ফিরোজ শাহ তুঘলকের রাজতান্ত্রিক আদর্শ

ফিরোজ শাহ তুঘলকের রাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রসঙ্গে স্বতন্ত্র নীতি, শরিয়ত অনুসরণ, ধর্মাশ্রিত রাজতন্ত্র, সুন্নী ধর্মগুরুদের সহায়তা, খলিফার সনদ লাভ, খুৎবা পাঠ, রাজনৈতিক দিক, উদাসীন থাকার নীতি ও নিকৃষ্ট দুর্নীতির যুগ সম্পর্কে জানবো।

ফিরোজ শাহ তুঘলকের রাজতান্ত্রিক আদর্শ

ঐতিহাসিক ঘটনাফিরোজ শাহ তুঘলকের রাজতান্ত্রিক আদর্শ
সুলতানফিরোজ শাহ তুঘলক
রাজত্ব১৩৫১-১৩৮৮ খ্রি:
বৈধতার দলিলখলিফার স্বীকৃতি পত্র
ফিরোজ শাহ তুঘলকের রাজতান্ত্রিক আদর্শ

ভূমিকা :- ড: আর. পি. ত্রিপাঠী ফিরোজ শাহ তুঘলকের রাজতান্ত্রিক আদর্শ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, “ফিরোজ শাহের রাজত্বকাল সমাপ্ত হলে, ভারতে মুসলিম রাজতন্ত্রের বিবর্তনের একটি অধ্যায়ের অবসান ঘটে।”

ফিরোজ শাহ তুঘলকের স্বতন্ত্র নীতি

ডঃ ত্রিপাঠীর মন্তব্য বিচার করলে দেখা যায় যে, তাঁর পূর্ববর্তী সুলতান আলাউদ্দিন খলজি এবং মহম্মদ বিন তুঘলক-এর রাজতান্ত্রিক আদর্শ থেকে সুলতান ফিরোজ শাহ এক স্বতন্ত্র নীতি গ্রহণ করেন।

ফিরোজ শাহ তুঘলক কর্তৃক শরিয়ত অনুসরণ

আলাউদ্দিন এবং মহম্মদ তাদের রাজ্যশাসন নীতির ক্ষেত্রে উলেমা ও মুসলিম ধর্মগুরুদের পরামর্শ আবশ্যকীয় মনে করতেন না। রাজস্ব নির্ধারণ, ফৌজদারী আইন বিধি প্রযোগ প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা ইচ্ছামত সিদ্ধান্ত নিতেন। ফিরোজ শাহ তুঘলক উলেমাদের দেওয়া শরিয়তের বিধান মেনে তার শাসন নীতি মোটামুটি স্থির করেন।

ফিরোজ শাহ তুঘলকের ধর্মাশ্রিত রাজতন্ত্র

ডঃ আর সি মজুমদার প্রমুখ ঐতিহাসিক এজন্য মন্তব্য করেছেন যে, ফিরোজ শাহ তুঘলক ধর্মাশ্রিত রাজতন্ত্রের আদর্শ প্রবর্তন করেন। কিন্তু গভীরভাবে বিচার করলে দেখা যাবে যে, শরিয়ত সম্মত আইন বিধিগুলিকে ফিরোজ শাহ আপন জনপ্রিয়তা লাভ ও তাঁর রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির জন্যই ব্যবহার করেন। তিনি ধর্মীয় প্রভাব বশত শরিয়তী আইনবিধি প্রয়োগ করেন একথা ভাবা উচিত হবে না।

ফিরোজ শাহ তুঘলকের সুন্নী ধর্মগুরুদের সহায়তা

রাজনৈতিক স্বার্থবশত তিনি শরিয়তী আইন বিধির সাহায্য নেন। ফিরোজ তাঁর সিংহাসনের অধিকারকে দৃঢ় ও সুরক্ষিত করার জন্য সুন্নী ধর্মগুরুদের সহায়তার প্রয়োজন বুঝেন।

সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক কর্তৃক খলিফার সনদ লাভ

ফিরোজ শাহ কেবলমাত্র উলেমা শ্রেণীর সহযোগীতা দ্বারা তার সিংহাসনকে মজবুত করেন নি। তিনি খলিফার সনদ লাভ করে নিজেকে খলিফার ভৃত্য বা নায়েব হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি খলিফার অছি বা ট্রাস্টি হিসেবে নিজেকে গণ্য করতেন।

ফিরোজ শাহ তুঘলকের খুৎবা পাঠ

সুলতান ফিরোজ যে খুৎবা বা ঘোষণাপত্র পাঠ করেন তাতে তাঁর নিজের নাম পূর্ববর্তী সুলতানদের সঙ্গে উল্লেখ করেন। এর দ্বারা তিনি দেখাতে চান যে, তিনি বৈধভাবে সিংহাসনে বসেছেন। ফিরোজ তাঁর আত্মজীবনীতে খলিফার স্বীকৃতিপত্রকে তার বৈধতার প্রধান দলিল বলে উল্লেখ করেন।

ফিরোজ শাহ তুঘলকের রাজনৈতিক দিক

আসলে উলেমাশ্রেণীর সমর্থন এবং খলিফার স্বীকৃতিপত্র ফিরোজের পক্ষে ভয়ানক দরকারি ছিল। ধর্মীয় কারণ অপেক্ষা ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক কারণে তিনি এই দুইটি বিষয়ের ওপর জোর দেন।

বিশেষ প্রয়োজন

  • (১) ফিরোজ জানতেন যে তাঁর মাতা ছিলেন হিন্দু রাজপুত রমনী। তাঁর দেহে বিশুদ্ধ মুসলিম রক্ত না থাকায় তাঁর অপেক্ষা মৃত সুলতান মহম্মদের নিকট আত্মীয়দের সিংহাসনের দাবী জোরালো ছিল।
  • (২) তিনি না ছিলেন যুদ্ধ বিশারদ সেনাপতি, না ছিলেন মৃত সুলতানের রক্ত সম্পর্কের দিক থেকে নিকট আত্মীয়। সেক্ষেত্রে তাঁর সিংহাসনের দাবীকে জোরালো করার জন্য উলেমাদের সমর্থন এবং খলিফার স্বীকৃতিপত্র ছিল তার কাছে বিশেষ মূল্যবান।

ফিরোজ শাহ তুঘলকের নীতি প্রতিষ্ঠা

ফিরোজের সিংহাসন লাভ, এই নীতির প্রতিষ্ঠা করে যে, সিংহাসন পেতে হলে সামরিক দক্ষতা না থাকলেও চলে। যদি অভিজাত ও উলেমাদের সমর্থন পাওয়া যায়, তবে শাসনগত দক্ষতা না থাকলেও শান্তিপূর্ণভাবে রাজত্ব করা যায়। এজন্য শুধু দুটি ব্যবস্থা দরকার – মুসলিম বুদ্ধিজীবি বা উলেমাদের সমর্থন লাভ এবং অভিজাতদের দুর্নীতি ও স্বার্থে আঘাত না করা।

নিজামীর অভিমত

ডঃ নিজামীর মতে, ফিরোজের শাসনকাল এই দুই শক্তিশালী শ্রেণীর প্রতি তোষণ নীতির দ্বারা চিহ্নিত ছিল। ডঃ আর. পি. ত্রিপাঠীও এই মত পোষণ করেন।

ফিরোজ শাহ তুঘলকের উদাসীন থাকার নীতি

ইনশা-আইন-ই-মহরু থেকে জানা যায় যে, ফিরোজের শাসনকালে হিন্দু মুসলিম উভয় শ্রেণীর অভিজাত বহু দুর্নীতি শুরু করে। ইক্তাগুলিকে বংশানুক্রমিক জাগীরে পরিণত করে। রাজস্ব সংগ্রহ করে কর ফাঁকি দেয়। কিন্তু সুলতান বিরোধীতার ভয়ে এ বিষয়ে উদাসীন থাকা তার বিশেষ নীতি হিসেবে বেছে নেন।

ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসন নিকৃষ্ট দুর্নীতির যুগ

যদিও ফিরোজের শাসন ব্যবস্থা ছিল উদার এবং তার আমলে সাম্রাজ্য-এ শান্তি ছিল, কিন্তু তাঁর শাসনকালকে সুলতানি যুগে শাসন ব্যবস্থার নিকৃষ্ট দুর্নীতির যুগ বলা যায়। ফিরোজ এই নিষ্ক্রিয় উদার নীতির জন্য জনপ্রিয়তা পান।

উপসংহার :- ফিরোজের এই রাজতান্ত্রিক ফলাফল বিচার করে ডঃ আর. পি. ত্রিপাঠী মন্তব্য করেছেন যে, “যে গুণগুলির জন্য ফিরোজ জনপ্রিয়তা পান, সেই গুণগুলি পরিণামে দিল্লীর সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের কারণ হিসেবে কাজ করে।” এটাই ছিল ফিরোজের অনিবার্য নিয়তি।

(FAQ) ফিরোজ শাহ তুঘলকের রাজতান্ত্রিক আদর্শ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কার মতে ফিরোজ শাহ ধর্মাশ্রিত রাজতন্ত্রের আদর্শ প্রবর্তন করেন?

আর সি মজুমদার।

২. খুৎবা পাঠে নিজের নাম পূর্ববর্তী সুলতানদের সঙ্গে উল্লেখ করেন কে?

ফিরোজ শাহ তুঘলক।

৩. ফিরোজ শাহ তুঘলক তার বৈধতার প্রধান দলিল বলে কাকে উল্লেখ করেন?

খলিফার স্বীকৃতিপত্রকে।

৪. সুলতানী যুগের আকবর কাকে বলা হয়?

ফিরোজ শাহ তুঘলক।

Leave a Comment