আলাউদ্দিন খলজির উত্তর ভারত অভিযান

আলাউদ্দিন খলজির উত্তর ভারত অভিযান প্রসঙ্গে গুজরাট জয়, রণথম্ভোর জয়, চিতোর জয়, চিতোর দুর্গ অবরোধ, চিতোর দুর্গ দখল, মেবারের হস্তচ্যুতি, মালব জয়, আলাউদ্দিনের রাজপুত নীতির মূল্যায়ন ও সীমাবদ্ধতার কারণ সম্পর্কে জানবো।

আলাউদ্দিন খলজির উত্তর ভারত অভিযান

ঐতিহাসিক ঘটনাআলাউদ্দিন খলজির উত্তর ভারত অভিযান
সুলতানআলাউদ্দিন খলজি
গুজরাট জয়১২৯৮ খ্রি
চিতোর অবরোধ১৩০৩ খ্রি
পদ্মাবৎ কাব্যমালিক মহম্মদ জয়সী
আলাউদ্দিন খলজির উত্তর ভারত অভিযান

ভূমিকা:- আলাউদ্দিন খলজির রাজ্যজয়কে দু-ভাগে ভাগ করা হয় – উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারত অভিযান। উত্তর ভারতের বিরুদ্ধে তার অভিযান চলেছিল ১২৯৭ থেকে ১৩০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।

আলাউদ্দিন খলজির গুজরাট জয়

  • (১) সিংহাসনে বসার পর আলাউদ্দিনের প্রথম অভিযান ছিল ১২৯৮ খ্রিস্টাব্দে গুজরাট অভিযান। গুজরাট ছিল খুবই সমৃদ্ধশালী অঞ্চল। বাঘেলা রাজপুত বংশীয় কর্ণদেব বা রায় করণ এই সময় গুজরাটের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
  • (২) আলাউদ্দিনের গুজরাট অভিযানের কারণ হিসেবে জনৈক রাজপুত কবি বলেছেন যে, গুজরাটের বাঘেলা রাজা করণ সিংহ তার এক মন্ত্রীর পত্নীর প্রতি অসম্মান করেন। এই বিক্ষুব্ধ মন্ত্রী দিল্লীতে এসে সুলতান আলাউদ্দিনকে গুজরাট অভিযানে প্ররোচনা দেন।
  • (৩) ডঃ নিজামী এই তথ্যের ওপর আস্থা স্থাপন করেছেন। কিন্তু ডঃ জে. এল. মেহতার মতে, আলাউদ্দিনের গুজরাট অভিযানের আরও যুক্তিপূর্ণ কারণ ছিল। গুজরাটের নিকটস্থ সিন্ধু ও মুলতান ছিল তার অধীনে। কাজেই সমৃদ্ধিশালী গুজরাটের দিকে তিনি লোলুপ দৃষ্টি দেন।
  • (৪) আলাউদ্দিন তাঁর দুই সেনাপতি নসরৎ খান ও উলুগ খানকে গুজরাট জয়ের জন্য পাঠিয়ে দেন। রাজা কর্ণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। রাজা কর্ণ আমেদাবাদের যুদ্ধে পরাস্ত হন। রাণী কমলাদেবী সুলতানি সেনার হাতে বন্দিনী হন। আলাউদ্দিন তাকে বিবাহ করেন।
  • (৫) রাজা কর্ণ তার কন্যা দেবলাদেবী বা দেবলরাণী সহ দক্ষিণে দেবগিরিতে পালিয়ে যান। সুলতানি সেনা ক্যাম্বে বন্দর ও সোমনাথের মন্দির লুঠ করে এবং প্রচুর ধনরত্নসহ দিল্লীতে ফিরে আসে। ক্যাম্বেতে সেনাপতি নসরৎ খান জনৈক খোজা, মালিক কাফুরকে কিনেন এবং সুলতানকে উপহার দেন। পরে মালিক কাফুর আলাউদ্দিনের প্রধান সেনাপতি হন।
  • (৬) গুজরাটে আলাউদ্দিনের এই সফলতার কারণ হিসেবে ইসামি বলেছেন যে, রায়করণ অতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে রাজ্য ছেড়ে পালান। তাঁর রাজধানী আনহিলওয়ারা লুণ্ঠিত হয়। ক্যাম্বে বন্দরের ধনী মুসলিম বণিকরা সেনাপতি নসরৎ খানকে প্রচুর অর্থ দিতে বাধ্য হন। গুজরাট সুলতানি সাম্রাজ্য-এর অন্তর্ভুক্ত হয়।
  • (৭) গুজরাট থেকে দিল্লীতে ফেরার সময় সুলতানি সেনাদলে বিদ্রোহ দেখা দেয়। ইসামির মতে গুজরাট থেকে সেনারা প্রচুর ধনরত্ন লুঠ করে। সুলতানের দুই সেনাপতি আইন মাফিক এই লুঠ করা ধনরত্নের ১/৫ ভাগ সুলতানের প্রাপ্য হিসেবে আদায় করার চেষ্টা করায় এই বিদ্রোহ হয়। সেনাপতি নসরৎ খান কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমন করেন।

সুলতান আলাউদ্দিন খলজির রণথম্ভোর জয়

  • (১) সুলতান আলাউদ্দিনের দ্বিতীয় অভিযান ছিল ১২৯৯-১৩০১ খ্রিস্টাব্দে রণথম্ভোরের চৌহান রাজা হামীরদেবের বিরুদ্ধে। রণথম্ভোর দুর্গ ছিল খুবই দুর্ভেদ্য এবং এই দুর্গ হাতে না থাকলে দিল্লী সুলতানি সাম্রাজ্য নিরাপদ হত না।
  • (২) রাজা হামীরদের বিদ্রোহী নব মুসলমানদের আশ্রয় দিয়ে আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধাচারণ করায় সুলতান রণথম্ভোর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। সেনাপতি উলুগ খান ও নসরৎ খান রণথম্ভোর অবরোধ করে বিফল হন। নসরৎ খান যুদ্ধে নিহত হন।
  • (৩) এরপর আলাউদ্দিন নিজে দুর্গটির অবরোধ পরিচালনা করেন। তিনি হামীরদেবের সেনাপতি রণমলকে উৎকোচদানে বশীভূত করে দুর্গ অধিকার করেন।

আলাউদ্দিন খলজির চিতোর জয়

  • (১) সুলতান আলাউদ্দিনের অন্যতম বিখ্যাত অভিযান ছিল ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে চিতোর আক্রমণ। চিতোর ছিল রাজপুতানার মেবার রাজ্যের রাজধানী। এই মেবার রাজ্যের রাজবংশ ছিল খুবই প্রাচীন ও সম্মানিত শিশোদিয়া বংশ। আমীর খসরু চিতোর আক্রমণের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন।
  • (২) চিতোরের রাণা রতন সিংহ আলাউদ্দিনের বশ্যতা গ্রহণের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলে সুলতান চিতোর অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। চিতোর দুর্গ বিরোধী শক্তির হাতে থাকলে সুলতানি সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিপন্ন হত। এজন্য চিতোরের ওপর দিল্লীর আধিপত্য স্থাপন করার উদ্দেশ্যে তিনি এক শক্তিশালী বাহিনী পাঠান।

সুলতান আলাউদ্দিন খলজির চিতোর দুর্গ অবরোধ

মেবার রাজ্যের চিতোর দুর্গটি ছিল ৩ মাইল লম্বা ৪০০-৫০০ ফুট খাড়া পাহাড়ের ওপর অবস্থিত। আলাউদ্দিন বহু চেষ্টা করে সম্মুখ যুদ্ধে দুর্গ দখল করতে বিফল হন। রাজপুতরা বীরবিক্রমে সুলতানি বাহিনীকে হঠিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত আলাউদ্দিন বিভিন্ন কৌশল দ্বারা দুর্গের প্রাচীর ভেঙে ফেলেন। মুসলিম লেখকদের মতে, রতন সিংহ নিজেই আত্মসমর্পণ করেন।

আলাউদ্দিন খলজির চিতোর দুর্গ দখল

রাজপুত লেখকদের মতে, আলাউদ্দিনের চিতোর আক্রমণের কারণ ছিল রাণা রতন সিংহের রানী সুন্দরী পদ্মিনীর প্রতি আলাউদ্দিনের লালসা। আলাউদ্দিন ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে চিতোর অবরোধ করেন এবং ৮ মাস অবরোধের পর চিতোর দুর্গ দখল করেন।

আলাউদ্দিনের চিতোর আক্রমণ সম্পর্কে পদ্মিনী উপাখ্যান

  • (১) ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ চিতোর অধিকারের ২৩৭ বছর পরে মালিক মহম্মদ জয়সী নামে এক কবি পদ্মাবৎ কাব্যে পদ্মিনী উপাখ্যান রচনা করেন। তখন থেকে রাজপুত লেখকরা পদ্মিনীর কাহিনীকে একটি কিংবদন্তিতে পরিণত করেছেন।
  • (২) জয়সীর মতে আলাউদ্দিন ৮ বছর অবরোধ করেও চিতোর দুর্গ দখল করতে পারেন নি। তারপর তিনি ছল চাতুরীর দ্বারা চিতোর অধিকার করেন। পদ্মিনী সহ দুর্গের অন্যান্য নারীরা জহর ব্রত পালন করে জীবন্ত অবস্থায় আগুনে ঝাঁপ দেন।
  • (৩) আলাউদ্দিন চিতোর দখল করে ৩০ হাজার রাজপুত যোদ্ধাকে হত্যা করেন। আধুনিক গবেষকদের মতে পদ্মিনী উপাখ্যানের কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। আমীর খসরু চিতোর অভিযানের সময় সুলতানের সঙ্গে ছিলেন। তিনি পদ্মিনীর উল্লেখ করেন নি।
  • (৪) আমীর খসরু রণথম্ভোর দুর্গে জহর ব্রতের উল্লেখ করলেও চিতোরে জহর ব্রতের উল্লেখ করেন নি। ইসামীও পদ্মিনী উপাখ্যানের উল্লেখ করেন নি। ডঃ নিজামীর মতে আলাউদ্দিন চিতোর দুর্গে ৩০ হাজার সর্দার বা মুকাদ্দমকে হত্যা করেন একথাও বিশ্বাস্য নয়।

আলাউদ্দিন খলজির মেবার হস্তচ্যুতি

  • (১) যাই হোক আলাউদ্দিন চিতোর অধিকারের পর দীর্ঘদিন দুর্গটি ও সংলগ্ন অঞ্চল তাঁর পুত্র খিজির খানের অধীনে রাখেন। রাজপুতদের পাল্টা আক্রমণে শেষ পর্যন্ত খিজির খান চিতোর থেকে চলে আসেন।
  • (২) এরপর মালদেব নামে এক রাজপুতকে চিতোরের শাসনকর্তা নিয়োগ করা হয়। কিছুদিন পরে শিশোদিয়া বংশীয় হামীরদের মালদেবকে বিতাড়িত করে পৈত্রিক চিতোর দুর্গ অধিকার করেন।

আলাউদ্দিন খলজির মালব জয়

  • (১) আলাউদ্দিন রাজপুতানা ও মধ্যপ্রদেশের সামরিক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল মালব জয়ের জন্য তাঁর সেনাপতি আইন-উল-মুলককে নির্দেশ দেন। আইন-উল-মুলক মালবের অধিপতি মহালকদেবকে পরাস্ত করে মাণ্ডু দুর্গ, উজ্জয়িনী, চান্দেরী ও ধর অধিকার করলে আলাউদ্দিনের ক্ষমতা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়।
  • (২) এরপর আলাউদ্দিন ১৩০৮ খ্রিস্টাব্দে ধারওয়ার বা শিয়ানা আক্রমণ করে সেখানকার রাজপুত রাজা শীতলদেবকে নিহত করেন। আলাউদ্দিন ১৩১১ খ্রিস্টাব্দে ধারবারের পার্শ্ববর্তী জালোর রাজ্য আক্রমণ করেন। জালোরের রাজা কানোরদেবকে সুলতানি বাহিনী নিহত করে। জালোর বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে আলাউদ্দিনের রাজপুতানা অভিযান শেষ হয়।

আলাউদ্দিনের রাজপুত নীতির মূল্যায়ন

  • (১) উত্তরপ্রদেশ, দিল্লী, পাঞ্জাব প্রভৃতি সুলতানের প্রত্যক্ষ শাসিত অঞ্চলে আলাউদ্দিন একটি সুনির্দিষ্ট শাসন নীতি নেন। রাজপুতানা জয়ের পর রাজপুতানা শাসনের জন্য আলাউদ্দিন কি কোনো বিশেষ নীতি নেন?
  • (২) ডঃ নিজামীর মতে, আলাউদ্দিনের কোনো সুনির্দিষ্ট রাজপুত নীতি ছিল না। যে রাজপুত রাজা তাঁর বিরোধিতা করতেন তিনি যুদ্ধ দ্বারা তাকে উৎখাত করলেও, তিনি রাজপুতানার কৃষক ও বণিকদের ওপর সুলতানি শাসন চাপিয়ে দেন নি।
  • (৩) রাজপুতানায় রাজার অধীনে যে সকল সামন্ত সর্দার শাসন করত, তিনি তাদের ক্ষমতা ধ্বংস করার জন্য কোনো চেষ্টা করেন নি। যদিও চিতোরে তিনি কিছু সংখ্যক সামন্ত সর্দারকে হত্যা করেন, সাধারণভাবে রাজপুতানার ওপর তিনি তাঁর প্রত্যক্ষ শাসন স্থাপনের জন্য কোনো বিশেষ উদ্যোগ নেন নি।
  • (৪) রাজপুতানার সামাজিক সংগঠন ও মধ্যবর্তী সামন্ত সর্দারদের ক্ষমতা ভেঙে ফেলার জন্য তিনি কোনো উদ্যোগ নেন নি। রাজপুতানার তিনটি প্রধান দুর্গ যথা চিতোর, রণথম্ভোর ও জালোর অধিকার করে তিনি সন্তুষ্ট থাকেন। আকবরের মত রাজপুত জাতি ও রাজপুত সেনাদলকে নিজ স্বার্থে ব্যবহারের জন্য তিনি কোনো চেষ্টা করেননি।

আলাউদ্দিনের রাজপুত নীতির সীমাবদ্ধতার কারণ

এই সীমাবদ্ধতার জন্য ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন কারণ দেখান। যেমন –

  • (১) সুলতানি আমলে রাজপুত রাজশক্তিগুলি নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদে মত্ত থাকায় রাজপুতদের মধ্যে একতা না থাকায়, আলাউদ্দিন রাজপুতদের সাহায্য নেওয়ার কথা ভাবেননি।
  • (২) রাজপুতানার শুষ্ক মরুভূমি, পর্বতমালা ও ভৌগোলিক বাধার জন্য আলাউদ্দিন এই অঞ্চলে পুরোপুরি আধিপত্য স্থাপনে সক্ষম হন নি।
  • (৩) চিতোর, রণথম্বোর ও জালোর জয়ে আলাউদ্দিনের প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতি হয়। তুলনামূলকভাবে তিনি রাজপুতানা থেকে বিশেষ অর্থ পান নি। এজন্য রাজপুতানা ছেড়ে দক্ষিণ ভারত -এর দিকে তিনি বিশেষ নজর দেন।

উপসংহার :- আলাউদ্দিনের রাজত্বের শেষ দিকে এবং তাঁর মৃত্যুর পর চিতোর প্রভৃতি রাজপুত রাজ্যগুলি সুলতানি সিংহাসনের অধীনতা পাশ ছিঁড়ে ফেলে।

(FAQ) আলাউদ্দিন খলজির উত্তর ভারত অভিযান সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. আলাউদ্দিন উত্তর ভারতের কোথায় প্রথম অভিযান করেন?

গুজরাট।

২. আলাউদ্দিনের গুজরাট আক্রমণের সময় সেখানকার রাজা কে ছিলেন?

কর্ণদেব বা রায় করণ।

৩. আলাউদ্দিনের চিতোর অভিযানের সময় সেখানকার রাজা কে ছিলেন?

রাণা রতন সিংহ।

৪. পদ্মাবৎ কাব্য কার লেখা?

মালিক মহম্মদ জয়সী।

Leave a Comment