ব্যাকট্রিয় বা ইন্দো-গ্ৰীক শাসনের গুরুত্ব

ব্যাকট্রিয় বা ইন্দো-গ্ৰীক শাসনের গুরুত্ব প্রসঙ্গে পরস্পর প্রভাব, মধ্য এশিয়ার সাথে যোগাযোগ, ভারতীয় জনগোষ্ঠীর শক্তি বৃদ্ধি, বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব, গরুঢ় স্তম্ভ নির্মাণ, সামাজিক ও রক্তের সম্পর্ক, ভারতীয় শিল্পে প্রভাব, বিজ্ঞানে প্রভাব ও সাহিত্যে প্রভাব সম্পর্কে জানবো।

ব্যাকট্রিয় বা ইন্দো-গ্ৰীক শাসনের গুরুত্ব

ঐতিহাসিক ঘটনাইন্দো-গ্ৰীক শাসনের গুরুত্ব
রাজ্যব্যাকট্রিয়া
রাজধানীশিয়ালকোট
বিখ্যাত রাজাডিমিট্রিয়াস, মিনান্দার
ব্যাকট্রিয় বা ইন্দো-গ্ৰীক শাসনের গুরুত্ব

ভূমিকা :- ডঃ জে. এন. বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন যে, ভারত -এর ইতিহাসে আলেকজাণ্ডারের ভারত আক্রমণ অপেক্ষা ব্যাকট্রিয় গ্রীক অধিকারের ফল অনেক বেশী গভীর ও স্থায়ী হয়েছিল।

পরস্পর প্রভাব

আলেকজাণ্ডার -এর আক্রমণের প্রত্যক্ষ ফল তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু ডিমিট্রিয়াস, মিনান্দার প্রমুখ ইন্দো-গ্রীক রাজারা দীর্ঘকাল ভারতে বাস করে ভারতের সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে প্রভাব ফেলেন। ইন্দো-গ্রীকরা ভারতীয় সভ্যতার দ্বারা নিজেরাও প্রভাবিত হন।

মধ্য এশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ

মৌর্য সাম্রাজ্য -এর পতন এবং শক-পার্থিয়-কুষাণ শক্তির উদ্ভবের মধ্যবর্তী সময়ে ভারত ইতিহাসে ইন্দো-গ্রীক শক্তির আগমন ঘটে। ইন্দো-গ্রীক রাজাদের প্রভাবে ব্যাকট্রিয়া বা মধ্য এশিয়ার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিম ভারতের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়।

ভারতীয় জনগোষ্ঠীর শক্তি বৃদ্ধি

ইন্দো-গ্রীকদের পথ ধরে শক পার্থিয়-কুষাণ প্রভৃতি জাতিগুলি ভারতে প্রবেশ করে। এই বহিরাগত জাতিগুলি ভারতীয় জনগোষ্ঠীতে মিশে গিয়ে ভারতীয় জনগোষ্ঠীকে সমৃদ্ধ করে।

বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব

ইন্দো-গ্রীকরা ভারতে আসার পর তারা ভারতীয় সভ্যতার প্রবল প্রাণশক্তির প্রভাব এড়াতে পারেনি। গ্রীক রাজাদের মধ্যে অনেকেই ভারতীয় ধর্ম গ্রহণ করেন। মিনান্দার বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন বলে জানা যায়।

গরুঢ় স্তম্ভ নির্মাণ

উত্তর-পশ্চিমের গ্রীক রাজা এ্যান্টিয়ালকিডাসের বিদিশায় প্রেরিত রাজদূত হেলিওডোরাস বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি ভগবান বিষ্ণুর স্মরণে বিদিশায় পিতলের তৈরি গরুড় স্তম্ভ নির্মাণ করেন। তার গায়ে তিনি পরম ভাগবত যবন হেলিওডোরাস বলে নাম খোদাই করান।

বুদ্ধের পবিত্র চিহ্ন স্থাপন

থিওডোরাস নামে এক গ্রীক কর্মচারী সোয়াট বা স্বাত উপত্যকার উদ্যান নামক স্থানে গৌতম বুদ্ধ -এর পবিত্র চিহ্ন স্থাপন করেন।

সামাজিক ও রক্তের সম্পর্ক

গ্রীক ও ভারতীয়দের মধ্যে সামাজিক ও রক্তের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সম্ভবত সেলুকাস -এর কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। পরবর্তীকালে ভারতীয় ও ইন্দো-গ্রীকদের মধ্যে বিবাহের সংখ্যা বাড়ে। এর ফলে ভারতীয় জাতি সমৃদ্ধ হয়।

ভারতীয় শিল্পে প্রভাব

ভারতীয় শিল্পের ক্ষেত্রে ইন্দো-গ্রীকদের অবদান লক্ষ্য করা যায়। যদিও কৃষাণ যুগে গান্ধার শিল্প পরিণতি পায় তথাপি গান্ধার শিল্পের সূত্রপাত ব্যাকট্রিয় যুগে ঘটেছিল। বুদ্ধ মূর্তিগুলোর গঠনে গ্রীক মাংসপেশী বহুল দেহভঙ্গির সঙ্গে ভারতীয় ধ্যানী বুদ্ধের নিমিলিত চক্ষু, অভয় মুদ্রা সংযুক্ত হয়। গ্রীকদের অনুকরণে ছাঁচে ঢালা একই ওজন, মাপ ও ছাপ মারা মুদ্রা ভারতে প্রচলিত হয়।

প্রতীক খোদাই করা মুদ্রা

ডঃ জে. এন. বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ব্যাকট্রিয় গ্রীকদের আগে, ভারতীয় মুদ্রা ছিল “পাঞ্চ মার্ক” অর্থাৎ প্রতীক খোদাই করা মুদ্রা। তাতে রাজার নাম, মূর্তি, সন-তারিখ থাকত না। ব্যাকট্রিয়দের প্রভাবে ভারতে ছাচে ঢালাই করা একই ওজনের রাজার মূর্তি, সন-তারিখযুক্ত মুদ্রার প্রচলন ভারতে শুরু হয়। গ্রীকরা তাদের মুদ্রায় ভারতীয় খরোষ্ঠী লিপি চালু করে।

গ্রীক বিজ্ঞানের প্রভাব

  • (১) গ্রীক জ্যোতির্বিজ্ঞান, গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান তত্ত্ব ভারতীয় বিজ্ঞানীরা শিক্ষা করেন বলে টার্ন (Tarn) বলেছেন। গ্রীকদের নাটক অনুষ্ঠানে পর্দা ব্যবহার করা হত। তার প্রভাবে ভারতীয় নাটকে পর্দা ফেলার প্রথা চালু হয়।
  • (২) যবন বা গ্রীকদের কাছ থেকে এই পর্দা প্রথা আসে বলে পর্দার নাম হয় ‘যবনিকা’। অবশ্য কোনো কোনো পণ্ডিত বলেন যে, ‘যবনিকা’ নামের উৎপত্তি হয়েছে গ্রীকদের দ্বারা তৈরি কাপড়ে পর্দা তৈরি করা হত বলে।

সাহিত্যে প্রভাব

  • (১) ডঃ সুনীতিকুমার চ্যাটার্জির মতে, রামায়ণ -এর কাহিনী, হোমারের ইলিয়াডের প্রভাবে রচিত হয়। ইন্দো-গ্রীকদের দ্বারা ইলিয়াডের কাহিনী ভারতে ছড়িয়েছিল। ভারতীয় সাহিত্য যুগ পুরাণে গ্রীক বা যবন আক্রমণের কথা উল্লিখিত হয়।
  • (২) মিলিন্দ প্রশ্ন গ্রন্থটিও ভারতীয় ধর্ম সম্পর্কে মিনান্দারের আগ্রহের পরিচয় দেয়। কেউ কেউ বলেন যে, ভারতীয় কাব্যের ছন্দ রচনায় গ্রীক কবিতার ষষ্ঠপদী ছন্দের প্রভাব দেখা যায়। তবে এ সম্পর্কে বিতর্ক আছে।

উপসংহার :- শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ব্যাকট্রিয় শাসন ব্যবস্থা পরবর্তীকালে শক-পার্থিয়রা গ্রহণ করে। ব্যাকট্রিয় রাজারা সামন্ত শাসকদের স্বায়ত্ব শাসনের অধিকার দিত। ব্যাকট্রিয়রা ভারতীয়দের প্রতি কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ করত না।

(FAQ) ব্যাকট্রিয় বা ইন্দো-গ্ৰীক শাসনের গুরুত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কোন ইন্দো-গ্ৰীক রাজা দ্বিভাষিক মুদ্রা প্রচলন করেন?

ডিমিট্রিয়াস।

২. ভারতে শিয়ালকোট নগরের পত্তন কে করেন?

ইন্দো-গ্ৰীক রাজা ডিমিট্রিয়াস।

৩. ভারতে সর্বাধিক জনপ্রিয় ব্যাকট্রিয় রাজা কে ছিলেন?

মিনান্দার।

Leave a Comment