ব্যক্তি হিসেবে হুমায়ুন

ব্যক্তি হিসেবে হুমায়ুন প্রসঙ্গে পিতার আদেশ, স্ত্রী পুত্রের প্রতি কর্তব্য, আত্মীয়তা, চরিত্রের কোমলতা, সামরিক কৃতিত্ব, সাহিত্য প্রতিভা, অমায়িক ব্যবহার, ধর্মীয় উদারতা ও শাসক হিসেবে কৃতিত্ব সম্পর্কে জানবো।

ব্যক্তি হিসেবে হুমায়ুন

বিষয়ব্যক্তি হিসেবে হুমায়ুন
সাম্রাজ্যমুঘল সাম্রাজ্য
বাদশাহহুমায়ুন
পূর্বসূরিবাবর
উত্তরসূরিআকবর
ব্যক্তি হিসেবে হুমায়ুন

ভূমিকা :- হুমায়ুন যে একজন যথার্থ সজ্জন ভদ্রলোক ছিলেন সে সম্পর্কে কোনো দ্বিমত নেই। সমসাময়িক ও আধুনিক সব ঐতিহাসিকই একমত যে, হুমায়ুন ছিলেন দয়াবান, স্নেহশীল ও হৃদয়বান নরপতি।

হুমায়ুন কর্তৃক পিতার আদেশ পালন

  • (১) যোগ্য পিতারূপে পুত্রের প্রতি তিনি যথারীতি দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনিও পুত্র হয়ে পিতার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। এমনকি পিতার মৃত্যুর পরও তাঁর আদেশ পালন করতে বিস্মৃত হন নি।
  • (২) নিজের সিংহাসন পণ করেও মৃত্যুশয্যায় পিতার দেওয়া আদেশ অনুযায়ী ভ্রাতাদের সাম্রাজ্য ভাগ করে দিতে তিনি কুণ্ঠাবোধ করেন নি।

স্ত্রী-পুত্রের প্রতি হুমায়ুনের কর্তব্য

মায়ের প্রতিও হুমায়ুনের সমান শ্রদ্ধা ছিল। স্ত্রী হামিদাবানুর প্রতিও ছিল গভীর কর্তব্যবোধ। পুত্র আকবরের প্রতি স্নেহশীল পিতা হিসেবে তিনি যে দায়িত্ব পালন করেছেন, তা খুব কম পিতার পক্ষেই সম্ভব।

হুমায়ুনের আত্মীয়তা

মহম্মদ জামাল মির্জা ও মহম্মদ সুলতান মির্জার বিদ্রোহ সত্ত্বেও তিনি তাদেরকে শুধুমাত্র আত্মীয়তার জন্য বারবার ক্ষমা করেছেন এবং তাঁদেরকে বিশ্বাস করে দায়িত্বও দিয়েছেন।

বাদশাহ হুমায়ুনের চরিত্রের কোমলতা

  • (১) পিতার মতোই তিনি তাঁর কর্মচারীদের সঙ্গে সহজ-সরলভাবে মিশতেন এবং তাদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হতেন। বিশেষত, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের প্রতি তাঁর উদারতার এত মাত্রাধিক্য ঘটেছিল যে, এর ফলে নিজেকেও বিপন্ন হতে হয়েছে।
  • (২) ভাইদের চরম শত্রুতার পরেও তাদের বারবার ক্ষমা করেছেন। এমনকি কামরানের শত্রুতার জন্য সিংহাসনকে নিষ্কণ্টক করার স্বার্থে অভিজাতগণ কামরানের প্রাণদণ্ড দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন।
  • (৩) হুমায়ুন অভিজাতদের উত্তর দিয়েছিলেন যে, “বুদ্ধির বিচারে আমি আপনাদের সঙ্গে একমত, কিন্তু অন্তরের দিক দিয়ে এই পরামর্শ গ্রহণে অক্ষম।” স্বীয় বিপদের সম্ভাবনা জেনেও তিনি নিজ চরিত্রের কোমলতাকে কখনও বিসর্জন দিতে পারেন নি।

হুমায়ুনের দৈহিক সামর্থ্য

  • (১) দৈহিক সামর্থ্যের দিক দিয়ে তিনি অক্ষম ছিলেন না। পিতার সহযোগী হিসেবে পানিপথের প্রথম যুদ্ধ-এ এবং খানুয়ার যুদ্ধ-এ মাত্র আঠারো বছর বয়সে তিনি শৌর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন।
  • (২) চরম সংকটেও যে তিনি অবিচলিত থাকতে পারতেন এবং দুঃখ, যন্ত্রণা ও দুর্দশা সহ্য করারও যে তাঁর মানসিকতা ছিল, তা তাঁর দীর্ঘ পনেরো বছরের নির্বাসিত জীবনে পরিচয় পাওয়া যায়।

মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের সামরিক কৃতিত্ব

চৌসার যুদ্ধকনৌজের যুদ্ধ-এ শেরশাহ যে কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন, মাছিয়ারা ও সিরহিন্দের যুদ্ধে হুমায়ুনও সেই কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছিলেন। গুজরাট ও মালব বিজয় হুমায়ুনের সামরিক কৃতিত্বের স্মারক হিসেবে চিহ্নিত।

হুমায়ুনের সাহিত্য প্রতিভা

বাবরের মতো সাহিত্য-প্রতিভা না থাকলেও, সাহিত্য-প্রীতি ও কবি-প্রতিভা তাঁর চরিত্রের অন্যতম গুণ ছিল। অঙ্ক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। দিল্লিতে তিনি একটি মানমন্দির তৈরি করার কথাও ভেবেছিলেন।

হুমায়ুনের অমায়িক ব্যবহার

  • (১) হুমায়ুনের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য গুণ হল অমায়িক ব্যবহার ও আনন্দপ্রবণ মেজাজ। ভাগ্যবিপর্যয় বা অজস্র দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে থেকেও তিনি তাঁর চিত্তের সরসতাকে বা সহৃদয়তাকে হারাতে পারেন নি।
  • (২) আত্মীয়, বন্ধু, সহযোগী ও অধস্তন ব্যক্তিদের প্রতি সর্বদা তিনি প্রীতি-স্নিগ্ধ আচরণ করতেন। এই স্বভাবসিদ্ধ সহৃদয়তা একজন শাসকের বিপদের কারণ হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

হুমায়ুন সম্পর্কে ফিরিস্তার অভিমত

তাই ফিরিস্তা বলেছেন, চরিত্রের সদগুণাবলির দিক দিয়ে হুমায়ুন সর্বশ্রেষ্ঠ। আবুল ফজল বলেছেন, হুমায়ূন আলেকজান্ডার-এর মতো উদ্যমী ও অ্যারিস্টটল-এর মতো জ্ঞানী ছিলেন।

বাদশাহ হুমায়ুনের ধর্মীয় উদারতা

  • (১) হুমায়ুন ধর্মের দিক দিয়ে নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন, কিন্তু তাঁর মধ্যে কোনো ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না। তিনি প্রতিদিন পাঁচবার ধর্মীয় প্রার্থনায় যোগ দিতেন, কিন্তু অপর ধর্মের প্রতি কোনো বিরূপ ধারণা পোষণ করতেন না।
  • (২) তাঁর প্রধান মহিষী হামিদাবানু ‘শিয়া’ সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। হুমায়ুনের জীবন সংকটকালে এবং তাঁর পুত্র আকবরের জীবন সংকটকালে যিনি পরিত্রাতার ভূমিকা নিয়েছিলেন, সেই বৈরাম খানও ‘শিয়া’ সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন।
  • (৩) এমনকি পারস্যের ‘সাফাভি’ রাজদরবারে হুমায়ুন যখন আশ্রিত ছিলেন, তখন তিনি ‘শিয়া’ সম্প্রদায়ের বিধি মেনে চলতে দ্বিধা করেন নি।

হুমায়ুনের রাজদরবারের সংস্কৃতি

তাঁর রাজদরবার সংস্কৃতির এক পীঠস্থানে পরিণত হয়েছিল। বহু পণ্ডিত তাঁর সভায় উপস্থিত থাকতেন। এঁদের মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য ছিলেন খুদামির, সাহাউদ্দিন কাফা ও জৌহর। জৌহরের বিবরণ মুঘল যুগের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল।

শাসক হিসেবে হুমায়ুনের কৃতিত্ব

  • (১) শাসক হিসেবে হুমায়ুন কিন্তু কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে যেতে পারেন নি। তাঁর শাসনকালের প্রথম দশ বছরে তিনি শাসনতান্ত্রিক বিষয়ে তেমন কোনো কৃতিত্বের পরিচয় দিতে পারেন নি।
  • (২) কারণ হিসেবে ঐতিহাসিক রাসব্রুক উইলিয়াম মনে করেন, তাঁর পিতার কাছ থেকে তখন তিনি এক কম্পমান সাম্রাজ্য পেয়েছিলেন। যে সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব নির্ভরশীল ছিল অবিরাম যুদ্ধের মাধ্যমে।
  • (৩) অবিরাম যুদ্ধ করতে গিয়ে এবং ভ্রাতাদের বিরোধিতায় বিব্রত হয়ে হুমায়ুন শাসনতান্ত্রিক বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারেননি।

হুমায়ুনসম্পর্কে ডঃ ত্রিপাঠীর অভিমত

আধুনিক ঐতিহাসিক ড. ত্রিপাঠী মনে করেন, তাঁর প্রথম দশ বছরের শাসনকালে কামরানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো ছিল। যখন কামরান দেখেন যে, হুমায়ুন শাসক হিসেবে ব্যর্থ, তখনই তিনি হুমায়ুনের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হন।

হুমায়ুনের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব

প্রকৃতপক্ষে নবপ্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যের সংহতি রক্ষার জন্য এবং আফগানদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার জন্য যে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রয়োজন, তা হুমায়ুনের মধ্যে ছিল না। হুমায়ুনের দুর্ভাগ্য যে, তাঁর অশেষ গুণাবলি থাকা সত্ত্বেও তিনি শাসক হিসেবে ব্যর্থ হন।

হুমায়ুন সম্পর্কে লেনপুলের মন্তব্য

ঐতিহাসিক লেনপুল মন্তব্য করেছেন যে, হুমায়ুন কোনো কাজ একনাগাড়ে বেশিক্ষণ করতে পারতেন না। তাছাড়া ‘অহিফেন’ সেবন করায় তাঁর সজীবতা বিনষ্ট হয় এবং ইহাই তাঁর জীবনের শোচনীয় ‘ট্র্যাজেডির’ মূল কারণ ছিল।

হুমায়ুন সম্পর্কে এস রায়ের অভিমত

ঐতিহাসিক এস. রায় বলেছেন, সিংহাসনের চেয়েও তিনি আফিম বেশি ভালোবাসতেন। তাঁর চরিত্রের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি ছিল তিনি কাউকেই সন্দেহ করতেন না। প্রকৃতপক্ষে তাঁর চরিত্রের অশেষ গুণাবলিই তাঁর বার্থতার পথ প্রশস্ত করেছিল।

ভাগ্যবিড়ম্বিত শ্রেষ্ঠ শাসক হুমায়ুন

এইদিক লক্ষ্য করেই লেনপুল বলেছেন, তৈমুর বংশের ভাগ্যবিড়ম্বিত শাসকদের মধ্যে তিনিই ছিলেন যোগ্যতায় শ্রেষ্ঠ। ভাগ্যের উদাসীনতাই তাঁকে বিফলতা বরণে বাধ্য করে। তিনি সারাজীবন ধরে বহুবার ব্যর্থ হয়েছেন, আবার পুনরায় সাফল্যও অর্জন করেছেন।

গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী হুমায়ুনের

হুমায়ুনের ব্যর্থতা সত্ত্বেও ড. ত্রিপাঠী হুমায়ুনকে “brave, cool, calm and dignified” বলে উল্লেখ করেছেন। তবে হুমায়ুনের ব্যর্থতা পর্যালোচনা করার সময় আমাদের একথা ভুললে চলবে না যে, বাবরকে লড়াই করতে হয়েছিল ইব্রাহিম লোদীর সঙ্গে। কিন্তু হুমায়ুনকে লড়াই করতে হয়েছিল ‘মহান আকবরের অগ্রদূত’ শের শাহের বিরুদ্ধে। তাই হুমায়ুনের দুর্বলতা ও ব্যর্থতা সত্ত্বেও ভারত ইতিহাসে হুমায়ুন ছিলেন এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী।

হুমায়ুনের গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্ব

যথাসময়ে মুঘল শক্তির পুনরুদ্ধার করা তাঁর প্রকৃতই এক গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্ব। যা পরবর্তীকালে আকবরের ভারতব্যাপী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পথকে নির্মাণ করে দিয়েছিল। এছাড়া ভারত ও পারস্যের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক স্থাপন ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসে এক সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য সৃষ্টি করেছিল।

উপসংহার :- পরিশেষে বলা যায়, তাঁর সবথেকে বড়ো সৌভাগ্য যে তিনি আকবরের মতো এক সুযোগ্য পুত্রকে মুঘল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। যিনি পরবর্তী বিশ্বের অন্যতম সুশাসকরূপে হুমায়ুনের নাম ও মুঘল রাজবংশকে বিশ্ব-ইতিহাসে স্থান করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

(FAQ) ব্যক্তি হিসেবে হুমায়ুন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. হুমায়ুন কথার অর্থ কি?

ভাগ্যবান।

২. তৈমুর বংশের ভাগ্যবিড়ম্বিত শাসকদের মধ্যে যোগ্যতায় শ্রেষ্ঠ কে?

হুমায়ুন।

৩. কার বিরুদ্ধে পরাজিত হয়ে হুমায়ুন রাজ্যচ্যুত হন?

শেরশাহ।

৪. হুমায়ুন পুনরায় রাজ্য লাভ করেন কখন?

১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Comment