প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রয়োজনীয়তা, জাতিসংঘের জনক, চোদ্দো দফা শর্ত, ভার্সাই সন্ধির অঙ্গ, কমিটি গঠন, লিগের চুক্তিপত্র, ধারা বা অনুচ্ছেদ, প্রতিষ্ঠা দিবস, প্রথম অধিবেশন, উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য, গঠন, সদস্য সংখ্যা, সংগঠন, কার্যাবলী, ব্যর্থতা, বিলুপ্তি ও জাতিসংঘের কৃতিত্ব সম্পর্কে জানবো।
জাতিসংঘ
ঐতিহাসিক ঘটনা | জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা |
প্রতিষ্ঠা দিবস | ২৮ এপ্রিল, ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ |
প্রথম অধিবেশন | ১০ জানুয়ারি, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ |
জনক | উড্রো উইলসন |
প্রেক্ষাপট | প্রথম বিশ্বযুদ্ধ |
ভূমিকা :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসকাণ্ড ও নারকীয় হত্যালীলা মানুষের মনে প্রবল আতঙ্ক ও হতাশার সৃষ্টি করে। পৃথিবীর সর্বত্রই শান্তির জন্য প্রবল ব্যাকুলতা দেখা দেয় এবং এই ব্যাকুলতা থেকেই জন্ম নেয় ‘লিগ অব নেশনস্’ বা ‘জাতিসঙ্ঘ’।
আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রয়োজনীয়তা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের রাজনীতিকরা পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে ও শান্তিপূর্ণভাবে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন।
জাতিসংঘের জনক
এই ব্যাপারে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। তাঁকে নিঃসন্দেহে ‘লিগ অব নেশনস্’ বা ‘জাতিসঙ্ঘের জনক’ বলা যেতে পারে।
উড্রো উইলসনের চোদ্দোদফা শর্ত
১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ৮ই জানুয়ারি ঘোষিত উড্রো উইলসনের বিখ্যাত চৌদ্দ দফা নীতি -এর সর্বশেষ দফায় জাতিসঙ্ঘের কথা বলা হয়েছে। যুদ্ধাবসানে ভার্সাই সম্মেলন বা প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি উইলসন এই প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং তা সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।
ভার্সাই সন্ধির অঙ্গ
কয়েকজন রাজনীতিবিদ এই পরিকল্পনাকে একটি পৃথক প্রস্তাব হিসেবে রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মার্কিন রাষ্ট্রপতির জেদাজেদিতে শেষ পর্যন্ত জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবটি ভার্সাই সন্ধির অঙ্গ হিসেবে গৃহীত হয়। তাঁর আশঙ্কা ছিল যে, একবার ভার্সাই সন্ধি গৃহীত হয়ে গেলে লিগ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আর কেউ আগ্রহী হবে না।
কমিটি গঠন
পরিকল্পনাটি ভালোভাবে বিচার-বিবেচনা ও তার নিয়মাবলী রচনার জন্য উড্রো উইলসনের সভাপতিত্বে এই সম্মেলনেই একটি কমিটি গঠিত হয়।
জাতিসংঘ বা লিগের চুক্তিপত্র
এই কমিটি ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসঙ্ঘের খসড়া সংবিধান প্রস্তুত করে। এর নাম হল ‘লিগ কভেনান্ট’ বা লিগের চুক্তিপত্র বা গঠনতন্ত্র। সামান্য সংশোধনের পর এই চুক্তিপত্র গৃহীত হয়।
জাতিসংঘের ধারা বা অনুচ্ছেদ
এই চুক্তিপত্রে ২৬টি ধারা বা অনুচ্ছেদ আছে এবং তাতে লিগের উদ্দেশ্য, গঠনতন্ত্র ও নিয়মাবলী সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা আছে।
জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা দিবস
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে এপ্রিল প্যারিস শান্তি সম্মেলনে জাতিসঙ্ঘের চুক্তিপত্রটি গৃহীত হয়। এই দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে লিগের প্রতিষ্ঠা দিবস বলা হয়ে থাকে।
জাতিসংঘের প্রথম অধিবেশন
১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১০ই জানুয়ারি লিগের প্রথম অধিবেশন বসে।
জাতিসংঘের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য
জাতিসঙ্ঘ বা লিগের চুক্তিপত্রে জাতিসঙ্ঘের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যের বিশদ বিবরণ আছে। এর মূল উদ্দেশ্য হল যুদ্ধের পরিবর্তে আপস-মীমাংসা ও পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান করে বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করা। লিগের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলি প্রতিশ্রুতি দেয় যে,
- (১) তারা পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখবে।
- (২) ন্যায় ও সততার ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করবে।
- (৩) আন্তর্জাতিক আইন, বিধি-নিষেধ, আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সন্ধির শর্তাদি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চলবে।
- (৪) কোনও রাষ্ট্র অন্যায়ভাবে অন্য রাষ্ট্র আক্রমণ করলে জাতিসঙ্ঘের নির্দেশে অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্র আক্রমণকারী দেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ, প্রয়োজনে সামরিক বলপ্রয়োগ করে বিশ্বশান্তিকে সুনিশ্চিত করবে।
- (৫) মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে অবহেলিত জাতিসত্তা, নারী, শিশু ও শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষা, বিশ্বস্বাস্থ্য এবং সেবাকার্যও এই সংগঠনের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে স্থির হয়।
জাতিসংঘের গঠন
জাতিসঙ্ঘে দু’ধরনের সদস্য ছিল – আদি বা প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং সাধারণ সদস্য (১) মিত্রপক্ষীয় যে সব রাষ্ট্র বিভিন্ন শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল তারা প্রাথমিক সদস্য বলে বিবেচিত হত। নিরপেক্ষ কোনও রাষ্ট্র এর সদস্যপদ গ্রহণ করলেও প্রাথমিক সদস্য বলে বিবেচিত হত। (২) বিজিত কোনও রাষ্ট্র এর সদস্য হলে সাধারণ সদস্য বলে বিবেচিত হত।
জাতিসংঘের সদস্য সংখ্যা
১৯২০ খ্রিস্টাব্দে লিগের প্রথম অধিবেশনে এর সদস্যসংখ্যা ছিল ৪০। পরে দ্বিতীয় শ্রেণির সদস্য গ্রহণের ফলে এর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে এর সদস্যসংখ্যা হয় ৬০। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ -এর প্রাক্কালে এর সদস্যসংখ্যা হ্রাস পেয়ে হয় ৪৬।
জাতিসংঘের সংগঠন
একটি সাধারণ সভা, একটি পরিষদ বা কাউন্সিল ও একটি সচিবালয় নিয়ে জাতিসঙ্ঘ গঠিত হয়। জাতিসঙ্ঘের প্রধান কার্যালয় বা সদর দপ্তর স্থাপিত হয় জেনেভা শহরে। এর অধীনে একটি আন্তর্জাতিক বিচারালয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা (International Labour Organisation) ছিল। এছাড়াও আরও কিছু উন্নয়নমূলক সংস্থা এর অধীনে ছিল।
জাতিসংঘের কার্যাবলী
জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার এক দশকের মধ্যে তার মর্যাদা সর্বোচ্চ সীমায় উপনীত হয়। এই সময়কালকে লিগের ইতিহাসে ‘সুবর্ণ যুগ’ বলে চিহ্নিত করা হয়। জাতিসঙ্ঘের প্রধান কাজ ছিল পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান। সর্বক্ষেত্রে প্রশংসনীয় সাফল্য না পেলেও দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তীকালে (১৯১৯-১৯৩৯ খ্রিঃ) এই ব্যাপারে লিগ যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে।
জাতিসংঘের ব্যর্থতা
কিছু ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করলেও বহুক্ষেত্রেই লিগ চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। যেমন –
- (১) ভিলনা শহরকে কেন্দ্র করে পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়া (১৯২২ খ্রিঃ) এবং গ্রিসের করফু দ্বীপকে কেন্দ্র করে গ্রিস ও ইতালির (১৯২৩ খ্রিঃ) বিরোধের মীমাংসা করা জাতিসঙ্ঘের পক্ষে সম্ভব হয় নি।
- (২) জাপান কর্তৃক চীন -এর মাঞ্চুরিয়া দখল (১৯৩১ খ্রিঃ), ইতালি কর্তৃক আবিসিনিয়া অধিকার (১৯৩৫-১৯৩৬ খ্রিঃ), নিরস্ত্রীকরণ সমস্যার সমাধান, জার্মানি কর্তৃক ক্রমাগত ভার্সাই সন্ধি লঙ্ঘন প্রভৃতি ক্ষেত্রে লিগ কোনও কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয় নি।
জাতিসংঘের বিলুপ্তি
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে কার্যত লিগের বিলুপ্তি ঘটে।
জাতিসংঘের ব্যর্থতার কারণ
জাতিসঙ্ঘের এই ব্যর্থতার মূলে নানা কারণ ছিল। যেমন ধারণার অভাব, ভার্সাই চুক্তির অংশ, বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির অনুপস্থিতি, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স -এর প্রাধান্য, আন্তরিকতা ও ঐক্যের অভাব, সাংগঠনিক দুর্বলতা, সামরিক শক্তির অভাব, অস্ত্রের প্রতিযোগিতা ইত্যাদি।
জাতিসংঘের কৃতিত্ব
লিগ তার উদ্দেশ্যপূরণে ব্যর্থ হলেও তার কৃতিত্বকে অস্বীকার করা যায় না। যেমন –
- (১) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত ও রণক্লান্ত পৃথিবীতে শান্তিপূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক বিবাদ-বিসম্বাদের মীমাংসা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় লিগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। সর্বক্ষেত্রে সফল না হলেও তার ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না।
- (২) বিশ্বের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থিক উন্নয়নেও লিগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। জনস্বাস্থ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শ্রমিকদের কল্যাণসাধন, দাসপ্রথার উচ্ছেদ, দরিদ্র জনসাধারণের আর্থিক উন্নয়ন, শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়ন প্রভৃতি কাজে লিগের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।
উপসংহার :- সবশেষে বলা যায় যে, লিগই প্রথম আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সম্প্রীতির ধারণাটিকে জনপ্রিয় করে তোলে। এটিই তার শ্রেষ্ঠ অবদান। এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠিত হয় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ।
(FAQ) জাতিসংঘ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৯১৯ সালে।
২৮ এপ্রিল।
১০ জানুয়ারি, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন।