প্রাচীন ভারতের বিদুষী নারী সুপ্রিয়া

প্রাচীন ভারতের বিদুষী নারী সুপ্রিয়া প্রসঙ্গে সুপ্রিয়ার জন্মগৌরব, বিদ্যানুরাগিনী সুপ্রিয়া, সুপ্রিয়ার বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা, সেবাধর্মে সুপ্রিয়ার আত্মনিয়োগ, দুর্ভিক্ষের সময় সুপ্রিয়ার অবদান, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় সুপ্রিয়া, সুপ্রিয়া কর্তৃক ভিক্ষান্নদ্বারা বসুধা রক্ষা, সুপ্রিয়া কর্তৃক গৌতম বুদ্ধ ও তার শিষ্যদের অন্ন সেবা ও সুপ্রিয়ার পূর্বজন্ম সম্পর্কে জানবো।

ভারতের বিদুষী নারী সুপ্রিয়া প্রসঙ্গে সুপ্রিয়ার জন্ম কাহিনী, সুপ্রিয়ার বিদ্যানুরাগ, বৌদ্ধ ধর্মে সুপ্রিয়ার দীক্ষা, সুপ্রিয়ার সেবাধর্মে আত্মনিয়োগ, সুপ্রিয়ার দুর্ভিক্ষে অবদান, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় সুপ্রিয়া, সুপ্রিয়া কর্তৃক গৌতম বুদ্ধ ও তার শিষ্যদের অন্ন সেবা সম্পর্কে জানব।

প্রাচীন ভারতের বিদুষী নারী সুপ্রিয়া

ঐতিহাসিক চরিত্রসুপ্রিয়া
পরিচিতিবৌদ্ধ ভিক্ষুণী
পিতাঅনাথপিণ্ডদ
বৌদ্ধ ধর্ম -এ দীক্ষিতমহাপ্রজাপতি গৌতমী
বিশেষ খ্যাতিসেবাধর্ম
প্রাচীন ভারতের বিদুষী নারী সুপ্রিয়া

ভূমিকা :- অনাথপিণ্ডদ -এর নাম বৌদ্ধশাস্ত্রে সুবিখ্যাত। এর প্রকৃত নাম সুদত্ত। একদিকে যেমন ছিল তাঁর অতুল ঐশ্বর্য, তেমনই ছিল তাঁর সমাজে সম্মান ও প্রতিপত্তি। সুদত্তের দানশীলতার সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধদেবের প্রতি অসাধারণ ভক্তি ছিল। দীন নরনারীর সাহায্য ও আশ্রয় দানের জন্য তিনি অনাথপিণ্ডদ নামে অভিহিত হয়েছিলেন। সুপ্রিয়া ছিলেন এই বণিক শ্রেষ্ঠ অনাথপিণ্ডদ -এর কন্যা।

সুপ্রিয়ার জন্মগৌরব

সুপ্রিয়া পুণ্যবান অনাথপিণ্ডদ -এর গৃহে জন্মগ্রহণ করে শ্রেষ্ঠি পরিবারকে যশোগৌরবমণ্ডিত করে গিয়েছেন।

বিদ্যানুরাগিণী সুপ্রিয়া

  • (১) শৈশব থেকেই সুপ্রিয়া বিদ্যানুরাগিণী ছিলেন। যখন তিনি সাত বছরের বালিকামাত্র সেই সময়ে অনাথপিণ্ডদ-এর গৃহে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু ভিক্ষার্থে উপস্থিত হয়েছিলেন। কথাপ্রসঙ্গে সেই সুপণ্ডিত ভিক্ষু বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে নানা কথার আলোচনা করেন।
  • (২) বালিকা সুপ্রিয়া বৌদ্ধভিক্ষুর নিকট বৌদ্ধধর্ম বিষয়ক সেই সকল সারগর্ভ উপদেশাবলী শ্রবণ করে এতদূর অভিভূতা হলেন যে, তিনি বালিকা বয়সেই সংসার ত্যাগ করে মঠে গমন পূর্বক বিদ্যালাভের জন্য সমুৎসুকা হলেন।
  • (৩) অনাথপিণ্ডদ কন্যাকে এত অল্প বয়সে সংসারত্যাগিনী হয়ে বৌদ্ধমঠে গিয়ে জ্ঞানার্জন করা সঙ্গত নয়, এই কথা বুঝাবার জন্য অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু সুপ্রিয়ার প্রাণে জ্ঞানোপার্জনস্পৃহা এতদূর প্রবল হয়েছিল যে, তিনি কিছুতেই নিরস্ত হতে চাইলেন না।

সুপ্রিয়ার বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা

অনাথপিণ্ডদ শেষে বাধ্য হয়ে কন্যাকে অনুমতি প্রদান করলেন। মহাপ্রজাপতী গৌতমী তাকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা দিলেন। এইভাবে সুপ্রিয়া ভিক্ষুণী ব্রত গ্রহণ করে কঠোর তপ ও সাধনা দ্বারা একদিকে জ্ঞানোপার্জন ও অন্যদিকে ধর্মোপার্জন করতে লাগলেন।

সেবাধর্মে সুপ্রিয়ার আত্মনিয়োগ

  • (১) কিছুকাল পরেই অসাধারণ সাধনাবলে তিনি ‘অর্হতী’ পদবী লাভ করেছিলেন। আমাদের দেশ ভারতবর্ষ-এ বৌদ্ধযুগ হতেই বিশেষভাবে সেবাধর্মের প্রচার হয়েছিল। সে যুগে নারীগণের নিকট সেবাধর্ম অতি শ্রেষ্ঠ ধর্মের আদি বলে বিবেচিত হত। সুপ্রিয়া জ্ঞান ও বিদ্যা অর্জন করে সেবাধর্মে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
  • (২) যেখানে রুগ্ন, যেখানে বিপন্ন, যেখানে দুর্ভিক্ষক্লিষ্ট নরনারী ব্যাধির বেদনায় এবং রোগযন্ত্রণায় হাহাকার করত, সেখানেই সুপ্রিয়া প্রাণভরা মমতা নিয়ে অগ্রসর হতেন, তাদের সেবা করতেন। দুর্ভিক্ষক্লিস্ট নরনারীকে অন্নদান করে তাদেরকে মৃত্যুমুখ হতে রক্ষা করতেন। এই সকল হতভাগ্য নরনারীর দুঃখদৈন্য দূর করবার জন্য তিনি দ্বারে দ্বারে ভিক্ষাপাত্র হাতে ভিক্ষা করতেন।
  • (৩) যে অনাথপিণ্ডদ অতুল ধনসম্পদের অধিকারী মহাবিজ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন, তার কন্যা হয়েও এই মনস্বিনী নারী নিজেকে ত্যাগের পুণ্যধারায় প্লাবিত করে ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়েছিলেন জনসেবার উদ্দেশ্যে। তাঁর এই দান বহুলোকের প্রাণরক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিল।

দুর্ভিক্ষের সময় সুপ্রিয়ার অবদান

একবার দেশে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হল। দেশের চারিদিকে হাহাকার পড়ে গেল। অনাহারে শত শত লোক প্রাণ দিতে লাগল। সেই সময়ে সুপ্রিয়া যেভাবে দুঃখদৈন্য দূর করবার জন্য আত্মশক্তি নিয়োগ করেছিলেন তা আশ্চর্য বলতে হবে। তিনি সেবার ও ভিক্ষালব্ধ অন্নের দ্বারা বহু দুর্ভিক্ষপীড়িত নরনারীর জীবন বাঁচিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের কবিতায় সুপ্রিয়া

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘নগরলক্ষ্মী’ কবিতায় সুপ্রিয়ার জনসেবার মধুর অনবদ্য চিত্রটি অঙ্কন করে বাঙ্গালী পাঠক পাঠিকার চিত্তে সুপ্রিয়ার বদান্যতার কথা অমর করে রেখেছেন।

সুপ্রিয়া কর্তৃক ভিক্ষান্নদ্বারা বসুধা রক্ষা

‘কল্পদ্রুমাবদানে’ সুপ্রিয়ার অন্নদান-চিত্রটি বর্ণিত আছে। সত্য সত্যই সেই দারুণ দুর্ভিক্ষে ভিক্ষুণী সুপ্রিয়া ভিক্ষান্নদ্বারাই বসুধা রক্ষা করেছিলেন।

সুপ্রিয়া কর্তৃক গৌতম বুদ্ধ ও তার শিষ্যদের অন্ন সেবা

  • (১) কিছুকাল পরে বুদ্ধদেব শ্রাবস্তী হতে রাজগৃহে যাচ্ছিলেন। সেই সময়ে তিনি শিষ্যগণ-সহ এক নিবিড় অরণ্যমধ্যে এসে পড়লেন। সেই নিবিড় বনের মধ্যে খাদ্যের সংস্থান হওয়া ছিল সম্পূর্ণ অসম্ভব। কোনরূপে সুপ্রিয়া জানতে পারলেন যে, অরণ্যমধ্যে বুদ্ধদেবের শিষ্যেরা খাদ্যাভাবে ক্লেশ পাচ্ছেন।
  • (২) সুপ্রিয়া তৎক্ষণাৎ সেই নিবিড় অরণ্যমধ্যে গমন করে শিষ্যদিগের খাদ্যাভাবক্লেশ দেখতে পেলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ নগরমধ্যে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং ভিক্ষাপাত্র হাতে পথে ভিক্ষার্থে বার হলেন।
  • (৩) একপাত্র অন্ন ভিক্ষা করে সুপ্রিয়া পুনরায় অরণ্যমধ্যে গমন করে সেই একপাত্র অন্ন দ্বারা বুদ্ধদেবের শত শত শিষ্যকে পরম পরিতোষের সাথে ভোজন করালেন। সকলের তৃপ্তিসহকারে ভোজন শেষ হলে যোগবলদ্বারা ভিক্ষাপাত্র অমৃতরসে পূর্ণ করছ, সকল শিষ্যকে পান করিয়েছিলেন।

বুদ্ধদেব কর্তৃক সুপ্রিয়ার পূর্বজন্ম বৃত্তান্ত প্রকাশ

  • (১) সুপ্রিয়ার অসাধারণ জনসেবা এবং অলৌকিক শক্তি দেখে একদিন কথা প্রসঙ্গে বুদ্ধদেবের প্রধান শিষ্য আনন্দ এর কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তাতে বুদ্ধদেব বলেছিলেন পূর্বজন্মে সুপ্রিয়া বারাণসীধামে একজন ধনী বণিকের গৃহের পরিচারিকা ছিলেন। একদিন প্রভুর জন্য সুমিষ্ট পিষ্টক নিয়ে পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন, এমন সময় কাশ্যপ এক গৃহস্থের বাড়ীতে ভিক্ষার জন্য যাচ্ছিলেন।
  • (২) তখন পরিচারিকা কোনরূপ ইতস্ততঃ না করে কাশ্যপকে দেখামাত্র তাঁর হাতের পিষ্টক প্রদান করলেন। কাশ্যপ পরিচারিকার এইরূপ বদান্যতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং তাঁকে অত্যন্ত যত্নের সাথে ধর্ম উপদেশ দিয়েছিলেন। পরিশেষে সেই পরিচারিকা কাশ্যপের নিকট বৌদ্ধধর্মে দীক্ষালাভ করে নির্বাণপথের পথিক হয়েছিলেন।

উপসংহার  :- পূর্বজন্মের সেই পরিচারিকাই এই জন্মের অনাথপিওদ-এর কন্যা সুপ্রিয়া। পূর্বজন্মের সুকৃতির ফলেই সে এইরূপ অসামান্য প্রতিভা, বদান্যতা ও বৈরাগ্যের পরিচয় দিয়েছেন।

(FAQ) প্রাচীন ভারতের বিদুষী নারী সুপ্রিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সুপ্রিয়া কে ছিলেন?

একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুণী।

২. সুপ্রিয়ার পিতা কে ছিলেন?

বণিক শ্রেষ্ঠ অনাথপিণ্ডদ।

৩. সুপ্রিয়া কার কাছে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন?

মহাপ্রজাপতি গৌতমী।

৪. কোন কাজে সুপ্রিয়া যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন?

সেবাধর্ম।

Leave a Comment