প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ প্রসঙ্গে যুদ্ধের সময়কাল, প্রেক্ষাপট, অগ্রগতি, যুদ্ধের অবসান, যুদ্ধের ফলাফল ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানবো।
১৯৯০-৯১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ প্রসঙ্গে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়কাল, প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বা পটভূমি বা কারণ, প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সূচনা, প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের অগ্রগতি, প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের অবসান ও প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের গুরুত্ব সম্পর্কে জানব।
প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ
ঐতিহাসিক যুদ্ধ | প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ |
অন্য নাম | প্রথম খাঁড়ি যুদ্ধ |
সময়কাল | ১৯৯০-৯১ খ্রি |
বিবাদমান পক্ষ | ইরাক ও আমেরিকার জোট |
ইরাকের রাষ্ট্রপতি | সাদ্দাম হুসেন |
ইরাকের কুয়েত দখল | ২ আগস্ট ১৯৯০ খ্রি |
ফলাফল | ইরাকের পরাজয় |
অবসান | ১৯৯১ খ্রি |
ভূমিকা :- ইরাক-ইরান যুদ্ধ-এর সময় এবং তার পরবর্তীকালে আমেরিকার কাছ থেকে ইরাক বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র লাভ করে নিজের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে। কিন্তু কিছুকাল পরেই আমেরিকার সঙ্গে ইরাকের সম্ভাব নষ্ট হয়। ফলে ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক জোট ও ইরাকের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধ প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ বা প্রথম খাঁড়ি যুদ্ধ নামে পরিচিত।
উপসাগরীয় সংকটের বহিঃপ্রকাশ
সাধারণত যে তিনটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে উপসাগরীয় সংকটের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল সেগুলি হল – (ট) ইরাক-ইরান যুদ্ধ (১৯৮০-৮৮ খ্রি.), (খ) ইরাক কর্তৃক কুয়েত দখলের ফলে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ (১৯৯০-৯১ খ্রি.) এবং (গ) দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধ (২০০৩ খ্রি.)।
প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের প্রেক্ষাপট
১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে ইরাক তার প্রতিবেশী কুয়েত আক্রমণ ও দখল করলে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরু হয়। বিভিন্ন ঘটনা এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। যেমন –
(১) আর্থিক সমৃদ্ধির চেষ্টা
ইরানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৮ বছরব্যাপী যুদ্ধে ইরাকের বিপুল আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। প্রতিবেশী কুয়েতের তৈল সম্পদ দখল করে ইরাকের রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হুসেন নিজ দেশের আর্থিক সমৃদ্ধি আনতে চেয়েছিলেন।
(২) কুয়েতের তৈলভাণ্ডার
পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের তেলের খনিগুলির প্রতি পশ্চিমি শক্তিগুলির লোভ সাদ্দাম মানতে রাজি ছিলেন না। সমগ্র বিশ্বের তেল ভাণ্ডারের ৯.৪ শতাংশ কুয়েতে রয়েছে। এজন্য সাদ্দাম হুসেন কুয়েত দখল করে পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলির লোভ দমন করার উদ্যোগ নেন।
(৩) ইরাকের অংশ কুয়েত
কুয়েত অতীতে ইরাকেরই অংশ ছিল। এজন্য সাদ্দাম হুসেন দাবি করেন যে হাজার বছর ধরে যুদ্ধ করে হলেও তিনি কুয়েত পুনরুদ্ধার করবেন।
(৪) কুয়েতে আমেরিকার আধিপত্য
সাদ্দাম কুয়েতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে, ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় কুয়েত তার তেলের খনিগুলির নিরাপত্তার দায়িত্ব আমেরিকার হাতে ছেড়ে দিয়ে মার্কিন আধিপত্যের সুযোগ করে দিয়েছে। কুয়েতের এই কাজের ফলে ওপেক (OPEC) নামে তেল সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রগুলির যথেষ্ট আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল।
(৫) ক্ষতিপূরণ দাবি
সাদ্দাম হুসেন কুয়েতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন যে, কুয়েত ইরাকের রুইমালা খনি থেকে চুরি করে তেল উত্তোলন করার ফলে ইরাকের প্রভূত আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এজন্য তিনি কুয়েতের কাছে ১৬ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। কুয়েত ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করলে সাদ্দাম হুসেন কুয়েত আক্রমণ করেন।
প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের গতি
এই যুদ্ধের বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(১) কুয়েত দখল
ইরাকের রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হুসেন ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ২ আগস্ট কুয়েতে প্রায় দুই লক্ষ সেনা পাঠালে দুর্বল কুয়েত তার কোনো প্রতিরোধই করতে পারে নি। সাদ্দাম কুয়েত দখল করে কুয়েতকে ইরাকের ১৯তম প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করেন।
(২) আমেরিকার নেতৃত্ব
সাদ্দাম হুসেন মনে করেছিলেন যে, তিনি কুয়েত আক্রমণ করলেও আমেরিকা বা পশ্চিমি শক্তিগুলি খুব একটা বিরোধিতা করবে না। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তা হয় নি। আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দেশগুলি আতঙ্কিত হয়েছিল যে, তৈল সমৃদ্ধ আরব দুনিয়া এভাবে সাদ্দাম হুসেনের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে তাদের প্রভূত ক্ষতি হবে। এজন্য আমেরিকা সক্রিয়ভাবে ইরাকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজে নেতৃত্ব দেয়।
(৩) জাতিপুঞ্জের উদ্যোগ
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ ৬ আগস্ট ইরাকের সঙ্গে সব দেশের অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রস্তাব দেয়। জাতিপুঞ্জ ইরাককে একটি চরমপত্র দিয়ে জানায় যে, ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে কুয়েত থেকে ইরাক সরে না এলে ইরাকের বিরুদ্ধে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
(৪) আমেরিকার অভিযান
ইতিমধ্যে সাদ্দাম ইরাকে কর্মরত বিদেশি কূটনীতিকদের সপরিবারে অবরুদ্ধ করার নির্দেশ দিলে আমেরিকা ইরাকের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক অভিযান শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। জাতিপুঞ্জের সময়সীমা অতিক্রান্ত হলে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী ১৫ জানুয়ারি (১৯৯১ খ্রি.) ইরাক আক্রমণ করে।
প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাকের পরাজয়
সাত মাস ধরে চলা এই যুদ্ধে নির্বিচারে প্রচুর বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়। শীঘ্রই কুয়েত থেকে ইরাকের বাহিনী সরে আসতে বাধ্য হয় এবং যুদ্ধে ইরাক শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।
প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের ফলাফল
প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের ফলাফলগুলি আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যেমন –
(১) সাদ্দাম-বিরোধী বিদ্রোহ
যুদ্ধ চলাকালে সাদ্দামের বিরুদ্ধে দেশের অভ্যন্তরে তীব্র গণ অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সাদ্দাম নির্মমভাবে বহু মানুষকে হত্যা করেন।
(২) ইরাকের ক্ষয়ক্ষতি
বহুজাতিক বাহিনীর আক্রমণে ইরাকের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। বাগদাদ-সহ ইরাকের বিভিন্ন স্থানের হাজার হাজার নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছিল এবং বহু রাস্তাঘাট, সেতু, সৌধ প্রভৃতি ধ্বংস হয়েছিল।
(৩) মার্কিন নিয়ন্ত্রণ
আমেরিকার লক্ষ্য ছিল কুয়েতের মুক্তি ঘটিয়ে এবং ইরাকের ক্ষমতা থেকে সাদ্দাম হুসেনকে সরিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের তৈলসম্পদের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। বলা বাহুল্য, এ কাজে আমেরিকা অনেকটাই সফল হয়েছিল।
(৪) ইরাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা
যুদ্ধে পরাজিত ইরাক জাতিপুঞ্জের কয়েকটি শর্ত মানতে বাধ্য হয়েছিল। শর্তে বলা হয়েছিল যে,
- (i) ইরাকের মজুত করা পরমাণু এবং অন্যান্য মারণাস্ত্র নষ্ট করতে হবে,
- (ii) পরমাণু অস্ত্র গবেষণা বন্ধ রাখতে হবে,
- (iii) কুর্দ জাতি অধ্যুষিত অঞ্চল উড়ানমুক্ত অঞ্চল বলে ইরাক মেনে নেবে।
(৫) আমেরিকার ক্ষমতা বৃদ্ধি
উপসাগরীয় যুদ্ধে জয়লাভের ফলে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশের মর্যাদা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। এর দ্বারা আমেরিকা এক মেরু বিশ্বের দিকে এক ধাপ এগিয়ে যায়।
উপসংহার :- এরপর ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের ২০ মার্চ ইরাকের ওপর মার্কিন ও বহুজাতিক সমরাভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন শক অ্যান্ড অ’ বা ‘অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম’। আমেরিকা ও তার দোসর বহুজাতিক বাহিনী ইরাকের ওপর প্রতিদিন ৫ হাজার টন বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে ইরাককে বিধ্বস্ত করে দেয়।
(FAQ) প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
প্রথম খাঁড়ি যুদ্ধ।
১৯৯০-৯১ খ্রিস্টাব্দে।
ইরাক ও আমেরিকার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক জোট।
সাদ্দাম হুসেন।
জর্জ বুশ।