গুপ্ত যুগের সাহিত্য প্রসঙ্গে কোশাম্বির ব্যাখ্যা, সংস্কৃত ভাষার সীমাবদ্ধতা, উচ্চ শ্রেণির বিনোদন, কালিদাস, বিশাখদত্ত, ভারবি, দণ্ডিন, বিষ্ণুশর্মা ও সুবন্ধু সম্পর্কে জানবো।
গুপ্ত যুগের সাহিত্য
বিষয় | গুপ্ত যুগের সাহিত্য |
সাম্রাজ্য | গুপ্ত সাম্রাজ্য |
শ্রেষ্ঠ রাজা | সমুদ্রগুপ্ত |
সাহিত্যের ভাষা | সংস্কৃত |
কবি সার্বভৌম | কালিদাস |
ভূমিকা :- প্রাচীন ভারত -এর গুপ্তযুগের সাহিত্য, শিল্প উচ্চ শ্রেণীর রুচির উপযোগী ছিল। সংস্কৃত ভাষা ছিল এই সাহিত্যের বাহন।
গুপ্ত যুগের সাহিত্য সম্পর্কে কোশাম্বির ব্যাখ্যা
- (১) কোশাম্বি সংস্কৃত ভাষা কেন গুপ্ত যুগে ব্যবহার করা হয় তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কোশাম্বি মনে করেন যে, নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রাখার জন্যই সংস্কৃতের আদর বাড়ে।
- (২) উচ্চশ্রেণী ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় সাধারণ লোক থেকে নিজেদের পার্থক্য রাখার জন্য এবং নবোদিত ধনীরা এই উচ্চতর সমাজে স্থান পাওয়ার জন্য সংস্কৃত ভাষাকে উচ্চশ্রেণীর ভাষা হিসেবে আঁকড়ে ধরেন। লোকের মুখের ভাষা প্রাকৃত আড়ালে পড়ে যায়। অলঙ্কার-বহুল, ব্যাকরণ-কণ্টকিত সংস্কৃত তার স্থান নেয়।
গুপ্ত যুগে সংস্কৃত ভাষার সীমাবদ্ধতা
- (১) সংস্কৃত ভাষাকে শব্দ ও ব্যাকরণের কঠিন নিয়মে বাধার ফলে এই ভাষার পরিবর্তনশীলতা, গভীরতা ও মানবতা প্রকাশের ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। শব্দের অর্থকে চিরন্তন মনে করায় অন্য অর্থে সেই শব্দকে ব্যবহার করে তার ব্যাপকতা ও ব্যঞ্জনা বাড়াবার ক্ষেত্র সীমিত হয়।
- (২) সংস্কৃত সাহিত্যে গদ্য এজন্য বিশেষভাবে দুর্বল। সংস্কৃত ভাষায় রচিত গ্রন্থের বিষয়বস্তু সীমাবদ্ধ। জীবনের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় বিষয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচনার অভাব চোখে পড়ার মত।
গুপ্ত যুগে উচ্চ শ্রেণীর বিনোদন
উচ্চ শ্রেণীর জন্য বিনোদন-মূলক সাহিত্য সংস্কৃতে বহু রচিত হয়েছে। ধর্ম ও দর্শনেও গ্রন্থ রচিত হয়েছে। কিন্তু স্থাপত্য, চিত্রকলা, ভাস্কর্য এবং প্রয়োগ বিজ্ঞানের ওপর সংস্কৃত গ্রন্থ বিশেষ নেই। কারণ সংস্কৃত গ্রন্থ যারা রচনা করতেন এবং যাদের জন্য রচিত হত তাঁরা ছিলেন অভিজাত ও উচ্চকোটির লোক। সংস্কৃত সাহিত্যে গদ্য রচনা বেশী নেই এবং কাব্যের তুলনায় গদ্য রচনা দুর্বল। সবল গদ্য ছাড়া কোন মননশীল রচনা সৃষ্টি করা কঠিন।
গুপ্ত যুগের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকার কালিদাস
- (১) গুপ্ত যুগের তথা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকার ছিলেন মহাকবি কালিদাস। কিংবদন্তি অনুসারে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার উজ্জ্বলতম রত্ন। কালিদাস গুপ্ত যুগে জীবিত ছিলেন কিনা এ নিয়ে নানা রকম মত প্রচলিত আছে।
- (২) অনেকে বলেন যে, তাঁর রচনায় বিক্রমাদিত্যের কথা জানা যায়। এই রাজা বিক্রম সম্ভবত উজ্জয়িনীর বিক্রমাদিত্য। কিংবদন্তী অনুসারে ইনি প্রথম খ্রিস্ট পূর্বে জীবিত ছিলেন। সুতরাং কালিদাস খ্রিস্ট পূর্ব প্রথম শতকের লোক। তিনি সম্রাট অগ্নিমিত্রের কথাও বলেছেন তার মালবিকা-অগ্নিমিত্র নাটকে। সুতরাং তিনি সম্ভবত শুঙ্গ রাজাদের সমকালীন ছিলেন।
- (৩) বেশীর ভাগ লেখকের মতে, কালিদাস ছিলেন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সমকালীন। কালিদাসের টীকাকার মল্লিনাথের টীকায় দিন্নাগাচার্যের উল্লেখ আছে। দিন্নাগাচার্য ছিলেন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সমসাময়িক। এই কারণে কালিদাসকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সমকালীন ধরা হয়। তাছাড়া দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের উপাধি ছিল বিক্রমাদিত্য। এর সঙ্গে রাজা বিক্রমের নাম কিংবদন্তীতে জড়িয়ে যায়।
- (৪) ডঃ অশোক শাস্ত্রীর মতো পণ্ডিতেরা বলেন যে, কালিদাস সমুদ্রগুপ্তের সমসাময়িক ছিলেন। কারণ, তাঁর রঘুবংশম্ মহাকাব্যে রঘুর দিগ্বিজয়ের যে বর্ণনা দেওয়া আছে তা প্রায় সমুদ্রগুপ্তের দিগ্বিজয়ের বর্ণনার অনুরূপ। কালিদাস, সমুদ্রগুপ্ত ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত উভয়ের সমকালীন ছিলেন। উভয়ের বিজয়কে অবলম্বন করে তিনি রঘুবংশম কাব্যে রঘুর দিগ্বিজয়ের বর্ণনা দিয়েছেন।
- (৫) এই মতের একটা বড় ত্রুটি এই যে, এতে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে শক-ক্ষত্রপদের যুদ্ধের বর্ণনা দেওয়া হয়নি। কিন্তু এমনও হতে পারে যে, শক যুদ্ধের আগেই কালিদাস তাঁর কাব্যটি রচনা করেন। এখন বেশীর ভাগ পণ্ডিত কালিদাসকে সমুদ্রগুপ্ত ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সমসাময়িক বলে মনে করেন।
- (৬) সমালোচকদের মতে কালিদাসের রচনার শ্রেষ্ঠ দিক হল উপমার ব্যবহার। কিন্তু এ কথা সর্বাংশে সত্য নয়। কালিদাসের ভাবগৌরব কম নেই। শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রার সময় কালিদাস যে বিষণ্ণ ও করুণ ভাবের অবতারণা করেছেন তার তুলনা খুব কম।
- (৭) কালিদাসের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলির মধ্যে অভিজ্ঞান শকুন্তলম, রঘুবংশম্, মেঘদূতম, কুমারসম্ভবম্, মালবিকাগ্নিমিত্রম্ প্রভৃতি বিখ্যাত। কালিদাস তাঁর মেঘদূতম্ মহাকাব্যে অনবদ্য একশটি শ্লোকে তাঁর ভাব প্রকাশ করেছেন। তিনি মেঘকে দূত হিসেবে ব্যবহার করে তাঁর কাব্য বিরহী যক্ষের মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেছেন। সমগ্র কাব্যটি মন্দাক্লাস্তা ছন্দে রচিত।
- (৮) কালিদাসের রচনা পড়ে মনে হয় যে, দর্শন শাস্ত্র, সাংখ্য, যোগ, নাট্য শাস্ত্র, জ্যোতিষ প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। প্রকৃতি ও মানুষকে তিনি ভালভাবে অনুধাবন করেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের সূক্ষ্ম অনুভূতি তিনি বিশ্লেষণে পারদর্শী ছিলেন। মালবিকাগ্নিমিত্রম নাটকে কালিদাস ঐতিহাসিক কাহিনী ব্যবহার করেছেন। অন্য নাটক ও কাব্যে তিনি পৌরাণিক কাহিনী ব্যবহার করেছেন।
গুপ্ত যুগের সাহিত্যকার বিশাখদত্ত
কালিদাস ছাড়া গুপ্ত যুগের অন্যান্য শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকার ছিলেন মুদ্রারাক্ষস নাটকের রচয়িতা বিশাখদত্ত। তার নাটক মুদ্রারাক্ষস ও দেবীচন্দ্রগুপ্তম ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে কাজে লাগে।
গুপ্ত যুগে রচিত মৃচ্ছকটিকম্
মৃচ্ছকটিকম নাটকের রচয়িতা শুদ্রক। খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে তিনি বর্তমান ছিলেন বলে অনুমান করা হয়।
গুপ্ত যুগের কবি ভারবি
কীরাতার্জুনীয়মের রচয়িতা ছিলেন ভারবি। ভারবি সঠিকভাবে গুপ্তযুগের কবি না হলেও গুপ্তযুগের ভাবধারায় তাঁর কাব্য রচনা করেন। তাঁর কাব্য অর্থগৌরবের জন্য বিখ্যাত। খ্রীঃ ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি তিনি জীবিত ছিলেন বলে মনে করা হয়।
গুপ্ত যুগে গদ্য সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রূপকার দণ্ডিন
ভারতের গুপ্ত যুগে সংস্কৃত গদ্য সাহিত্যের বিশেষ উন্নতি হয়। দণ্ডিন ছিলেন সংস্কৃত গদ্য সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রূপকার। তিনি তাঁর দশকুমার চরিত ও কাব্যাদর্শ অনবদ্য গদ্যে রচনা করেন। দণ্ডীর রচনায় সমাজের নিম্নবর্গের মানুষদের কথা জানা যায়। তিনি লোকচরিত্র অত্যন্ত নিপুণভাবে বিশ্লেষণ করেন।
গুপ্ত যুগের গল্পকার বিষ্ণুশর্মা ও সুবন্ধু
বিষ্ণুশর্মা বিখ্যাত পঞ্চতন্ত্রের কাহিনী রচনা করেন। গুপ্তযুগের ছায়ায় সুবন্ধু তাঁর বাসবদত্তার কাহিনী রচনা করেন। তাঁর রচনায় আড়ম্বরপূর্ণ, অলঙ্কার-বহুল বাক্যের ব্যবহার বেশী দেখা যায়।
উপসংহার :- এই সময় অমরসিংহ ছন্দাকারে সংস্কৃত অভিধান অমরকোষ রচনা করেন। গুপ্তযুগে সংস্কৃত ব্যাকরণ -এ চন্দ্র যোমিন ও জিনেন্দ্র বিশেষ খ্যাতি পান। এছাড়া সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেণ, চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী বীরসেনও ছিলেন কবি।
(FAQ) গুপ্ত যুগের সাহিত্য সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
সংস্কৃত।
কালিদাস।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য।
বিশাখদত্ত।