জাতির সামনে ত্যাগ, তিতিক্ষা, আত্মদান, বীরত্ব ও অসম সাহসিকতার যে নজির রেখে গেছেন তা চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। নরমপন্থী কংগ্রেসের ব্যর্থতা ও চরমপন্থী কংগ্রেসের ব্যর্থতার দিনে তাঁদের কর্মপ্রয়াস জাতির মনে আশা-আকাঙ্ক্ষা ও উদ্দীপনার সঞ্চার করেছিল, তাদের কর্মপ্রয়াস জাতীয় আন্দোলনকে আরও গতিশীল ও সংগ্রামমুখী করেছিল। 

(FAQ) বিপ্লবী আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ভারতে বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা হয় কোথায়?

মহারাষ্ট্রে।

২. ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র কাকে বলা হয়?

বাংলাকে।

৩. কাদের আদর্শে বিপ্লবীরা উদ্বুদ্ধ করেছিল?

স্বামী বিবেকানন্দ ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

৪. বিপ্লবীদের ব্যর্থতাকে বীরোচিত ব্যর্থতা বলেছেন কে?

ডঃ সুমিত সরকার।

Leave a Comment