শিল্প বিপ্লব

এই শিল্প বিপ্লব -এর বৈশিষ্ট্য, শিল্প বিপ্লবের কারণ, শিল্প বিপ্লবের ফলাফল, শিল্প বিপ্লবের সুফল ও কুফল সম্পর্কে আলোচনা করা হল।

শিল্প বিপ্লব প্রসঙ্গে ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্প বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব কি, শিল্প বিপ্লব কথাটির প্রথম ব্যবহার, শিল্প বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য, শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপট, শিল্প বিপ্লব কথাটির জনপ্রিয়তা, ফ্যাক্টরি প্রথা, ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপট, অষ্টাদশ শতাব্দীতে শিল্প বিপ্লব, ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের ইতিহাস, শিল্প বিপ্লবের সুফল, শিল্প বিপ্লবের কুফল, শিল্প বিপ্লবের ফলে নগর সভ্যতার উন্মেষ, শিল্প বিপ্লব সম্পর্কে স্পিনিং জেনি, ব্লাস্ট ফার্নেস, উড়ন্ত মাকু, শিল্প বিপ্লবের ফলাফল।

ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব

ঐতিহাসিক ঘটনাশিল্পবিপ্লব
সময়কালঅষ্টাদশ শতাব্দী
প্রথম সংঘটনইংল্যান্ড
কথাটির ব্যবহারলুই অগাস্তে ব্ল্যাঙ্কি
বৈজ্ঞানিক যন্ত্রআবিষ্কারক
বাষ্পীয় ইঞ্জিনজেমস্ ওয়াট
বাষ্পচালিত রেল ইঞ্জিনজর্জ স্টিফেন সন
সেফটি ল্যাম্পহামফ্রে ডেভি
স্পিনিং জেনিহারগ্রিভস
কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্র ও তাদের আবিষ্কারকের নাম

ভূমিকা :- ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে গৌরবময় বিপ্লবের পর ইংল্যান্ডে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসে ও শান্তির পরিবেশ গড়ে ওঠে। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, কৃষির উন্নতিসহ অন্যান্য অনুকূল উপাদানের সাহায্যে ইংল্যান্ডেই প্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটে।

শিল্প বিপ্লব কি?

কোনে ক্ষেত্রে দ্রুত এবং আমূল পরিবর্তনকে সাধারণভাবে বিপ্লব বলা হয়। আর শিল্প বিপ্লব হল শিল্পের ক্ষেত্রে দ্রুত এবং আমূল পরিবর্তন ।

শিল্প বিপ্লব কথাটির প্রথম ব্যবহার

১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি সমাজতন্ত্রী নেতা লুই অগাস্তে ব্ল্যাঙ্কি ( Louis Auguste Blanqui ) শিল্প বিপ্লব কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন।

পুনরায় শিল্প বিপ্লব কথাটির ব্যবহার

১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে জার্মান সমাজতন্ত্রী দার্শনিক ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস পুনরায় শিল্প বিপ্লব কথাটি ব্যবহার করেন। জন স্টুয়ার্ট মিল ও কার্ল মার্কসও শিল্প বিপ্লব কথাটি প্রয়োগ করেন।

শিল্প বিপ্লব কথাটি কে জনপ্রিয় করেন

১৮৮০-৮১ খ্রিস্টাব্দে বিশিষ্ট ব্রিটিশ ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়েনবি শিল্প বিপ্লব কথাটিকে জনপ্রিয় করেছিলেন।

শিল্পবিপ্লবের সাথে সম্পৃক্ত দিক

শুধু যন্ত্র দ্বারা উৎপাদন হলেই শিল্পবিপ্লব হয় না – এর সাথে আরও কতকগুলি আনুষঙ্গিক পরিবর্তন ঘটলে তবেই শিল্প বিপ্লব হয়। এই বিষয়গুলি হল –

  • (১) মূলধন বিনিয়োগের দ্বারা যন্ত্রচালিত বৃহৎ কারখানা স্থাপন।
  • (২) উৎপাদিত পণ্য মুনাফার ভিত্তিতে বাজারে বিক্রি করা।
  • (৩) উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মজুরির বিনিময়ে শ্রমিক নিয়োগ।
  • (৪) উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল ও শ্রমিকের পাশাপাশি মূলধন সরবরাহের জন্য ব্যাঙ্ক বা অর্থ বিনিয়োগকারী সংস্থার বিকাশ ঘটানো।
  • (৫) মাল পরিবহনের উপযুক্ত ব্যবস্থা করা প্রভৃতি।

এইসব ব্যবস্থার একত্র সমন্বয় ঘটলে তবেই শিল্প বিপ্লব হয়।

শিল্প বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য

এই শিল্প বিপ্লবের বৈশিষ্ট্যগুলি হল বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয়। যেমন-

  • (১) অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ধীরে ধীরে মন্থর গতিতে বহু মানুষের সম্মিলিত চেষ্টার ফলে শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। শিল্প বিপ্লবে কোনও চমক বা আকস্মিকতা নেই।
  • (২) শিল্প বিপ্লব সর্বত্র একই সময়ে দেখা দেয় নি। বিপ্লবের সূচনা হয় ইংল্যান্ডে এবং পরে তা ইউরোপের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
  • (৩) শিল্প বিপ্লবের ফলে ইউরোপ -এর কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়।
  • (৪) শিল্প বিপ্লবের ফলে মানুষ শহরমুখী হয় ও কলকারখানায় শিল্পকর্মে যোগ দেয়। এইভাবে শহরকেন্দ্রিক শিল্প-সভ্যতা গড়ে ওঠে।
  • (৫) শিল্প বিপ্লব কৃষি, বস্ত্র, কয়লা, লৌহ, পরিবহন — সবক্ষেত্রেই প্রযুক্তি ও কৌশলগত বিপ্লব এনে দেয়।

শিল্প বিপ্লবের কারণ বা ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার কারণ

ইউরোপের মধ্যে ইংল্যান্ডেই প্রথম শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হয়। শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হওয়ার জন্য কিছু উপাদানের প্রয়োজন হয়। ইংল্যান্ডে সেই উপাদানগুলির সবকটিই উপস্থিত ছিল বলে শিল্পবিপ্লব ত্বরান্বিত হয়েছিল। ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্প বিপ্লব শুরু হওয়ার কারণগুলি হল-

(১) বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার

ইংল্যান্ডে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার (যেমন – জন কে-র ‘উড়ন্ত মাকু’ বা ‘ফ্লাইং শাটল’, জেমস ওয়াট-এর বাষ্পীয় ইঞ্জিন প্রভৃতি) শিল্পবিপ্লব ঘটাতে সাহায্য করেছিল।

(২) কৃষির উন্নতি

অষ্টাদশ শতকে কৃষিবিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ড খাদ্যশস্য ও কাঁচামাল উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছিল। ফলে কৃষির ওপর ভিত্তি করে শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপট রচিত হয়।

(৩) মূলধনের প্রাচুর্য

সামুদ্রিক বাণিজ্যের মধ্যে দিয়ে ইংল্যান্ড ধনসম্পদে পূর্ণ একটি দেশে পরিণত হয়। তাছাড়া অষ্টাদশ শতকের ইংল্যান্ডে ব্যাংকিং ও ইনসিওরেন্স প্রথা চালু হলে ইংল্যান্ডের শিল্পক্ষেত্রে জোয়ার আসে।

(৪) অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ

উত্তরসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝে অবস্থিত ইংল্যান্ডের স্যাতসেঁতে আবহাওয়া শিল্প উৎপাদনে, বিশেষ করে বস্ত্রশিল্পের পক্ষে ছিল খুবই অনুকূল।

(৫) কাঁচামালের প্রাচুর্য

ইংল্যান্ডের খনিতে কয়লা, লোহা ছাড়াও টিন ও তামার ভাণ্ডার বৃহৎ শিল্পের দ্রুত প্রসারে সহায়তা করেছিল।

(৬) সুলভ শ্রমিকের সুবিধা

অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ও বহু কৃষক জমিচ্যুত হয়। ফলে সুলভে শিল্পে শ্রমিকের জোগান দেয়।

(৭) কাঁচামাল

ভারতবর্ষ, আমেরিকা ও পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের ইংরেজ উপনিবেশগুলি থেকে সস্তায় প্রচুর কাঁচামাল ইংল্যান্ডে আসত।

(৮) বাজার

উপনিবেশগুলি ছিল ইংল্যান্ড-জাত পণ্যদ্রব্যের একচেটিয়া বাজার। উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ে সাহায্য করে এই বাজার গুলি।

(৯) রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কারণ। ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের পর কোনও ধ্বংসাত্মক প্রভাব ইংল্যান্ডের উপর পড়ে নি।

(১০) সামাজিক গতিশীলতা

ইংল্যান্ডের মুক্ত সমাজ ও সামাজিক গতিশীলতা শিল্প বিপ্লবের অন্যতম সহায়ক ছিল। ইংল্যান্ডের সমাজে কোনও ধরনের বন্ধন ছিল না। ব্যক্তি-স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা শিল্পায়নের গতিকে ত্বরান্বিত করে।

(১১) যোগাযোগ ব্যবস্থা

ইংল্যান্ড ছিল সমুদ্রবেষ্টিত দ্বীপপুঞ্জ।

  •  (ক) সমুদ্রপথে সারা বিশ্বের সঙ্গে ইংল্যান্ডের যোগাযোগ স্থাপন সহজ ছিল। তাছাড়া ভালো এবং উন্নত মানের জাহাজ ও বন্দরও ছিল।
  • (খ) ইংল্যান্ডের দীর্ঘ উপকূলভাগ ছিল ভগ্ন। এর ফলে প্রচুর বন্দর গড়ে ওঠে। এইসব বন্দর থেকে দেশের অভ্যন্তরে যোগাযোগের জন্য অনেক খাল খনন করা হয়।
  • (গ) এছাড়া, বহু রাস্তাও নির্মিত হয়।

এক কথায়, স্বদেশ ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে এই যোগাযোগ শিল্প বিপ্লবের পক্ষে সহায়ক হয়।

(১২) বাণিজ্য নির্ভরতা

ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে ইংল্যান্ডই সপ্তদশ শতকে কৃষি-নির্ভরতা ত্যাগ করে। ঔপনিবেশিক বাণিজ্য-লব্ধ বিপুল মুনাফা বিভিন্ন কলকারখানা ও শিল্পে বিনিয়োগ করা হতে থাকে।   

(১৩) সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা

ব্রিটিশ সরকার দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের নানাভাবে সাহায্য করে।

(১৪) বাষ্পশক্তি

১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে জেমস ওয়াট বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার করলে উৎপাদন পদ্ধতিতে এক বিপ্লব ঘটে যায়। জল ও বায়ু শক্তির স্থান নেয় বাষ্পশক্তি।

(১৫) লৌহশিল্প

শিল্পের প্রসারে লোহা ও ইস্পাতের ভূমিক গুরুত্বপূর্ণ। ইংল্যান্ড ছিল লোহার অফুরন্ত ভাণ্ডার। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে জন স্মিটন লোহা গলাবার চুল্লি বা ‘ব্লাস্ট ফার্নেস’ আবিষ্কার করলে খুব কম খরচে লোহা উৎপাদন সম্ভব হয়।

(১৬) কয়লা

লোহার ব্যাপক ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে কয়লার চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। খনিগর্ভে নিরাপদে কাজ করার জন্য ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে হামফ্রে ডেভি আবিষ্কার করেন ‘সেফটি ল্যাম্প।

(১৭) পরিবহন

উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়া শিল্প বিপ্লব হতে পারে না। ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে টেলফোর্ড ও জন ম্যাকডাম পাথরকুচি ও পিচ দিয়ে মজবুত রাজপথ তৈরির কৌশল আবিষ্কার করেন। এইসব কারণে ইংল্যান্ড প্রথম শিল্প বিপ্লবের পথে অগ্রসর হয়।

শিল্প বিপ্লবের ফলাফল

ইউরোপে তথা সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে শিল্প বিপ্লবের ফলাফল ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী। শিল্প বিপ্লব বিশ্বের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করে।

(১) রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শিল্প বিপ্লবের ফল

শিল্প বিপ্লবের ফলে ইউরোপের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তনবর্তন দেখা দেয়।

(ক) ভূস্বামী ও অভিজাতদের ক্ষমতা হ্রাস

শিল্প বিপ্লবের আগে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভূস্বামী ও অভিজাতরাই সকল ক্ষমতা ভোগ করত, কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পরবর্তীকালে মূলধনী ও শ্রমিক শ্রেণি রাজনৈতিক প্রতিপত্তি লাভে সক্ষম হয়।

(খ) গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি

শিল্প বিপ্লবের পর মূলধনী ও শ্রমিক শ্রেণি গণতান্ত্রিক অধিকার দাবি করতে থাকে। নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য ইংল্যান্ডের শ্রমিকরা ‘চার্টিস্ট ইন্দোলন’ শুরু করে।

(গ) সাম্যবাদী ভাবধারার বিকাশ

সমাজে শ্রমিক শ্রেণির দুর্দশা এবং শিল্পপতিদের হাতে দেশের সব সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদী ভাবধারা জনপ্রিয় হতে থাকে।

(ঘ) জাতিয়তাবাদের বিকাশ

শিল্প বিপ্লবের ফলে জাতীয়তাবাদী আদর্শ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শিল্প বিপ্লবের ফলে সমগ্র দেশে একই শিল্প-নির্ভর অর্থনীতি চালু হলে জাতীয় সংহতি গড়ে ওঠে এবং জাতীয়তাবাদের পথ প্রশস্ত হয়।  

(ঙ) আন্তর্জাতিকতার বিকাশ

জাতীয়তাবাদের অগ্রগতি আন্তর্জাতিকতাবাদের পথকে প্রশস্ত করে। উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা, বাণিজ্যিক কারণে বিভিন্ন দেশ ও জাতি বর্গের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আন্তর্জাতিকতাবাদের উন্মেষ ঘটায়।

(চ) ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা

শিল্পোন্নত দেশগুলি নিজেদের দেশে উৎপন্ন উদ্বৃত্ত পণ্যাদি বিক্রির জন্য ইউরোপ ও তার পৃথিবীর নানা দেশে বাজার খুঁজতে থাকে। ফলে তাদের মধ্যে তীব্র ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়।

(২) সামাজিক ক্ষেত্রে শিল্প বিপ্লবের ফল

শিল্প বিপ্লব ইউরোপের সামাজিক ক্ষেত্রে বিরটি পরিবর্তন নিয়ে আসে।

(ক) শ্রমিক-মালিক দুই শ্রেণি

সমাজে দুটি নতুন শ্রেণির উদ্ভব হয়—পুঁজিপতি মালিক ও শোষিত শ্রমিক।

(খ) জনশূন্য গ্রাম

শিল্প বিপ্লবের ফলে গ্রামের কৃষকরা মজুরির আশায় দলে দলে শহরের কলকারখানাগুলিতে যোগ দিতে থাকলে গ্রামগুলি জনশূন্য হয়ে পড়ে।

(গ) শ্রমিকদের দুরবস্থা

শিল্প বিপ্লব সমাজে নানা কুফল ডেকে আনে। শ্রমিকদের বাসস্থানগুলির অবস্থা ছিল শোচনীয়, অস্বাস্থ্যকর ও অমানবিক মালিকপক্ষ নানাভাবে তাদের শোষণ করত।

(ঘ) শ্রমিক সংঘ

একসঙ্গে বাস করার ফলে শ্রমিকদের মধ্যে ঐক্যবোধ গড়ে ওঠে এবং তারা শ্রমিক সংঘ গঠন করে ধর্মঘটের মাধ্যমে তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ে সচেষ্ট হয়। 

(ঙ) মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব

শিল্প বিপ্লবের ফলে শিল্পপতি, বণিক, মহাজন প্রভৃতির সমন্বয়ে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি আবির্ভাব হয়।

(চ) জনসংখ্যা বৃদ্ধির

শিল্প বিপ্লবের ফলে ইউরোপে জনসংখ্যার হার প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে সমাজে নানা জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়।

(৩) অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শিল্প বিপ্লবের ফল

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শিল্প বিপ্লব বহুমখী পরিবর্তনের সূচনা করে।

(ক) ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা

শিল্প বিপ্লবের ফলে অল্প সময়ে উৎপাদিত প্রচুর পরিমাণ পণ্যসামগ্রী বিক্রির জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধে প্রতিযোগিতা শুরু হয়।

(খ) ফ্যাক্টরি প্রথা

শিল্পবিপ্লবের ফলে ‘ফ্যাক্টরি প্রথা বা বৃহৎ কারখানার উদ্ভব হয়। ‘ফ্যাক্টরি প্রথা’-র কাছে কুটির শিল্পের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হয় নি।

(গ) শ্রম বিভাজন

শিল্প বিপ্লবের ফলে ব্যাপক হারে উৎপাদন হতে থাকলে এক একজনকে দ্রব্যটির এক একটি অংশ তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এইভাবে শ্রম বিভাজন নীতি চালু হয়।

(ঘ) বাণিজ্যিক মূলধন

শিল্প বিপ্লবের পর পুঁজিপতিরা ব্যবসা-বাণিজ্য অপেক্ষা শিল্পে মূলধন বিনিয়োগ করতে থাকেন। ফলে বাণিজ্যিক মূলধন শিল্প মূলধনে পরিণত হয়।

(ঙ) মুনাফার পাহাড়

মুনাফা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে শিল্পপতিরা শ্রমিকদের যতটা সম্ভব কম মজুরি দিতে থাকেন। শ্রমিকরা নানাভাবে শোষিত হতে থাকে। ফলে ধনী দিন দিন আরও ধনী এবং দরিদ্র আরও দরিদ্র হতে থাকে।

শিল্প বিপ্লবের সুফল

মানবসভ্যতার প্রগতির পথে শিল্পবিপ্লব ছিল আশীর্বাদস্বরূপ। যেমন –

(১) নগরকেন্দ্রিক সমাজ সৃষ্টি

শিল্পবিপ্লবের ফলে শিল্প বা কলকারখানা ও বাণিজ্যস্থলকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন নগরের সৃষ্টি হয়। ফলে নগরকেন্দ্রিক সমাজ ও সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়।

(২) বিলাসবহুল জীবনযাপন

শিল্পবিপ্লবের ফলে সর্বক্ষেত্রে আরাম ও বিলাসের অজস্র উপকরণ নির্মিত হতে থাকে। মানুষ অর্থের বিনিময়ে সেইসব দ্রব্য ক্রয় করে নিজেদের জীবনকে বিলাসবহুল করে তোলে।

(৩) প্রকৃতিকে জয়

শিল্পবিপ্লবের ফলে আবিষ্কৃত বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির দ্বারা মানুষ কয়লা, খনিজ তেল, জল প্রভৃতি প্রাকৃতিক উপাদান থেকে বিদ্যুৎ তৈরিতে মানুষ সক্ষম হয়।

(৪) সময়ের সাশ্রয়

শিল্পবিপ্লবের ফলে যন্ত্রের দ্বারা অল্প সময়ে অধিক দ্রব্য উৎপাদনে মানুষ সক্ষম হয়। ফলে সময়ের অনেক সাশ্রয় হয়।

(৫) শ্রমবিভাজন নীতির উদ্ভব

শিল্প বিপ্লবের পর একজন শ্রমিক একটি দ্রব্যের একটি অংশ তৈরির সঙ্গে যুক্ত হয় পুরো দ্রব্যের সঙ্গে নয়। ফলে বিশেষীকরণের উদ্ভব হয় এবং দ্রব্যের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়।

(৬) ব্যাবসা বাণিজ্যের প্রসার

শিল্প বিপ্লবের পর উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল। ইংল্যান্ডের উৎপাদিত সামগ্রী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বাজার দখল করে নিয়েছিল।

শিল্প বিপ্লবের কুফল

শিল্পবিপ্লব আশীর্বাদের সঙ্গে কিছু কিছু অভিশাপও বয়ে নিয়ে আসে। যেমন –

(১) জনশূন্য গ্রাম

শিল্পবিপ্লবের ফলে গ্রামের মানুষ কাজের খোঁজে শহরে এসে ভিড় করে। ফলে লোকসংখ্যার অভাবে গ্রামগুলি ধ্বংসের মুখোমুখি হয়।

(২) কুটিরশিল্পের ধ্বংসসাধন

শিল্পবিপ্লবের ফলে নতুন নতুন যন্ত্রের আবিষ্কৃত হয়। যন্ত্রগুলির সাহায্যে কলকারখানায় অল্প সময়ে ব্যাপক উৎপাদন শুরু হলে চিরায়ত কুটিরশিল্প ধ্বংসের সম্মুখীন হয়।

(৩) শোষক শ্রেণির আবির্ভাব

শিল্প বিপ্লবের ফলে সমাজে মালিক ও শ্রমিক শ্রেণির আবির্ভাব হয়। মালিকশ্রেণি শ্রমিকদের শোষণ করে মূলধনের পাহাড় জমা করে।

(৪) মালিক-শ্রমিক শ্রেণির সংঘাত

মালিক শ্রেণির অত্যধিক কাজের চাপ, অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান, অমানবিক আচরণ শ্রমিকদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। এর ফলে শ্রমিক ও মালিকশ্রেণির মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়।

(৫) ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা

শিল্পবিপ্লবের ফলে উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী বিক্রির জন্য ইংল্যান্ড ও ইউরোপের অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশগুলির মধ্যে উপনিবেশ দখলের লড়াই শুরু হয়।

(৬) ঔপনিবেশিক শোষণ

শিল্প বিপ্লবের ফলে শিল্পমালিকেরা উপনিবেশের কাঁচামাল, ভূখণ্ড, জনসংখ্যা প্রভৃতির উপর আধিপত্য স্থাপন করে শোষণ চালাতে থাকে।

(৭) শ্রেণিবৈষম্য সৃষ্টি

শিল্প বিপ্লবের ফলে মালিকরা সর্বদা শ্রমিকদের শোষণ করে ধনী হয় এবং শ্রমিকরা শোষিত হতে হতে শোষণের শেষপ্রান্তে পৌঁছোয়। অর্থাৎ শ্রেণি বৈষম্য সৃষ্টি হয়।

উপসংহার :- ইতিহাসের পাতায় ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব একটি উল্লখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বিভিন্ন সুযোগসুবিধা সে সময়কার ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে কেবলমাত্র ইংল্যান্ডেই বর্তমান থাকায় সেখানেই প্রথম শিল্পবিপ্লব হয়।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “শিল্প বিপ্লব” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) শিল্প বিপ্লব হতে জিজ্ঞাস্য?

১. শিল্প বিপ্লব কথাটি প্রথম কে ব্যবহার করেছিল?

ফরাসি দার্শনিক লুই অগাস্তে ব্ল্যাঙ্কি ।

২. শিল্প বিপ্লব প্রথম কোথায় সংঘটিত হয়েছিল?

ইংল্যাণ্ডে ।

৩. শিল্প বিপ্লব প্রথম কোথায় শুরু হয়?

ইংল্যাণ্ডে ।

অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি

Leave a Comment