তৈমুর লঙের ভারত আক্রমণের ফলাফল

তৈমুর লঙের ভারত আক্রমণের ফলাফল প্রসঙ্গে ধনরত্ন লুণ্ঠন, দিল্লিতে দুর্ভিক্ষ, উত্তর ভারতে চরম নৈরাজ্য, যোগ্য শাসকের অভাব, সুলতানি সাম্রাজ্য প্রায় নিশ্চিহ্ন, স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব, মহাশ্মশান দিল্লি, অর্থনৈতিক দুর্দশা, অরক্ষিত উত্তর পশ্চিম সীমান্ত, রাজনৈতিক অস্তিত্বের মূলোৎপাটন ও রাজনীতি অখণ্ডতার বিনাশ সম্পর্কে জানবো।

তৈমুর লঙের ভারত আক্রমণের ফলাফল

বিষয়তৈমুর লঙের ভারত আক্রমণের ফলাফল
সময়কাল১৩৯৮ খ্রি:
আক্রমণকারীতৈমুর লঙ
দিল্লির সুলতাননাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ
তৈমুরের প্রতিনিধিখিজির খান
তৈমুর লঙের ভারত আক্রমণের ফলাফল

ভূমিকা :- ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ডিসেম্বর তৈমুর লঙ দিল্লি দখল করেন এবং অবাধ লুণ্ঠনকার্য চালান। বহু মানুষ প্রাণ দেন। প্রায় পনেরো দিন ধরে তাণ্ডব চলে। লুণ্ঠন ও হত্যার ফলে দিল্লি শ্মশানে পরিণত হয়। সমসাময়িক একজন ঐতিহাসিক বলেছেন, দিল্লিতে দু’মাস কোনো পাখি উড়তে দেখা যায় নি।

ধনরত্ন লুন্ঠন

১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি তিনি দিল্লির সমস্ত সম্পদ লুণ্ঠনের নির্দেশ দেন। যুগ যুগ ধরে দিল্লির সঞ্চিত ধনরত্ন তৈমুর হস্তগত করেন। এমনকি যাঁরা পালিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁরাও রেহাই পান নি। তাঁর আদেশে বিজয়ী সৈন্যবাহিনী নিষ্ঠুরভাবে অনুসরণ করে। এরপর তিনি পশ্চিমে অভিযান চালান এবং নগরকোট ও জম্মু লুণ্ঠন করেন।

দিল্লিতে দুর্ভিক্ষ

১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ মার্চ একটা বিশেষ দরবারে তিনি খিজির খানকে মুলতান, লাহোর ও দীপালপুরের শাসক নিযুক্ত করেন এবং ১৯ মার্চ অসংখ্য বন্দি ও লুণ্ঠিত ধনরত্নসহ সিন্ধুনদ অতিক্রম করে স্বদেশে ফিরে যান। তাঁর প্রস্থানের পর দিল্লিতে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।

বিয়োগান্ত ঘটনা

তৈমুরের ভারত আক্রমণ শুধুমাত্র ভারতবর্ষের ইতিহাসে নয়, সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসেই সম্ভবত সবচেয়ে বিয়োগান্ত ঘটনা।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিকের মন্তব্য

একজন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ঠিকই বলেছেন, “Timur had inflicted on India more misery than had ever before been inflicted by any conqueror in a single invasion.”

উত্তর ভারতে চরম নৈরাজ্য

আক্রমণের ফলে শুধু দিল্লির ধনসম্পদ বিনষ্ট হয় নি, সমগ্র উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিপন্ন হয়ে পড়ে। সমগ্র উত্তর ভারতে চরম নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। দিল্লি জনশূন্য হয়ে পড়ে।

সার্বভৌম শাসকের অভাব

দিল্লির সুলতান নিজেই ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর আক্রমণের ফলে দিল্লিতে প্রকৃতপক্ষে কোনো সার্বভৌম শাসক ছিলেন না।

সুলতানি সাম্রাজ্য প্রায় নিশ্চিহ্ন

সুলতানদের গৃহযুদ্ধের ফলে ইতিপূর্বেই তুঘলক সাম্রাজ্যের ভিত্তি শিথিল হয়ে গিয়েছিল। আর তৈমুরের আঘাতে সুলতানি সাম্রাজ্য প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। চারিদিকে বিদ্রোহ দেখা দেয়।

স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব

  • (১) বঙ্গদেশ, দাক্ষিণাত্য এবং বিজয়নগর তৈমুরের আক্রমণের পূর্বেই স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল। খাজা জাহান কনৌজ, অযোধ্যা, বিহার, জৌনপুর, কারা প্রভৃতি নিয়ে গঠিত এক বিস্তীর্ণ ভূভাগে রাজত্ব করতে শুরু করেন।
  • (২) লাহোর, দীপালপুর, মুলতান এবং সিন্ধুর কিছু অঞ্চলের ওপর তৈমুরের প্রতিনিধি হিসাবে খিজির খান শাসন করতে থাকেন। তাছাড়া সামানা, বিয়ানা, কাল্পী এবং মাহবা প্রভৃতি স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। সাম্রাজ্যের অধিকাংশ অঞ্চল দিল্লির হস্তচ্যুত হয়ে যায়।

মহাশ্মশান দিল্লি

তৈমুরের আক্রমণ কেবলমাত্র তুঘলক বংশের ওপর মারাত্মক আঘাত হানে নি, এই আক্রমণ দিল্লির সমগ্র সুলতানি শাসনের অবসানের পথ সুগম করে। দিল্লির রাজশক্তি একেবারে ভেঙে পড়ে। দিল্লির সিংহাসন তিন মাস শূন্য হয়ে পড়ে থাকে। এই মহাশ্মশানে মামুদ ফিরতে চান নি। এক কথায় দিল্লি মহাশ্মশানে পরিণত হয়েছিল।

অর্থনৈতিক দুর্দশা

  • (১) তৈমুরের আক্রমণের ফলে অর্থনৈতিক দিক থেকেও দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্য চরম দুর্দশায় উপনীত হয়। মাঠের শস্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তৈমুরের সেনাবাহিনী যে অঞ্চল দিয়ে গেছে, সেই অঞ্চল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। চরম দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
  • (২) খাদ্যসংকট তীব্র আকার ধারণ করে। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে এই আক্রমণে ভারতবর্ষ নিঃস্ব হয়ে যায়। স্বর্ণ, রৌপ্য, মণি-মুক্তা প্রভৃতি প্রচুর ধনসম্পদ ভারত থেকে চলে যায়। ফলে ভারতের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডও ভেঙে যায়।

অরক্ষিত উত্তর পশ্চিম সীমান্ত

তৈমুরের আক্রমণের ফলে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অরক্ষিত থেকে যায়। দুর্বল শাসকরা এই সীমান্ত রক্ষার সুব্যবস্থা না করায় পরবর্তীকালে মুঘল আক্রমণের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা অবলম্বন করা সম্ভব হয় নি। তৈমুরের আক্রমণে মনোবল ও ধর্মবলে ভারত নিঃস্ব হয়ে যায়।

তৈমুরের ঘোষণা

তৈমুর ভারত আক্রমণের সময় ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি ভারতকে হিন্দুশূন্য করবেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁর লড়াই হয়েছিল ভারতীয় মুসলমানদের সঙ্গেই, কিন্তু সর্বনাশ হয়েছিল উভয় সম্প্রদায়ের।

মাহমুদ শাহের পলায়ন

তৈমুরের আক্রমণের সময় তুঘলক বংশের সুলতান মাহমুদ শাহ গুজরাটে পলায়ন করেছিলেন। সেখান থেকে পরিশেষে তিনি মালবে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

মাহমুদের দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন

  • (১) তৈমুরের প্রস্থানের পর সুলতান মাহমুদ ১৪০১ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করেন। ফিরিস্তা ও ইয়াহিয়া-বিন-সিরহিন্দের মতে, ১৪১২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুকাল পর্যন্ত শাসন করেন।
  • (২) তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে প্রায় আঠারো বছরের অগৌরবময় শাসনের পর তুঘলক বংশের যেমন অবসান হয়, তেমনি ভারতে দিল্লি সুলতানি যুগের প্রায় দু’শতাব্দী কালের এক গৌরবময় শাসনকালের অবসান ঘটে।

দৌলত খান লোদীর শাসন

মাহমুদ শাহের মৃত্যুর পর ১৪১৩ খ্রিস্টাব্দে দৌলত খান লোদিকে দিল্লির অভিজাতগণ খুবই কম সময়ের জন্য দিল্লির শাসনভার অর্পণ করেন। কিন্তু দৌলত খান লোদি কখনও রাজকীয় উপাধি গ্রহণ করেন নি।

নতুন রাজবংশের শাসন

১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে তৈমুর কর্তৃক নিযুক্ত মুলতানের শাসক খিজির খান দৌলত খান-কে পরাস্ত করে দিল্লি দখল করেন ও নিজেকে দিল্লির সুলতান বলে ঘোষণা করেন। খিজির খান-ই সৈয়দ বংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং এক নতুন রাজবংশের শাসন শুরু হয়।

ইয়াহিয়া- বিন-সিরহিন্দের বর্ণনা

তারিখ-ই-মুবারকশাহীর লেখক ইয়াহিয়া- বিন-সিরহিন্দ লিখেছেন, রাষ্ট্রের সমস্ত কাজকর্ম চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে পতিত হয়। সুলতান তাঁর কর্তব্যে অবহেলা করেন এবং সিংহাসনের স্থায়িত্বের প্রতি অমনোযোগী হন। তিনি তাঁর সমস্ত সময় লাম্পট্য ও স্ফুর্তিতে অতিবাহিত করেন। সুলতান মাহমুদের সময় দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যের আয়তন সংক্ষিপ্ত হতে হতে পালামে এসে ঠেকেছিল।

নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা

তৈমুরের প্রতিনিধি খিজির খান তুঘলক বংশের অবসান ঘটিয়ে নতুন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করে দিল্লিকে কেন্দ্র করে এক নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা করেন।

রাজনৈতিক অস্তিত্বের মূলোৎপাটন

তৈমুরের ভারত আক্রমণ শুধুমাত্র দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদাই বিনষ্ট করে নি, তার দুশো বছরের রাজনৈতিক অস্তিত্বের মূলোৎপাটন করেছিল।

রাজনৈতিক অখণ্ডতা বিনাশ

তৈমুরের আক্রমণের ফলে ভারতে যে রাজনৈতিক অখণ্ডতা বিনাশপ্রাপ্ত হয়, তা মুঘলদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত আর ফিরে আসে নি।

উপসংহার :- তাই আমীর খসরু তার The Delhi Sultanate গ্রন্থে তৈমুরের ভারত আক্রমণকে “A grim tragedy, perhaps unparalleled in history of the world” বা সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে অতুলনীয় এক করুণ বিয়োগান্ত পরিণতি বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

(FAQ) তৈমুর লঙের ভারত আক্রমণের ফলাফল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. তৈমুর লঙ কখন ভারত আক্রমণ করেন?

১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে।

২. তৈমুর লঙের ভারত আক্রমণের সময় কোন বংশ দিল্লী শাসন করত?

তুঘলক বংশ।

৩. তৈমুর লঙের ভারত আক্রমণের সময় দিল্লির সুলতান কে ছিলেন?

নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ।

৪. তৈমুর লঙ কাকে তার প্রতিনিধি হিসেবে স্থাপন করেন?

খিজির খান।

Leave a Comment