সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা প্রসঙ্গে গৌরবময় অধ্যায়, সাম্রাজ্যের রক্ষা, সাম্রাজ্যের সংহতি ও সম্প্রসারণ, দিল্লি সুলতানির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা, কেন্দ্রীয় শাসনের গোড়াপত্তন, কন্যাকে মনোনয়ন, মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিরোধ, কার্যকরী শাসন ব্যবস্থা, মুদ্রা ব্যবস্থা ও দিল্লীর আন্তর্জাতিক মর্যাদা সম্পর্কে জানবো।
সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা
ঐতিহাসিক ঘটনা | সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা |
সুলতান | ইলতুৎমিস |
উপাধি | সুলতান-ই-আজম |
পূর্বসূরি | কুতুবউদ্দিন আইবক |
উত্তরসূরি | রুকনউদ্দিন ফিরোজ |
ভূমিকা :- দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রথমদিকের সুলতানদের মধ্যে ইলতুৎমিস সর্বাপেক্ষা সুদক্ষ শাসক ও বিজেতা ছিলেন। তিনি ছিলেন ক্রীতদাসের ক্রীতদাস এবং অত্যন্ত হীনাবস্থা থেকে জীবন আরম্ভ করে, দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
গৌরবময় অধ্যায়
তাঁর রাজোচিত সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্বময় দক্ষতা তাঁর প্রভু কুতুবউদ্দিন আইবককে মুগ্ধ করেছিল। তাঁর ছাব্বিশ বছরের রাজত্বকাল দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়।
সাম্রাজ্যের রক্ষা
ইলতুৎমিসের সিংহাসনে আরোহণ মোটেই সুখের ও আরামদায়ক হয়নি। তখন দিল্লির রাজমুকুট কাঁটার মুকুট হিসাবে বিবেচিত হত। তাঁর সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব, কুতুবউদ্দিন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যকে তিনি রক্ষা করেছিলেন এবং সেটার সুদৃঢ়করণের কাজ যোগ্যতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছিলেন।
সাম্রাজ্যের সংহতি ও সম্প্রসারণ
দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যের সংহতি ও সম্প্রসারণের দায়িত্বও তিনি একইসঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন। এই কাজের জন্য তাঁকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যুদ্ধ করতে হয়েছিল। তাই ঐতিহাসিক আর. পি. ত্রিপাঠী বলেছেন “The history of Muslim sovereignty in India begins properly speaking with Iltutmish.”
দিল্লী সুলতানির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা
তৎকালীন পরিস্থিতিতে সবদিক বিবেচনা করে, অনেকে তাঁকে দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলে অভিহিত করেছেন। কারণ,
- (১) কুতুবউদ্দিন-প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব ইলতুৎমিসের সময় একই রকম ছিল না। কুতুবউদ্দিনের মৃত্যুর পর আরাম শাহের সংক্ষিপ্ত ও দুর্বল শাসনকালেই, কুতুবউদ্দিন আইবক যে সমস্ত রাজ্য জয় করেছিলেন তা দিল্লির হাতছাড়া হয়ে যায়। সিন্ধুদেশ, বঙ্গদেশ, গোয়ালিয়র ও রণথম্বোরের নাম এই প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
- (২) এরকম এক চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে, ইলতুৎমিস শুধুমাত্র হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারের কাজেই আত্মনিয়োগ করেননি, বহু নতুন রাজ্যও জয় করে সমগ্র ভারতবর্ষ -এ তুর্কি প্রভুত্বের সূচনা করেন।
- (৩) যে প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে দিল্লি শিশু সুলতানি সাম্রাজ্যের ভাগ্য নির্ধারণ করেছিলেন এবং চারিদিকের বিদ্রোহ দমন করে যেভাবে শিশু সুলতানি সাম্রাজ্যের একটি প্রশাসনিক কাঠামো নির্মাণ করে এই সাম্রাজ্যের ভিত মজবুত করেছিলেন।
- (৪) এই জন্য অনেক ঐতিহাসিক তাঁকে একদিকে যেমন সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলেছেন, আবার অনেক ঐতিহাসিক তাঁকে “শ্রেষ্ঠ সুলতান’ বলে অভিহিত করেছেন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতো ঐতিহাসিকও বলেছেন “Iltutmish may justly be regarded as the greatest ruler of the early Turkish Sultanate of Delhi which lasted till 1290 A.D.”
কেন্দ্রীয় শাসনের গোড়াপত্তন
- (১) তিনি শুধুমাত্র রাজ্যজয় করেই সন্তুষ্ট ছিলেন না, দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যের ভবিষ্যতে চলার পথকেও মসৃণ করেন। মহম্মদ ঘুরি ও কুতুবউদ্দিন আইবক তাঁদের শাসনকাল সংক্ষিপ্ত হওয়ার জন্য, দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় শাসনের কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থা করে যেতে পারেননি।
- (২) ইলতুৎমিসই দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় শাসনের গোড়াপত্তন করেন। এই কাজ ছিল অত্যন্ত কঠিন। কারণ, তাঁর সম্মুখে কোনো শাসনতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত ছিল না। ইলতুৎমিসই প্রথম কেন্দ্রীয় শাসনের পরিকাঠামো নির্মাণ করেন।
- (৩) তিনিই প্রথম আরবীয় মুদ্রার অনুকরণে রৌপ্যমুদ্রা চালু করেন। এটা তাঁর সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতীক। দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্য যে সম্পূর্ণ বিদেশি নিয়ন্ত্রণমুক্ত, তার চরম দৃষ্টান্ত ইলতুৎমিসই স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি যে শাসনব্যবস্থার কাঠামো নির্মাণ করে যান, তা সমগ্র দিল্লি সুলতানি শাসনকালে অব্যাহত ছিল।
কন্যাকে মনোনয়ন
- (১) তিনিই একমাত্র সুলতান, যিনি পুত্ররা বর্তমান থাকা সত্ত্বেও, শুধুমাত্র পুত্রদের রাজ্যশাসনে অযোগ্যতার জন্যই উপযুক্ত কন্যাকে রাজ্যের উত্তরাধিকারিণী মনোনীত করেছিলেন।
- (২) আবার কন্যাকে উত্তরাধিকারিণী মনোনীত করে কোরানে বর্ণিত ‘ফরাজ’ বা উত্তরাধিকারী আইনকে অস্বীকার করে সমগ্র ইসলামীয় দুনিয়ায় এক নতুন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন এবং রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে দূরে থাকার এক নতুন পথ নির্মাণ করে দিয়েছিলেন।
- (৩) মধ্যযুগের ভারত-ইতিহাসে এটা তাঁর এক অভিনব ব্যবস্থা। এর থেকে প্রমাণিত হয়, রাজ্যের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার কথা তিনি কত গভীরভাবে চিন্তা করেছিলেন। তবে তাঁর মৃত্যুর পর একজন নারীর মনোনয়ন যে, তাঁর পুত্রগণ ও অভিজাতগণ মেনে নেবে না, এটা তিনি বুঝতে পারেননি।
- (৪) রাজিয়া মাত্র তিন বছর রাজত্ব করার পর, তাঁকে সিংহাসনচ্যুত হতে হয়। ঐতিহাসিক ড. ত্রিপাঠী বলেছেন, “তাঁর বিচক্ষণতা প্রকাশিত হয় যখন তুর্কি অভিজাতগণ নিজেরাই তুর্কি সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য রাজিয়াকে সিংহাসনে বসাতে বাধ্য হন।”
মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিরোধ
- (১) মোঙ্গল আক্রমণ তিনি যেভাবে প্রতিহত করেছিলেন, তাতে তাঁর উচ্চস্তরের রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি যে শুধুমাত্র একজন সৈনিক নন, একজন দক্ষ রাজনীতিকও, সে-পরিচয়ও তিনি দিয়েছিলেন।
- (২) তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতার আরও পরিচয় পাওয়া যায়, যখন তিনি তাঁর পুত্র থাকা সত্ত্বেও কন্যা রাজিয়াকে দিল্লি সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারিণী মনোনীত করেন। একজন নারীর সিংহাসনে আরোহণ, মধ্যযুগের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য দান করেছিল। এর থেকে ইলতুৎমিসের চরম রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়।
কার্যকরী শাসনব্যবস্থা
- (১) ইলতুৎমিস শুধুমাত্র সাম্রাজ্যের সংহতি রক্ষা করেই ক্ষান্ত ছিলেন না, সেই সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব রক্ষার জন্য একটি কার্যকরী শাসনব্যবস্থা রচনা করেন। তিনি ইক্তা ব্যবস্থার প্রবর্তন করে মাকতি বা ইজারাদারদের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করেন।
- (২) প্রাক-তুর্কি যুগের সামন্ত ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে উত্তর ভারতের সমগ্র অঞ্চলকে কেন্দ্রীয় সুলতানি শাসনের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি ইক্তাদারদের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যবস্থা করেন। বড়ো বড়ো ইক্তাগুলি একই সঙ্গে রাজস্ব আদায় ও প্রশাসনিক দায়িত্ব বহন করত।
- (৩) তবে তুর্কিরাই প্রধানত ইজাদারের পদে নিযুক্ত হত। প্রকৃতপক্ষে ইলতুৎমিসের শাসনকালে ইক্তাদাররা সরকারি কর্মী হিসেবে গণ্য হতেন। তাদের মধ্যে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে উঠতে দেন নি। তিনি মুসলিম আইন অনুসারে ন্যায় বিচারের ব্যবস্থা করেন। তিনি রাজকীয় সেনাবাহিনী গঠন করেন।
মুদ্রা ব্যবস্থা
তিনি স্বর্ণ মুদ্রা ও রোপ্য মুদ্রা চালু করেন এবং তামার জিতল চালু করেন। তাঁর রৌপ্য মুদ্রার ওজন ছিল ১৭৫ গ্রাম। নেলসন রাইট-এর মতে দিল্লির মুদ্রাব্যবস্থার ইতিহাসে ইলতুৎমিসের শাসনকাল একটি গুরুত্বপূর্ণ যুগ ছিল।
অভিজাত ও উলেমাদের পদমর্যাদা
Dr. J. L. Mehta বলেছেন তিনি দরবারে অভিজাত ও উলেমাদের যথোচিত পদমর্যাদা দিতেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন ধার্মিক মুসলমান। কিন্তু উলেমাদের তাঁর রাজকার্যে হস্তক্ষেপ করতে তিনি দিতেন না।
সুফিসন্তদের প্রতি অনুরাগ
তিনি সুফিসন্তদের প্রতি অনুরাগ দেখান। এমনকি সুফি সাধু সেখ কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকির স্মরণে কুতুবউদ্দিন আইবক ১২১১ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ কার্য শুরু করেন, কিন্তু এই মিনারের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন ইলতুৎমিস।
ধর্মপ্রাণ মুসলমান
- (১) নির্ভীকতা, ন্যায়পরায়ণতা ও বিচক্ষণতা তাঁর চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলেও, তিনি ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন, কিন্তু হিন্দুদের প্রতি ব্যবহারে তিনি সমদর্শিতা দেখাতে পারেন নি। এই বক্তব্য যথার্থ নয়।
- (২) কারণ, উলেমাদের বক্তব্য তিনি শোনেন নি। তিনি বলেছিলেন আমরা ভাতের একটু নুনের মতো অবস্থান করি। অতএব রাজধানীর সম্মুখ দিয়েই মিছিল করে ঠাকুর বিসর্জন হবে।
দিল্লীর আন্তর্জাতিক মর্যাদা
- (১) ইলতুৎমিস বিদ্যোৎসাহী ও শিল্পানুরাগী নরপতি ছিলেন। তিনি বহু বিদ্বান ও গুণী ব্যক্তিকে দিল্লিতে আশ্রয় দিয়ে, দিল্লিকে ইসলামীয় সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কেন্দ্রে পরিণত করেন। তিনিই প্রথম দিল্লিকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা এনে দিয়েছেন, যা আজও বর্তমান আছে।
- (২) তিনিই দিল্লিতে কুতুবমিনারের নির্মাণকার্য শেষ করেন, যা আজও তাঁর মহত্ত্বের পরিচয় বহন করছে। তাঁর আদেশে আজমিরেও একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যকে তিনিই প্রথম চরম সমৃদ্ধি ও গৌরব দান করেছিলেন। ইলতুৎমিসই সামরিক দখলদারিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে তার স্থায়িত্ব দান করেন।
উপসংহার :- এই সব দিক বিবেচনা করেই ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ বলেছেন, “নিঃসন্দেহে ইলতুৎমিস ছিলেন দাস বংশের প্রকৃতি প্রতিষ্ঠাতা। ড. হবিবুল্লাহ ঠিকই বলেছেন, “Aibak outlined the Delhi Sultanate and its Sovereign status; Iltutmish was unquestionably its first king.”
(FAQ) সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
ইলতুৎমিস।
কুতুবউদ্দিন আইবক, ইলতুৎমিস।
ইলতুৎমিস।
কুতুবউদ্দিন আইবক।