মারাঠা জাতির অভ্যুত্থান

মারাঠা জাতির অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে মারাঠা জাতীয়তাবাদের উদ্ভব, ভৌগোলিক অবস্থান, সাহসী ও কষ্টসহিষ্ণু কৃষক, গেরিলা যুদ্ধে পারদর্শী, পর্বত সঙ্কুল ভূমি, রাজনৈতিক ও সামরিক শিক্ষা, মালিক অম্বর, জায়গীরদারদের ক্ষমতা বৃদ্ধি, যোদ্ধা জাতি, মুঘলদের গতিরোধের চেষ্টা, সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য, ভক্তিধর্মের প্রভাব, মারাঠী সাহিত্যের প্রভাব ও শিবাজীর প্রভাব সম্পর্কে জানবো।

মারাঠা জাতির অভ্যুত্থান

ঐতিহাসিক ঘটনামারাঠা জাতির অভ্যুত্থান
নেতাশিবাজী
গুরুরামদাস
পোবাড়াবীরগাথা
মারাঠা জাতির অভ্যুত্থান

ভূমিকা :- বোম্বাই, কোঙ্কন, খান্দেশ ও বেরারকে মারাঠাবাদ অঞ্চল বলা হত। মারাঠাবাদের বৃহত্তর অংশের নাম ছিল মহারাষ্ট্র। মহারাষ্ট্রের অধিবাসীদের বলা হত মহারাষ্ট্রী বা মারাঠী।

মারাঠা জাতীয়তাবাদের উদ্ভব

প্রকৃতপক্ষে মারাঠা জাতীয়তাবাদের উদ্ভব কোনো একজন ব্যক্তির প্রভাবে ঘটে নি। মারাঠা জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের পশ্চাতে বিবিধ শক্তির প্রভাব দেখা যায়।

মারাঠা জাতির উত্থানে ভৌগোলিক অবস্থান

মহারাষ্ট্রের ভৌগোলিক অবস্থান এই অঞ্চলটিকে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। বিন্ধ্য ও সাতপুরা পর্বতমালা এবং নর্মদা নদীর দ্বারা মহারাষ্ট্র উত্তরের হিন্দুস্থান হতে বিচ্ছিন্ন। ভৌগোলিকভাবে উত্তর ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায়, উত্তরের সমতল অঞ্চলের অধিবাসীদের থেকে মারাঠীদের চরিত্র জীবনধারা আলাদা।

মারাঠা জাতির উত্থানেসাহসী ও কষ্টসহিষ্ণু কৃষক

উত্তর ভারতের মত উর্বরা পলিমাটির সমতল জমি মহারাষ্ট্রে নেই। অনুর্বরা পাথুরে মাটিতে চাষ-আবাদ হবার ফলে মারাঠী কৃষকরা খুব কষ্টসহিষ্ণু। পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসের ফলে মারাঠীরা সাহসী ও সংগ্রামী প্রকৃতির। প্রকৃতির সঙ্গে নিরন্তর সংগ্রামের ফলে মারাঠী কৃষকরা ছিল আত্ম-বিশ্বাসী, আত্মমর্যাদা সচেতন এবং সংগ্রামী।

মারাঠা জাতির উত্থানে গেরিলা যুদ্ধে পারদর্শী মারাঠি

মহারাষ্ট্রের পর্বতমালা ও গিরি দুর্গগুলির দ্বারা সহজে আত্মরক্ষার সুযোগ থাকায় মারাঠীরা স্বভাবতই আত্মরক্ষায় সক্ষম ও গেরিলা যুদ্ধে পারদর্শী।

মারাঠা জাতির উত্থানে পর্বতসঙ্কুল ভূমি

মহারাষ্ট্রের পর্বতসঙ্কুল ভূমিতে বহিরাগত আক্রমণকারীর পক্ষে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বজায় রাখা এবং মারাঠীদের গেরিলা আক্রমণের বিরুদ্ধে দাঁড়ান কঠিন ছিল। এই সকল প্রাকৃতিক সুযোগ ও প্রাকৃতিক প্রভাব মারাঠা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করে।

মারাঠা জাতির উত্থানে রাজনৈতিক ও সামরিক শিক্ষা

  • (১) মহারাষ্ট্রের ভূমি বিশেষ উর্বরা ছিল না। জীবিকার প্রয়োজনে মারাঠীরা প্রতিবেশী অঞ্চলে কৃষি ও চাকুরী সূত্রে ছড়িয়ে পড়ে। মারাঠী কৃষক ও জায়গীরদাররা আহমদনগর ও বিজাপুর প্রভৃতি রাজ্যের অধীনে চাষ-আবাদ ও চাকুরী করত।
  • (২) দক্ষিণের এই বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার সুলতানিগুলির অধীনে শাসন ও সামরিক দপ্তরে কাজ করে মারাঠীরা কুটনৈতিক ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা লাভ করে। মারাঠী ব্রাহ্মণরা দক্ষিণের সুলতানিগুলির কূটনৈতিক ও গোপন দপ্তরের কাজ চালাতেন।

মারাঠা জাতির উত্থানে মালিক অম্বরের অবদান

আহমদনগরের প্রবীণ মন্ত্রী মালিক অম্বর মারাঠী কৃষকদের কষ্টসহিষ্ণু ও সংগ্রামী চরিত্র লক্ষ্য করে সর্বপ্রথম তাদের গেরিলা যুদ্ধের কৌশল শিক্ষা দেন। তখন থেকেই মারাঠীরা যুদ্ধ ও কূটনীতিতে দক্ষতা দেখায়।

মারাঠা জাতির উত্থানে জায়গীরদারদের ক্ষমতা বৃদ্ধি

শাহজাহান -এর রাজত্বকালে মুঘল সম্রাট বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা অধিগ্রহণের চেষ্টা করেন। এই সুলতানিগুলির অধীনস্থ মারাঠা জায়গীরদাররা দ্রুত ক্ষমতা বাড়িয়ে ফেলে।

মারাঠা জাতির উত্থানে যোদ্ধা জাতির ভূমিকা

  • (১) বিজয়নগর সাম্রাজ্য-এর আমলে দাক্ষিণাত্যের মারাঠা ও কুনবী-কৃষকরা যোদ্ধার কাজ করত। বিজয়নগরের পতন হলে এই সকল যোদ্ধা শ্ৰেণী স্থানীয় জমিদার, জায়গীরদারদের অধীনে চাকুরী নেয়।
  • (২) তারা ভাড়াটিয়া সৈনিকের কাজ করত। এই সৈনিকদের নায়করা এভাবে অর্থ ও জমি উপার্জন করে যোদ্ধা জমিদারে পরিণত হয়। শিবাজীর সেনাদলে এরাই যোগ দেয়।

প্রতিদ্বন্দ্বী মুঘলদের গতিরোধের চেষ্টা

  • (১) আহমদনগরের ওপর ভোঁসলে পরিবারের দাবী বিজয়নগরের আমল থেকে ছিল। আহমদনগর নিজামশাহী সুলতান বংশ অধিকার করায় ভোঁসলে বংশ সেই দাবী হারায়। মুঘল সম্রাট শাহজাহান আহমদনগর অধিকার করলে শাহজী ভোঁসলে তাদের প্রাচীন বংশগত অধিকার ফেরত চান।
  • (২) এই উপলক্ষে মুঘলদের সঙ্গে ভোঁসলে পরিবারের বিবাদ দেখা দেয়। শাহজী বিজাপুরের সঙ্গে যোগ নিয়ে মুঘলকে হঠাতে চেষ্টা করেন। মুঘলের হাতে বিজাপুর সুলতান বন্দী হলে শাহজী এক বালককে বিজাপুর সিংহাসনে বসিয়ে মুঘলের গতিরোধের চেষ্টা করেন।

মারাঠা জাতির উত্থানে সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য

  • (১) মহারাষ্ট্রের সমাজ ও ধর্ম আন্দোলন মহারাষ্ট্রের জাগরণের পটভূমি রচনা করে। মহারাষ্ট্রের সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য তেমন ছিল না। অনুর্বরা, বন্ধ্যাভূমি, অধিক লোকসংখ্যার জন্য মহারাষ্ট্রে ভূমি মুষ্টিমেয় লোকের হাতে ছিল না। স্ত্রী স্বাধীনতা মহারাষ্ট্রে থাকার ফলে জাতীয় শক্তি দৃঢ় ছিল।
  • (২) প্রাচীনকাল থেকে জমির রায়তি বন্দোবস্তের ফলে এই দেশে মধ্যস্বত্বভোগীদের সংখ্যা কম ছিল। অর্থনৈতিক পার্থক্য না থাকায় সমাজে বিভেদ কম ছিল এবং শোষক শ্রেণীর সংখ্যা বেশী ছিল না। সকলের একই প্রকার অর্থনৈতিক অবস্থা থাকায়, জাতীয় ঐক্য দৃঢ় হয়।

মারাঠা জাতির উত্থান সম্পর্কে স্যার সরকারের অভিমত

স্যার যদুনাথ সরকার-এর মতে, “ধনী ও সভ্য সমাজে যেমন শ্রেণী বিভাগ, উচ্চ-নীচ ভেদ আছে, ষোড়শ শতকের সরল, গরীব মারাঠাদের মধ্যে সেরূপ ছিল না।”

ভক্তি ধর্মের প্রভাবে মারাঠা জাতির উত্থান

  • (১) ভক্তি আন্দোলন -এর প্রভাবে মহারাষ্ট্রে সামাজিক সাম্য ও জাতীয় ঐক্য দৃঢ় হয়। মহারাষ্ট্রের ভক্তিধর্মের গুরুরা ছিলেন নিম্নবর্ণের লোক। তারা জাতিভেদ, ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি ও সামাজিক ভেদাভেদের বিরূদ্ধে প্রচার চালান।
  • (২) এই প্রচার এতই আবেগধর্মী ও জনপ্রিয় ছিল যে, সমগ্র মহারাষ্ট্র তাতে প্লাবিত হয়। মহারাষ্ট্রের পুরাতন প্রথা ও সামাজিক বিভেদগুলি ভক্তিধর্মের প্রভাবে ভেঙে পড়ে। একনাথ, তুকারাম, বামন পণ্ডিত, রামদাস প্রমুখ ভক্তিবাদী গুরুদের বাণী ও ভক্তিগীতগুলি মহারাষ্ট্রের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে।
  • (৩) তাঁরা ভক্তিকেই সার এবং পুজো, উপাসনা, যজ্ঞ, জাতিভেদ মিথ্যা বলে প্রচার করেন। সকল মানুষ সমান, ব্রাহ্মণ ও চণ্ডালে ভেদ নেই এই তত্ত্ব তারা প্রচার করেন। তুকারামের ‘আভঙ্গ’ নামে ভক্তিগীতিগুলিও খুব জনপ্রিয় ছিল।
  • (৪) রামদাস সমর্থ ছিলেন শিবাজীর গুরু। তিনি মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন গ্রামে মঠ প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাঁর শিষ্যদের মধ্যে অভিবাদ, মারাঠা জাতির অতীত গৌরবের কথা প্রচার করেন। তাঁর “দাশবোধ” নামে ভক্তিগ্রন্থ মহারাষ্ট্রের ঘরে ঘরে পড়া হত।
  • (৫) এই ধর্মগুরুদের প্রভাবে মারাঠা জাতির মধ্যে ঐক্য ও জাতীয় প্রেরণার উদ্ভব হয়। এই ভক্তিবাদী গুরুদের স্থাপিত তীর্থে মারাঠীরা এসে এক প্রাণ, এক মন লাভ করে। গ্রাম ও নগরের মধ্যে প্রভেদ দূর হয়। ঔরঙ্গজেব -এর আক্রমণের বিরুদ্ধে মারাঠারা জাতীয়ভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে শিবাজীর পিছনে দাঁড়ায়।

মারাঠা জাতির উত্থানে মারাঠী সাহিত্যের প্রভাব

  • (১) ইতিহাসে দেখা যায় যে, কোনো জাতির জাগরণের ক্ষেত্রে সেই জাতির সাহিত্যের ভূমিকা থাকে। মহারাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয় নি। মারাঠীদের মুখের ভাষায় রচিত সাহিত্য মারাঠীদের মধ্যে ঐক্য বাড়ায়।
  • (২) তুকারামের ‘আভঙ্গ’, রামদাসের ‘দাশবোধ’, আনন্দ-বন-ভূবন প্রভৃতি কথ্য ভাষার সাহিত্য মারাঠীদের মধ্যে ঐক্যবোধ সৃষ্টি করে। মহারাষ্ট্রে বর্ষাকালে ও শীতকালে মারাঠা গৃহস্থরা শ্রীধর কবির “পোথী” (পুথি), রামদাসের দাশবোধ, তুকারামের আভঙ্গের পাঠ শুনত।
  • (৩) এই ধর্ম সাহিত্যগুলির ভাব ও বিভিন্ন রস মারাঠা জাতির প্রাণকে এক সুরে বেঁধে দেয়। সাধারণ মারাঠা ব্যালাড বা বীরগাথার নাম ছিল পোবাড়া। মহারাষ্ট্রের চারণ কবি বা গোন্ধালীরা গ্রামে গ্রামে এই ‘পোবাড়া গেয়ে বেড়াত।
  • (৪) এই ব্যালাডগুলিতে মহারাষ্ট্রের প্রাচীন ইতিহাস, চালুক্য, রাষ্ট্রকূট যুগে মারাঠাদের ভারত বিজয়ের কাহিনী বর্ণনা করা হত। এর ফলে মারাঠীদের মনে অতীত গৌরবের কথা উদিত হয়।

মারাঠা জাতির উত্থানে শিবাজীর প্রভাব

সব মিলিয়ে মারাঠা জাতির মধ্যে জাগরণের ক্ষেত্র তৈরি হলেও নেতার অভাব ছিল। শিবাজীর আবির্ভাবের ফলে সেই অভাব দূর হয়। তার বিরাট সংগঠন শক্তি, রণকুশলতা ও রাষ্ট্রনৈতিক প্রতিভার দ্বারা শিরাজী মারাঠা জাতিকে এক নবজীবন দান করেন।

উপসংহার :- ইতিহাসে যে কোনো বৃহৎ ঘটনা পরিস্থিতি ও নেতৃত্ব উভয়ের সমন্বয়েই ঘটে থাকে। ভৌগোলিক, সামরিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি দিক দিয়ে সমৃদ্ধি লাভ করে শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠা জাতির অভ্যুত্থান ঘটে।

(FAQ) মারাঠা জাতির অভ্যুত্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. পোবাড়া কি?

সাধারণ মারাঠা ব্যালাড বা বীরগাথার নাম ছিল পোবাড়া।

২. মারাঠাদের দুজন ভক্তিগুরুর নাম লেখ।

একনাথ, তুকারাম, রামদাস।

৩. কার নেতৃত্বে মারাঠা জাতির অভ্যুত্থান ঘটে?

শিবাজী।

৪. শিবাজীর গুরু কে ছিলেন?

রামদাস।

Leave a Comment