ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের সভ্যতা ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গে কৃষির অগ্রগতি, বাণিজ্যের অগ্রগতি, শিল্পের অগ্রগতি, নগরের প্রসার, ধর্মীয় জীবন, সাহিত্যে অগ্রগতি, শিল্পকলার ক্ষেত্রে অগ্রগতি ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উন্নতি সম্পর্কে জানবো।
প্রাচীন গ্রিসের ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের সভ্যতা ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গে ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের কৃষির বিকাশ, ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের বাণিজ্যের বিকাশ, ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের শিল্পের বিকাশ, ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের সাহিত্যের বিকাশ, ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উন্নতি ও ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে জানব।
ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের সভ্যতা ও সংস্কৃতি
ঐতিহাসিক ঘটনা | ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের সভ্যতা ও সংস্কৃতি |
অবস্থান | প্রাচীন গ্ৰিস |
বৃহৎ নগর | আলেকজান্দ্রিয়া |
নাট্যকার | মিনান্দার |
শ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ | আর্কিমিডিস |
জ্যোতির্বিদ | হিপার্কাস |
ভূগোলবিদ | এরাটোস্থেনিস |
ভূমিকা :- প্রাচীন গ্রিসের উত্তর অংশে ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যটি গড়ে উঠেছিল। ক্যারানাস (৮০৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ-৭৭৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এই রাজ্যটির প্রতিষ্ঠা করেন। ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্য ছিল বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও শক্তিশালী সাম্রাজ্য।
ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের সভ্যতা ও সংস্কৃতি
ম্যাসিডনীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটেছিল। যেমন –
(ক) কৃষির অগ্রগতি
ম্যাসিডনের শাসকরা পূর্বতন বৃহৎ ভূস্বামীদের বিপুল পরিমাণ জমি বাজেয়াপ্ত করে তা রাজকীয় সম্পত্তিতে পরিণত করেছিলেন। পরে এই জমি রাজার অনুগত বিভিন্ন অভিজাত পরিবার ও কৃষকদের মধ্যে বিলি করা হয়। এর ফলে জমির প্রাপকদের উদ্যোগে কৃষি উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল।
(খ) শিল্পের অগ্রগতি
ম্যাসিডনীয় রাজ্যে শিল্পের কাজেও বিশেষ গতি এসেছিল। রাজকোশ সমৃদ্ধ হওয়ায় ম্যাসিডনের বিভিন্ন শাসক শিল্পের অগ্রগতিতে সহায়তা করতেন। আলেকজান্ডার-এর পরবর্তীকালে ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্য ভেঙে যে সব রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সেখানেও শিল্পের যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। যেমন – মিশর-এর টলেমি বংশের শাসকরা প্রায় প্রতিটি শহর ও গ্রামে কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেলুকাস-এর রাজ্যেও শিল্পের অগ্রগতিতে নজর দেওয়া হয়েছিল।
(গ) বাণিজ্যের অগ্রগতি
- (১) ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যে বাণিজ্যের যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। আলেকজান্ডারের দিগবিজয়ের পর ম্যাসিডনীয় বাণিজ্য ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সীমানা ছাড়িয়ে উত্তরে দানিয়ুব থেকে দক্ষিণে ইথিওপিয়া এবং পূর্বে ভারত ও চিন থেকে পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূল পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল।
- (২) এর ফলে ম্যাসিডনের বাণিজ্য অল্পদিনের মধ্যে পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। জলপথে বিভিন্ন দূরদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক আদানপ্রদান বৃদ্ধি পেয়েছিল। আলেকজান্ডারের পরবর্তী শাসকরাও বাণিজ্যের কাজে যথেষ্ট উৎসাহ দিতেন।
(ঘ) নগরজীবনের প্রসার
- (১) ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যে নগরজীবনের যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। এই যুগে অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বসবাস করলেও শিল্প ও বাণিজ্যের অগ্রগতির কারণে বহু মানুষের মধ্যেই শহরে যাওয়ার একটা প্রবণতা ছিল। এই যুগে নগরের আয়তন ও সংখ্যা দ্রুত বাড়ছিল।
- (২) আলেকজান্দ্রিয়া ছিল এই যুগের সবচেয়ে বড়ো এবং বিখ্যাত নগর। এই নগরের জনসংখ্যা ছিল ৫ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষের মতো। এখানকার বিভিন্ন সুবিশাল ও মনোরম প্রাসাদ, উদ্যান, জাদুঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গ্রন্থাগার প্রভৃতি ছিল উল্লেখযোগ্য।
(ঙ) ধর্মীয় জীবন
- (১) ম্যাসিডনীয় যুগে বুদ্ধিজীবী গ্রিকরা সেখানকার সাধারণ ধর্মের পরিবর্তে গ্রিক দার্শনিক জেনো প্রবর্তিত স্টয়িকবাদ এবং এপিকিউরাস প্রবর্তিত এপিকিউরাসবাদের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছিল। উভয় ধর্মেই ব্যক্তির কল্যাণসাধন ও জগতের সব মানুষের অভিন্নতার কথা বলা হয়েছিল।
- (২) সাধারণ মানুষ গ্রহণ করেছিল প্রাচ্যের অতীন্দ্রিয়বাদী ধর্ম। ম্যাসিডনিয়ার ধর্মীয় জীবনে জরথুস্ট্রবাদের বিভিন্ন শাখা, বিশেষ করে মিথরাসবাদের যথেষ্ট প্রভাব পড়েছিল। ধর্মের সহায়তায় জ্যোতিষচর্চাও বৃদ্ধি পেয়েছিল।
(চ) সাহিত্যে অগ্রগতি
- (১) সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ম্যাসিডনীয় যুগে যথেষ্ট অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়। এই যুগের অন্তত ১১০০ জনেরও বেশি লেখকের নাম এপর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে। সকলের রচনা উন্নতমানের না হলেও কোনো কোনো রচনা ছিল নিঃসন্দেহে যথেষ্ট উৎকৃষ্ট। এই যুগের কাব্যের প্রধান ধারা ছিল নাটক ও দৃশ্যকাব্য। নাটকগুলি ছিল মিলনান্তক। মিনান্দার ছিলেন এই যুগের বিখ্যাত নাট্যকার।
- (২) কাব্য ছাড়াও ইতিহাস, জীবনকাহিনি, কল্পকাহিনি প্রভৃতি বিষয়ে প্রচুর গদ্যসাহিত্য এই যুগে রচিত হয়েছিল। এই যুগের খ্যাতনামা ঐতিহাসিক পলিবিয়াস নিরপেক্ষভাবে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ করে তাঁর ইতিহাস রচনা করেছিলেন।
(ছ) শিল্পকলার ক্ষেত্রে অগ্রগতি
প্রাচীন গ্রিক স্বর্ণযুগের শিল্পের গুণগত মান বজায় রাখতে না পারলেও ম্যাসিডনীয় যুগে শিল্পকলার অগ্রগতি মোটেই থেমে থাকে নি। এই যুগে বহু বিলাসবহুল ও সুবিশাল প্রাসাদ, অট্টালিকা, সর্বজনীন ভবন, স্মৃতিস্তম্ভ প্রভৃতি নির্মিত হয়েছিল। আলেকজান্দ্রিয়ায় বিখ্যাত আলোকস্তম্ভটি এই যুগের উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য কীর্তি। সমুদ্রের জাহাজগুলির পথনির্দেশের উদ্দেশ্যে এই আলোকস্তম্ভটি নির্মিত হয়েছিল। তবে এই যুগের ভাস্কর্যে ইন্দ্রিয়পরায়ণতা ও রোমাঞ্চের বাহুল্য রয়েছে। ভেনাস ডি মিলো নামে পরিচিত আফ্রেডিটির মূর্তিটি হল এই যুগের একটি উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য।
(জ) বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উন্নতি
ঐতিহাসিকদের মতে, ম্যাসিডনীয় যুগে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। যেমন –
(১) জ্যোতির্বিদ্যা
অ্যারিস্টারকাস (৩১০- ২৩০ খ্রি.পূ.) হলেন এই যুগের বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ। তিনিই সর্বপ্রথম বলেন যে, সূর্যের চারদিকে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ ঘুরছে। এই যুগের অপর জ্যোতির্বিদ হিপার্কাস (১৯০-১২০ খ্রি.পূ.) অ্যাস্ট্রোল্যাব যন্ত্র আবিষ্কার করেন এবং পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব নির্ণয় করেন। টলেমি এই যুগে জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক ‘আল মাজেস্ট’ গ্রন্থটি রচনা করেন।
(২) গণিত
এই যুগের শ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ ইউক্লিড (আনু, ৩২৩-২৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) জ্যামিতি বিষয়ক ‘এলিমেন্টস’ নামক গ্রন্থখানি রচনা করেন। জ্যোতির্বিদ ও গণিতজ্ঞ হিপার্কাস সমতলীয় ও বৃত্তীয় ত্রিকোণমিতির ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের অন্যতম আর্কিমিডিস ছিলেন এই সময়ের অপর উল্লেখযোগ্য গণিতজ্ঞ। তিনি সংখ্যাতত্ত্ব ও জ্যামিতির ক্ষেত্রে বেশ কিছু নতুন আবিষ্কার করেন।
(৩) ভূগোল
বহু প্রতিভার অধিকারী ইরাটোস্থেনিস (আনু. ২৭৬-১৯৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ছিলেন এই যুগের এক উল্লেখযোগ্য ভূগোলবিদ। তিনি দুটি সূর্যঘড়ি স্থাপন করে তার ভিত্তিতে পৃথিবীর পরিধি নির্ণয় করেন। তিনি ভূপৃষ্ঠকে বিভিন্ন অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশে বিভক্ত করে ভূপৃষ্ঠের মানচিত্র অঙ্কন করেন।
(৪) চিকিৎসাবিদ্যা
অ্যানাটমি বা শারীরসংস্থানবিদ্যায় পারদর্শী হিরোফিলাস ছিলেন এই যুগের বিখ্যাত চিকিৎসক। তিনি মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের বিবরণ দেন এবং হৃৎপিণ্ড থেকে ধমনির মাধ্যমে সারা দেহে রক্ত সঞ্চালনের কথা জানান। ইরাসিসট্রেটাস ছিলেন এই যুগের অপর এক সুবিখ্যাত চিকিৎসক।
(৫) পদার্থবিদ্যা
আর্কিমিডিস (আনু: ২৮৭-২১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ছিলেন এই যুগের শ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ। তিনি ভাসমান বস্তু ও স্থিতিবিদ্যার বিষয়ে কয়েকটি সূত্র এবং বিভিন্ন কৌশল আবিষ্কার করেন। বিজ্ঞানী হিরো এই যুগে বেশ কিছু যান্ত্রিক কৌশল আবিষ্কার করেন।
মৌর্য ও ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের যোগসূত্র
প্রাচীন ভারতের মৌর্য সাম্রাজ্য এবং ইউরোপ-এর ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে যোগসূত্র গড়ে উঠেছিল। যেমন –
(১) আলেকজান্ডারের আক্রমণ
প্রথম পর্বে বিশ্বজয়ে বেরিয়ে ৩২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ম্যাসিডনের সম্রাট তৃতীয় আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করেন এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের সিন্ধু ও পাঞ্জাব অঞ্চলে গ্রিক অর্থাৎ ম্যাসিডনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন।
(২) গ্রিকদের বিতাড়ন
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর (৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) পর মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সিন্ধু ও পাঞ্জাবের গ্রিক শাসকদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে (৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) সেখান থেকে গ্রিকদের বিতাড়িত করেন।
(৩) সেলুকাসের উদ্যোগ
পরবর্তীকালে আলেকজান্ডারের অন্যতম সেনাপতি সেলুকাস চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের হাত থেকে ভারতের গ্রিক সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিন্ধু অঞ্চলে হাজির হন। তবে সেলুকাস ও চন্দ্রগুপ্তের মধ্যে আদৌ যুদ্ধ হয়েছিল কি না বা যুদ্ধ হলেও এতে কে জয়ী হয়েছিলেন তা জানা যায় না।
সেলুকাস ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সন্ধি
যাই হোক, ঐতিহাসিক স্ট্র্যাবো উল্লেখ করেছেন যে, উভয়ের মধ্যে একটি সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। গ্রিক সেনাপতি সেলুকাস ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মধ্যে স্বাক্ষরিত সন্ধির শর্ত অনুসারে,
- (১) সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তকে কাবুল, কান্দাহার, হিরাট ও বালুচিস্তানের মাকরান প্রদান করেন।
- (২) চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সেলুকাসকে ৫০০ হাতি উপহার দেন।
- (৩) সেলুকাসের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নিজ কন্যা হেলেনের বিবাহ দেন।
- (৪) সেলুকাস গ্রিক দূত মেগাস্থিনিসকে চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় পাঠান। মেগাস্থিনিস ৩০৪ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ২৯১ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজধানী পাটলিপুত্র-এ কাটিয়ে ইন্ডিকা নামে ভারত-বিষয়ক একটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন।
উপসংহার :- ১৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ম্যাসিডন সম্পূর্ণ রোমানদের দখলে চলে যায়। এর ফলে শক্তিশালী ও বৃহৎ ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
(FAQ) ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
মিনান্দার।
টলেমি।
ইউক্লিড।
আর্কিমিডিস।