পাকিস্তানের জাতীয় কবি মহম্মদ ইকবাল প্রসঙ্গে জন্ম, বংশ পরিচয়, শিক্ষা জীবন, স্যার টমাস আর্নল্ড এর সংস্পর্শ, বিবাহ, পেশাগত জীবন, রাজনীতিতে মহম্মদ ইকবালের যোগদান, মুসলিম লীগের সভাপতি, উল্লেখযোগ্য রচনা, তার মৃত্যু ও সমাধি সম্পর্কে জানবো।
মহম্মদ ইকবাল প্রসঙ্গে অবিভক্ত ভারতবর্ষের মুসলিম কবি মহম্মদ ইকবাল, দার্শনিক মহম্মদ ইকবাল, রাজনীতিবিদ মহম্মদ ইকবাল, দক্ষিণ এশীয় ইসলামিক দার্শনিক মহম্মদ ইকবাল, উর্দু ভাষার কবি মহম্মদ ইকবাল সম্পর্কে আলোচনা।
কবি মহম্মদ ইকবাল
ঐতিহাসিক চরিত্র | মহম্মদ ইকবাল |
জন্ম | ৯ নভেম্বর, ১৮৭৭ খ্রি: |
পরিচিতি | কবি ও লেখক |
বিশেষ খ্যাতি | পাকিস্তান -এর জাতীয় কবি |
খেতাব অর্জন | নাইট উপাধি |
মৃত্যু | ২১ এপ্রিল, ১৯৩৮ খ্রি: |
ভূমিকা :- স্যার মহম্মদ ইকবাল ছিলেন অবিভক্ত ভারতবর্ষ-এর মুসলিম কবি, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও ব্যারিস্টার।
মহম্মদ ইকবালের জন্ম
১৮৭৭ সালের ৯ নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের (বর্তমানে পাকিস্তান) শিয়ালকোটের একটি জাতিগত কাশ্মীরি পরিবারে ইকবাল জন্মগ্ৰহণ করেন। তিনি আল্লামা ইকবাল নামে ব্যাপক পরিচিত।
কবি মহম্মদ ইকবালের বংশ পরিচয়
- (১) তার পরিবার কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ সাপ্রু যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তার দাদা শেখ রফিক কাশ্মিরী শাল তৈরি ও ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন।
- (২) ইকবালের বাবা শেখ নূর মহম্মদ ছিলেন দর্জি, আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত নন, তিনি একজন ধর্মীয় মানুষ ছিলেন। তার স্ত্রী, মহম্মদ ইকবালের মা ইমাম বিবিও ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক মহিলা।
মহম্মদ ইকবালের শিক্ষা জীবন
- (১) শিয়ালকোটে ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কটিশ মিশন কলেজেই ইকবাল সর্বপ্রথম আধুনিক শিক্ষা প্রাপ্ত হন। ইকবাল তার কাব্য প্রতিভার স্বীকৃতি পান তার শিক্ষক সৈয়দ মীর হাসানের কাছ থেকে।
- (২) ১৮৮৫ সালে স্কটিশ মিশন কলেজের পড়াশোনা শেষ করে ইকবাল লাহোরের সরকারি কলেজে ভর্তি হয়। দর্শন, ইংরেজি ও আরবি সাহিত্য নিয়ে তিনি পড়াশোনা করে, এখান থেকে স্বর্ণ পদক নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
- (৩) তিনি ১৮৯৫ সালে চারুকলা অনুষদ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। ১৮৯৯ সালে যখন তিনি মাষ্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন ততদিনে তিনি সাহিত্য অঙ্গনে পরিচিত ব্যক্তিত্ব।
স্যার টমাস আর্নল্ড এর সংস্পর্শে মহম্মদ ইকবাল
ইকবাল মাস্টার্স ডিগ্রিতে পড়বার সময় স্যার টমাস আর্নল্ড এর সংস্পর্শে আসেন। এই শিক্ষাবিদ ইসলাম ও আধুনিক দর্শনে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। ইকবালের কাছে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেন। স্যার টমাস আর্নল্ডই ইকবালকে ইউরোপ-এ উচ্চ শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করেন।
মহম্মদ ইকবালের বিবাহ
১৮৯৫ সালে ১৮ বছর বয়সে গুজরাটি চিকিৎসকের মেয়ে করিম বিবির সাথে তার প্রথম বিবাহ হয়েছিল। তাদের বিচ্ছেদ হয় ১৯১৬ সালে। এই দম্পত্তির তিনটি সন্তান ছিল। ১৯১৪ সালের ডিসেম্বরে ইকবালের মা মারা যাওয়ার পরের নভেম্বর মাসে মুখতার বেগমের সাথে ইকবালের দ্বিতীয় বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। তবে মা এবং পুত্র ১৯৪৪ সালে জন্মের পরেই মারা যান। পরে ইকবাল সরদার বেগমকে বিয়ে করেন। তাদের দুই সন্তান, ছেলে জাভেদ ইকবাল এবং মেয়ে মুনিরা বানো।
লেখক মহম্মদ ইকবালের পেশাগত জীবন
- (১) ১৯০৮ সালে ইকবাল ইউরোপ থেকে দেশে ফিরে আসেন এবং লাহোরের সরকারি কলেজে যোগদান করেন। এই সময় একই সাথে তিনি আইন ব্যবসা, শিক্ষাদান ও সাহিত্য চর্চা শুরু করেন।
- (২) মূলত অর্থনৈতিক কারণেই তিনি ১৯০৯ সালে সার্বক্ষণিক আইন পেশায় নিয়োজিত হন। ইকবাল কেবল একজন উঁচুমানের লেখকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন পরিচিত আইনজীবীও।
- (৩) তিনি দেওয়ানী ও ফৌজদারি উভয় বিষয়েই লাহোর হাইকোর্ট-এ হাজির থাকতেন। তার নামে ১০০ টিরও বেশি রায় দেওয়া হয়েছে। তবে তিনি তার সাহিত্যর জন্য বেশি সময় ব্যয় করতেন।
- (৪) তিনি তার পিতাকে প্রতিজ্ঞা করেন যে কবিতার বিনিময়ে কোনো অর্থ তিনি গ্রহণ করবেন না। অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কারণে তিনি সে প্রতিজ্ঞা রাখতে পারেন নি।
রাজনীতিতে মহম্মদ ইকবালের যোগদান
- (১) ব্রিটেনে থাকতেই ইকবাল সর্বপ্রথম রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। ১৯০৬ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হবার পরপরই তিনি তাতে যোগ দেন।
- (২) সৈয়দ হাসান বিলগামী এবং সৈয়দ আমির আলির সাথে তিনি উপ-কমিটির সদস্য হিসেবে মুসলিম লীগের খসড়া সংবিধান প্রস্তুত করেন। এর পর ১৯২৬ সালে তিনি লাহোরের মুসলিম লীগের পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হন।
মুসলিম লীগের সভাপতি মহম্মদ ইকবাল
ইকবাল ১৯৩০ সালে ইউনাইটেড প্রদেশের এলাহাবাদে মুসলিম লীগের অধিবেশনে এবং ১৯৩২ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচিত হন।
কবি মহম্মদ ইকবাল কর্তৃক স্বাধীন রাষ্ট্রের রূপরেখা প্রদান
২৯ ডিসেম্বর ১৯৩০-এ তার রাষ্ট্রপতির ভাষণে তিনি উত্তর-পশ্চিম ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলির জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের রূপরেখা তুলে ধরেন –
“আমি দেখতে চাই পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু এবং বেলুচিস্তানকে একটি একক রাজ্য হিসেবে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে স্ব-শাসন বা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ব্যতীত, একটি সংহত উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় মুসলিম রাষ্ট্র গঠন আমার কাছে অন্তত উত্তর-পশ্চিম ভারতের মুসলমানদের চূড়ান্ত নিয়তি বলে মনে হয়।”
মহম্মদ ইকবালের কবিতা অন্যতম শ্রেষ্ঠ
তার ফার্সি ও উর্দু কবিতা আধুনিক যুগের ফার্সি ও উর্দু সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
পাকিস্তানের আধ্যাত্মিক জনক মহম্মদ ইকবাল
মহম্মদ ইকবালকে পাকিস্তানের আধ্যাত্মিক জনক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
স্বাধীন পাকিস্তানের জাতীয় কবি মহম্মদ ইকবাল
ইকবাল তার ধর্মীয় ও ইসলামের রাজনৈতিক দর্শনের জন্যও বিশেষভাবে সমাদৃত ছিলেন। তিনি পাকিস্তানের জাতীয় কবি হিসেবে সমাদৃত
যুবকদের উপর মহম্মদ ইকবালের কাব্যের প্রভাব
আধুনিক ভারতের একজন অতি বিশিষ্ট কবি মহম্মদ ইকবাল তাঁর কাব্য রচনার মধ্য দিয়ে তরুণ ভারতীয় সমাজের দার্শনিক ও ধর্মীয় চিন্তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। তাঁর এই প্রভাব শুধু মুসলিম যুবকদের নয় সমানভাবে তা হিন্দু তরুণদেরও চিত্ত স্পর্শ করেছিল।
বিবেকানন্দের মতোই মহম্মদ ইকবালের কর্মদ্যোম
স্বামী বিবেকানন্দ-এর মতই তিনি প্রবল কর্মদ্যোমের সপক্ষে এবং পারিপার্শ্বিকতা সম্বন্ধে নৈরাশ্য, নিষ্ক্রিয়তা ও ঔদাসীন্যের বিরুদ্ধে লেখনী সঞ্চালন করেছিলেন। তিনি চাইতেন একটা বৈপ্লবিক ভাবধারা ও কর্মোদ্যম যা জগতকে নূতনরূপে গড়ে তুলবে।
মানবতাবাদী মহম্মদ ইকবাল
মূলত তিনি ছিলেন মানবতাবাদী। মানুষের কর্মশক্তিকে তিনি সর্বোত্তম গুণ রূপে বিবেচনা করতেন। তাঁর আদর্শ ছিল এই যে প্রকৃতির কাছে অথবা প্রচলিত ব্যবস্থার কাছে আত্মসমর্পণ করে দুর্গতিবহন মানব ধর্ম নয়। তাঁর মতে প্রবল কর্মনিষ্ঠা প্রয়োগ করে বিশ্ব ব্যাপারকে নিয়ন্ত্রণ করাই হচ্ছে প্রকৃত মানব ধর্ম।
লেখক মহম্মদ ইকবালের মতে নৈতিক বিচ্যুতি
যা ঘটছে ঘটুক, নির্বিচারে তাই ঘটতে দেওয়া তাঁর মতে ছিল ঘোরতর নৈতিক বিচ্যুতি। তিনি ধর্মানুষ্ঠান, অনাবশ্যক কৃচ্ছসাধন, ও ইহলোক চিন্তা বাদ দিয়ে পরকাল চিন্তা যারা করে থাকে তাদের নিন্দা করতেন।
মহম্মদ ইকবাল কর্তৃক বিশ্বাসঘাতক মুসলিমদের নিন্দা
একটি অনুচ্ছেদে, ইকবাল মুসলমানদের নিন্দা করেছেন, যারা বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা এবং মহীশূরের টিপু সুলতান-এর পরাজয় ও মৃত্যুতে ভূমিকা রেখেছিলেন এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের সুবিধার জন্য তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন।
আম্বেদকরের সাথে ইকবালের সংলাপ
ড: বি আর আম্বেদকর-এর সাথে একটি সংলাপে, ইকবাল ভারতীয় প্রদেশগুলিকে ব্রিটিশ সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে এবং কেন্দ্রীয় ভারতীয় সরকার ছাড়াই স্বায়ত্তশাসিত হিসাবে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
মহম্মদ ইকবালের উল্লেখযোগ্য রচনা
ইকবালের উল্লেখযোগ্য রচনা গুলি হল –
- (১) ইলম আল ইক্তিউদ (The Science of Economics) – উর্দু ছন্দ (১৯০১)
- (২) Islam as an Ethical and Political Ideal – ইংরেজি (১৯০৮)
- (৩) The Development of Metaphysics in Persia – ইংরেজি (১৯০৮)
- (৪) আসরার ই খুদি (The Secrets of the Self) – ফার্সি (১৯১৫)
- (৫) রুমিজ ই বেখুদি (The Mysteries of Selflessness) – ফার্সি (১৯১৭)
- (৬) পয়গাম ই মাশরিক (The Message of the East) – ফার্সি (১৯২৩)
- (৭) বাং ই দারা (The Call of the Marching Bell) – উর্দু ও ফার্সি (১৯২৪)
- (৮) জুবুর ই আজাম (The Psalms of Persia) – ফার্সি (১৯২৭)
- (৯) The Reconstruction of Religious Thought in Islam (ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন) (১৯৩০)
- (১০) জাভেদ নামা (The Book of Eternity) – ফার্সি (১৯৩২)
- (১১) বাল ই জিবরাইল (The Gabriel’s Wings) – উর্দু ও ফার্সি (১৯৩৩)
- (১২) পাস ছে বায়াদ কারদ আই আক্বওয়াম ই শারক (So What Should be Done O Oriental Nations) – ফার্সি (১৯৩৬)
- (১৩) মুসাফির (The Wayfarer) – ফার্সি (১৯৩৬)
- (১৪) জারব ই কালিম (The Blow of Moses) – উর্দু ও ফার্সি (১৯৩৬)
- (১৫) আরমাঘান ই হিজাজ (The Gift for Hijaz) – ফার্সি ও উর্দু (১৯৩৮)।
কবি মহম্মদ ইকবালের নাইট উপাধি লাভ
বিখ্যাত কবি ইকবালকে ব্রিটিশ সরকার “আসরার-ই-খোদায়ী” পুস্তকের জন্য নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন।
মহম্মদ ইকবালের মৃত্যু
১৯৩৩ সালে, স্পেন এবং আফগানিস্তান ভ্রমণ থেকে ফিরে আসার পর, ইকবাল গলায় একধরণের অজ্ঞাত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। কয়েক মাস অসুস্থ থাকার পর, ইকবাল ২১ শে এপ্রিল ১৯৩৮ সালে লাহোরে মারা যান।
লেখক মহম্মদ ইকবালের সমাধি
তার সমাধি বাদশাহী মসজিদের গেট এবং লাহোর ফোর্টের মাঝামাঝি হুজুরিবাগের বাগানে অবস্থিত। পাকিস্তান সরকার সেখানে নিরাপত্তা প্রদান করে।
উপসংহার :- তাঁর শিক্ষা ছিল কর্মের মধ্যে নিজেকে সমর্পণ করে ইহজগতেই সুখের সন্ধান মানুষের কর্তব্য। তাঁর প্রথম যুগের রচনায় তিনি ছিলেন স্বদেশপ্রেমের প্রবক্তা। তবে পরবর্তী কালে তিনি মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন।
(FAQ) পাকিস্তানের জাতীয় কবি মহম্মদ ইকবাল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
মহম্মদ ইকবালকে।
আল্লামা ইকবাল।
পাঞ্জাব প্রদেশের শিয়ালকোটে (বর্তমান পাকিস্তান)।
নাইট উপাধি।