মুঘল সম্রাট শাহজাহানের প্রাথমিক সমস্যা প্রসঙ্গে দুটি বিদ্রোহ, বীর সিংহ বুন্দেলা, জুঝর সিং, সম্পৎ রায়ের বিদ্রোহ, জগৎ সিংহের বিদ্রোহ, খান জাহান লোদির বিদ্রোহ, পোর্তুগিজদের দ্বারা বিব্রত, গুজরাট ও দাক্ষিণাত্যে দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে জানবো।
মুঘল সম্রাট শাহজাহানের প্রাথমিক সমস্যা
বিষয় | শাহজাহানের প্রাথমিক সমস্যা |
মুঘল বাদশা | শাহজাহান |
সময়কাল | ১৬২৮-১৬৫৮ খ্রি |
পূর্বসূরি | জাহাঙ্গীর |
উত্তরসূরি | ঔরঙ্গজেব |
ভূমিকা :- সিংহাসনে আরোহণের পর শাহজাহানকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
শাহজাহানের আমলে দুটি বিদ্রোহ
রাজত্বের প্রথমদিকে তাঁকে দুটি বিদ্রোহের মোকাবিলা করতে হয়। প্রথমটি বুন্দেলা সর্দার বীরসিংহ বুন্দেলার পুত্র জুঝর সিংহের বিদ্রোহ এবং দ্বিতীয়টি, দাক্ষিণাত্যের সুবাদার আমির খান জাহান লোদির বিদ্রোহ।
বীরসিংহ বুন্দেলা
বীরসিংহ বুন্দেলাই সেলিমের পক্ষ নিয়ে আকবর-এর রাজত্বের শেষের দিকে আবুল ফজলকে হত্যা করেছিলেন এবং সেলিম সিংহাসনে আরোহণ করে তাকে নানাভাবে পুরষ্কৃত করেছিলেন। এছাড়া তিনি বিরাট ধনসম্পদের অধিকারীও হন।
শাহজাহানের আমলে জুঝর সিংহের বিদ্রোহ
- (১) বীরসিংহ বুন্দেলার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র জুঝর সিংহ বুন্দেলার রাজা হন। শাহজাহানের কাছে যখন খবর আসে জুঝর সিংহ অত্যাচারী হয়ে উঠেছেন, শাহজাহান তখনই জুঝর সিংহের কৈফিয়ত তলব করে তাকে আগ্রায় ডেকে পাঠান।
- (২) জুঝর সিংহ শাহজাহানের এই মনোভাবে ভীত হয়ে, সম্রাটের অনুমতি ছাড়াই গোপনে আগ্রা ত্যাগ করে বুন্দেলায় পলায়ন করেন। জুঝর সিংহের এইরূপ ব্যবহারে শাহজাহান অসন্তুষ্ট হয়ে তাকে দমন করার উদ্দেশ্যে মহাবত্ খান, খান-ই-জাহান ও আবদুম খানের নেতৃত্বে এক মুঘল বাহিনী প্রেরণ করেন।
- (৩) শাহজাহান চারদিক থেকে বুন্দেলা আক্রমণ করিয়ে জুঝর সিংহকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। প্রকৃতপক্ষে এই বিদ্রোহ দমনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ঔরঙ্গজেব। জুঝর সিংহ আত্মসমর্পণ করেন এবং জায়গির রক্ষার জন্য শাহজাহানকে প্রচুর অর্থ দিয়ে তিনি জায়গির ফিরে পান।
- (৪) কিন্তু শাহজাহানকে আরও একবার বুন্দেলায় জুঝর সিংহকে দমনের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী প্রেরণ করতে হয় এবং এই অভিযানে জুঝর সিংহ নিহত হন। বুন্দেলখণ্ড রাজ্য সম্পূর্ণভাবে মুঘলদের অধীনস্থ হয়।
শাহজাহানের রাজত্বে সম্পৎ রায়ের বিদ্রোহ
১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে মহোবার সম্পৎ রাই মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত বীরসিংহ বুন্দেলার অপর পুত্র পহারসিংহের মধ্যস্থতায় তাঁকে শাহজাহানের বশ্যতা স্বীকার করতে হয়।
শাহজাহানের বিরুদ্ধে জগৎসিংহের বিদ্রোহ
মৌ-নূরপুরের রাজা বাসু জাহাঙ্গিরের বিশ্বস্ত ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর পুত্র জগৎসিংহও শাহজাহানের কাছ থেকে প্রভূত সম্মান পেয়েছিলেন। কিন্তু পুত্র রাজরূপের প্ররোচনায় তিনি ১৬৪১ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ করেন। এই বিদ্রোহ সহজেই দমিত হয় এবং জগৎসিংহ বশ্যতা স্বীকার করেন।
শাহজাহানের বিরুদ্ধে খান জাহান লোদির বিদ্রোহ
- (১) দ্বিতীয় বিদ্রোহ দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা আমির খান জাহান লোদির নেতৃত্বে ঘটে। জাহাঙ্গির আমির খান-জাহানকে একসময় দাক্ষিণাত্যের শাসক রাজপুত্র পারভেজের উপদেষ্টা নিয়োগ করেছিলেন।
- (২) তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে দাক্ষিণাত্যের নীতি-নির্ধারক। সৈনিক ও শাসক হিসেবেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। দাক্ষিণাত্যে তিনি যে নীতি অবলম্বন করছিলেন, শাহজাহান সিংহাসনে আরোহণ করার পর তা প্রতিক্ষেত্রেই অনুমোদন করতেন না।
- (৩) এখানে উল্লেখ্য, জাহাঙ্গিরের মৃত্যু হলে খান জাহান নুরজাহান-এর পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। স্বভাবতই খান-জাহান মুঘলদের শত্রু আহম্মদনগরের নিজামশাহি বংশের নরপতি দ্বিতীয় মুর্তজার সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে মুঘলদের অধিকৃত স্থান বালাঘাট নিজামশাহি রাজ্যকে ছেড়ে দেন।
- (৪) এর ফলে শাহজাহান মহাবং খানকে খান জাহান লোদির স্থলে দাক্ষিণাত্যে নিয়োগ করে, খান জাহানকে আগ্রায় ডেকে পাঠান। কিন্তু খান জাহান আগ্রায় এসে দরবারের পরিস্থিতি বিবেচনা করে, দাক্ষিণাত্যে পলায়ন করেন।
- (৫) দাক্ষিণাত্যে নিজামশাহির রাজ্যের নরপতি দ্বিতীয় মুর্তজার সাহায্য নিয়ে তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এই বিদ্রোহ দমন করতে শাহজাহানের প্রায় তিন বছর সময় লেগেছিল।
- (৬) খান জাহান লোদির সঙ্গে নিজামশাহি রাজ্যের নরপতি দ্বিতীয় মুর্তজা, রাজপুত ও মারাঠারা যুক্ত হওয়ায় দাক্ষিণাত্য মুঘলদের হস্তচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। যাই হোক, শেষপর্যন্ত শাহজাহান এই বিদ্রোহ সম্পূর্ণভাবে দমন করেন এবং সিন্ধুর তীরে খান জাহান লোদি নিহত হন।
পোর্তুগিজদের দ্বারা বিব্রত শাহজাহান
- (১) এই সময়েই শাহজাহান পোর্তুগিজদের দ্বারা বিব্রত হন। আকবর ও জাহাঙ্গির পোর্তুগিজদের ওপর সদয় ছিলেন এবং তাদের বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করার অনুমতি দিয়েছিলেন।
- (২) এই অনুমতির বলে তারা পশ্চিমবঙ্গ-এ সাতগাঁও-এর বাণিজ্যকুঠি নির্মাণ করেছিলেন এবং শাহজাহানের রাজত্বকাল-এর প্রথমদিকে তারা শক্তিবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে হুগলিতে বাণিজ্যকুঠির অন্তরালে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করে।
- (৩) পোর্তুগিজরা শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবসা করার জাত ছিল না। তারা বেআইনিভাবে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তামাকের ওপর শুল্ক আদায় করতে থাকে। এতে বাদশাহি আয়ের ক্ষতি হয়।
- (৪) উপরন্তু তারা বঙ্গদেশের নানাস্থানে লুণ্ঠন, দাস-ব্যবসা এবং বলপূর্বক সাধারণ মানুষকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করতে থাকে। জাহাঙ্গির হুগলির পোর্তুগিজদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেন নি।
- (৫) ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে পোর্তুগিজরা ঢাকার কাছে একটি গ্রাম লুণ্ঠন করলে এবং মমতাজমহলের দুজন হারেমের মহিলাকে আটক করলে, ঢাকার শাসক কাশিম খান শাহজাহানের কাছে বঙ্গদেশ থেকে পোর্তুগিজদের বিতাড়িত করার সুপারিশ করেন।
- (৬) এই সুপারিশ অনুযায়ী এক বিরাট মুঘল বাহিনী কাশিম খানের নেতৃত্বে হুগলি অভিযান করে এবং পোর্তুগিজদের নির্মূল করে দিতে সমর্থ হয়। কাশিম খান পোর্তুগিজদের বিরুদ্ধে নৌকোয় কামান সাজিয়ে এই আক্রমণের মোকাবিলা করেন এবং পোর্তুগিজ সেনাপতিদের কঠোরভাবে শাস্তি দেন।
- (৭) এই ঘটনার পর থেকে পোর্তুগিজরা পাকাপাকিভাবে উচ্ছেদ হয়। প্রায় চার হাজার পোর্তুগিজকে বন্দি অবস্থায় আগ্ৰায় আনা হয়। অবশ্য ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে শাহজাহান পোর্তুগিজদের হুগলিতে পুনরায় শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের অনুমতি দেন।
- (৮) অনেক ঐতিহাসিক পোর্তুগিজদের দমন করাকে শাহজাহানের ওপর ধর্মীয় সংকীর্ণতার অভিযোগ এনেছেন। কিন্তু এই অভিযোগ যথার্থ নয়। কারণ, পোর্তুগিজদের বিরুদ্ধে শাহজাহানের ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে, এই বিধর্মী জলদস্যুদের হাত থেকে বাংলার মান-ইজ্জত রক্ষা পায়।
- (৯) পোর্তুগিজ মিশনারিদের কার্যকলাপকে বার্নিয়ে তীব্রভাবে নিন্দা করেছেন। এমনকি সমসাময়িক ঐতিহাসিক আবদুর রসিদ শাহজাহনের কার্যকলাপের যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা অর্থাৎ শাহজাহানের ভূমিকাকে ন্যায়সংগত বলে মন্তব্য করেছেন।
শাহজাহানের আমলে গুজরাট ও দাক্ষিণাত্যে দুর্ভিক্ষ
- (১) এইসব অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনের সঙ্গে সঙ্গে শাহজাহান তাঁর রাজত্বকালের চতুর্থ ও পঞ্চম বছরে গুজরাট ও দাক্ষিণাত্যে আর একটি বিরাট বিপর্যয়, অর্থাৎ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হন। খাদ্যের অভাবে গুজরাট ও দাক্ষিণাত্যে হাহাকার ওঠে।
- (২) দরবারি ঐতিহাসিক আবদুল হামিদ লাহোরি এই ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের এক মর্মস্পর্শী বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এই দুর্ভিক্ষের ভয়ংকর বিবরণ লিখতে গিয়ে বলেছেন, “একটুকরো রুটির জন্য মানুষ আত্মবিক্রয় করতে প্রস্তুত ছিল, কিন্তু খরিদ্দার জুটত না। খাদ্যের অভাবে মানুষ মানুষের মাংস ভক্ষণ করতে থাকে, পুত্র-স্নেহ অপেক্ষা পুত্রের মাংস অধিক লোভনীয় ছিল। মৃতদেহের স্তূপের জন্য রাস্তাঘাটে যাতায়াত করা যেত না।”
- (৩) সমকালীন ইংরেজ পর্যটক পিটার মান্ডিও এই ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। শাহজাহান কিন্তু মধ্যযুগীয় শাসকদের মতো নীরব না থেকে, মুঘল ঐতিহ্যানুযায়ী প্রজাদের এই ভয়ংকর কষ্ট লাঘবের ব্যবস্থা করেন।
- (৪) তিনি মনসবদারদের নির্দেশ দেন তাঁরা যেন জনসাধারণের কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সেবামূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। উপরন্তু লঙ্গরখানা খুলে খাদ্য বিতরণের ব্যবস্থা করেন। ওই দুই রাজ্যের ৭০ লক্ষ টাকার রাজস্ব মকুব করে দেন।
- (৫) এছাড়া জনসাধারণকে সরকারি কোষাগার থেকে প্রতিদিন অর্থ সাহায্যের ব্যবস্থাও করেন। ইংরেজ ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ, পিটার মান্ডির বিবরণ বিশ্বাস করে, শাহজাহানের দুর্ভিক্ষ লাঘবের ক্ষেত্রে অপ্রতুলতার অভিযোগ এনেছেন। এই অভিযোগ যথার্থ নয় বলে আধুনিক ঐতিহাসিক ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ মন্তব্য করেছেন।
উপসংহার :- এইভাবে অভ্যন্তরীণ সমস্যায় বিব্রত হলেও, পিতামহের মতো তিনি এই সমস্যাগুলির সমাধান করেন এবং মুঘল রণতরির যে যাত্রা আকবর শুরু করিয়েছিলেন, তার যাত্রা অক্ষুণ্ণ রাখেন।
(FAQ) মুঘল সম্রাট শাহজাহানের প্রাথমিক সমস্যা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
গুজরাট ও দাক্ষিণাত্যে।
শাহজাহান।
শাহজাহান।
আবদুল হামিদ লাহোরি।