ভারতের জাতীয় চেতনার উন্মেষ প্রসঙ্গে ভারতে বিভিন্ন আর্থনীতিক শ্রেণীর আবির্ভাব, শিক্ষিত মধ্যশ্রেণির বিক্ষোভ, জাতীয়তাবাদের তিনটি উপাদান, ভারতের জাতীয় বিদ্রোহের অগ্রদূত বুদ্ধিজীবী-সম্প্রদায়, ভারতের নির্ভীক সাংবাদপত্র, ভারতে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি প্রতিষ্ঠা, ভারত সভা প্রতিষ্ঠা ও জনসমষ্টির ক্ষোভ সম্পর্কে জানবো।
ভারতের জাতীয় চেতনার উন্মেষ
ঐতিহাসিক ঘটনা | জাতীয় চেতনার উন্মেষ |
মহাবিদ্রোহ | ১৮৫৭ খ্রি: |
ভারত সভা | ১৮৭৬ খ্রি: |
বেঙ্গলি পত্রিকা | সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় |
কেশরী পত্রিকা | বাল গঙ্গাধর তিলক |
ভূমিকা :- ভারত-এর ইতিহাসে যুগান্তকারী ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পর একদিকে ভারতের উপর বিজয়-গর্বে উন্মত্ত হয়ে ইংরেজ শাসকগণের উৎপীড়ন ও শোষণের বন্যা বইতে থাকে এবং অপর দিকে তার ফলে ভারতীয় সমাজের সকল দিকে একটা আলোড়ন আরম্ভ হয়। সেই আলোড়নের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে এক নূতন ভারতবর্ষের, জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ এক নূতন জাতির জন্ম আরম্ভ হয়।
ভারতে বিভিন্ন আর্থনীতিক শ্রেণীর আবির্ভাব
- (১) ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহের মধ্য দিয়ে পুরাতন সামন্তশ্রেণীর ইংরেজ-বিরোধিতার অবসানের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ হতে চিরপুরাতন ধর্ম ও সংস্কারের বাধাও বিলুপ্ত হতে থাকে। তার পরিবর্তে নূতন আর্থনীতিক ব্যবস্থার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসে বিভিন্ন আর্থনীতিক শ্রেণী।
- (২) তারা সঙ্গে নিয়ে আসে বিদেশী শাসকের সর্বগ্রাসী শোষণ থেকে আত্মরক্ষা ও জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এক নূতন চেতনা, এক নূতন ইংরেজ-বিরোধী সংগ্রামের ধ্বনি। ভিন্ন দিক হতে আর একটা সংগ্রামের ধ্বনি ভারতবর্ষকে কাঁপিয়ে তোলে।
সমকালে ভারতের শিক্ষিত মধ্যশ্রেণীর বিক্ষোভ
- (১) গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের সংগ্রাম নূতন করে আরম্ভ হয়, শহরে আত্মপ্রতিষ্ঠা-কামী ভারতীয় ধনতন্ত্র তার শিল্প-বিকাশের জন্য সাম্রাজ্যবাদের অনিচ্ছুক হাত থেকে আর্থনীতিক ও রাজনীতিক সুবিধা আদায় করবার সংকল্প নিয়ে অগ্রসর হয়।
- (২) নবজাত শিল্পসমূহের মধ্য থেকে বেরিয়ে শ্রমিকশ্রেণী শহরের সাথে গ্রামাঞ্চলের সংযোগ সাধন করে এবং ইংরেজী ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যশ্রেণীর ভিতর আর্থনীতিক বিক্ষোভ উগ্র হয়ে উঠে।
জাতীয়তাবাদের তিনটি উপাদান
জাতীয়তাবাদের নিম্নোক্ত তিনটি প্রধান উপাদান ইতিমধ্যেই ভারতের সমাজের মধ্যে তৈরী হয়ে গিয়েছিল। এই তিনটি উপাদানের মাধ্যমে ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ভিত্তি গড়ে উঠে। উপাদান গুলো হল –
- (১) বিপুল আর্থনীতিক স্বার্থের প্রতিনিধি হিসাবে এবং ভারতের নিজস্ব শিল্প-বিকাশের ঘোরতর বিরোধীরূপে একটা স্বেচ্ছাচারী ও উৎপীড়ক বিদেশী সরকার।
- (২) ভারতের ক্রমবর্ধমান ধনিকশ্রেণী।
- (৩) উন্নত ইংরেজী শিক্ষায় সুশিক্ষিত ও অর্থনীতিক কারণে বিশেষ বিক্ষুদ্ধ ভারতীয় বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়।
পরাধীন ভারতের জাতীয় বিদ্রোহের অগ্রদূত বুদ্ধিজীবী-সম্প্রদায়
- (১) উৎপীড়নকারী বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের জাতীয় বিদ্রোহের অগ্রদূতরূপে বুদ্ধিজীবী-সম্প্রদায় কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়। বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশরূপে দেখা দেয় কয়েকখানি নূতন সংবাদপত্র।
- (২) এই সংবাদপত্রগুলি তীব্র ভাষায় লিখিত তীক্ষ্ণ সমালোচনার কশাঘাতে ভারতের ইংরেজ-সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে, তাদের সমালোচনা ইংরেজ শাসনের উৎপীড়ন ও শোষণের বর্বররূপ উদ্ঘাটিত করে জনগণের চোখ খুলে দিতে থাকে। ফলে শিক্ষিত সমাজের মধ্যে জাতীয়তার উন্মেষ আরম্ভ হয়।
ভারতের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ
- (১) ইংরেজ শাসকগণ এই আক্রমণ এবং মধ্যশ্রেণীর জাতীয়তাবাদের বাহনস্বরূপ এই সংবাদপত্রগুলিকে বেশী দিন বরদাস্ত করতে পারে নি। এই সকল সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করবার প্রয়োজন বোধ করে।
- (২) তাই ইংরেজ শাসকগণ ১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দে “দেশীয় প্রেস-আইন” নামে একটি দমনমূলক আইন পাশ করে। এই আইনে দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলির স্বাধীনতা বহুলাংশে খর্ব করা হয়। কিন্তু ইংরেজী ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলিতে ইংরেজ শাসনের উপর আক্রমণ সমানভাবেই চলতে থাকে।
সমকালে ভারতের নির্ভীক ইংরেজি সংবাদপত্র
এই সময় বাংলাদেশ-এ ‘অমৃতবাজার পত্রিকা‘, ‘দি বেঙ্গলি পত্রিকা’, ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা‘; মাদ্রাজে ‘হিন্দু পত্রিকা’। বোম্বাইয়ের ‘মারাঠা পত্রিকা’ ও ‘কেশরী পত্রি’ প্রভৃতি ইংরেজী সংবাদপত্রগুলি নির্ভীকভাবে ইংরেজ শাসনের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে থাকে।
ভারতের সংবাদপত্রের প্রভাব
এই সকল সংবাদপত্রের প্রভাব শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং এই সংবাদপত্রগুলির উদ্যোগেই ভারতের জাতীয় আন্দোলনের সংগঠন গড়ে উঠতে আরম্ভ করে।
কলকাতায় ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা
- (১) ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দে বাংলাদেশের ‘দি বেঙ্গলী’ নামক ইংরেজী সংবাদপত্রের সম্পাদক সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দোগে ‘ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশন’ বা ভারত সভা নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়।
- (২) এই সংগঠনটির উদ্দেশ্য ছিল “শিক্ষিত মধ্যশ্রেণীর মতের প্রতিনিধিত্ব করা এবং সামাজিক ক্রিয়াকলাপে তাদের উদ্বুদ্ধ করে তোলা।” এই সংগঠনটি সর্বপ্রথম সরকারী কার্যে ভারতীয়দের সমান অধিকারের দাবি নিয়ে ভারতব্যাপী আন্দোলন আরম্ভ করে এবং এর প্রতিনিধি হিসাবে লালমোহন ঘোষকে ভারতের অনুকূলে ইংল্যান্ড-এ জনমত গঠনের জন্য প্রেরণ করে।
ভারতে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি প্রতিষ্ঠা
- (১) বাংলাদেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের উদ্যোগে জাতীয় সংগঠন সৃষ্টির প্রথম প্রচেষ্টা আরম্ভ হয় ১৮৪৩ খ্রীষ্টাব্দ থেকে। ঐ বৎসর “দেশের সকল শ্রেণীর স্বার্থ ও অধিকার রক্ষা এবং মঙ্গল বিধানের উদ্দেশ্য” নিয়ে ‘ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া সোসাইটি‘ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। ১৯৫১ খ্রীষ্টাব্দে এই সংগঠন ‘ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশন’ নামে আর একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে মিলিত হয়।
- (২) এই সম্মিলিত প্রতিষ্ঠানটি পরের বছর ইংল্যাণ্ডের পার্লামেন্টের নিকট “জাতীয় দাবি” হিসাবে করভার হ্রাস, শিল্প-বিকাশে সরকারী সাহায্য, শিক্ষার প্রসার, শাসনকার্যে ভারতীয়দের অংশ গ্রহণের ব্যবস্থা, জনস্বার্থের প্রতিনিধিস্বরূপ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে আইনসভা গঠন ইত্যাদি দাবি জানায়।
- (৩) রাজেন্দ্রলাল মিত্র, বাগ্মী রামগোপাল ঘোষ, লেখক প্যারীচাদ মিত্ৰ নিৰ্ভীক সাংবাদিক হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র।
পরাধীন ভারতে ‘বম্বে এসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা
ঠিক এই সময়েই বোম্বাই প্রদেশেও জগন্নাথ শঙ্কর শেঠ, ভি. এন. মাণ্ডলিক, দাদাভাই নওরোজি প্রমুখর নেতৃত্বে ‘বম্বে এসোসিয়েশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতার জন্য এই সকল প্রতিষ্ঠানের কোনটিই স্থায়িত্ব লাভ করিতে পারে নি।
ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অগ্রদূত
- (১) এর পরেই বাংলাদেশে ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র প্রতিষ্ঠাতা শিশিরকুমার ঘোষের উদ্যোগে ‘বেঙ্গল ন্যাশনাল লীগ’, বোম্বাই প্রদেশের মহাদেব গোবিন্দ রাণাডে-এর উদ্যোগে পুণাশহরে ‘সার্বজনিক সভা’ এবং মাদ্রাজে ‘নেটিভ এসোসিয়েশন’ গঠিত হয়। মাদ্রাজের এই সংগঠনটি ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে ‘মহাজনসভা’র সাথে মিলিত হয়।
- (২) এই সকল প্রতিষ্ঠানের কোনটিই শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হতে না পারলেও মধ্যশ্রেণীর মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তুলবার পক্ষে এদের দান অস্বীকার করিবার উপায় নেই। এই প্রতিষ্ঠানগুলিই ছিল পরবর্তী কালের জাতীয় কংগ্রেসের অগ্রদূত।
সর্ব-ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের জন্ম অবশ্যম্ভাবী
- (১) তৎকালে এই সকল প্রতিষ্ঠান ইংরেজ শাসনের উৎপীড়নের বিরুদ্ধে জাতীয় জাগরণের সঠিক পথের সন্ধান লাভের জন্য অন্ধকারে ঘুরছিল। দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় ব্যাপক জাতীয় প্রতিরোধের প্রয়োজন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছিল।
- (২) এই প্রয়োজনীয়তা-বোধই তাহাদের সাংগঠনিক প্রচেষ্টা আরও বাড়িয়ে তোলে। বিদেশী ইংরেজ শাসনের উৎপীড়ন ও শোষণ প্রতিদিন বীভৎসরূপে আত্মপ্রকাশ করে দেশের মধ্যে যে ব্যাপক গণ-বিক্ষোভ সৃষ্টি করেছিল তার ফলেই এক সর্ব-ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের জন্ম অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
ব্রিটিশ সরকারের সাম্রাজ্যবাদী ক্ষুধার নিবৃত্তির
১৮৭৭ খ্রীষ্টাব্দে সমগ্র ভারতে এক ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই দুর্ভিক্ষের ফলে পঞ্চাশ-ষাট লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়। কিন্তু এই দুর্ভিক্ষের মধ্যেই মহারানী ভিক্টোরিয়ার “ভারত-সম্রাজ্ঞী” খেতাব গ্রহণ উপলক্ষে দিল্লীতে কোটি কোটি কাটা ব্যয়ে এক দরবার বসে। কেবল তাই নয়, এই সময়েই ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের সাম্রাজ্যবাদী ক্ষুধার নিবৃত্তির জন্য ভারতবর্ষের বহু কোটি টাকা ব্যয়ে কাবুল আক্রমণ করে।
ভারতের নূতন বস্ত্রশিল্পের অস্তিত্ব বিপন্ন
ব্রিটিশ সরকার উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের উপজাতীয় অধিবাসীদের দমনের জন্য সামরিক অভিযান চালাতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা নষ্ট করে এবং ইংল্যাণ্ডের বস্ত্রশিল্পের মালিকগোষ্ঠীর স্বার্থে ইংল্যাণ্ডের তুলাজাত দ্রব্যের উপর থেকে আমদানি শুল্ক হ্রাস করে ভারতের নূতন বস্ত্রশিল্পের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তোলে।
ভারতীয় জনসমষ্টির ক্ষোভ
এই সকল উৎপীড়নের বিরুদ্ধে দেশীয় সংবাদপত্রগুলির তীব্র প্রতিবাদ স্তব্ধ করে দেবার জন্য ইংরেজ শাসকগণ ‘দেশীয় সংবাদপত্র আইন’ পাশ করে। এর ফলে ভারতবর্ষে এক দিকে একটা পতনোন্মুখ মিথ্যা বাজেটের উপর প্রতিষ্ঠিত বেপরোয়া আমলাতান্ত্রিক সরকার ধ্বংসোন্মুখ হয়ে উঠে এবং অপর দিকে দেশের বিপুল জনসমষ্টি একটা প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়তে থাকে।
উপসংহার :- ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দের ‘ইলবার্ট-বিল‘ উপলক্ষ করে এই গণ-বিক্ষোভ দেশব্যাপী একটা বিরাট আন্দোলনের রূপ গ্রহণ করে। ইংরেজদের ঔদ্ধত্য ও উৎপীড়নে শিক্ষিত মধ্যশ্রেণীর মধ্যে জাতীয় অপমানবোধ জাগ্রত হবার ফলে তাহাদের ধূমায়িত বিক্ষোভ দাবাগ্নিতে পরিণত হয়।
(FAQ) ভারতের জাতীয় চেতনার উন্মেষ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে।
১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে।
শিশিরকুমার ঘোষ।
১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে।