বৈষ্ণব সম্প্রদায়

বৈষ্ণব সম্প্রদায় প্রসঙ্গে বৈষ্ণব দর্শন, নির্গুন হওয়ার উপদেশ, গুপ্তযুগে বৈষ্ণব দর্শন, বৈষ্ণব দর্শন চর্চার স্থান, বৈষ্ণবদের বসবাস, গৌড়ীয় বৈষ্ণব শাখা, বৈষ্ণবদের জীবনের উদ্দেশ্য, পূজা, শাস্ত্র অনুসরণ, দীক্ষা, প্রধান তীর্থস্থান, দুটি মহাকাব্য ও পত্রিকা প্রকাশ সম্পর্কে জানবো।

বৈষ্ণব সম্প্রদায়

বিষয়বৈষ্ণব সম্প্রদায়
উপাস্য দেবতাবিষ্ণু বা তার অবতার
অন্তর্ভুক্তিহিন্দু ধর্ম
ভোজননিরামিষ
গৌড়ীয় বৈষ্ণবশ্রীচৈতন্য
বৈষ্ণব সম্প্রদায়

ভূমিকা :- হিন্দুধর্মের শাখা সম্প্রদায় হল বৈষ্ণব সম্প্রদায় বা বৈষ্ণববাদ। এই সম্প্রদায় বিষ্ণু বা তার অবতারগণকে (মুখ্যত রাম ও কৃষ্ণ) আদি তথা সর্বোচ্চ ঈশ্বর রূপে পূজা করে থাকে।

বৈষ্ণব দর্শন

দর্শনে সমগ্র জগতের পালনকর্তা রূপে বিষ্ণুকে গণ্য করা হয়। বিশ্বাস ও ধর্মানুশীলনের ক্ষেত্রে, বিশেষত ভক্তি ও ভক্তিযোগ প্রসঙ্গে, বৈষ্ণব দর্শনের প্রধান তাত্ত্বিক ভিত্তি উপনিষদ, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ভাগবত পুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, গরুড় পুরাণ ও পদ্মপুরাণ।

বৈষ্ণব

ভাগবত ধর্মে বৈষ্ণব সম্প্রদায় অনুগামীদের বৈষ্ণব নামে অভিহিত করা হয়। বৈষ্ণব দর্শনের মূল কথা হল আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন। এই একাত্মতার জন্য যে পথ অবলম্বন করা হয় তা হল প্রেম ও ভক্তি এবং সম্পূর্ণরূপে অহিংসা।

বৈষ্ণব দর্শনে নির্গুণ হওয়ার উপদেশ

পরমাত্মার উপাসনার জন্য বৈষ্ণব দর্শনে সকল প্রকার জাগতিক গুণ বর্জন করে নির্গুণ হয়ে পরমাত্মার সাথে একাত্ম হওয়ার উপদেশ দেওয়া হয়েছে।

গুপ্ত যুগে বৈষ্ণব দর্শন

প্রাচীন ভারত-এ গুপ্তযুগে এই বৈষ্ণব দর্শনের প্রচলন ছিল। এই গুপ্তযুগেই বিখ্যাত বৈষ্ণব ধর্মগ্রন্থ ‘বিষ্ণুস্মৃতি’ রচিত হয়।

বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ভোজন

এই বৈষ্ণবরা মূলত নিরামিষ ভোজী। তবে ভারতবর্ষের উড়িষ্যার জগন্নাথ মন্দিরে বিশেষ পূজায় মাছ বলি দেওয়ার প্রচলন আছে।

বৈষ্ণদের বসবাস

বৈষ্ণবরা হিন্দু সমাজের অন্যতম বৃহৎ অংশ। এঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠের বাস ভারতে। তবে ভারতের বাইরে ইন্দোনেশিয়াতেও বিষ্ণু পূজার নিদর্শন রয়েছে। বর্তমান কালে ধর্মসচেতনতা, স্বীকৃতি ও ধর্মপ্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের বাইরে বৈষ্ণবদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

বৈষ্ণব দর্শন চর্চার স্থান

দক্ষিণ ভারতে অঙ্করভাট মন্দির, তিরুপতি বালাজির মন্দির ও পদ্মনাভস্বামী মন্দির বৈষ্ণব দর্শনের চর্চার জন্য বিখ্যাত।

গৌড়ীয় বৈষ্ণব শাখা

  • (১) ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে গৌড়ীয় বৈষ্ণব শাখাটি আন্তর্জাতিক স্তরে বৈষ্ণব দর্শনের প্রসারে বিশেষ ভূমিকা নিয়ে আসছে। ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদীয়া জেলার অন্তর্গত নবদ্বীপ গ্রামে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর হাত ধরেই এই গৌড়ীয় বৈষ্ণব শাখাটির প্রচলন।
  • (২) চৈতন্য মহাপ্রভুর ভাবধারাকে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ ইসকন ‘হরে কৃষ্ণ’ আন্দোলন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভৌগোলিক প্রসার ঘটিয়ে সম্পাদন করছে। অনেক বিদেশিও এই নবদ্বীপে এসে সমগ্র বিশ্বে বৈষ্ণব দর্শনের প্রচারের জন্য অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে চলেছেন।

ঐতিহাসিক বিষ্ণুধর্ম

  • (১) ভাগবতধর্ম, আদি রামধর্ম ও কৃষ্ণধর্মের মিলন ঘটেছে ঐতিহাসিক বিষ্ণুধর্মে। আবার ঐতিহাসিক বৈদিকধর্মের একটি অঙ্গ হল ঐতিহাসিক বিষ্ণুধর্ম। আসলে বিষ্ণু পূজার প্রাধান্য অন্যান্য ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলি থেকে পৃথক করেছিল ঐতিহাসিক বিষ্ণুধর্মকে।
  • (২) ভারতে সর্বপ্রথম বৈষ্ণব ধর্মমতের চর্চা শুরু হয় বিষ্ণুধর্মের আকারেই। এককথায় এই বিষ্ণুধর্ম ছিল ভারতের প্রথম দেশজ সম্প্রদায়গত ধর্মমত। এই ধর্মমতে বিষ্ণুকে সকল অবতারের উৎসস্বরূপ বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়।

বিষ্ণুর নাম ও বৈশিষ্ট্য

বিষ্ণু নামটি শুধুমাত্র সর্বোচ্চ দেবতা অনেকগুলি নামের মধ্যে অন্যতম বলে পরিগণিত হয়। বিষ্ণুর অন্যান্য নামগুলি হল নারায়ণ, বাসুদেব ও কৃষ্ণ। প্রত্যেকটি নামের সঙ্গে স্বকীয় দিব্য বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব আরোপিত হয়।

কৃষ্ণধর্ম

বৈষ্ণবধর্মেরই একটি শাখা কৃষ্ণধর্ম। গৌড়ীয় বৈষ্ণব, নিম্বার্ক ও বল্লভাচার্য সম্প্রদায় কৃষ্ণকে সর্বোচ্চ ঈশ্বর বা স্বয়ং ভগবান মনে করে। অন্যদিকে বিষ্ণু মতের অনুগামীরা তা স্বীকার করেন না।

বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ দেবতা

  • (১) এই বৈষ্ণব ধর্মের বিষ্ণুকেন্দ্রিক সম্প্রদায়গুলি বিষ্ণু বা নারায়ণকে সর্বোচ্চ দেবতা মনে করে। বল্লভ সম্প্রদায় বা গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মতো কৃষ্ণকেন্দ্রিক সম্প্রদায়গুলি কৃষ্ণকেই সর্বোচ্চ দেবতা তথা সকল অবতারের উৎস বলে মনে করে থাকে।
  • (২) দেবতা বিষ্ণুর শ্রেষ্ঠত্বের বিশ্বাসের মূল ভিত্তি পুরাণে বর্ণিত বিষ্ণুর নানা অবতারের উপাখ্যান। এই সব উপাখ্যানে তার সঙ্গে গণেশ, সূর্য, দুর্গা প্রমুখ দেবতার পার্থক্য প্রতিপাদন করে তাদের উপদেবতার পর্যায়ে পর্যবসিত করা হয়েছে।
  • (৩) বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী হিন্দু ত্রিমূর্তির অন্যতম দেবতা শিব হলেন বিষ্ণুর অনুগত ভক্ত ও স্বয়ং এক বৈষ্ণব। হিন্দুধর্মের প্রতিষ্ঠাতা স্বামীনারায়ণ এই মতের বিরোধী। তার কথায় শিব ও বিষ্ণু একই ঈশ্বরের দুই পৃথক সত্ত্বা।
  • (৪) হিন্দুধর্মের বহুদেববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিষ্ণুকে দেখা হয়। এখানে সকল সত্ত্বাই ঈশ্বরে সমাহিত এবং ঈশ্বর সকল সত্ত্বার মধ্যেই অস্তিত্বমান। বৈষ্ণব ধর্মমতে একটি বিশিষ্ট বক্তব্য হল ঈশ্বর (বিষ্ণু অথবা কৃষ্ণ) সত্য ব্যক্তিত্ব এবং তার বহুবর্ণময় সৃষ্টিও সত্য।

বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের পূজা

  • (১) বৈষ্ণব দর্শনের মূলভিত্তি হিন্দুধর্মের কয়েকটি কেন্দ্রীয় ধর্মমত – বহুদেববাদ, পুনর্জন্ম, সংসার, কর্ম এবং বিভিন্ন যোগশাস্ত্র। তবে ভক্তি যোগের পথে বিষ্ণুর প্রতি ভক্তিই এই ধর্মে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আর এই ভক্তির অঙ্গ হল বিষ্ণুর নামগান (ভজন ও কীর্তন), তার রূপচিন্তন এবং দেবপূজা।
  • (২) পঞ্চরাত্র ও বিভিন্ন সংহিতায় দেবপূজার তত্ত্ব ও পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। বৈষ্ণবগণ পূজার মাধ্যমে বিষ্ণুকে তাদের অন্তরে অধিষ্ঠিতরূপে কল্পনা করেন। তারা এই রূপে তাদের সত্ত্বার উৎস ঈশ্বরকে অন্তর্যামী নামে অভিহিত করেন। এই নাম নারায়ণ নামের সংজ্ঞার একটি অংশ।

বৈষ্ণবদের জীবনের উদ্দেশ্য

হিন্দুধর্মের অন্যান্য শাখাসম্প্রদায়ের জীবনের উদ্দেশ্য যেখানে মোক্ষ লাভ বা পরমব্রহ্মের সঙ্গে মিলন, সেখানে বৈষ্ণবদের জীবনের উদ্দেশ্য বিষ্ণু বা তার কোনো অবতারের সেবায় মায়াময় জগতের বাইরে ‘বৈকুণ্ঠধামে’ অনন্ত আনন্দময় এক জীবনযাপন।

বৈষ্ণবদের তিন বৈশিষ্ট্য

ভাগবত পুরাণ অনুযায়ী বৈষ্ণবদের সর্বোচ্চ সত্ত্বার তিন বৈশিষ্ট্য – ব্রহ্মণ, পরমাত্মা ও ভগবান। অর্থাৎ, বিশ্বময় বিষ্ণু, হৃদয়যামী বিষ্ণু ও ব্যক্তিরূপী বিষ্ণু।

বৈষ্ণবদের দীক্ষা

বৈষ্ণব সম্প্রদায় সাধারণত দীক্ষা অনুষ্ঠান প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করেন। গুরুর দ্বারা দীক্ষিত হয়ে তারা গুরুর অধীনেই বৈষ্ণব ধর্মানুষ্ঠান শিক্ষা করেন। দীক্ষার সময় শিষ্যকে নির্দিষ্ট মন্ত্র দান করা হয়। পূজার অঙ্গ রূপে এই মন্ত্রটিকে সোচ্চারে বা অনুচ্চারে বারংবার আবৃত্তি করতে হয়। বারংবার মন্ত্র আবৃত্তিকে জপ বলা হয়।

বৈষ্ণব বলে পরিগণিত

গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ধর্মশাস্ত্রগুলিতে বলা হয়েছে যে, যিনি বিষ্ণু বা কৃষ্ণের নামজপ মাত্র পূজা করেন তিনিই ধর্মানুশীলনের প্রশ্নে বৈষ্ণব বলে পরিগণিত হন।

বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের শাস্ত্র অনুসরণ

নিজস্ব ঐতিহ্য অনুসারে বৈষ্ণব সম্প্রদায়গুলি তাদের পূর্বতন আচার্যদের রচনাকেই প্রামাণ্য শাস্ত্র রূপে গ্রহণ করেন। স্মার্তবাদ ও অদ্বৈতবাদী দর্শনে কথিত মুখ্যবৃত্তির আক্ষরিক অর্থ এই ধর্মে প্রধান আলোচ্য।

বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের উপশাখা

  • (১) বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীরা চারটি প্রধান উপশাখায় বিভক্ত। এই উপশাখাগুলিকে বলা হয় সম্প্রদায়। এগুলি হল লক্ষ্মী-সম্প্রদায়, ব্রহ্মা সম্প্রদায়, রুদ্র সম্প্রদায়, নিম্বার্ক সম্প্রদায়
  • (২) প্রত্যেক সম্প্রদায়ের আদর্শ কোনো নির্দিষ্ট বৈদিক চরিত্র। জীবাত্মা ও পরমাত্মা (বিষ্ণু বা কৃষ্ণ) সম্পর্কে এই চার সম্প্রদায়ের মতের সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। যদিও অধিকাংশ বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মূল মতবাদ একই প্রকারের।

বৈষ্ণবদের তিলক

  • (১) বৈষ্ণবদের মধ্যে কপালে তিলক অঙ্কণ করার রীতি আছে। অনেকে দৈনিক উপাসনার অঙ্গ হিসেবে তিলক আঁকেন। আবার কেউ কেউ তিলক কাটেন বিশেষ অনুষ্ঠান বা উৎসব উপলক্ষে। বিভিন্ন বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের নিজস্ব তিলক অঙ্কণশৈলী রয়েছে। এগুলি সেই নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্তের প্রতীক।
  • (২) সাধারণত তিলকের আকার ইংরেজি Y অক্ষরের মতো। দুই বা ততোধিক লম্বরেখা ও নাকের উপর অপর একটি রেখা বিশিষ্ট এই তিলক বিষ্ণুর পদ ও পদ্মের প্রতীক।

বৈষ্ণব ধর্মের ঐতিহাসিক দিক

  • (১) ভারতে মহাকাব্য বা ঐতিহাসিক যুগ থেকেই বিষ্ণুর পূজা প্রচলিত। হপকিনসের মতে, “বিষ্ণুধর্ম ছিল ভারতে প্রচলিত একমাত্র স্থানীয় ধর্মসম্প্রদায়।” মহাভারতের একটি অংশ ভগবদ্গীতায় বৈষ্ণবধর্মের ধারণাটি পাওয়া যায়।
  • (২) ভগবদ্গীতার অংশটি কৃষ্ণ ও অর্জুনের মধ্যে কথোপকথনের আকারে বিবৃত রয়েছে। এখানে কৃষ্ণ বিষ্ণু অন্যতম অবতার এবং অর্জুনের রথের সারথি। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ও তার পরবর্তী বহু রাজাই পরমভাগবত বা ভাগবত বৈষ্ণব নামে পরিচিত ছিলেন।
  • (৩) শৈবধর্ম প্রভাবিত দক্ষিণ ভারতে খ্রিষ্টীয় সপ্তম থেকে দশম শতকের মধ্যবর্তী সময়ে বৈষ্ণবধর্মের প্রসার ঘটে। আজও এই অঞ্চলে বৈষ্ণবধর্ম প্রচলিত। তামিলনাড়ুতে বারোজন আলভার সন্ত ভক্তিমূলক স্তোত্ররচনার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে বৈষ্ণবধর্মকে ছড়িয়ে দেন।
  • (৪) আলভারেরা যে সব মন্দিরে গমন করেছিলেন বা যে মন্দিরগুলি প্রতিষ্ঠা করেন সেগুলি দিব্য দেশম নামে পরিচিত। তামিল ভাষায় রচিত তাদের বিষ্ণু বা কৃষ্ণের স্তোত্রগুলি দিব্য প্রবন্ধ নামে পরিচিত। তামিলনাড়ুতে বৈষ্ণবধর্মের জনপ্রিয়তার মূলেও রয়েছেন তারা।
  • (৫) পরবর্তীতে রামানুজাচার্য, মাধবাচার্য, বেদান্ত দেসিকা, সুরদাস, তুলসীদাস, ত্যাগরাজ প্রমুখ আচার্যগণের প্রভাবে বৈষ্ণব ধর্ম ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
  • (৬) সমগ্র ভারতেই আজ বিরাট সংখ্যক বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী দেখতে পাওয়া যায়। পশ্চিম মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও গুজরাটের মত পশ্চিম ভারতীয় রাজ্যগুলিতে এই ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা অধিক।

বিষ্ণু ধর্ম সম্পর্কে হপকিনসের মতবাদ

  • (১) এডওয়ার্ড ওয়াসবার্ন হপকিনস তার ‘দ্য রিলিজিয়ন অফ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে বলেছেন যে, বিষ্ণু ধর্ম বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল। এই ধর্ম আসলে ব্রাহ্মণ্যধর্মেরই একটি অংশ। অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালে কৃষ্ণধর্মের উদ্ভব হয়।
  • (২) কারণ হিসেবে বলা হয় যে আধ্যাত্মিক বা নৈতিক চরিত্রের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও ব্রাহ্মণদের কাছে কৃষ্ণের তুলনায় শিব অধিক গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে বিষ্ণুধর্মই কৃষ্ণধর্মের সঙ্গে মিশে যায়। হপকিনসের মতটি বর্তমানে সর্বজনগ্রাহ্য।

বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রধান তীর্থস্থান

এই বৈষ্ণবদের প্রধান প্রধান তীর্থক্ষেত্র গুলি হল গুরুভায়ুর মন্দির, শ্রীরঙ্গম, বৃন্দাবন, মথুরা, অযোধ্যা, তিরুপতি, পুরী, মায়াপুর, দ্বারকা ও খেতুরী ধাম।

ভারতের বাইরে বৈষ্ণব ধর্মের প্রসার

বিশ শতকে ভারতের বাইরে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা ও রাশিয়ায় বৈষ্ণবধর্ম প্রসারিত হয়। ১৯৬৬ সালে অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ প্রতিষ্ঠিত ইসকন আন্দোলনের ফলে এই প্রসার সম্ভব হয়েছিল।

বৈষ্ণব দর্শন, ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে দুটি মহাকাব্য

  • (১) দুটি প্রসিদ্ধ ভারতীয় পৌরাণিক মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত বৈষ্ণব দর্শন, ধর্মতত্ত্ব ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিষ্ণুর অবতার রামের উপাখ্যান হল রামায়ণ। ধর্মনীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের বিচারে ইতিহাসে রামকে ‘আদর্শ রাজা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
  • (২) রামের পত্নী সীতা, ভাই লক্ষ্মণ ও ভক্ত হনুমানের আচরণও বৈষ্ণবদের কাছে আদর্শ। এই মহাকাব্যের খলনায়ক রাবণ এক দুষ্ট রাজা। আসলে বৈষ্ণবদের কী করা উচিত নয় তার উদাহরণ রাবণ।
  • (৩) মহাভারত মহাকাব্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র বিষ্ণুর অপর অবতার কৃষ্ণ। এই মহাকাব্যের মূল উপজীব্য হল একটি পারিবারিক গৃহযুদ্ধ। এই যুদ্ধে কৃষ্ণ ধার্মিক পাণ্ডবদের পক্ষ অবলম্বন করেন।
  • (৪) কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক মুহুর্তে কৃষ্ণ ও অর্জুনের যে কথোপকথন হয় তা ভারতীয় দর্শনের একটি মূল্যবান উপাদান। মহাভারতের এই অংশটি ভগবদ্গীতা নামে হিন্দুদের একটি স্বতন্ত্র ধর্মগ্রন্থের মর্যাদাপ্রাপ্ত। হিন্দু দর্শনের উপর এই গ্রন্থটির ব্যাপক প্রভাব আছে।
  • (৫) বৈষ্ণবদের কাছে গীতা আরও বেশি মূল্যবান। কারণ, তারা মনে করেন এই গ্রন্থের প্রতিটি বক্তব্যই কৃষ্ণের নিজের মুখ থেকে উৎসারিত হয়েছে। বৈষ্ণব সম্প্রদায়গুলির কাছে কৃষ্ণের মর্যাদা অত্যন্ত সম্মানজনক। কোনো কোনো সম্প্রদায় তাকে বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার মনে করেন।
  • (৬) বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীরা এই দুই মহাকাব্যের নানা অংশ অবলম্বন করে নাট্য রচনা করে থাকেন। সংশ্লিষ্ট অবতারের উৎসবে এই নাটকগুলি অভিনীত হয়। ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বহুপঠিত ভগবদ্গীতা ইংরেজি সহ বিশ্বের একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম বিষয়ে পত্রিকা প্রকাশ

স্টিভেন রোসেন ১৯৯২ সালে দ্য জার্নাল অফ বৈষ্ণব স্টাডিজ নামক হিন্দু গবেষণা পত্রিকাটি চালু করেন। এই পত্রিকায় বৈষ্ণবধর্ম, বিশেষত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

উপসংহার :- ভারতে কয়েক শতাব্দী ধরে বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্ব ছিল ভক্ত, দার্শনিক ও পণ্ডিতদের গবেষণা ও তর্কবিতর্কের বিষয়। সাম্প্রতিক কয়েক দশকে ইউরোপে অক্সফোর্ড সেন্টার ফর হিন্দু স্টাডিজ ও ভক্তিবেদান্ত কলেজের মতো কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই ধর্মতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে।

(FAQ) বৈষ্ণব সম্প্রদায় সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বৈষ্ণব সম্প্রদায় কোন ধর্মের শাখা?

হিন্দু ধর্ম।

২. গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন কে?

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু।

৩. বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবতা কে?

বিষ্ণু ও তার অবতার।

৪. বৈষ্ণব সম্প্রদায় কি আহার ভোজন করেন?

নিরামিষ।

Leave a Comment