ব্রিটিশ সরকারের বিভাজন ও শাসন নীতি প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম বিভাজন ও শাসন নীতি কার্যকর, বিভাজন ও শাসন নীতির প্রেক্ষাপট, বিভাজন ও শাসন নীতির ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক তোষণনীতি, সাম্প্রদায়িক বিভেদের জন্য পদক্ষেপ, বিভাজন ও শাসন নীতি সম্পর্কে রাজেন্দ্র প্রসাদের মন্তব্য ও লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মন্তব্য সম্পর্কে জানবো।
ব্রিটিশ সরকারের বিভাজন ও শাসন নীতি
ঐতিহাসিক ঘটনা | বিভাজন ও শাসন নীতি |
প্রথম কার্যকর করেন | জন লরেন্স |
প্রথম কার্যকরী | পাঞ্জাবের সেনাবাহিনীতে |
আলিগড় কলেজ | ১৮৭৫ খ্রি |
জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা | ১৮৮৫ খ্রি |
ভূমিকা :- স্যার জন স্ট্রাচে এক সময় লেখেন যে, “ভারতে পরস্পরবিরোধী বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর অস্তিত্ব আমাদের পক্ষে একটি দারুণ সুবিধা।” মাউন্টস্টুয়ার্ট এলফিনস্টোন ব্রিটিশ সরকারকে পরামর্শ দেন যে, “প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্য-এর প্রধান নীতি ছিল ‘বিভাজন ও শাসন’, আমাদের এই নীতি গ্রহণ করা উচিত।” ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে বড়োলাট লর্ড কার্জন স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন যে, “যতদিন আমরা ভারত শাসন করব, ততদিন পর্যন্ত আমরা হলাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শক্তি।”
বিভাজন ও শাসন নীতি কি?
নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতেই ভারত-এ ব্রিটিশ শাসনকে নিরাপদ ও দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যেই ব্রিটিশ সরকার দেশের জাতি, ধর্ম, ভাষা প্রভৃতির মধ্যে বিভেদ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়। এই বিভেদের মাধ্যমে ভারতের সাম্প্রদায়িক ঐক্য ধ্বংস করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে দুর্বল করাই ছিল ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে নিরাপদ ও দীর্ঘস্থায়ী করার অন্যতম কৌশল। ভারতে ব্রিটিশদের এই শাসন পদ্ধতি ‘বিভাজন ও শাসন নীতি’ নামে পরিচিত।
সর্বপ্রথম বিভাজন ও শাসন নীতি কার্যকর
আমাদের দেশ ভারতবর্ষ-এ সর্বপ্রথম জন লরেন্স পাঞ্জাবের সেনাবাহিনীতে ‘বিভাজন ও শাসন নীতি’ কার্যকরী করেন।
বিভাজন ও শাসন নীতির প্রেক্ষাপট
ভারতে ব্রিটিশ সরকার যে, ‘বিভাজন ও শাসননীতি’ প্রয়োগ করেছিল তার প্রধান প্রেক্ষাপট ছিল নিম্নরূপ –
(ক) জাতীয় কংগ্রেসের উদ্ভব
১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর এই দলের শক্তি ও জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে কংগ্রেস জাতীয় আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকে। এরূপ পরিস্থিতিতে সরকার হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ ও বিরোধ সৃষ্টি করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দমনের প্রয়োজন উপলব্ধি করে। ব্রিটিশ সরকার ভারতের জাতি, ধর্ম, অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রভৃতির সুযোগ কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
(খ) ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়ের গতিরোধ
ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় হিন্দু ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায় শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় চেতনায় এগিয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার ভারতের মুসলিম ও অন্যান্য অব্রাহ্মণ সম্প্রদায়গুলির মধ্যে ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে বিদ্বেষ সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। ব্রাহ্মণদের প্রাধান্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সরকার তাদের উৎসাহিত করে। এভাবে তারা হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে, এমনকি বর্ণহিন্দু ও পিছিয়ে পড়া হিন্দুদের মধ্যে বিরোধ ও বিভেদ বৃদ্ধি করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে দুর্বল করার চেষ্টা চালায়।
বিভাজন ও শাসন নীতির ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক তোষণনীতি
ভারতের ব্রিটিশ সরকার সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির যে উদ্যোগ নেয় তাতে মূলত তিনটি পর্যায় লক্ষ্য করা যায়। যথা –
(ক) সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির প্রথম পর্যায়
ব্রিটিশরা প্রথমে মুসলিমদের আধিপত্য ধ্বংস করে ভারতে সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটিয়েছিল। তা ছাড়া প্রথমদিকে ব্রিটিশ প্রশাসনের নিম্নস্তরের বিভিন্ন পদে কাজের জন্য শিক্ষিত হিন্দু ব্রাহ্মণরা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই পর্যায়ে ব্রিটিশরা হিন্দুদের প্রতি সদয় ছিল।
(খ) সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির দ্বিতীয় পর্যায়
- (১) প্রশাসনে হিন্দু ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের আধিপত্য কিছুদিনের মধ্যেই সরকারের নজরে আসে। স্যার উইলিয়াম লি নামে জনৈক উচ্চপদস্থ ব্রিটিশকর্তা ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্য করেন যে, ১৮৬৯ থেকে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে শিক্ষাক্ষেত্রে এবং ব্রিটিশ প্রশাসনে ব্রাহ্মণদের আধিপত্য অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
- (২) এই সময় মনে হচ্ছিল যে, ব্রাক্ষ্মণরাই যেন দেশ পরিচালনা করছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ব্রাহ্মণরাই অগ্রভাগে থাকে বলে সরকারের নজরে আসে। দেখা যায়, ব্রিটিশবিরোধী কংগ্রেস দলে এবং অ্যানি বেসান্তের হোমরুল আন্দোলন-এও ব্রাহ্মণরাই অগ্রভাগে রয়েছে।
- (৩) ব্রাহ্মণরাই সমগ্র হিন্দু সম্প্রদায়কে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে প্ররোচনা দিচ্ছে বলে ব্রিটিশ সরকার মনে করতে থাকে। তাই এই পর্যায়ে সরকার মুসলিম সম্প্রদায়কে তোষণ করে হিন্দুদের দুর্বল করার চেষ্টা করে।
(গ) সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির তৃতীয় পর্যায়
তৃতীয় পর্যায়ে সরকার উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলিম তোষণের পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া হিন্দু ও অন্যান্য সম্প্রদায়গুলিকেও তোষণ করতে শুরু করে।
সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ
সরকার ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ধ্বংস করে এদেশে তাদের সাম্রাজ্যবাদী শাসন দীর্ঘস্থায়ী করতে ‘বিভাজন ও শাসন’ নীতির বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। মুসলিমদের শিক্ষাপ্রসঙ্গে স্যার ডব্লিউ. এইচ. গ্রেগরি ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ডাফরিনকে লেখেন, ” আমি নিশ্চিত যে, মুসলিমদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ব্রিটিশ সরকারের কাছে খুবই ফলদায়ক হবে। শিক্ষিত মুসলিমরা হিন্দু ব্রাহ্মণ ও বাবুদের আন্দোলন থেকে দূরে থাকবে। মুসলিমদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।” এই নীতির মাধ্যমে ভারতে সাম্প্রদায়িক বিভেদ বৃদ্ধি করতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এগুলি হল –
(ক) সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে নানান সরকারি সুযোগ দান
ব্রিটিশ সরকার আইনের চোখে সাম্যনীতির দোহাই দিয়ে সরকার ধর্ম ও সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে আর্থিক সহায়তা দান করে এবং স্থানীয় ও প্রাদেশিক স্তরের শিক্ষাক্ষেত্রে বা সরকারি চাকরিতে তাদের নিয়োগের ব্যবস্থা করে।
(খ) মুসলিম তোষণ
- (১) ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বে ভারতে মুসলিমরাই ছিল রাজশক্তি। কিন্তু ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলে হিন্দু সম্প্রদায়ের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনায় মুসলিম সম্প্রদায় আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে সরকার মুসলিমদের তোষণ করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হিন্দুদের বিরুদ্ধে তাদের ব্যবহার করে।
- (২) আলিগড় আন্দোলন-এর নেতা স্যার সৈয়দ আহমদ খান ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে আলিগড়ে অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই কলেজের আর্চিবোল্ড, থিওডোর বেক, মরিসন প্রমুখ অধ্যক্ষ হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মুসলিমদের মনে বিদ্বেষপূর্ণ মানসিকতা তৈরি করেন।
(গ) অনগ্রসর শ্রেণির প্রতি তোষণ
- (১) মুসলিম সম্প্রদায়ের আনুগত্য নিশ্চিত হওয়ার পর ব্রিটিশ সরকার অন্যান্য অব্রাহ্মণ ও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের প্রতি তোষণ নীতি গ্রহণ করে। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের তৎকালীন সেক্রেটারি অফ স্টেট জর্জ ফ্রাঙ্কিস হ্যামিলটন বড়োলাট লর্ড কার্জনকে লেখেন যে, “আমরা যদি হিন্দুদের দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত করতে পারি তবে আমাদের শক্তি আরও সুদৃঢ় হবে।”
- (২) এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সরকার হিন্দু সম্প্রদায়কে উচ্চবর্ণ ও অনগ্রসর – এই দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করে। উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে দাবিদাওয়া আদায়ের বিষয়ে সরকার অনগ্রসর শ্রেণির নেতাদের উৎসাহিত করতে থাকে।
- (৩) আজমগড়ের ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ইউটিস জে. কিট্স্ ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে আদমশুমারির ভিত্তিতে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে অনগ্রসর শ্রেণির একটি তালিকা তৈরি করেন এবং শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে তাদের জন্য সংরক্ষণ ও বাড়তি সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
- (৪) মিলার কমিটির সুপারিশ অনুসারে মহীশূরের প্রাদেশিক সরকার ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে চাকরি ক্ষেত্রে অনগ্রসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজ এবং ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাই প্রদেশেও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষণ চালু হয়।
- (৫) যুক্তপ্রদেশে প্রতি চারটি আসনের মধ্যে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, মুসলিম ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের জন্য ১টি করে আসন সংরক্ষিত হয়। আদমশুমারিতেও হিন্দুদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত করা হয়। এভাবে সরকার অনগ্রসর সম্প্রদায়কে তাদের অনুগত শ্রেণিতে পরিণত করে জাতীয় আন্দোলন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা চালায়।
- (৬) ব্রিটিশ সরকারের বিভেদ নীতির ফলে অনগ্রসর শ্রেণির জন্য পৃথক নির্বাচন, আইনসভা ও চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ প্রভৃতির দাবিতে ১৯২০-র দশকে ড. আম্বেদকর-এর নেতৃত্বে অনগ্রসর শ্রেণির আন্দোলন গড়ে ওঠে। এভাবে ব্রিটিশ-ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িক বিভেদ চূড়ান্ত সমস্যার সৃষ্টি করে।
বিভাজন ও শাসন নীতি সম্পর্কে রাজেন্দ্র প্রসাদের মন্তব্য
ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ-এর মতে, “জনগণকে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীতে বিভক্ত করার যে নীতি মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন দ্বারা গ্রহণ করা হয়েছিল, তা মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইন-এ আরও প্রসারিত হয়েছিল।”
বিভাজন ও শাসন নীতি সম্পর্কে পৃথক নির্বাচন
মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কারে নির্বাচক মণ্ডলীকে অন্তত দশটি অংশে বিভক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে তা দশ থেকে বেড়ে সতেরো হয়েছিল এবং হিন্দু সম্প্রদায়কে আরও দুর্বল করার উদ্দেশ্যে তপশিলি জাতিকেও পৃথক নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়েছিল।
বিভাজন ও শাসন নীতি সম্পর্কে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মন্তব্য
পণ্ডিত লালবাহাদুর শাস্ত্রী সরকারের এই বিভেদনীতিকে ‘ভারতের জাতীয় ইতিহাসের ক্ষেত্রে একটি নির্লজ্জ ঘটনা’ বলে অভিহিত করেছেন।
উপসংহার :- ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে মি. ডি. এন. নারায়ণ এই বিভেদ নীতিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মন্তব্য করেন, “তখন বৈচিত্র্য, দ্বন্দ্ব ও সমস্যায় জর্জরিত ভারতবর্ষ ছিল শাসনের অযোগ্য।” দুর্ভাগ্যের বিষয় স্বাধীনতার পরও এই বিভেদনীতির চিত্র একটুকুও বদলায় নি।
(FAQ) ব্রিটিশ সরকারের বিভাজন ও শাসন নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
জন লরেন্স।
পাঞ্জাবের সেনাবাহিনীতে।
১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে।
স্যার সৈয়দ আহমেদ খান ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে।
বাবাসাহেব আম্বেদকর।