৫০৯-৩১ খ্রিস্টপূর্বে প্রজাতন্ত্রের যুগে রোম প্রসঙ্গে রোমে প্যাট্রিসিয়ান-প্লেবিয়ান দ্বন্দ্ব, রোমে সাংবিধানিক পরিবর্তন, ইতালিতে রোমের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা, রোমে শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন, রোমের শাসনব্যবস্থায় সেনেটের ক্ষমতা, রোমে জনসাধারণের তিনটি সভার অস্তিত্ব, রোম ও কার্থেজ সংঘাত-পিউনিক যুদ্ধ ও রোম-ম্যাসিডন যুদ্ধ সম্পর্কে জানব।
খ্রিস্টপূর্ব কালে প্রজাতন্ত্রের যুগে রোম
ঐতিহাসিক ঘটনা বা গল্প | প্রজাতন্ত্রের যুগে রোম |
সময়কাল | খ্রি.পূ. ৫০৯-খ্রি.পূ. ৩১ অব্দ |
প্রথম পিউনিক যুদ্ধ | খ্রি.পূ. ২৬৪-খ্রি.পূ. ২৪১ অব্দ |
দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধ | খ্রি.পূ. ২১৮-খ্রি.পূ. ২০১ অব্দ |
তৃতীয় পিউনিক যুদ্ধ | খ্রি.পূ. ১৪৯-খ্রি.পূ. ১৪৬ অব্দ |
প্রথম রোম-ম্যাসিডন যুদ্ধ | খ্রি.পূ. ২১৫-খ্রি.পূ. ২০৫ অব্দ |
দ্বিতীয় রোম-ম্যাসিডন যুদ্ধ | খ্রি.পূ. ২০০-খ্রি.পূ. ১৯৭ অব্দ |
তৃতীয় রোম-ম্যাসিডন যুদ্ধ | খ্রি.পূ. ১৭১-খ্রি.পূ. ১৬৮ অব্দ |
চতুর্থ রোম-ম্যাসিডন যুদ্ধ | খ্রি.পূ. ১৪৮-খ্রি.পূ. ১৪৬ অব্দ |
ভূমিকা :- রোম-এর শেষ রাজা লুসিয়াস টারকুইনিয়াস সুপারবাসকে সিংহাসনচ্যুত করার মাধ্যমে খ্রিস্টপূর্ব ৫০৯ অব্দ নাগাদ রোমে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায় ৫০০ বছর ধরে রোমে এই শাসনব্যবস্থা চালু ছিল। এই ব্যবস্থায় রাজার পরিবর্তে শাসনভার দেওয়া হত দুজন নির্বাচিত ম্যাজিস্ট্রেটকে। এই ম্যাজিস্ট্রেটরা পরিচিত ছিলেন কনসাল নামে। প্রথম দুজন কনসাল হলেন লুসিয়াস জুনিয়াস ব্রুটাস, যিনি প্রজাবিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং লুসিয়াস টারকুইনিয়াস কোলাটিনাস। কনসালরা এক বছরের জন্য নিযুক্ত হতেন।
প্রজাতন্ত্রের যুগে রোমে প্যাট্রিসিয়ান-প্লেবিয়ান দ্বন্দ্ব
রোমের সমাজে অভিজাত প্যাট্রিসিয়ান এবং অনভিজাত প্লেবিয়ানদের অস্তিত্ব ছিল। কনসাল হিসেবে সাধারণত প্যাট্রিসিয়ানরাই নিযুক্ত হতেন। নানা কারণে এঁরা পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় এবং উভয়ের মধ্যে কয়েকটি যুদ্ধও সংঘটিত হয়। এগুলিতে বিনা রক্তপাতে প্লেবিয়ানরা জয়ী হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে প্যাট্রিসিয়ান ও প্লেবিয়ানদের দ্বন্দ্ব ছিল নিয়মতান্ত্রিক। ঐতিহাসিক ফিশার বলেছেন যে, সামাজিক চাপে ক্রমাগত পরিবর্তনকে দক্ষতার সাথে মানিয়ে চলে এবং মানুষের কর্তব্যবোধকে গভীরভাবে জাগ্রত করে রোমান প্রজাতন্ত্র ধীরে ধীরে সংবিধানের বিকাশ ঘটিয়েছিল।
প্রজাতন্ত্রের যুগে রোমে সাংবিধানিক পরিবর্তন
এই সময়কালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল, প্লেবিয়ানদের চাপে রোমের আইন সংস্কার ও লিপিবদ্ধকরণ। রোমে প্রচলিত আইনগুলির কোনো লিখিত বিধান না থাকায় প্রায়শই এগুলির অপপ্রয়োগ ঘটত। এই কারণে খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৯ অব্দে দশজনের (পরে বারোজন) একটি গোষ্ঠী রোমের প্রধান প্রধান আইনগুলিকে বারোটি প্রস্তর খণ্ডের (Tablets) ওপর খোদাই করে। এই আইনবিধি দ্বাদশ বিধান (The Code of Twelve Tables) নামে পরিচিত। এটি ছিল রোমান প্রজাতন্ত্রের প্রথম লিখিত আইনবিধি।
ইতালিতে রোমের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা
প্রজাতন্ত্রের যুগে প্রায় সমগ্র ইতালি রোমান প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রজাতান্ত্রিক বাহিনী খ্রিস্টপূর্ব ৪০৫ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৬ অব্দের মধ্যে এট্রুস্কানদের এট্রুরিয়া দখল করে। ‘ভেই’ নগরীও রোমানদের হস্তগত হয়। এপ্রেনিন পার্বত্য জাতি সামনাইটদের যুদ্ধে পরাজিত করে ইতালির বিস্তীর্ণ অঞ্চল অধিকার করে। ফলে ইতালিতে রোমের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
রোমে প্রজাতন্ত্রের যুগে শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন
প্রজাতন্ত্রের আমলে রোমে শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়। এই শাসনব্যবস্থাকে পলিবিয়াস মিশ্র শাসনব্যবস্থা রূপে অভিহিত করেছেন। কারণ এই শাসনব্যবস্থায় ম্যাজিস্ট্রেটরা রাজতন্ত্র, সেনেটের সদস্যরা অভিজাততন্ত্র এবং জনসাধারণের পরিষদ গণতন্ত্রে আস্থাশীল হয়ে উঠেছিল। শাসনব্যবস্থায় ম্যাজিস্ট্রেট তথা কনসালরাই ছিলেন সর্বেসর্বা। তাঁদের সাহায্য করতেন হভাইল (পূর্ত বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত), কোয়েস্টার (রাজস্ব বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত), সেনসর (রাজস্ব বা কর তালিকা প্রণয়নকারী), ট্রিবিউন (প্লেবিয়ানদের স্বার্থরক্ষাকারী) প্রমুখ কর্মচারীরা।
প্রজাতন্ত্রের যুগে রোমে সেনেটের ক্ষমতা
শাসনব্যবস্থার শীর্ষে ‘কনসাল’ থাকলেও রোমের শাসনব্যবস্থায় সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিল সেনেট। প্রচলিত রীতিনীতি ও আইনের ভিত্তিতে ‘সেনেট’ এই ক্ষমতা অর্জন করেছিল।
রোমে প্রজাতন্ত্রের যুগে জনসাধারণের তিনটি সভার অস্তিত্ব
এসময় রোমে জনসাধারণের তিনটি সভার অস্তিত্ব দেখা যায়। যথা- কমিসিয়া কিউরিয়াটা (প্যাট্রিসিয়ানদের), কমিসিয়া সেঞ্চুরিয়াটা (প্যাট্রিসিয়ান ও প্লেবিয়ানদের) এবং কমিসিয়া ট্রিবিউটা (প্লেবিয়ানদের)।
প্রজাতন্ত্রের যুগে রোম ও কার্থেজ সংঘাত-পিউনিক যুদ্ধ
এই সময়ের রোমের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল পিউনিক যুদ্ধ। এই শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধ হয়েছিল তিনটি পর্যায়ে। এগুলি হল – প্রথম পিউনিক যুদ্ধ (খ্রি.পূ. ২৬৪ অব্দ-খ্রি.পূ. ২৪১ অব্দ), দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধ (খ্রি.পূ. ২১৮ অব্দ খ্রি.পূ. ২০১ অব্দ) এবং তৃতীয় পিউনিক যুদ্ধ (খ্রি.পূ. ১৪১ অব্দ-খ্রি.পৃ. ১৪৬ অব্দ)। কার্থেজীয়রা জাতিতে ফিনিশীয় ছিল। ল্যাটিন জাতি ফিনিশীয়কে ‘পুনি’ উচ্চারণ করত। এই ‘পুনি’ থেকে পিউনিক শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়।
(১) প্রজাতন্ত্রের যুগে প্রথম পিউনিক যুদ্ধ
রোম প্রথমে ইতালিতে আধিপত্য বিস্তার করে এবং এরপর ভূমধ্যসাগরের অপর পারে অবস্থিত কার্থেজ নগরীর দুর্ধর্ষ ফিনিশীয় বণিকদের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলে প্রথম পিউনিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল এবং নৌশক্তিতে বলীয়ান কার্থেজের সঙ্গে রোমের এই যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধের প্রধান বিষয় ছিল সিসিলি দ্বীপে অধিকার প্রতিষ্ঠা। এই যুদ্ধে সেনাপতি হ্যামিলকার বার্কা-র নেতৃত্বে কার্থেজ রোমের কাছে পরাজিত হয়। অবশেষে রোম-কার্থেজ সন্ধির মাধ্যমে এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।
(২) প্রজাতন্ত্রের যুগে দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধ
খ্রিস্টপূর্ব ২১৮ অব্দ নাগাদ রোমের সঙ্গে কার্থেজের দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধের কারণ ছিল কার্থেজের স্যাগানটাম জয় ও ভূমধ্যসাগরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত দ্বন্দ্ব। এই কারণে কার্থেজের সেনাপতি হ্যানিবল রোম অভিযান করেন। খ্রিস্টপূর্ব ২০২ অব্দে জামা-র যুদ্ধে (Battle of Zama) হ্যানিবল পরাজিত হলে দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধ শেষ হয়। এর ফলে রোমান সেনাপতি পারিয়াস কর্নেলিয়াস সিপিও ‘আফ্রিকানাস’ উপাধি লাভ করেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কার্থেজ-রোম সন্ধি হয়। এই যুদ্ধে জয়লাভ রোমের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক পরিবর্তনের সূচনা করে। রোমে সেনেটের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের প্রধান আর্থিক ও বাণিজ্যিক শক্তিরূপে রোম আত্মপ্রকাশ করে।
(৩) প্রজাতন্ত্রের যুগে তৃতীয় পিউনিক যুদ্ধ
খ্রিস্টপূর্ব ১৪৯ অব্দে সংঘটিত তৃতীয় পিউনিক যুদ্ধে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটে এবং রোম কার্থেজ জ্বালিয়ে দেয়। এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া মাইনরের বিস্তীর্ণ এলাকায় রোমের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রজাতন্ত্রের যুগে সংঘটিত পিউনিক যুদ্ধের গুরুত্ব
রোম এবং কার্থেজের মধ্যে এই সংঘর্ষ কেবল যে দুটি রাষ্ট্রের শক্তি পরীক্ষার দ্বন্দ্ব তা বলা যায় না। কেন-না এই সংঘর্ষের মূল কথা ছিল প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে নতুন বা নবজাগ্রত সভ্যতার বিরোধ এবং শেষ পর্যন্ত নতুনেরই জয় হয়েছিল। অনেকে আবার এই যুদ্ধকে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের দ্বন্দ্ব বলেও অভিহিত করেছেন। কার্থেজের পতনের পর রোমের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। সমগ্র ভূমধ্যসাগরের উপর রোমের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম হয়। শুধু তাই নয় ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা তিন মহাদেশ জুড়ে রোম এক বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল।
প্রজাতন্ত্রের যুগে রোম-ম্যাসিডন যুদ্ধ
কার্থেজের বিরুদ্ধে পিউনিক যুদ্ধের পাশাপাশি রোমানরা ম্যাসিডনের বিরুদ্ধে চারটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এক্ষেত্রে যুদ্ধের কারণ ছিল পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা।
(১) প্রজাতন্ত্রের যুগে প্রথম রোম-ম্যাসিডন যুদ্ধ
প্রথম রোম-ম্যাসিডন যুদ্ধ (খ্রি.পূ. ২১৫ অব্দ খ্রি.পূ. ২০৫ অব্দ) শেষ হয় ম্যাসিডনরাজ ফিলিপের সাথে এটোলিয়ানদের সন্ধির মাধ্যমে। এই যুদ্ধে কোনো পক্ষই চূড়ান্ত জয়লাভ করেনি।
(২) প্রজাতন্ত্রের যুগে দ্বিতীয় রোম-ম্যাসিডন যুদ্ধ
দ্বিতীয় রোম-ম্যাসিডন যুদ্ধে (খ্রি.পূ. ২০০ অব্দ খ্রি.পূ. ১৯৭ অব্দ) রোমানরা জয়লাভ করে। ফলে গ্রিকদের সঙ্গে রোমানদের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
(৩) প্রজাতন্ত্রের যুগে তৃতীয় ও চতুর্থ রোম-ম্যাসিডন যুদ্ধ
তৃতীয় (খ্রি.পূ. ১৭১ অব্দ খ্রি.পূ. ১৬৮ অব্দ) ও চতুর্থ রোম-ম্যাসিডন যুদ্ধে (খ্রি.পূ. ১৪৮ অব্দ খ্রি.পূ. ১৪৬ অব্দ) রোমানদের প্রাধান্য বজায় থাকে। যুদ্ধগুলির ফলে গ্রিস প্রথমে রোমের করদ রাজ্যে ও পরে একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়।
উপসংহার :- এইসব যুদ্ধ কেবল রোম বা ম্যাসিডনের ইতিহাসকে প্রভাবিত করেনি; গ্রিস, কার্থেজ, মিশর, পশ্চিম এশিয়া, সিরিয়া, স্পেন, ইলিরিয়া তথা সমগ্র পূর্ব ও পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল। ফলে পরিপূর্ণ রোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। আত্মপ্রকাশ ঘটে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা-এই তিনটি মহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিস্তৃত রোমান সাম্রাজ্যের।
(FAQ) প্রজাতন্ত্রের যুগে রোম সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
খ্রি.পূ. ৫০৯-খ্রি.পূ. ৩১ অব্দ।
পিউনিক যুদ্ধ ও রোম-ম্যাসিডন যুদ্ধ।
খ্রি.পূ. ২৬৪-খ্রি.পূ. ২৪১ অব্দ।
রোম ও কার্থেজ।
খ্রি.পূ. ২১৫-খ্রি.পূ. ২০৫ অব্দ।