খলজি ব্যবস্থার দুর্বলতা

খলজি ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রসঙ্গে দুর্বল ও অস্থায়ী উপাদান, ব্যক্তিগত সামরিক প্রতিভা, সামরিক শক্তির উপর নির্ভরশীল, অভিজাতদের ক্ষোভ, হিন্দু রাজা ও ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ, নব মুসলমানদের ক্ষোভ, উলেমাদের অশ্রদ্ধা, মালিক কাফুরের প্রতি আসক্তি, ব্যক্তি কেন্দ্রিক ও স্বেচ্ছাচারিতার চরম ব্যবস্থা সম্পর্কে জানবো।

খলজি ব্যবস্থার দুর্বলতা

বিষয়খলজি ব্যবস্থার দুর্বলতা
বংশখলজি বংশ
সময়কাল১২৯০-১৩২০ খ্রি:
প্রতিষ্ঠাতাজালালউদ্দিন খলজি
শ্রেষ্ঠ সুলতানআলাউদ্দিন খলজি
শেষ সুলতানকুতুবউদ্দিন মোবারক খলজি
খলজি ব্যবস্থার দুর্বলতা

ভূমিকা :- আলাউদ্দিন যে খলজি সাম্রাজ্যের ভিত্তিস্থাপন করেছিলেন তার ভিত্তি ছিল খুবই দুর্বল। এই দুর্বল ভিত্তি কখনও একটা সাম্রাজ্যকে বেশিদিন স্থায়িত্ব দান করতে পারে না।

দুর্বল ও অস্থায়ী উপাদান

খলজি ব্যবস্থার ব্যর্থতার কারণ নিরূপণ করা খুব দুঃসাধ্য নয়। খলজি সাম্রাজ্য এমন কতকগুলি উপাদানের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই দুর্বল ও অস্থায়ী উপাদানগুলিই পরবর্তীকালে খলজি ব্যবস্থার পতনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে বিবেচিত হয়।

ব্যক্তিগত সামরিক প্রতিভা

  • (১) এই ব্যবস্থা আলাউদ্দিনের ব্যক্তিগত সামরিক প্রতিভার ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত প্রতিভার একটা সীমা থাকে। আলাউদ্দিন নিঃসন্দেহে সমকালীন শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি।
  • (২) কিন্তু তিনিও একজন রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ ছিলেন। যত তাঁর বয়স বাড়তে লাগল, ততই তিনি ক্লান্ত ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ক্রমেই তিনি সব বিভাগের কাজকর্ম পরিদর্শনের ক্ষমতা হারান। তাঁর মৃত্যুর পূর্বেই বহু ষড়যন্ত্র ও গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

সামরিক শক্তির উপর নির্ভরশীল

খলজি সাম্রাজ্যবাদ সম্পূর্ণভাবে সামরিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল ছিল। সেখানে জনসাধারণের মতামতের কোনো স্থান ছিল না। সামরিক শক্তির প্রকৃতিই হল অত্যাচারী হয়ে ওঠা এবং জনসাধারণের কল্যাণের চেয়ে সামরিক গৌরব বৃদ্ধির দিকেই ঝোঁক বাড়ে।

অভিজাতদের ক্ষোভ

স্বভাবতই যতদিন যেতে থাকে ততই আলাউদ্দিনের শাসন-ব্যবস্থা জনপ্রিয়তা হারায়। তুর্কি অভিজাত, যাঁরা ক্ষমতা ও মর্যাদা হারিয়েছিলেন তাঁরা বিক্ষুব্ধ হন।

হিন্দু রাজা ও ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ

হিন্দু রাজারা আলাউদ্দিনের কঠোরতায় শুধুমাত্র তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করার পক্ষপাতী ছিলেন। ব্যবসায়ীরা নানারকম বিধি-নিষেধের জন্য অত্যন্ত বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন।

নব মুসলমানদের ক্ষোভ

নব মুসলমানদের প্রতি আলাউদ্দিনের ব্যবহার জার্মানিতে হিটলারের ইহুদিদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাঁরাও আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং হত্যার জন্য সব সময় সচেষ্ট ছিলেন।

উলেমাদের অশ্রদ্ধা

উলেমাদের প্রতি তাঁর অশ্রদ্ধা নিজধর্মাবলম্বীদের কাছেও অপ্রিয় করে তুলেছিল। কঠোর গুপ্তচর ব্যবস্থা, মধ্যবিত্তশ্রেণী ও অভিজাতশ্রেণী সকলকেই বিদ্বিষ্ট করেছিল। তিনি প্রায় সকল শ্রেণীর মানুষকেই চটিয়েছিলেন। সকলেই তাঁর শাসনব্যবস্থার উচ্ছেদের সুযোগ খুঁজছিলেন।

দুর্বল উত্তরাধিকারী

আলাউদ্দিন তাঁর উত্তরাধিকারী তথা পুত্রদের সুযোগ্য করে গড়ে তোলার শিক্ষা দিতে পারেন নি। খিজির খান এবং তাঁর অন্যান্য ভাইরা ভীষণ দুর্বল চরিত্রের ও ব্যক্তিগত নৈতিক কলুষতায় মগ্ন থাকায় শাসনব্যবস্থার প্রতি মনোযোগ দেওয়ার অবসর ছিল না।

মালিক কাফুরের প্রতি আসক্তি

শেষজীবনে মালিক কাফুরের প্রতি তাঁর আসক্তি শুধু তাঁর মৃত্যুকেই ডেকে আনে নি, তাঁর সাম্রাজ্যেরও সর্বনাশ ডেকে এনেছিল।

ব্যক্তিগত জীবনে অসুখী

ব্যক্তিগত জীবনে আলাউদ্দিন প্রথম থেকেই অসুখী ছিলেন এই কারণে তাঁর শাসনব্যবস্থা এক নির্মম ও হৃদয়হীন যন্ত্রে পরিণত হয়েছিল।

বিভীষিকাময় ব্যবস্থা

আলাউদ্দিনের জীবনের শেষ তিন বছর বলতে গেলে এক বিভীষিকাময় ব্যবস্থা চলছিল। তাঁর আকাশছোঁয়া উচ্চাশা এবং তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য যে পরিশ্রম করতে হয়েছিল তার প্রতিফল অতি দ্রুত শুরু হয়।

উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রা

আলাউদ্দিন খলজির উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রা তাঁর স্বাস্থ্যের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে। ফলে নিজের দেহ ও সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থার ওপর তাঁর কর্তৃত্ব বিনষ্ট হয়।

গৃহযুদ্ধ

এই সময় তাঁর দুই বিশ্বস্ত কর্মচারী মালিক কাফুর ও আলপ খান পরস্পর শত্রুতে পরিণত হয়েছিলেন এবং সুলতানের মৃত্যুর পর এক ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হন।

মালিক কাফুরের ক্ষমতা দখল

এই গৃহযুদ্ধে মালিক কাফুর জয়লাভ করে মাত্র পঁয়ত্রিশ দিনের জন্য ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

জনসাধারণকে স্বস্তি দানের চেষ্টা

এরপর আলাউদ্দিনের শেষ রাজকীয় উত্তরাধিকারী মুবারক শাহ ক্ষমতা দখল করেছিলেন। তিনি তাঁর পিতার আমলের কঠোর আইনগুলি ও বহু কর প্রত্যাহার করে জনসাধারণকে স্বস্তি দিতে চেয়েছিলেন।

খলজি শাসনের অবসান

মোবারক খলজির অপরিণামদর্শী কার্যকলাপ ও ব্যক্তিগত চারিত্রিক কলুষতা খলজি রাজতন্ত্রের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করে এবং তাঁর প্রিয়পাত্র খুসরভের হাতে প্রাণ দেন। মুবারকের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে খলজি শাসনব্যবস্থা ধ্বংস হয়।

ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও স্বেচ্ছাচারিতার চরম ব্যবস্থা

এই সমস্ত দিক বিবেচনা করে অধ্যাপক শরণ, অধ্যাপক লাল প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ আলাউদ্দিনের ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও স্বেচ্ছাচারিতার চরম ব্যবস্থা বলে অভিহিত করেছেন।

উপসংহার :- ড. কে. কে. দত্ত যথার্থই বলেছেন, “The foundation of the military monarchy that Alauddin tried to build up was laid upon sand.” অর্থাৎ বালির ওপর আলাউদ্দিন সামরিক রাজতন্ত্রের ভিত্তি নির্মাণ করার চেষ্টা করেছিলেন।

(FAQ) খলজি ব্যবস্থার দুর্বলতা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. খলজি ব্যবস্থা কিসের উপর নির্ভরশীল ছিল?

আলাউদ্দিন খলজির ব্যক্তিগত সামরিক প্রতিভা।

২. শেষ জীবনে আলাউদ্দিন খলজি কার প্রতি আসক্তি দেখান?

মালিক কাফুর।

৩. খলজি বংশের শেষ সুলতান কে ছিলেন?

কুতুবউদ্দিন মোবারক খলজি।

৪. খলজি বংশের সময়কাল কত ছিল?

১২৯০-১৩২০ খ্রিস্টাব্দ।

Leave a Comment