সেন বংশের গুরুত্ব প্রসঙ্গে রাজনৈতিক গুরুত্ব, শাসন ব্যবস্থা, সংস্কৃত ভাষার চর্চা, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের জাগরণ, জাতি বিভাগ, সংকীর্ণ নীতি ও নৈতিক শৈথিল্য সম্পর্কে জানবো।
সেন বংশের গুরুত্ব
ঐতিহাসিক ঘটনা | সেন বংশের গুরুত্ব |
বংশ | সেন বংশ |
প্রতিষ্ঠাতা | সামন্ত সেন |
শ্রেষ্ঠ রাজা | বল্লাল সেন |
শেষ রাজা | লক্ষ্মণ সেন |
ভূমিকা :- ডঃ মজুমদার মন্তব্য করেছেন যে, “বাংলার ইতিহাসে সেন যুগ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।”
সেন যুগের রাজনৈতিক গুরুত্ব
- (১) রাজনৈতিক দিক থেকে বিচার করলে সেন যুগের গোড়ার দিক ছিল পাল যুগের অনুবর্তী। পাল যুগে যেরূপ বাংলার সীমানা উত্তরে মগধ ছাড়িয়ে উত্তর প্রদেশে, পূর্বে কামরূপ রাজ্য ও দক্ষিণে কলিঙ্গে বিস্তৃত হয়; বিজয় সেন ও বল্লাল সেনও বাংলার সীমান্তকে একই অঞ্চলে স্থাপন করেন।
- (২) কিন্তু পাল যুগ হতে উত্তর ভারত -এ তুর্কী আক্রমণ সম্পর্কে যেমন বাংলার রাজাদের ঔদাসীন্য ছিল, সেন যুগেও সেরূপ ঔদাসীন্য থাকায় তার কুফল লক্ষ্মণ সেনের আমলে দেখা যায়। পশ্চিমবাংলা সেন রাজাদের হাত ছাড়া হয়ে তুর্কী অধিকারে চলে যায়।
বাংলার সেন যুগের শাসন ব্যবস্থা
- (১) সেন আমলে পাল যুগের রাজ্যশাসন প্রথা মোটামুটি অব্যাহত ছিল। তবে গ্রাম শাসনব্যবস্থায় পাল যুগ অপেক্ষা অবনতি ঘটে বলে মনে করা যায়। পাল যুগের গ্রামিক নামে কর্মচারী সেন যুগে দেখা যায় না। রাষ্ট্রের সঙ্গে জনসাধারণের যোগসূত্র সেন যুগে অনেক শিথিল হয়ে যায়। জনপদগুলি বহু অংশে ভাগ হয়।
- (২) সেন আমলে রাণী বা মহিষীরাও ভূমিদানের কাজে অংশ নিতেন। তাঁরা শাসনের কাজে হস্তক্ষেপ করতেন কিনা তা সঠিক জানা যায় নি। গৌড় বা লক্ষণাবতী ছিল সেন রাজাদের প্রকৃত রাজধানী। বিকল্প রাজধানী ছিল ঢাকার বিক্রমপুর। নবদ্বীপ বা নদীয়া রাজধানী ছিল না।
- (৩) সেন রাজ্য ভূক্তি, বিষয়, মণ্ডল, গ্রামে বিভক্ত হত। কোটিবর্ষ বিষয় বা দিনাজপুর জেলা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেন যুগে সামন্ত প্রথার প্রচলন ছিল। সরকারী পদগুলি পাল যুগের মতই ছিল। আমলাতন্ত্র আরও ব্যাপক ও প্রবল হয়েছিল।
- (৪) মন্ত্রীদের সংখ্যা বেড়েছিল। তাছাড়া মহাকরণাধ্যক্ষ, মহাসেনাপতি প্রভৃতি কর্মচারীও ছিল। রাষ্ট্রের সকল করণ বা বিভাগের কর্তা ছিলেন মহাকরণাধ্যক্ষ। সেন যুগে ব্রাহ্মণরা অনেক সময় রাজকর্মচারীর বৃত্তি নিতেন। ফলে রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণদের প্রভাব দেখা যায়। পুরোহিতরা অধ্যক্ষের মর্যাদা ভোগ করতেন।
- (৫) সেন যুগে প্রজাপীড়নের আভাষ পাওয়া যায়। রাজকর্মচারীরা প্রজার কাছ থেকে উপকর আদায় করত। রাজারা প্রজাদের দুঃখ নিরূপণের জন্য কোনোরূপ বিধিসঙ্গত প্রচেষ্টা করেন নি। সাধারণ শ্রমিক, ভূমিহীন শ্রমিকরা বেশ দুঃখ-কষ্টে দিন কাটাত।
সেন যুগে সংস্কৃত ভাষার চর্চা
বাংলার সেন যুগের সভ্যতা ও সংস্কৃতির কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। সেন যুগে সংস্কৃত ভাষার চর্চায় বিশেষ অগ্রগতি দেখা যায়। যেমন –
(১) সেন যুগের কবি জয়দেব
সেন যুগের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন জয়দেব। তিনি রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে অবলম্বন করে বিখ্যাত গীতগোবিন্দম্ রচনা করেন। গীতগোবিন্দের সুললিত কাব্য-বিন্যাস পাঠকের মনোহরণ করে।
(২) অন্যান্য কবি ও পণ্ডিত
শরণ, হলায়ুধ, ধোয়ি, উমাপতি ধর প্রমুখ বিখ্যাত কবি ও পণ্ডিত সেন যুগে জীবিত ছিলেন। সংস্কৃত দূতকাব্যের অনুকরণে ধোয়ি তার পবনদূতম রচনা করেন। দেওপাড়া লিপির রচয়িতা ছিলেন শরণ।
সেন যুগে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের জাগরণ
- (১) সেন যুগে ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্মের জাগরণ ঘটানোর চেষ্টা করা হয়। পাল যুগের সহজিয়া ও তন্ত্রধর্মের প্রভাবে ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্মে যে অপসংস্কৃতি ও প্রথা ঢুকেছিল তা দূর করে ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে তার পুরাতন চরিত্র ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সেন রাজারা চেষ্টা করেন। তারা অবশ্য ভুলে যান যে, ভারতের সভ্যতার মর্ম হল সমন্বয়।
- (২) বল্লাল সেন দানসাগর ও অদ্ভুতসাগর নামে দুটি হিন্দু আচার গ্রন্থ রচনা করেন। বৈদিক শাস্ত্রের ভিত্তিতে তারা বিশুদ্ধ আচার প্রবর্তনের চেষ্টা করেন। এর পিছনে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অপেক্ষা তাদের গোঁড়ামি বেশী কাজ করেছিল বলে ডঃ নীহাররঞ্জন রায় মন্তব্য করেন।
বাংলার সেন যুগের জাতি বিভাগ
- (১) পাল যুগে বিভিন্ন ধর্মমতের প্রতি সহনশীলতা দেখান হত। সেন যুগে এই সমন্বয়বাদী সহনশীল নীতি পরিত্যক্ত হয়। বিশুদ্ধ বৈদিক আচারকেই একমাত্র প্রাধান্য দেওয়া হয়। এজন্য সেন রাজারা নতুন করে জাতি বিভাগ করেন।
- (২) মধ্য যুগের ইউরোপ -এ খ্রীষ্টীয় গীর্জা যেরূপ জনগণের জীবনকে কঠোর শৃঙ্খলায় বাঁধত, সেন রাজারা সেইরূপ আচার পদ্ধতি, বিবাহ সম্পর্ক রীতি, জাতি বিভাগ করে হিন্দু সমাজকে কঠোর শৃঙ্খলায় বাধবার আয়োজন করেন। এর পিছনে ছিল সেন রাজাদের দক্ষিণ ভারতীয় হিন্দু গোঁড়ামি ও অন্ধ বিশ্বাস।
- (৩) সমাজ সমন্বয়ের দ্বারা শক্তিশালী হয় একথা তারা বুঝতেন না। ফলে কুলীন, ভঙ্গ কুলীন, অভঙ্গ কুলীন, রাঢ়ী, বৈদিক, বরেন্দ্র প্রভৃতি অসংখ্য কুলে তাঁরা ব্রাহ্মণদের ভাগ করে ফেলেন। অব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রেও নানা ভাগ করা হয়।
- (৪) অনুগত ব্রাহ্মণদের সাহায্যে পুরাণ ও পুঁথি লিখিয়ে ইচ্ছামত বিভিন্ন জাতির উৎপত্তি বর্ণনা করা হয় এবং স্বেচ্ছাচারীভাবে কাহাকেও উচ্চ, কাহাকেও নীচু বলে ঘোষণা করা হয়। সমাজে জাত-পাতের বিভেদটাই প্রবল হয়ে ওঠে। সংহতি ও ঐক্য ধ্বংস হয়। এর আড়ালে একটি তথাকথিত উচ্চ বর্ণ ও গোষ্ঠী গড়ে ওঠে যারা সমাজের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার একচেটিয়া ভাগীদার হন।
সেন যুগের সংকীর্ণ নীতি
- (১) ডঃ নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙালীর ইতিহাস গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, পাল যুগের ভূমিপট্টলী হতে দেখা যায় বহু বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণদের তারা ভূমি দান করেন। সেন যুগে কোনো নিম্নবর্ণের হিন্দুকে দান সম্বলিত কোনো ভূমিপট্টলী এখনও পাওয়া যায়নি। বৌদ্ধদেরও কোনো ভূমি দান করা হয়নি।
- (২) পাল যুগে সমাজের নীচু তলার সম্পদ উৎপাদনকারী শ্রেণী যথা – কৃষক, কৈবর্ত, কামার প্রভৃতির মঙ্গলের জন্য চেষ্টা করা হত। সেন যুগে নব হিন্দু ধর্মের গোড়ামির দরুন এই নীতি পরিত্যক্ত হয়। সেন যুগের সমাজকর্তা ভবদেব ভট্ট জাতিভেদের আইনকে এত কড়া করেন, যে সকল ব্রাহ্মণ নিম্নবর্ণের হিন্দুদের জন্য পুরোহিতের কাজ করতেন তাদের পতিত বলে গণ্য করা হয়।
- (৩) ব্রাহ্মণদের যজন ছাড়া আর কোনো বৃত্তি এমন কি চিকিৎসকের বৃত্তিও নিতে নিষেধ করা হয়। গৃহবিপ্র বা দেবল ব্রাহ্মণরা জ্যোতিষ চর্চা করত বলে তাদের পতিত ঘোষণা করা হয়। বল্লাল চরিত থেকে জানা যায় যে, সুবর্ণ বণিকরা সেন রাজাদের কোপে পড়ে জাতিচ্যুত হয়ে নিম্নবর্ণে পরিণত হন।
সেন যুগের নৈতিক শৈথিল্য
বাংলার সেন যুগের সমাজে নৈতিক শিথিলতাও দেখা যায়। গোবর্ধনের আর্য সপ্তশতিতে বহু কামোদ্দীপক অশ্লীল পদ দেখা যায়। জয়দেবের গীতগোবিন্দম্ কাব্য ধর্মের দিক থেকে শ্রেষ্ঠ হলেও, বিষয়বস্তু অনেক সময় অশ্লীলতার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। জোলক, বসন্ত উৎসব প্রভৃতি দ্বারা সামাজিক শৈথিল্য প্রকাশিত হত। কুল-বিবেক গ্রন্থে এই সকল আচারকে প্রশংসা করা হয়েছে।
উপসংহার :- সেন বংশ একশ বছরের বেশি (১০৯৭-১২২৫ খ্রি) সময় বাংলা শাসন করে। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস-এ এগারো শতকের অন্তিমলগ্নে পাল সাম্রাজ্য -এর অবসান ঘটিয়ে সেনদের উত্থান একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
(FAQ) সেন বংশের গুরুত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
সামন্ত সেন।
বিজয় সেন।
বল্লাল সেন।
লক্ষ্মণ সেন।