বিদ্রোহ দমনে বলবনের ভূমিকা প্রসঙ্গে মেওয়াটি দমন, দোয়াবে দস্যু দমন, তুঘ্রিল খানের বিদ্রোহ ও তার গুরুত্ব, তুঘ্রিল খানের বিরুদ্ধে অভিযান, বলবনের বাংলা অভিযান ও শাস্তিদান সম্পর্কে জানবো।
বিদ্রোহ দমনে বলবনের ভূমিকা
বিষয় | বিদ্রোহ দমনে বলবনের ভূমিকা |
সুলতান | গিয়াসউদ্দিন বলবন |
বাংলায় বিদ্রোহ | তুঘ্রিল খাঁ |
রক্ত ও লৌহ নীতি | গিয়াসউদ্দিন বলবন |
ভূমিকা :- দিল্লীর সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন রাজ্য শাসনের ক্ষেত্রে রক্ত ও লৌহ নীতি অনুসরণ করেন। তার আমলে সংঘটিত উপদ্রব ও বিদ্রোহ গুলি তিনি কঠোর হাতে দমন করেন।
মেওয়াটী দস্যু দমনে বলবনের ভূমিকা
- (১) তিনি মেওয়াটী দস্যুদলকে দমনের জন্য দিল্লীর চতুর্দিকে জঙ্গলগুলি কাটাই করান। এই জঙ্গলে দস্যুরা বাসা বেঁধেছিল। তিনি দ্রুতগামী অশ্বারোহী বাহিনী দ্বারা বহু মেওয়াটীদের ধরে নিহত করেন। দিল্লীর চতুর্দিকে সামরিক ছাউনী ও থানা স্থাপন করেন।
- (২) মেওয়াটী দস্যুদের দমনের জন্য গোপালগিরে একটি দুর্গ স্থাপন করা হয়। মেওয়াটী গ্রামগুলি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। মেওয়াটীদের জমিগুলি বাজেয়াপ্ত করে সাহসী তুর্কী সেনাদের বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। বলবনের রক্ত ও লৌহ নীতির ফলে মেওয়াটী উপদ্রব দমিত হয়।
দোয়াবে দস্যু দমনে বলবনের কৃতিত্ব
- (১) এর পর তিনি অযোধ্যা ও দোয়াবে অরাজকতা ও দস্যুদলের অত্যাচার বন্ধের ব্যবস্থা করেন। দোয়াব ছিল সুলতানি সাম্রাজ্য-এর শস্য ভান্ডার। এই স্থানে দস্যুতার তান্ডব সুলতানি সাম্রাজ্যের ক্ষতির কারণ হয়। দোয়াবের বিদ্রোহীদের পরিচয় এক্ষেত্রে উল্লেখ্য।
- (২) যদিও বরণী তাদের দস্যু বলে অভিহিত করেছেন, কোনো কোনো গবেষক মনে করেন যে এরা ছিল দোয়াব ও অযোধ্যার ধনী হিন্দু কৃষক ও জমিদার শ্রেণী। এরা তুর্কী শাসনের নিকট বশ্যতা স্বীকারে রাজী ছিল না এবং এই উর্বরা অঞ্চলে মুসলিম জাতি তখনও বিস্তৃতি না হওয়ায় তারা নিজেদের স্বাধীন বলে মনে করত।
- (৩) সুলতানি সরকারকে তারা নিয়মিত কর দিত না এবং ইক্তাদারদের ক্ষমতা অগ্রাহ্য করত। দোয়াবের বিদ্রোহী গ্রামগুলিকে ধ্বংস করে ছারখার করা হয়, সক্ষম পুরুষদের নিহত করা হয় এবং নারী ও শিশুদের দাসদাসীতে পরিণত করা হয়।
- (৪) দোয়াবের জঙ্গলগুলি কেটে ফেলা হয়, দোয়াব অঞ্চলকে ছোট্ট ছোট্ট ইক্তায় ভাগ করা হয়। তুর্কী ও আফগান সেনাপতিদের সেই ইক্তাগুলি দিয়ে দোয়াবে বসবাসের আদেশ দেওয়া হয়। তাদের দায়িত্ব থাকে স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা।
- (৫) তারা নিজ নিজ অঞ্চলে বিদ্রোহী ও দস্যুদলকে দমন করে এবং বিনিময়ে সৈন্য-সামন্তসহ জমি ভোগ করে। এছাড়া কাম্পিলি, পাতিয়ালী ও ভোজপুরে দুর্গ নির্মাণ করে সেই দুর্গে সেনাদল রাখা হয়। দরকারের সময় এই সেনারা ইক্তাদারদের সাহায্য করত।
বলবনের আমলে তুঘ্রিল খানের বিদ্রোহ
- (১) বলবনের শাসনকালে বাংলায় তুঘ্রিল তুগান খানের বিদ্রোহ ছিল এক বড় ধরনের রাজনৈতিক সমস্যা। তুঘ্রিল খান ছিলেন বলবনের দাস কর্মচারী। আরসলান খানের পর তিনি বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন।
- (২) বলবন উত্তর-পশ্চিমে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিরোধে ব্যস্ত থাকায় এবং বার্ধক্যদশাগ্রস্থ হওয়ায় তুঘ্রিল খান উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে পড়েন। তিনি মনে করেন যে সুদূর বাংলায়, এই বৃদ্ধ সুলতান, তাঁর আধিপত্য রাখতে পারবেন না। তুঘ্রিল খান নিজ নামে খুৎবা পাঠ করেন এবং তিনি একটি রাজকীয় উপাধি নেন।
বলবনের আমলে তুঘ্রিলের বিদ্রোহের গুরুত্ব
তুঘ্রিল খানের বিদ্রোহকে বলবন খুবই বিপজ্জনক ঘটনা বলে মনে করতেন। কারণ,
- (১) তুঘ্রিলের ন্যায় দাস কর্মচারী বিদ্রোহ করলে এই অনুকরণে অন্যান্য প্রদেশের দাস কর্মচারীরা বিদ্রোহ করতে পারতেন। সুতরাং এই বিদ্রোহকে অঙ্কুরে বিনাশ করার কথা বলবন ভাবেন।
- (২) বাংলা ছিল সীমান্ত রাজ্য। বাংলা বিচ্ছিন্ন হলে পূর্ব ভারত সুলতানি শাসনের হাতছাড়া হত।
- (৩) বাংলা থেকে দিল্লীতে প্রভৃত রাজস্ব যেত। তা বন্ধ হলে দিল্লী সুলতানির আর্থিক ক্ষতি হয়।
তুঘ্রিলের বিরুদ্ধে বলবনের বাহিনীর অভিযান
- (১) বলবন প্রথমে অযোধ্যার শাসনকর্তা আমিন খাঁর নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী বাহিনী তুঘ্রিলের বিরুদ্ধে পাঠান। কিন্তু তুঘ্রিলের অশ্বারোহী ও বাঙালী পাইক সেনার আক্রমণে ঘর্ঘরা যুদ্ধে আমিন খাঁ পিছু হঠে আসতে বাধ্য হন। বহু তুর্কী আমীর দিল্লীর পক্ষ ছেড়ে তুঘ্রিলের পক্ষে যোগ দেয়।
- (২) এরপর বলবন বাহাদুর নামে দিল্লীর এক দক্ষ সেনাপতির অধীনে এক নতুন বাহিনী তুঘ্রিলকে দমন করার জন্য পাঠান। কিন্তু তুঘ্রিল এই বাহিনীকেও পরাস্ত করেন এবং বাহাদুর দিল্লীতে ফিরে যেতে বাধ্য হন।
বলবনের বাংলা অভিযান
- (১) পর পর দুবার তাঁর অভিযান ব্যর্থ হলে ১২৮০-৮১ খ্রিস্টাব্দে বলবন বৃদ্ধ বয়সে নিজে বাংলায় তৃতীয় অভিযান পরিচালনা করেন। বলবনের সহকারী ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় পুত্র মহম্মদ বুঘরা খান।
- (২) তুঘ্রিল সুলতানি সেনার চাপে লক্ষ্মণাবতী ছেড়ে সোনারগাঁও বা ঢাকা পালান। বলবন তার পিছু নিয়ে অতর্কিত আক্রমণ করে তাকে নিহত করেন। তিনি তার পুত্র বুঘরা খানকে বাংলার শাসনকর্তার পদে বসান।
বলবন কর্তৃক শাস্তি প্রদান
দিল্লীতে ফিরে এসে সুলতান বাংলার দুই অভিযানের বিফল সেনাপতিদের এবং তুঘ্রিলের পক্ষভুক্ত তুর্কী সেনাদের শূলে চড়িয়ে দেন। দিল্লীর পথের ধারে দু মাইল সারি সারি শূল বসান হয় এবং তাতে বলবনের সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের এই বিদ্রোহে জড়িত থাকার অভিযোগে বসিয়ে দেওয়া হয়। দিল্লীর আকাশ বাতাস মরণাপন্ন ব্যক্তিদের আর্ত চীৎকারে ভরে ওঠে।
উপসংহার :- এইভাবে কঠোর নীতি অবলম্বন করে বলবন বুঝিয়ে দেন যে, তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করার শাস্তি কিরূপ ভয়াবহ হতে পারে। শেষ পর্যন্ত সেনাদলের কাজীর অনুরোধে তিনি আর বেশী লোককে শূলে চড়ান বন্ধ করেন।
(FAQ) বিদ্রোহ দমনে বলবনের ভূমিকা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
তুঘ্রিল খাঁ।
তিনটি।
গিয়াসউদ্দিন বলবন।
পুত্র বুঘরা খাঁ কে।