হিন্দুদের প্রতি আকবরের নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কর বিলোপ, হিন্দু আচার অনুষ্ঠান পালন, হিন্দুদের উচ্চ পদে নিয়োগ, শিল্প, সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা ও সামাজিক সংস্কার সম্পর্কে জানবো।
হিন্দুদের প্রতি আকবরের নীতি প্রসঙ্গে আকবরের ধর্মীয় সহনশীলতা, আকবরের রাজপুত নীতি, উচ্চপদে হিন্দুদের নিয়োগ, হিন্দু -মুসলিম ঐক্য, বিভিন্ন কর বিলোপ, আকবর কর্তৃক হিন্দু আচার অনুষ্ঠান পালন ও আকবরের সমাজ সংস্কার সম্পর্কে জানবো।
হিন্দুদের প্রতি আকবরের নীতি (Akbar’s Policy towards the Hindus)
ঐতিহাসিক ঘটনা | হিন্দুদের প্রতি আকবরের নীতি |
তীর্থ কর বিলোপ | ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দ |
জিজিয়া কর বিলোপ | ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দ |
রাজসভায় হিন্দু ব্যক্তি | তানসেন, বীরবল, মহেশ দাস |
সূচনা :- আকবর উপলব্ধি করেন যে বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বাসভূমি ভারতবর্ষ-এ স্থায়ী কোনও সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সহযোগিতা অপরিহার্য। এই কারণে তিনি হিন্দুদের সম্পর্কেউদারনীতি গ্রহণ করেন।
বিভিন্ন কর বিলোপ
- (১) তিনি প্রায় দুই কোটি টাকা রাজস্বের ক্ষতি স্বীকার করে ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের ওপর থেকে বৈষম্যমূলক ‘তীর্থকর’ প্রত্যাহার করেন।
- (২) ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি বহু সমালোচিত ‘জিজিয়া কর’ তুলে দেন। ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে তিনি হিন্দু যুদ্ধবন্দিদের ক্রীতদাসে পরিণত করার রীতি নিষিদ্ধ করেন।
- (৩) যুদ্ধবন্দি হিন্দুদের ধর্মান্তরিতকরণের প্রতিও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এইভাবে তিনি হিন্দু ও মুসলিম প্রজাবর্গের মধ্যে বিভেদ দূরীকরণে উদ্যোগী হন।
হিন্দু আচার-অনুষ্ঠান পালন
- (১) হিন্দু ধর্ম, সংস্কৃতি ও মতাদর্শ দ্বারা তিনি যে যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। হিন্দু মন্দির নির্মাণ এবং হিন্দু উৎসব উপলক্ষে মেলা বসানো প্রভৃতি বিষয়ে তিনি পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।
- (২) হিন্দু ধর্মবেত্তা পুরুষোত্তম, দেবী এবং অন্যান্যসাধু-সন্তদের সঙ্গে তিনি হিন্দুধর্ম নিয়ে গভীর আলোচনা করতেন। হিন্দুদের জন্মান্তরবাদ ও কর্মফলবাদে তাঁর প্রবল বিশ্বাস ছিল।
- (৩) ব্যক্তিগত জীবনে তিনি হিন্দুদের বহু আচার অনুষ্ঠান পালন করতেন। তিনি প্রত্যেক দিন সংস্কৃত ভাষায় একহাজার বার সূর্যের মন্ত্র জপ করতেন, পাগড়ি পরিধান করতেন, তিলক কাটতেন এবং গঙ্গাজলের পবিত্রতায় বিশ্বাস করতেন ও গঙ্গাজল পান করতেন।
- (৪) তিনি নিরামিষ খেতেন, পিঁয়াজ-রসুন খাওয়া ত্যাগ করেছিলেনএবং সাম্রাজ্যে গোহত্যা নিষিদ্ধ হয়েছিল। তিনি খুব জাঁকজমকের সঙ্গে রাখি বন্ধন, দশেরা, দীপাবলি ও বসন্তোৎসব পালন করতেন।
- (৫) শিবরাত্রি-র দিন সাধু-সন্তদের সঙ্গে তিনি একত্রে আহার করতেন। হিন্দু পত্নীদের সঙ্গে তিনি হোম-যজ্ঞ প্রভৃতি করতেন। মাতা হামিদাবানুর মৃত্যুর পর তিনি মস্তক মুণ্ডন করে হিন্দু রীতিতে শ্রাদ্ধ করেন।
- (৬) এই সব কারণেই গোঁড়া মুসলিম ঐতিহাসিক বদাউনি আকবরকে ইসলাম পরিত্যাগকারী বলে অভিহিত করেন।
হিন্দুদের উচ্চপদে নিয়োগ
- (১) তিনি যোগ্যতার ভিত্তিতে হিন্দুদের প্রশাসনের উচ্চপদে নিয়োগ করেছিলেন। পূর্বে এই পদগুলি ছিল মুসলিমদের একচেটিয়া। কিন্তু তাঁর আমলে বিহারীমল, ভগবান দাস, মান সিংহ, বীরবল, টোডরমল এবং অপরাপর হিন্দুদের নিয়োগ করা হয়।
- (২) পূর্বে মুসলিম কাজি হিন্দুদের বিচারকার্য নিষ্পন্ন করত। আকবরের আমল থেকে হিন্দুদের জন্য ব্রাহ্মণ বিচারকের ব্যবস্থা করা হয়।
- (৩)এইভাবে তিনি সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও মুসলিমদের সঙ্গে হিন্দুদের সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে উদ্যোগী হন।
হিন্দু সাহিত্য-শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা
- (১) হিন্দু শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি আকবরের প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল এবং তিনি হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতির মিলনে আগ্রহী ছিলেন।
- (২) আবুল ফজল রচিত ‘আইন-ই-আকবরী’ থেকে জানা যায় যে, আকবরের দরবারে সমসাময়িক যে একুশজন পণ্ডিত উপস্থিত হতেন, তাঁদের মধ্যে নয়জনই ছিলেন হিন্দু। এঁরা প্রত্যেকেই তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন।
- (৩) সংগীতজ্ঞ তানসেন, সুরসিক সমালোচক বীরবল এবং চিত্রকর মহেশ দাস তাঁর রাজসভা অলংকৃত করতেন।
- (৪) তিনি একটি অনুবাদ বিভাগ খোলেন এবং তাঁর উদ্যোগে রামায়ণ, মহাভারত, অথর্ব বেদ, গীতা, হরিবংশ, পঞ্চতন্ত্র, কথাসরিৎসাগর প্রভৃতি বিভিন্ন সংস্কৃত গ্রন্থ ফারসি ভাষায় অনুদিত হয়।
- (৫) রামায়ণের বহু ঘটনাকে অবলম্বন করে তিনি চিত্রাঙ্কনে উৎসাহ দান করেন।
আকবরের সমাজ সংস্কার
- (১) হিন্দু সমাজে প্রচলিত নানা অনাচার ও কুপ্রথা সম্পর্কেও আকবর সজাগ ছিলেন এবং এগুলি দূর করার ব্যাপারে তিনি সচেষ্ট হন।
- (২) তিনি সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, পণপ্রথা ও ভিক্ষাবৃত্তি নিবারণ, গণিকাবৃত্তি ও মদ বিক্রি নিয়ন্ত্রণ এবং বিধবাবিবাহ প্রচলন প্রভৃতি ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিলেন।
- (৩)একজন মুসলিম নরপতি হয়েও হিন্দু সমাজ সম্পর্কে তাঁর এই আগ্রহ তাঁকে নিশ্চয়ই একজন যথার্থ জাতীয় নরপতিতে পরিণত করেছে।
উপসংহার :- সংস্কারক হিসেবে আকবরের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আধুনিক। কিন্তু মধ্যযুগীয় চিন্তাধারায় আচ্ছন্ন জনসাধারণের পক্ষে সংস্কারের যৌক্তিকতা উপলব্ধি করা সম্ভব হয় নি। এদিক থেকে আকবরকে অবশ্যই রামমোহন–বিদ্যাসাগর -এর অগ্ৰদূত হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
(FAQ) হিন্দুদের প্রতি আকবরের নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে।
১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে।
১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে।
ঐতিহাসিক বদাউনি।