জাতীয় কংগ্রেসের সুরাট বিচ্ছেদ -এর সময়কাল, আদর্শগত বিচ্ছেদ স্বদেশী আন্দোলনের নেতৃত্ব, স্বদেশী ও বয়কটের প্রয়োগ, কলকাতা কংগ্রেস, বারাণসী কংগ্রেস, স্বরাজ বিষয়ে মতপার্থক্য, সুরাট অধিবেশন, গোলমাল ও ভাঙচুর, সুরাট বিচ্ছেদ, সুরাট বিচ্ছেদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে জানবো।
সুরাট বিচ্ছেদ প্রসঙ্গে কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশন, কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনের সময়কাল, কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনের স্থান, কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনে সভাপতি, সুরাট অধিবেশনে ভাঙচুর ও গোলমাল, সুরাট বিচ্ছেদ, সুরাট বিচ্ছেদের গুরুত্ব ও সুরাট বিচ্ছেদের তাৎপর্য সম্পর্কে জানব।
সুরাট বিচ্ছেদ (১৯০৭ খ্রিঃ)
ঐতিহাসিক ঘটনা | সুরাট বিচ্ছেদ |
সময়কাল | ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দ |
স্থান | গুজরাটের সুরাট শহর |
সভাপতি | রাসবিহারী ঘোষকে সভাপতি |
ফলাফল | কংগ্রেসের নরমপন্থী ও চরমপন্থী দলের বিচ্ছেদ |
ভূমিকা :- জাতীয় কংগ্রেসে নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মতাদর্শ ও কর্মপন্থার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য ছিল। উনিশ শতকের নয়ের দশক থেকে নরমপন্থী ভাবধারা ও নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠতে শুরু করে। অরবিন্দ ঘোষ ‘ইন্দুপ্রকাশ’ পত্রিকায় নরমপন্থীদের নির্মম সমালোচনা করে ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’-কে ‘ভারতীয় বিজাতীয় কংগ্রেস’ (‘Indian Un-National Congress’) বলে অভিহিত করেন।
নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের আদর্শগত বিচ্ছেদ
দুই গোষ্ঠীর আদর্শগত বিচ্ছেদ অনিবার্য ছিল এবং জাতীয় কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশন ছিল এরই অনিবার্য পরিণতি।
স্বদেশী আন্দোলনের নেতৃত্ব
আন্দোলনের সূচনায় নেতৃত্ব ছিল নরমপন্থী সুরেন্দ্রনাথ -এর হাতে, কিন্তু ক্রমে নরমপন্থীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন এবং চরমপন্থী বিপিনচন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হন।
‘স্বদেশী’ ও ‘বয়কট’ -এর প্রয়োগ
স্বদেশী আন্দোলনকালে দুই মতাদর্শের মধ্যে বিরোধ প্রকট হয়ে ওঠে। দু’পক্ষই স্বদেশী ও বয়কটের পক্ষে থাকলেও তাদের পরিধি, সীমানা বা প্রয়োগ ক্ষেত্র নিয়ে তাঁদের মধ্যে বিরোধ ছিল। যেমন-
- (১) নরমপন্থীরা ‘স্বদেশী’ ও ‘বয়কটের’ আদর্শকে কেবলমাত্র বাংলার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে, চরমপন্থীদের লক্ষ্য ছিল সারা ভারতে এই দুই অস্ত্রের সম্প্রসারণ।
- (২) ‘বয়কট‘ বলতে নরমপন্থীরা বুঝতেন বিলিতি পণ্যাদি বর্জন। অন্যদিকে, চরমপন্থীরা বুঝতেন বিদেশি পণ্যের সঙ্গে বিদেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিচার ব্যবস্থা, পৌরসভা ও সরকারকে বর্জন করা।
বারাণসী কংগ্রেস
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের বারাণসী অধিবেশনে ‘বয়কট’-এর প্রয়োগ নিয়ে দুই দলে বিরোধ বাধে। পরবর্তীকালে এই বিরোধ ক্রমশ বৃদ্ধি পায়।
কলকাতা কংগ্রেস
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে এই বিরোধ চাপা দেবার উদ্দেশ্যে দাদাভাই নওরোজি-কে সভাপতি করা হয়। জাতীয় কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে তিনিই প্রথম ঘোষণা করেন যে, ‘স্বরাজ’ লাভই হল জাতীয় কংগ্রেসের উদ্দেশ্য।
স্বরাজ বিষয়ে মতপার্থক্য
‘স্বরাজ’ কথার অর্থ নিয়েও দুই গোষ্ঠীর মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। ‘স্বরাজ’ বলতে নরমপন্থীরা বুঝতেন ইংরেজের অধীনে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্বশাসন। অন্যদিকে, চরমপন্থীরা বুঝতেন ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণমুক্ত পূর্ণ স্বাধীনতা।
সুরাট অধিবেশন
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে নরমপন্থীদের শক্ত ঘাঁটি সুরাটে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন বসে। পরিস্থিতি এমনিতেই উত্তেজক ছিল। এই অধিবেশনে নরমপন্থীরা রাসবিহারী ঘোষকে সভাপতি করতে চাইলে বিবাদ শুরু হয়।
সুরাট অধিবেশনে ভাঙচুর ও গোলমাল
উত্তেজিত নরমপন্থী প্রতিনিধিদের হাতে মঞ্চের ওপর বিবাদে লিপ্ত বাল গঙ্গাধর তিলক নিগৃহীত হন, সুরেন্দ্রনাথ ও ফিরোজ শাহ মেহতার গায়ে চটির আঘাত লাগে। সভাস্থলে টেবিল, চেয়ার, লাঠি ও জুতো ছোঁড়াছুড়ি চলতে থাকে। সভায় প্রচণ্ড ভাঙ্গচুর ও গোলমাল হয়।
সুরাট বিচ্ছেদ
পুলিশ এসে প্যাণ্ডেল ফাঁকা করে দেয়। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনে এই ঘটনার পর চরমপন্থীরা কংগ্রেস থেকে বিতাড়িত হন। এই ঘটনা ‘সুরাট বিচ্ছেদ’ নামে খ্যাত।
সুরাট বিচ্ছেদের গুরুত্ব
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের সুরাট অধিবেশন এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা।
- (১) শ্রীমতী অ্যানি বেশান্ত বলেন যে, “কংগ্রেসের ইতিহাসে সুরাটের ঘটনা সর্বাপেক্ষা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা।”
- (২) সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন যে, সুরাটের ঘটনার ফলে জাতীয় কংগ্রেসের ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায়ের অবসান এবং এক নতুন যুগের সূচনা হয়।
- (৩) এই ঘটনার ফলে কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসে পড়ে এবং এই মহান সংগঠনের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত হয়।
- (৪) এই ঘটনার পূর্বে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে গোপালকৃষ্ণ গোখলে লেখেন যে, “ভাঙ্গন হলে তার অর্থ হবে বিপর্যয়। কারণ,আমলাতন্ত্রের পক্ষে উভয় অংশকে দমন করা খুব কঠিন হবে না।”
- (৫) এই ঘটনায় তিলক খুবই মর্মাহত হন এবং একে বিপর্যয়’(‘Catastrophe’) বলে অভিহিত করেন। তিনি ও অরবিন্দ ঘোষ কংগ্রেসের ঐক্য ফিরিয়ে আনতে চাইলেও, ফিরোজ শাহ মেহতা ও অন্যান্য নরমপন্থী নেতাদের অনমনীয় মনোভাবের ফলে তা সম্ভব হয় নি।
- (৬) বড়লাট মিন্টো (Minto) এই ঘটনায় খুব খুশি হন, কারণ দ্বিখণ্ডিত জাতীয় কংগ্রেস যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়বে। এছাড়া, নরমপন্থীদের নিয়ন্ত্রণ করাও সরকারের পক্ষে অধিকতর সহজ ছিল।
- (৭) তিনি ভারত সচিব মর্লে (Morley) কে লেখেন যে, “কংগ্রেসের বিচ্ছেদ আমাদের পক্ষে এক বিরাট জয়।”
সুরাট বিচ্ছেদের তাৎপর্য
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ।
- (১) জাতীয় কংগ্রেসের বিভাজনের ফলে জাতীয় আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ সরকার এরপর নরমপন্থীদের মদত দিয়ে চরমপন্থীদের থেকে দুরে রাখার কৌশল গ্রহণ করে যাতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সক্রিয় হয়ে উঠতে না পারে।
- (২) এই বিভাজনের ফলে নরমপন্থীদের প্রাধান্য হ্রাস পায় এবং চরমপন্থীদের নেতৃত্বে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন সংগঠিত হয়।
- (৩) সুরাট বিভাজনের ফলে নরমপন্থী নেতৃত্ব কংগ্রেসে তরুণ সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হন।
- (৪) চরমপন্থী নেতৃবৃন্দের পরিচালনায় সংগ্রামী জাতীয়তাবাদ এক সুনির্দিষ্ট ভাবধারায় পরিণত হয়।এর একটি হল নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ বা স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলন, অন্যটি হল সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন।
উপসংহার :- ভারত সচিব জন মর্লে কংগ্রেসের সুরাট বিচ্ছেদের মধ্যে চরমপন্থীদের জয়ই লক্ষ্য করেছেন। তাঁর মতে, অচিরেই জাতীয় কংগ্রেস একটি চরমপন্থী সংগঠনে পরিণত হবে।
(FAQ) সুরাট বিচ্ছেদ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে সুরাটে জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন বসলে নরমপন্থী ও চরমপন্থী গোষ্ঠীর মধ্যে মত বিরোধ চরম পর্যায়ে পৌঁছায়।শেষ পর্যন্ত চরমপন্থী গোষ্ঠী অধিবেশন ছেড়ে চলে যায়।এই ঘটনা সুরাট বিচ্ছেদ নামে পরিচিত।
গুজরাটের সুরাট শহরে।
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে।
রাসবিহারী ঘোষ।
কংগ্রেসের নরমপন্থী ও চরমপন্থী দলের বিচ্ছেদ।