আকবরের শাসন ব্যবস্থা

মোগল সম্রাট আকবরের শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য, মৌলিকত্ব, জনসাধারণের সমর্থন, কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থায় সম্রাট ও মন্ত্রীগণের অবস্থান ও দায়িত্ব, মন্ত্রীসভা, কর্মচারীবৃন্দ, প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থায় সুবাদার, দেওয়ান, স্থানীয় শাসন ব্যবস্থায় সরকার ও পরগণা সম্পর্কে জানবো।

আকবরের শাসন ব্যবস্থা (Administrative System of Akbar)

ঐতিহাসিক ঘটনা আকবরের শাসন ব্যবস্থা
সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থান স্বয়ং সম্রাট
ভকিল প্রধানমন্ত্রী
দেওয়ান অর্থমন্ত্রী
মির বক্সী সামরিক বিভাগের প্রধান
আকবরের শাসন ব্যবস্থা

ভূমিকা :- কেবলমাত্র সমরকুশলী বীর হিসেবেই নয়- একজন সুশাসক হিসেবেও আকবর ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। প্রকৃতপক্ষে, আকবরই হলেন ভারতে মোগল শাসনব্যবস্থার প্রবর্তক।

শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

ঔদার্য, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, প্রজাহিতৈষণাও ধর্মনিরপেক্ষতা হল তাঁর শাসনব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

রিজভীর অভিমত

ঐতিহাসিক রিজভী-র মতে, “আকবরের শাসনব্যবস্থা শের শাহ প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থার অনুকরণ।”

যদুনাথ সরকারের অভিমত

ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকারের মতে, আকবরের শাসনব্যবস্থা হল “ভারতীয় ভিত্তির ওপর আরবীয়-পারসিক ভাবধারার মিশ্রণ।”

ঈশ্বরী প্রসাদের অভিমত

ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ-এর মতে, “মোগল শাসনব্যবস্থায় কোনও মৌলিকত্ব ছিল না, তা দেশি ও বিদেশি আদর্শের মিশ্রণ।”

শাসন ব্যবস্থার মৌলিকত্ব

দেশি-বিদেশি বহু উপাদানে তাঁর শাসনব্যবস্থা গঠিত হলেও, তাতে যে মৌলিকত্ব কিছু ছিল সে সম্পর্কে সন্দেহ নেই।

বিভিন্ন ভাবধারার সমন্বয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা

আকবর উদ্ভাবক ছিলেন না সত্য, কিন্তু দেশি বিদেশি বিভিন্ন ভাবধারার সমন্বয়ে সুদক্ষ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে গেলে যে অসামান্য প্রতিভার প্রয়োজন তা আকবরের ছিল।

জনসাধারণের সমর্থন

প্রচলিত ভারতীয় রীতি-নীতি, গ্রামীণ স্বায়ত্বশাসন ব্যবস্থা—কোনও কিছুই আকবর উপেক্ষা করেন নি। তাঁর শাসনব্যবস্থা জনসাধারণের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা

সম্রাট আকবরের কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা ছিল নিম্নরূপ-

(ক) সম্রাট

  • (১) শাসনব্যবস্থায় সম্রাট ছিলেন সর্বেসর্বা। তাঁর ক্ষমতা ছিল অসীম। তিনি দৈবস্বত্ব, সিংহাসনের সার্বভৌমত্ব ও স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতায় বিশ্বাসী ছিলেন।
  • (২) অবশ্য এই কথা ঠিকই যে, তিনি অত্যাচারী শাসক ছিলেন না। তিনি নিজেকে প্রজাবর্গের অভিভাবক ও পালক বলে মনে করতেন এবং তাঁর শাসনব্যবস্থার মূল লক্ষ্যই ছিল জনকল্যাণ।

(খ) মন্ত্রীগণ

সম্রাটকে সাহায্য করার জন্য কয়েকজন মন্ত্রী ছিলেন। এরা হলেন –

(১) ভকিল

সম্রাটের পরেই ছিলেন ভকীল বা প্রধানমন্ত্রী। তিনি ছিলেন সম্রাটের প্রধান পরামর্শদাতা এবং সম্রাট ও প্রশাসনের মধ্যে যোগসূত্র। প্রশাসন পুরোপুরি তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল। তিনি কর্মচারীদের নিয়োগ, পদচ্যুতি, বদলি এবং সকল দপ্তরের কাজকর্ম তদারকি করতেন।

(২) দেওয়ান

দেওয়ান বা অর্থমন্ত্রী রাজস্ব বিভাগের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। সাম্রাজ্যের আয়-ব্যয়, রাজস্বের হিসেব এবং খালিসা ও জায়গির সকল জমিই ছিল তাঁর হাতে। সম্রাটের সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি সাম্রাজ্যেরঅর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন।

(৩) মির বক্সী

মির বক্সী ছিলেন সামরিক বিভাগের প্রধান। সেনাবাহিনীর সকল নিয়োগ, সেনাদলের বেতন সেনার সংখ্যা, মনসবদারের পদমর্যাদা মন্ত্রী ও কর্মচারীবৃন্দ প্রভৃতি বিষয়ে তিনি সম্রাটকে পরামর্শ দিতেন। রাজপ্রাসাদের রক্ষীবাহিনীর দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর। সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে ছড়িয়েথাকা গুপ্তচরদের কাছ থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে গুরুত্ব অনুযায়ী তা সম্রাটকে জানাবার দায়িত্বও ছিল তাঁর। প্রয়োজনে তাঁকে যুদ্ধ পরিচালনাও করতে হত।

(৪) সদর-উস-সুদূর

সদর-উস-সুদূর ছিলেন ইসলাম ধর্ম, দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও দান বিভাগের অধিকর্তা এবং শরিয়তি আইনের প্রধান ব্যাখ্যাকার। তিনি উলেমা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসায় নিষ্কর জমি দানের ব্যাপারে সুপারিশ করতেন।

(৫) কাজি-উল-কাজাৎ

কাজি-উল-কাজাৎ বা প্রধান কাজি ছিলেন সম্রাটের অধীনে প্রধান বিচারক।

(৬) মির সামান

মির সামান ছিলেন সম্রাটের গৃহ-পরিচালনার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী। সম্রাটও তাঁর পরিবার-পরিজন, হারেম এবং রাজসরকারের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি তাঁকে সরবরাহ করতে হত।

(৭) মুহতসিব

মুহতসিব ছিলেন জনসাধারণের মধ্যে ধর্ম ও নৈতিকতা প্রচারের ভারপ্রাপ্ত। মহম্মদ-প্রচারিত ধর্মীয় আদর্শ যাতে তাঁর স্বধর্মাবলম্বীদের দ্বারা লঙ্ঘিত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখাই ছিল তাঁর দায়িত্ব।

(গ) মন্ত্রীসভা

সে যুগে কোনও মন্ত্রিসভার অস্তিত্ব ছিল না। সম্রাট ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতেন মাত্র।

(ঘ) কর্মচারীবৃন্দ

বিভিন্ন মন্ত্রী ছাড়াও দারোগা-ই-গুসলখানা, আরিজ-ই-মুবারক, মির আরাজ, মুস্তাফী, মির বাহরি, মির মঞ্জিল, মির তোজক প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ কর্মচারীরা রাজকার্যে নিযুক্ত ছিলেন।

প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা

আকবর তাঁর সাম্রাজ্যকে কয়েকটি ‘সুবা’ বা প্রদেশে বিভক্ত করেন। প্রথমে তাঁর প্রদেশের সংখ্যা ছিল ১২। পরে তা হয় ১৫ এবং দাক্ষিণাত্য জয়ের পর এই সংখ্যা বেড়ে হয় ১৮। এছাড়াও তাঁর অধীনে স্বশাসিত বেশ কিছু সামন্ত রাজ্য ছিল, যেগুলির আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তিনি হস্তক্ষেপ করতেন না।

(ক) সুবাদার

  • (১) ‘সুবা’-র প্রধান শাসনকর্তাকে বলা হত ‘সুবাদার’, ‘নাজিম’, ‘সিপাহসালার’ বা ‘সাহেব-সুবা’। সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত ‘সুবাদার’ প্রদেশের সকল সামরিক ও বেসামরিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।
  • (২) তাঁর প্রধান দায়িত্ব দেওয়ান ছিল প্রদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, নিরাপত্তা বিধান এবং বিদ্রোহ দমন করা। তিনি প্রাদেশিক সেনাবাহিনীরও প্রধান ছিলেন।

(খ) দেওয়ান

  • (১) ‘সুবা’-য় রাজস্ব-সংক্রান্ত সব বিষয়ের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন ‘দেওয়ান’। রাজস্ব আদায়, রাজস্ব বিভাগের কর্মচারী নিয়োগ, দেওয়ানি মামলার বিচার পরিচালনা তাঁর কার্যাবলীর অন্তর্ভুক্ত ছিল।
  • (২) সুবাদারের কর্তৃত্ব থেকে তিনি সর্বতোভাবে মুক্ত ছিলেন। তিনি সরাসরি সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হতেন, রাজস্ব আদায় করে সম্রাটের কাছে পাঠাতেন এবং কেবলমাত্র সম্রাটের কাছেই তিনি দায়বদ্ধ ছিলেন।
  • (৩)’সুবাদার’ ও ‘দেওয়ান’ উভয়েই স্ব স্ব স্বাধীনভাবে কাজ করতেন—কেউ কারো কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারতেন না।

(গ) অন্যান্য কর্মচারী

প্রদেশগুলিতে কেন্দ্রের মতোই মির বক্সী, সদর-উস্-সুদূর, কাজি, ওয়াকিনবিস, মির বাহার প্রভৃতি কর্মচারী নিযুক্ত ছিলেন।

স্থানীয় শাসন

স্থানীয় শাসনের বিভিন্ন দিকগুলি হল –

(ক) সরকার

  • (১) ‘সুবা’ বা প্রদেশগুলি ‘সরকার’ বা জেলায় বিভক্ত ছিল। এর প্রধান ছিলেন ‘ফৌজদার’। তিনি ছিলেন সামরিক কর্মচারী।
  • (২) তাঁর কাজ ছিল জেলার আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, চুরি-ডাকাতি দমন, সরকারি আইন কার্যকর করা, বিদ্রোহী কৃষক ও জমিদারদের দমন করা।
  • (৩) তাঁর অন্যতম প্রধান দায়িত্ব ছিল অধীনস্থ সেনাবাহিনীকে সর্বদা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখা। তিনি ‘সুবাদার’ ও মির বক্সী’-র নির্দেশে কাজ করতেন।
  • (৪) জেলায় রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব ছিল ‘আমাল গুজার’ নামক কর্মচারীর ওপর। রাজস্বের হিসাব রাখা, কৃষকদের ঋণদান, জমি জরিপ, রাজস্ব সংক্রান্ত রিপোর্ট তৈরি তাঁর কাজের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ সব কাজে তাঁকে সাহায্য করতেন ‘বিতিকচি’, ‘খাজনাদার’ প্রমুখ কর্মচারীরা।

(খ) পরগনা

‘সরকার’ বা জেলাগুলি ‘পরগণা’ বা মহকুমায় বিভক্ত ছিল। ‘শিকদার’ পরগণা-র আইন শৃঙ্খলা, শান্তিরক্ষা, বিচার ও সাধারণ প্রশাসন পরিচালনা করতেন। আমিল ছিলেন রাজস্ব বিভাগের ভারপ্রাপ্ত। জমি জরিপ, রাজস্ব নির্ধারণ, রাজস্ব আদায় প্রভৃতি কাজ তাকে করতে হত। ফতোদার ছিলেন পরগণার কোষাধ্যক্ষ।

উপসংহার :- উদারতা, ধর্মসহিষ্ণুতা ও প্রজাবর্গের সর্বাধিক কল্যাণ সাধনই ছিল সম্রাট আকবরের শাসন নীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। পরবর্তী মোগল সম্রাটরা তো বটেই— এমনকী ইংরেজ শাসকগণও অনেকাংশে তাঁর শাসননীতিকে গ্রহণ করেন।

(FAQ) আকবরের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সম্রাট আকবরের কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার সর্বেসর্বা কে ছিলেন?

সম্রাট নিজে।

২. আকবরের রাজত্বকালে ভকিল কাকে বলা হত?

প্রধানমন্ত্রী।

৩. আকবরের রাজত্বকালে প্রধান কাজীকে কি বলা হত?

কাজি-উল-কাজাৎ।

৪. আকবরের রাজত্বকালে ‘সুবা’-র প্রধান কে কী বলা হত?

সুবাদার।

Leave a Comment