ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক অগ্রগতি

ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক অগ্রগতি প্রসঙ্গে সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা, উত্থান, রাজনৈতিক অগ্রগতি, দ্বিতীয় ফিলিপের সাম্রাজ্য বিস্তার, তৃতীয় আলেকজান্ডারের অবদান, ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের বিভাজন, পঞ্চম ফিলিপের রাজত্বকাল, সাম্রাজ্যের পতন এবং মৌর্য ও ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের যোগসূত্র সম্পর্কে জানবো।

প্রাচীন গ্রিসের ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক অগ্রগতি প্রসঙ্গে ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা, ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের উত্থান, ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের অগ্রগতিতে দ্বিতীয় ফিলিপের অবদান, ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের অগ্রগতিতে তৃতীয় আলেকজান্ডারের অবদান, মৌর্য ও ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের যোগসূত্র এবং ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের পতন সম্পর্কে জানব।

ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক অগ্রগতি

ঐতিহাসিক ঘটনাম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক অগ্ৰগতি
স্থানপ্রাচীন গ্ৰিস
উত্থানকাল৮০৮ খ্রিস্টপূর্ব
প্রতিষ্ঠাতাক্যারানাস
বিস্তারকরণদ্বিতীয় ফিলিপ
ভারত অভিযানআলেকজান্ডার
হিদাস্পিসের যুদ্ধপুরু ও আলেকজান্ডার
ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক অগ্রগতি

ভূমিকা :- ইউরোপ-এর ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্য ছিল বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সাম্রাজ্য। প্রাচীন গ্রিসের উত্তর অংশে ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যটি গড়ে উঠেছিল।

ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা

ক্যারানাস (৮০৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ – ৭৭৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এই রাজ্যটির প্রতিষ্ঠা করেন। ম্যাসিডন রাজ্যের প্রথম পর্বের রাজধানী ছিল পেল্লা। ম্যাসিডনের বাসিন্দারা জাতিতে গ্রিক হলেও ম্যাসিডনে প্রাচীন গ্রিসের অনুরূপ পলিস বা নগর-রাষ্ট্র গড়ে ওঠে নি। ম্যাসিডনিয়ার পশ্চিমদিকে ছিল এপিরাস এবং এর পূর্বদিকে ছিল থ্রেস।

শক্তিশালী ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের উত্থান

ম্যাসিডনিয়া প্রাচীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী সাম্রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে বা সপ্তম শতকের প্রথমদিকে আরগিড-এর নেতৃত্বে শক্তিশালী ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে।

ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের বীরত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অগ্ৰগতি

তৃতীয় অ্যামিনটাস ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যকে সর্বপ্রথম সুসংহত রূপ দান করলেও অ্যামিনটাসের পুত্র দ্বিতীয় ফিলিপের রাজত্বকাল থেকে এই সাম্রাজ্যের বীরত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অগ্রগতি শুরু হয়েছিল। পরবর্তী সম্রাট তৃতীয় আলেকজান্ডারের রাজত্বকালে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছোয়।

দ্বিতীয় ফিলিপের সাম্রাজ্য বিস্তার

ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের রাজত্বকালের বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) সিংহাসন লাভ

তৃতীয় অ্যামিনটাসের পুত্র দ্বিতীয় ফিলিপ তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা তৃতীয় পারডিক্কাসকে সিংহাসনচ্যুত করে ম্যাসিডনিয়ার শাসন ক্ষমতা দখল করেন।

(২) সামরিক সংগঠন

তিনি পুরোনো হপলাইট সেনাদলকে ঢেলে সাজান এবং অশ্বারোহী বাহিনীকে শক্তিশালী করেন।

(৩) চেরোনিয়ার যুদ্ধজয়

তাঁর বিরুদ্ধে এথেন্স, থিবস ও অন্যান্য গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলির একটি জোট গড়ে উঠলে তিনি ৩৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চেরোনিয়ার যুদ্ধে এই জোটকে পরাজিত করেন। তিনি থ্রেস, পাইওনিয়া, ইলিরিয়া, ইজিয়ান সাগরের উপকূল অঞ্চল, অ্যাম্‌ফিপলিস, পিডনা, পটিডিয়া, ফোকিস ও অন্যান্য গ্রিক অঞ্চলে সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটান।

(৪) সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত প্রসার

তাঁর রাজত্বকালে (৩৫৯-৩৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) প্রায় সমগ্র গ্রিসে ম্যাসিডনিয়ার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে ম্যাসিডনিয়ার সামরিক শক্তি যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। থেসালির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি মূল গ্রিসের রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণের সুযোগ পান।

ম্যাসিডন সম্রাট তৃতীয় আলেকজান্ডার

দ্বিতীয় ফিলিপের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র তৃতীয় আলেকজান্ডার (৩৩৬-৩২৩ খ্রিস্টপূর্ব) মাত্র ২০ বছর বয়সে ম্যাসিডনের সিংহাসনে বসেন। তার রাজত্বকালের বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) বিদ্রোহ দমন

সিংহাসনে বসেই তিনি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহগুলি দমন করেন। তিনি সমগ্র বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখতেন।

(২) প্রথমদিকের অভিযান

তিনি ৩৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এশিয়া অভিযানে বেরিয়ে পারসিক বাহিনীকে পরাজিত করে এশিয়া মাইনর দখল করেন। এরপর একে একে সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, মিশর, গাজা, টায়ার প্রভৃতি অঞ্চল দখল করেন।

(৩) ভারত অভিযান

তিনি ৩২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ৩০ হাজার সৈন্য-সহ আফগানিস্তান ও ভারত অভিযান করেন। ভারতের ঝিলাম ও চন্দ্রভাগা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলের রাজা পুরু বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেও ঝিলাম বা হিদাসপিসের যুদ্ধ-এ (৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) আলেকজান্ডারের কাছে পরাজিত ও বন্দি হন।

(৪) সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ

এভাবে আলেকজান্ডার একে একে ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, পারস্য, উত্তর আফ্রিকা এবং ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশে অবস্থিত সিন্ধু ও পাঞ্জাবের বিভিন্ন অংশে ম্যাসিডনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে ম্যাসিডনিয়া তৎকালীন বিশ্বে সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

(৫) পিতার কৃতিত্ব ম্লান

সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় পুত্র আলেকজান্ডারের কাছে পিতা দ্বিতীয় ফিলিপের কৃতিত্ব অনেকটা ম্লান হয়ে যায়।

(৬) মৃত্যু

ভারত অভিযান করে স্বদেশে ফেরার সময় জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আলেকজান্ডার মাত্র ৩৩ বছর বয়সে ব্যাবিলন শহরে মারা যান (৩২৩ খ্রিস্টপূর্ব)।

ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের বিভাজন

আলেকজান্ডারের মৃত্যুর (৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) পরবর্তীকালে ম্যাসিডনের বিভিন্ন সেনাপতির মধ্যে সাম্রাজ্য বিভক্ত হয়ে যায়। ম্যাসিডনিয়া ও গ্রিসে প্রথম অ্যান্টিগোনাসের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

পঞ্চম ফিলিপের রাজত্বকাল

পরবর্তীকালে ম্যাসিডনের শাসক পঞ্চম ফিলিপ (২২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ১৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) রোম-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। তিনি প্রথম ম্যাসিডনের যুদ্ধে (২১৫ – ২০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) জয়ী হলেও দ্বিতীয় ম্যাসিডনের যুদ্ধে (২০০-১৯৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) রোমের কাছে পরাজিত হন। ফলে ম্যাসিডনের নৌবাহিনীর একটি বড়ো অংশ, একটি বড়ো ভূখণ্ড ও প্রচুর অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে রোমের হাতে তুলে দিতে হয়।

ম্যাসিডন সাম্রাজ্যের পতন

এরপর পারসিয়াস (১৭৯-১৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) তৃতীয় ম্যাসিডনের যুদ্ধে রোমানদের কাছে পরাজিত হয়ে সিংহাসনচ্যুত হন। ১৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ম্যাসিডন সম্পূর্ণ রোমানদের দখলে চলে যায়।

মৌর্য ও ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের যোগসূত্র

প্রাচীন ভারতের মৌর্য সাম্রাজ্য এবং ইউরোপের ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে যোগসূত্র গড়ে উঠেছিল। যেমন –

(১) আলেকজান্ডারের আক্রমণ

প্রথম পর্বে বিশ্বজয়ে বেরিয়ে ম্যাসিডনের সম্রাট তৃতীয় আলেকজান্ডার ৩২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারত আক্রমণ করেন এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের সিন্ধু ও পাঞ্জাব অঞ্চলে গ্রিক অর্থাৎ ম্যাসিডনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন।

(২) গ্রিকদের বিতাড়ন

আলেকজান্ডারের মৃত্যুর (৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) পর মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সিন্ধু ও পাঞ্জাবের গ্রিক শাসকদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে (৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) সেখান থেকে গ্রিকদের বিতাড়িত করেন।

(৩) সেলুকাসের উদ্যোগ

পরবর্তীকালে আলেকজান্ডারের অন্যতম সেনাপতি সেলুকাস চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের হাত থেকে ভারতের গ্রিক সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিন্ধু অঞ্চল -এ হাজির হন। তবে সেলুকাস ও চন্দ্রগুপ্তের মধ্যে আদৌ যুদ্ধ হয়েছিল কি না বা যুদ্ধ হলেও এতে কে জয়ী হয়েছিলেন তা জানা যায় না।

সেলুকাস ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সন্ধি

যাই হোক, ঐতিহাসিক স্ট্র্যাবো উল্লেখ করেছেন যে, উভয়ের মধ্যে একটি সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। গ্রিক সেনাপতি সেলুকাস ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মধ্যে স্বাক্ষরিত সন্ধির শর্ত অনুসারে,

  • (১) সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তকে কাবুল, কান্দাহার, হিরাট ও বালুচিস্তানের মাকরান প্রদান করেন।
  • (২) চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সেলুকাসকে ৫০০ হাতি উপহার দেন।
  • (৩) সেলুকাসের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নিজ কন্যা হেলেনের বিবাহ দেন।
  • (৪) সেলুকাস গ্রিক দূত মেগাস্থিনিসকে চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় পাঠান। মেগাস্থিনিস ৩০৪ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ২৯১ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজধানী পাটলিপুত্র-এ কাটিয়ে ইন্ডিকা নামে ভারত-বিষয়ক একটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন।

উপসংহার :- ম্যাসিডনীয় সম্রাটরা সামরিক শক্তির জোরে শুধু ইউরোপেই নয় ইউরোপের বাইরেও এক সুবিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। এই সাম্রাজ্যের দুজন শ্রেষ্ঠ সম্রাট হলেন দ্বিতীয় ফিলিপ এবং তৃতীয় আলেকজান্ডার। তাঁরা উভয়েই সাম্রাজের প্রসারে সর্বাধিক কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।

(FAQ) ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক অগ্রগতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ম্যাসিডনিয়া সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে কোথায়?

প্রাচীন গ্রিসের উত্তর অংশে।

২. ম্যাসিডনিয়া সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন কে?

ক্যারানাস ৮০৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।

৩. ম্যাসিডনিয়া সাম্রাজ্য চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় কার রাজত্বকালে?

তৃতীয় আলেকজান্ডার।

৪. ম্যাসিডনিয়া সাম্রাজ্যের কোন রাজা ভারত অভিযান করেন?

আলেকজান্ডার।

Leave a Comment