ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাস রচনায় ইন্দো-পারসিক ঐতিহ্য

ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাস রচনায় ইন্দো-পারসিক ঐতিহ্য প্রসঙ্গে ভারতে ইন্দো-পারসিক ভাষাচর্চার সূচনা, ভারতে ইন্দো-পারসিক চর্চার প্রসার, ইন্দো-পারসিক ইতিহাসচর্চার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, ধর্মীয় চিন্তাধারা, বিভিন্ন ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গি, পারসিক ইতিহাসচর্চার বিভিন্ন ধারা, ঐতিহাসিকদের ত্রুটি, ইন্দো পারসিক ইতিহাস চর্চার অবসান সম্পর্কে জানবো।

মধ্যযুগের ইতিহাস রচনায় ভারতে ইন্দো-পারসিক ঐতিহ্য প্রসঙ্গে ভারতে ইন্দো-পারসিক ভাষাচর্চার সূচনা, ভারতে ইন্দো-পারসিক ইতিহাসচর্চার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, ভারতে ইন্দো-পারসিক ইতিহাসচর্চায় ধর্মীয় চিন্তাধারা, ভারতে ইন্দো-পারসিক ইতিহাসচর্চায় বিভিন্ন ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গি ও পারসিক ইতিহাসচর্চার বিভিন্ন ধারা সম্পর্কে জানব।

ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাস রচনায় ইন্দো-পারসিক ঐতিহ্য

ঐতিহাসিক ঘটনাভারতীয় মধ্যযুগের ইতিহাস রচনায় ইন্দো-পারসিক ঐতিহ্য
শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিকজিয়াউদ্দিন বরনি
আরবদের সিন্ধু জয়৭১২ খ্রি
তৈমুর লঙের ভারত আক্রমণ১৩৯৮ খ্রি
কিরান উস সাদাইনআমির খসরু
ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাস রচনায় ইন্দো-পারসিক ঐতিহ্য

ভূমিকা :- ৭১২ খ্রিস্টাব্দে আরবদের সিন্ধুদেশ জয় এবং ত্রয়োদশ শতকে (১২০৬ খ্রি.) তুর্কিদের দিল্লির শাসনক্ষমতা অধিকার ভারত-এর ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা করে। আরব ও তুর্কি ঐতিহাসিকদের আগমনে প্রচুর ইতিহাস গ্রন্থাদি রচিত হতে শুরু করে।

যদুনাথ সরকারের মন্তব্য

স্যার যদুনাথ সরকার তাই বলেন যে, ‘সমকালীন ভারতীয় সংস্কৃতিতে মুসলিম ইতিহাসচর্চা হল পারসিক ভাবধারাযুক্ত তুর্কিদের একটি মহান উপহার।’

ভারতে ইন্দো-পারসিক ভাষাচর্চার সূচনা

  • (১) হজরত মহম্মদ-এর মৃত্যুর পরে বিভিন্ন পণ্ডিত ও বিদ্বান ব্যক্তি মুসলিম সংস্কৃতির উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। গজনির সুলতানদের শাসনকালে (৯৭৭ খ্রি.-১১৮৬ খ্রি.) মুসলিম সেনাদল যখন ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য সীমান্তে অভিযান চালায় তখন বেশ কিছু পারসিক লেখক ও বুদ্ধিজীবী তাদের সঙ্গী হয়ে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশে বসবাস শুরু করেন।
  • (২) মূলত তাঁরাই ভারতীয় উপমহাদেশে পারসিক ভাষায় বিদ্যাচর্চার ঐতিহ্যের সূচনা করেন। এই ঐতিহ্যের ভিত্তি পরবর্তীকালে মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমণের (১১৭৫ খ্রি.- ১১৯২ খ্রি.) পর আরও শক্তিশালী হয়। এই সময় থেকে ভারতে ইন্দো-পারসিক ইতিহাসচর্চারও সূত্রপাত ঘটে।

ভারতে ইন্দো-পারসিক ইতিহাসচর্চার প্রসার

হিন্দু পারস্যের ইতিহাস চর্চার প্রসারের প্রধান দুটি দিক হলো –

(১) সুলতানি আমল

দিল্লি সুলতানির শাসনকালে বিশেষ করে খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকে ভারতে ইন্দো-পারসিক জ্ঞানের চর্চা এবং সেই সঙ্গে ইন্দো-পারসিক ইতিহাসচর্চা যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। অবশ্য তৈমুর লঙ-এর ভারত আক্রমণের (১৩৯৮ খ্রি.) পরবর্তীকালে এদেশে ইন্দো-পারসিক ইতিহাসচর্চার গতি কিছুকালের জন্য ব্যাহত হয়।

(২) মোগল আক্রমণ

ভারতে মোগল শাসনকালের প্রথম দুশো বছর ইন্দো-পারসিক ইতিহাসচর্চার গতি যথেষ্ট তীব্রতর ছিল। মোগল শাসনাধীন বিস্তৃত অঞ্চল, এমনকি বাংলা, গুজরাট, দাক্ষিণাত্য, প্রভৃতি আঞ্চলিক রাজ্যেও ইন্দো-পারসিক ইতিহাসচর্চার গতি বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই গতি অন্তত অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

ইন্দো-পারসিক ইতিহাসচর্চার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য

ভারতে ইন্দো-পারসিক ইতিহাসচর্চার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন –

(১) সঠিক কালানুক্রম

৭১২ খ্রিস্টাব্দে আরবদের সিন্ধু জয়ের সময় আরবি ভাষার মাধ্যমে সেখানকার ইতিহাসচর্চা পদ্ধতি ভারতে প্রবেশ করে। আরবদের ইতিহাসচর্চার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সঠিক কালানুক্রম ও সঠিক সন-তারিখের উপস্থাপনা। আরব ঐতিহাসিকদের কালচেতনা ছিল বিস্ময়কর। ইন্দো-পারসিক ধারার ঐতিহাসিকরখও পরবর্তীকালে আরব ঐতিহাসিকদের এই কালচেতনা ও সঠিক সন-তারিখের উপস্থাপনারীতি অনুসরণ ও অনুকরণ করেন। ফলে ইন্দো- পারসিক ইতিহাসচর্চার মাধ্যমে ভারতে যথার্থ কালানুক্রম অনুসারে ইতিহাস লেখার প্রসার ঘটে।

(২) উচ্চস্তরের মানুষের আলোচনা

পারসিক ঐতিহাসিকরা ভারতে বিভিন্ন রাজদরবারের সমর্থনপুষ্ট ছিলেন এবং শাসকশ্রেণির কার্যাবলির মধ্যে তাঁরা নিজেদের কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। ফলে তাঁরা রাজশক্তির স্তাবকতা করতে বাধ্য হন। এককথায় তাঁদের ইতিহাসচর্চার আলোচ্য বিষয় ছিল সমাজের উচ্চস্তরের মানুষেরা। দেশের বৃহত্তর জনসমাজ, ধর্ম, অর্থনীতি, শিল্পকলা প্রভৃতি তাদের আলোচনায় স্থান পায় নি। মুসলিম ইতিহাসচর্চার এই ধারা ‘মনাফির’ বা ‘ফজাইল’ নামে পরিচিত ছিল।

ধর্মীয় চিন্তাধারা

  • (১) ইন্দো-পারসিক যুগে ঐতিহাসিকদের মধ্যে অনেকেই ইসলামীয় চিন্তাধারায় আচ্ছন্ন ছিলেন। তাঁরা সব কিছুই ইসলামীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতেন। তাঁরা ধর্মীয় চিন্তার দ্বারা এতটাই আচ্ছন্ন ছিলেন যে, ইসলাম-বিরোধী বা ইসলাম কর্তৃক স্বীকৃত নয়, এমনকি সকল কাজকেই তাঁরা বিরূপভাবে উপস্থাপিত করেছেন।
  • (২) উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সুলতানি যুগের শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরনির মতে, ইতিহাসের সঙ্গে হাদিসের সম্পর্ক আছে। ড. মহিবুল হাসান বলেন যে, এই ধরনের ধর্মীয় চিন্তায় আচ্ছন্ন ঐতিহাসিকদের মানসিক সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আধুনিক পাঠকদের সতর্ক থাকা অত্যন্ত জরুরি। এই সময় অবশ্য এমন অনেক ঐতিহাসিকই ছিলেন যাঁরা সকল ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে বিরাজ করতেন।

বিভিন্ন ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গি

  • (১) আমির খসরু, জিয়াউদ্দিন বরনি, ইসামি, আফিফ, ইয়াহিন-বিন-আহম্মদ, সরহিন্দ ইতিহাসকে অভিজাত মানুষের কার্যাবলির বিবরণ বলেই মনে করতেন। সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষ সম্পর্কে তাঁদের সীমাহীন বিদ্বেষ ছিল। বরনির মতে, নিম্নবর্গের মানুষদের শিক্ষা দেওয়া উচিত নয়।
  • (২) বরনির মতে, মহম্মদ-বিন-তুঘলক নিম্নবর্গের মানুষদের উচ্চপদে বসিয়ে রাষ্ট্রের সর্বনাশ ডেকে এনেছেন। বরনি তাঁর ‘তারিখ-ই- ফিরোজশাহি’-র মুখবন্ধে বলেন যে, বাদশাহ ও শাসকশ্রেণির শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে সকলকে অবহিত করার জন্যই তিনি এই গ্রন্থটি রচনা করেন। আমির খসরু বলেন যে, তিনি রাজার আদেশ পালনের জন্যই ‘কিরান-উস-সাদাইন’ রচনা করেন।

পারসিক ইতিহাসচর্চার বিভিন্ন ধারা

ভারতে পারসিক ভাষায় ইতিহাসচর্চা বিভিন্ন ধারায় বিকশিত হয়েছিল। এসব ধারার মধ্যে অন্যতম ছিল আত্মজীবনীমূলক রচনা, কাব্য, নীতিশাস্ত্র, প্রশাসনিক বিবরণ, কথোপকথন, উপদেশমূলক সাহিত্য, সুফিসাধকদের জীবনী, রাজনৈতিক ইতিহাস প্রভৃতি।

ঐতিহাসিকদের ত্রুটি

ইন্দো-পারসিক শ্রেণীভুক্ত ঐতিহাসিকদের বিভিন্ন ত্রুটি গুলি হল –

(ক) রাজ আনুকূল্য

  • (১) ইন্দো-পারসিক শ্রেণিভুক্ত এইসব ঐতিহাসিকদের প্রায় সকলেই দিল্লির সুলতানদের অনুগ্রহপুষ্ট ছিলেন এবং দিল্লি দরবারে উচ্চ রাজপদে আসীন ছিলেন। আমির খসরু ও জিয়াউদ্দিন বরনি যথাক্রমে আলাউদ্দিন খলজিফিরোজ শাহ তুঘলক-এর অনুগ্রহপুষ্ট ছিলেন। তাঁদের পক্ষে সুলতানের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা সম্ভব ছিল না।
  • (২) আমির খসরু আলাউদ্দিন খলজি সম্পর্কে অনেক কথা বললেও তাঁর নিষ্ঠুরতা ও বিশ্বাসঘাতকতার কোনো উল্লেখ করেন নি। এই যুগের ঐতিহাসিকদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন মহম্মদ ইসামি, যিনি সুলতানদের আনুকূল্য বা আতঙ্কের কোনো তোয়াক্কা করেন নি।

(খ) রাজনীতির বিবরণ – সমাজ ও অর্থনীতির নয়

এইসব ঐতিহাসিক বাদশার দরবার, যুদ্ধবিগ্রহ, রাজ্যবিস্তার, প্রশাসন, বিদ্রোহ প্রভৃতির কথা বললেও সমাজ, অর্থনীতি, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির কথা কিছুই বলেন নি। ফলে তাঁদের ইতিহাসচর্চা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলেন বরনি। তিনি অন্যদের তুলনায় এ সম্পর্কে অনেক বেশি তথ্য তুলে ধরেছেন।

(গ) ধর্মীয় সংকীর্ণতা

এই যুগের লেখকরা ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও অসহিষুতা দ্বারা আচ্ছন্ন ছিলেন। তাঁদের পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ ইতিহাস রচনা করা সম্ভব হয় নি। এই যুগের শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরনিও এই অভিযোগ থেকে মুক্ত ছিলেন না। তিনি জাগতিক সমস্ত কার্যকলাপের পশ্চাতে ঈশ্বরের নির্দেশ লক্ষ্য করেছেন। তাঁর ইতিহাসচর্চার উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠা।

ইন্দো পারসিক ইতিহাস চর্চার অবসান

অষ্টাদশ শতকের পর ভারতে মোগল শাসনের ভাঙন শুরু হলে ইন্দো-পারসিক ধারার ঐতিহাসিকরা রাজানুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হতে থাকেন। ফলে ভারতে ইন্দো-পারসিক ইতিহাসচর্চার প্রায় অবসান ঘটে।

উপসংহার :- কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি, চেন্নাই-এর গভর্নমেন্ট ওরিয়েন্টাল ম্যানুসক্রিপ্টস লাইব্রেরি ও অন্যান্য বিভিন্ন স্থানে ইন্দো-পারসিক ইতিহাসচর্চার বহু পাণ্ডুলিপি এখনও সংরক্ষিত আছে।

(FAQ) ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাস রচনায় ইন্দো-পারসিক ঐতিহ্য হতে জিজ্ঞাস্য?

১. সুলতানি যুগের শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক কে ছিলেন?

জিয়াউদ্দিন বরনী।

২. জিয়াউদ্দিন বরনীর লেখা গ্রন্থের নাম কি?

তারিখ ই ফিরোজশাহী।

৩. তৈমুর লং কখন ভারত আক্রমণ করে?

১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে।

৪. কিরান উস সাদাইন কে রচনা করেন?

 আমির খসরু।

Leave a Comment